শিলং উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড় জেলার একটি শহর ও পৌরসভা এলাকা। এটি মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। শিলং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে এবং ভুটান-ভারত সীমান্তের প্রায় ১০০ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত। এটি সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৫০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
এখানে রয়েছে পাইন অরণ্য, জলপ্রপাত এবং পার্বত্য জলধারার সমারোহ। ইংরেজরা ভালোবেসে এই শৈলশহরের নাম দিয়েছিলো “প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড”। একবার এই অসাধারন সৌন্দর্যে অনন্য শিলং শহর ভ্রমনের সুযোগ হয়েছিলো আমার। প্রতিদিনই ভাবি সেই অভিজ্ঞতাকে ফুটিয়ে তুলব কলমের আচড়ে,কিন্তু সময়ের অভাবে তা আর হয়ে উঠেনা। আজ দেখি কিছু লেখা যায় কিনা।
আমার সাথে সঙ্গী হয়রছিলো আমার স্বামী ও একমাত্র সন্তান। ঢাকা থেকে রাত ১২ টার সোহাগ পরিবহনের বাসে রওয়ানা দেই সিলেটের উদ্দেশ্যে। ভোর ৬ টায় পৌছুই সিলেট। সেখান থেকে মাইক্রো বাস এ করে তামাবিল বর্ডার প্রায় ২ ঘন্টার পথ। রাস্তার চারপাশে পাহাড় আর চা বাগান যে কারো মন ভালো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
তামাবিল যেতে যেতেই চোখে পড়ে শিলং এর সুউচ্চ সব পাহাড়। যা আমার ভ্রমনের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুন পরিমানে। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করেই পা বাড়াই মেঘরাজ্য মেঘালয়ের দিকে। তামাবিল বর্ডার থেকে মাত্র দুকদম দুরেই ভারতের ডাউকি সীমান্ত। ডাউকি তে প্রবেশের পর আবার ইমিগ্রেশন চেক...এরমধ্যেই ঝটপট করে তুলে নিলাম কিছু ছবি।
আগে থেকেই ট্যাক্সি ঠিক করা ছিলো আমাদের, আমাদের গাইড বিমলদা অসাধারন ভালো এবং হাস্যরসিক একজন মানুষ। পুরো রাস্তাটাই আনন্দে মাতিয়ে রাখলেন,ডাউকি থেকে শিলং প্রায় ৩-৩.৫ ঘন্টার রাস্তা। পাহাড় ঘেষে আমাদের ক্যাব উপরে উঠছে, প্রথমে একটু ভয় পাচ্ছিলাম, কিন্তু পরে ভালো লাগতে শুরু করলো। কেমন যেন নেশা লেগে যায়। মাঝে মাঝে রাস্তায় ক্যাব থামিয়ে ছবি তুলছিলাম আমরা।
প্রকৃতির এই অসধারণ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে গেলাম আমি। যেন এ এক স্বপ্নরাজ্য।
শিলং ছোট হয়েও অসাধারন সুন্দর একটি শহর, শিলং এর কেন্দ্রস্থল পুলিশ বাজার। আমরা উঠলাম হোটেল মেঘনাম এ, একদম শহরের মাঝখানে। তারপর সারাদিন ঘুম শেষে বিকেলে পুরো পুলিশ বাজার ঘুরে দেখলাম, টুকটাক কেনাকাটাও করলাম।
পরদিন সকাল বেলা বিমলদা আমাদেরকে নিয়ে গেল ক্যাথলিক ক্যাথিড্রাল এ, এটি শিলং এর সবচেয়ে বড় চার্চ। শিলং এর অধিকাংশ মানুষ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বি,ধর্মপ্রানও বটে। চার্চে গিয়ে বসলাম আমরা, ফাদারের কন্ঠে বাইবেল শুনে মনটা কেমন যেন সজীব ও পবিত্র হয়ে গেল। ফেরার পথে ঘুরে এলাম ডন ভস্কো স্কুল, সেখানেই জানতে পারলাম ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা অক্ষয় কুমার পড়াশুনা করেছেন এই স্কুলেই। শিলং এর ঘরবাড়িগুলো খুব ছোট ছোট কিন্তু অনেক গুছানো ও পরিপাটি ,সবচেয়ে যে ব্যাপারটা আমাকে মুগ্ধ করলো তা হচ্ছে শিলং এর প্রত্যেক্টা বাড়ীর সামনেই রঙ বেরং এর গোলাপ ফুলের বাগান।
ঘর যত ছোটই হোক না কেন গোলাপ ফুলের স্নিগ্ধ ছোঁয়া যেন তাতে থাকবেই, এ যেন তাদের রূচির ই পরিচায়ক!বিকেলে গেলাম শিলং গলফ ক্লাব এ, অপুর্ব সুন্দর একটি জায়গা,না দেখলে বিশ্বাস হবেনা কারো।
পরদিন সকালে বের হলাম চেরাপুঞ্জির উদ্দেশ্যে,বিমলদা বললেন পুরো একটি দিন চেরাপুঞ্জির জন্য রাখতে তা না হলে ভ্রমনের মজাই নাকি বুঝবোনা। যাই হোক আমরা রওয়ানা দিলাম, আবারো পাহাড়ের উপরে উঠছি, মেঘগুলো মাথার উপরে ছোটুছুটি করছে যেন চাইলেই ছুঁয়ে দিতে পারবো!কুয়াশায় ভরা ধোঁয়াটে প্রকৃতি আর পাহাড়ের হাতছানি কেমন যেন এক মাদকতা সৃষ্টি করে মনে। মন ভরে উপভোগ করলাম চেরাপুঞ্জি ফলসের অপরূপ সৌন্দর্য,ফেরার সময় গেলাম Mowsmai cave এ। আমিতো ভিতরে যেতেই চাচ্ছিলাম না, এত অন্ধকার!!যাই হোক বিমলদার আবদারে ভিতরে যেতেই হল,অনেকেই ভয়ে মাঝরাস্তা থেকে ফিরে গেছে,আমরাই একমাত্র সফলভাবে গুহা থেকে বের হয়ে আসলাম।
শিলং এর খাবার দাবার বেশ ভালো, কিন্তু অনেক মশলাদার। কম দামের মধ্যেই অনেক ভালো হোটেলও পাওয়া যায়। কম দামে ঝামেলাহীনভাবে ঘুরে আসার জন্য শিলং একটি উপযুক্ত স্থান। পরদিন ঘুরে এলাম শিলং পিক, যেতে হয় শিলং ক্যান্টনমেন্ট এর ভিতর দিয়ে,শিলং এর অধিকাংশ এলাকা জুড়েই ক্যান্টনমেন্ট। শিলং পিক হচ্ছে শিলং এর সবচেয়ে উঁচু স্থান।
যে কারো মাথা ঘুরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। সেখান থেকে পুরো শিলং শহরকে দেখা যায়, ছোঁয়া যায় মেঘকেও। ফেরার পথেই পরলো এলিফ্যান্ট ফলস, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত। যে কেউ মুগ্ধ হবেন আমি নিশ্চিত!কিন্তু কষ্টও হবে,সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আবার উপরে উঠার সময় পা দুটোর বারোটা বাজবে!টিকিটও কাটতে হবে,প্রতিজন ১০ রূপী করে।
শিলং এ কেনাকাটা করার জন্য তেমন ভালো কোন মার্কেট নেই, তবে স্কুল আর চার্চ আছে অনেক।
বাংলাদেশের অনেক ছেলেমেয়েও পড়াশুনা করে শিলং এ।
গোলাপের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাক্টাসের ও দেখা মিলবে শিলং এ। ভালো মানের স্ট্রবেরির ছড়াছড়ি এখানে।
পরদিন ক্যাব নিয়ে এমনিই ঘুরাঘুরি,পাহাড়ের উপত্যকা বেয়েঁ একেঁ বেকেঁ চলছে গাড়ী। মাঝে মাঝেই দেখা মিলে পাথরের পাহাড়, অনেকদিন ধরে মাটি জমে জমে পাথর হয়ে গেছে, বিভিন্ন খনিজ সম্পদের ভান্ডার শিলং।
এর মধ্যেই অনেক ঝর্নাধারা, যেন কঠিন পাহাড়ের বুক চিরে চুইঁয়ে পড়ছে সুখের স্রোত!
শিলং থেকে কিছু দুরেই উমিয়াম লেক, এরই অন্য নাম বরাপানি। দিগন্তঘেরা পাহাড়শ্রেণি। মাঝখানে উপত্যকা। ঢেউ খেলানো উপত্যকায় মাঝে মধ্যেই বড় বড় লম্বা পাথর রাখা। অদ্ভুত লেগেছিল প্রথমে।
পরে জানতে পারলাম প্রিয়জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে রাখা এই পাথরখণ্ডকে ‘কিমন’ বলে। লেকের পাড় ঘেষে হলদেটে সবুজ ঘাস, লেকের স্বচ্ছ পানি মন কেড়ে নেয়। এই অপরূপ সৌন্দর্যের রেশ চোখে নিয়েই ফিরে এলাম হোটেলে। বিমলদার সঙ্গে গেলাম তার বাসায়,ভারতীয় খাবারে তার স্ত্রীর আপ্যায়ন ভুলার নয়। বিকেলে কিছু কেনাকাটা করে ফিরলাম হোটেলে, শুরু হল ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি।
ফেরার পথে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ফিরে ফিরে চাইছিলাম সেই স্বপ্ননগরীর দিকে।
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/neel_pori_1280022912_3-2085784609_cc5d4cb91a.jpg
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/neel_pori_1280023244_1-Mawsmai_cave.jpg
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।