writerrazu.com
গ্রামের হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে রবিন ভর্তি হল থানা সদরের খলিলুর রহমান ডিগ্রী কলেজে। প্রথম মাসখানেক রবিন বাড়ি থেকে সাইকেলে চড়ে কলেজ করল। কিন্তু সাইকেলে চড়ে কলেজে আসায় রবিনের সহপাঠীদের কাছে সে ‘দরিদ্র কৃষকের ব্রিলিয়ান্ট ছেলে’ হিসেবে অল্প দিনেই পরিচিত হয়ে গেল। সহপাঠী কয়েকটি মেয়ের অতিÑসহানুভূতি দিনদিন বাড়তেই থাকল। এই অতিÑসহানুভূতি রবিনের আত্মসম্মানে বুলডোজার দিয়ে আঘাত হানল।
তাতে আত্মসম্মান ভাঙ্গল, নাকি বুলডোজার ভাঙ্গল? অবশ্যই বুলডোজার। যাদের ধন-দৌলত-টাকা-পয়সা থাকেনা তাদের আত্মসম্মান খুব মজবুত হয়। আর যাদের এই সব থাকে তাদের আত্মসম্মান থাকে না বললেই চলে। সবার সব কিছু থাকেনা।
বুলডোজার ভেঙ্গে যাওয়ায় রবিনকে বিকল্প চিন্তা করতে হল।
প্রতিদিন ভ্যানে চড়ে এসে কলেজ করা অসম্ভব, অনেক খরচ। থানা সদরে বাসা ভাড়া করে থাকার তো প্রশ্নই উঠে না। আরও বেশী খরচ। কিছু একটাতো করতেই হবে। কলেজে একটা হোস্টেল আছে বটে কিন্তু সেটাতো ডিগ্রী ক্লাসের ছাত্রদের জন্যে, ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্ররা সেখানে সিট পাবে না।
কিন্তু রবিনকে সেখানে উঠতেই হবে, বাই হুক অর বাই ক্রুক। কলেজ সংসদের ভিপির পিছু লাগল রবিন। টানা এক সপ্তাহ পিছ পিছ ঘুরে এবং দলের জন্যে “প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার” প্রতিজ্ঞায় হোস্টেলের এক রুমের ফ্লোরে সিট পেল রবিন। শুরু হল রবিনের রাজনৈতিক জীবন। নিজের ফিগারের এবং সাহসের গুণে অল্প দিনেই রবিন হয়ে গেল ‘রবিন ভাই’।
ভিপির ওয়ালথার পি৯৯ সেমি অটোমেটিক পিস্তলটা এখন প্রায়ই রবিন ভাইয়ের কোমড়ে গোঁজা থাকে। এই জিনিস কাছে থাকলে শরীরটা কেমল হালকা হয়ে যায়, ভাসতে থাকে, চিৎকার করে অট্টহাসি হাসতে ইচ্ছে করে। এই জিনিসের একটা গন্ধ আছে। মেয়েদের শরীরের মত, খুব টানে। ভিপির বাইকটাও মাঝে মাঝে পায় রবিন ভাই।
যে মেয়ে সহপাঠীরা একদিন তার প্রতি খুব সহানুভূতিশীল ছিল আজ তারাই তাকে যমের মত ভয় পায়। একদিন কলেজগেটে মোটর সাইকেলের উপর বসেছিল রবিন-
Ñওই সোনিয়া, এত দূরে দূরে থাকিস ক্যান? চিনিসÑইÑনা মনে হয়!
Ñনা মানে, রবিন ভাই, পড়াশুনা নিয়ে একটু ব্যস্ত। তাই-
Ñআর পড়াশুনা! চল কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসি। ওঠ বাইকে।
Ñরহমত স্যারের একটা জরুরী ক্লাস ছিল ভাই।
না গেলে-
Ñআরে ঐ রহমত মিয়ারে আমি কইয়া দিবো, তুই ওঠ। আর আপনিÑআপনি করছিস কেন?
ততক্ষণে সোনিয়ার হার্ট বানরের মত লাফাতে শুরু করেছে। ‘না’ বলার যে প্রিপারেশন সে নিয়েছিল, দ্রুত হার্টবিটের ধাক্কায় সেই ‘না’ শব্দটা তার মুখের মধ্যেই আটকে গেল। সেখানেই তার সমাধি। মুখের লালার সাগরে সলিল সমাধি।
হিপনোটাইজড মানুষের মত সোনিয়া রবিনের বাইকের পিছনে ওঠে। ভ্রুম-ম-ম-ম-
প্রথমে ক্যাম্পাসের মধ্যেই একটা চক্কর দেয় রবিন তারপর সোজা রওনা দেয় নদীর পাড়ের দিকে। বাইকের পিছনে সোনিয়া তাদের দুজনের মধ্যকার ‘সম্পর্ক নিরূপক’ দূরত্ব বজায় রেখেই বসেছে। কিন্তু নিতান্ত প্রয়োজনের খাতিরেই রবিন যখন কষে ব্রেক করছে তখন আর সেই দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
ওরা কলেজ ক্যাম্পাস ছাড়ার পড়ই শুরু হয়ে গেল কানাঘুষা, বিশেষ করে মেয়েরা-
Ñকিরে রবিন কি এইÑসবÑও শুরু করে দিল নাকি? সোনিয়াই কি প্রথম, নাকি আরো অনেককেই খেয়েছে?
Ñসোনিয়া কি শেষ পর্যন্ত রবিনের প্রেমে পড়ল? এই রকম মাস্তান একটা ছেলের সাথে?
Ñও! তলে তলে এতদূর!
নদীর পাড়টা খুবই সুন্দর, সবুজ ঘাঁসে মোড়া।
সাধারণত এই টাউনের কোন বাড়িতে কোন মেহমান বেড়াতে এলে বিকাল বেলায় তাদের এইখানে বেড়াতে নিয়ে আসে বাড়ির লোকজন। অন্য সময় গরু-ছাগল চড়ে। একটা তাল গাছের ছায়ায় বসল সোনিয়া-রবিন। ৫/৭ মিনিট নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় কয়েকটি বিষয়ে কথা বলতে না বলতেই রবিনের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। রবিন কার সঙ্গে কথা বলল তা সোনিয়া বুঝল না, কিন্তু সে গুণে রেখেছে, রবিন মোট ৪৩ বার ‘ভাই’ শব্দটা উচ্চারণ করেছে।
‘ভাই’ শব্দটা গোনার উদ্দেশ্য; রবিন ঠিক কোন বিষয়ে কথা বলছে, এবং সেটা কোনভাবে সোনিয়ার জন্যে ক্ষতিকর কিনা তা বোঝা। কিন্তু সোনিয়া বুঝল ফোনের আলাপ তার সম্পর্কে নয়, অন্য কিছু।
“চল তোকে ক্যাম্পাসে আগায় দিয়ে আসি। আমার অন্য একটা কাজ পড়ছে। ” ঠিক কি কারণে সোনিয়াকে এখানে এনেছিল রবিন, তা সোনিয়া বুঝতে পারল না।
এমনকি রবিনের চেহারায় ‘কোনকিছু প্রকাশ না করতে পারার অতৃপ্তি’ও নেই। বরং এই মুহুর্তে সে অন্য কিছু ভাবছে। ফেরার পথে রবিন একবারও ব্রেক কষল না। বেশ রিস্কে, বেশ দ্রুত বাইক চালাচ্ছে। শক্ত করে পিছনের ক্যারিয়ার ধরে রেখেছে সোনিয়া।
‘সম্পর্ক নিরূপক’ দুরুত্বটা এখন আগের চেয়েও বেশী।
এভাবে তিন বছর পেরিয়ে গেল। কোন রকম পড়াশুনা ছাড়াই এইচএসসিতে রবিন ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করল। সে শুধু পরীক্ষার হলে অ্যাটেন করত, উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্দেশে প্রতিদিন তার খাতা পাল্টে যেত, এভাবেই এই ফলাফল। রবিন এখন কলেজের ভিপি।
একবার শাকিব খানের একটা পোস্টারে সে দেখল শাকিব খান একটা লাল হুডওয়ালা পুলওভার পড়ে আছে। খুবই পছন্দ হল তার। পরের মাসে ঢাকায় গিয়ে ঠিক ঐ রকম একটা হুডি কিনল রবিন। তারপর সেই হুডি পড়ে পার করল আরও ২ বছর। লোকজন সামনে তাকে বলে রবিন ভাই আর আড়ালে আবডালে বলে রবিন হুডি।
নিজেও নিজেকে রবিন হুড ভাবে সে। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-দালালি থেকে যে বিপুল অংকের টাকা আয় হয় তার বেশির ভাগই সে বিলিয়ে দেয় গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষদের। অসহায়-দরিদ্র মানুষ রবিন ভাই বলতে অজ্ঞান। কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার শেষ আশ্রয় স্থল রবিন হুডি, অসুস্থ রোগীর শেষ আশ্রয়স্থল রবিন হুডি, রেজিস্ট্রেশনের টাকা না থাকা মেধাবী ছাত্রের বাবার শেষ গন্তব্য রবিন হুডি। এই এলাকায় রবিন হুডি ঈশ্বরের চেয়েও বেশী জনপ্রিয়।
উৎসাহিত হয়ে রবিন হুডি চাঁদার পরিমাণও বাাড়িয়ে দেয়। বাড়তি টাকায় বাড়তি সমাজ সেবা, বাড়তি নাম-ডাক। হুডির জনপ্রিয়তা এলাকার “রাজধানী প্রবাসী” এমপি সাহেবের কানেও পৌছায়। সেই উপজেলা চেয়ারম্যানও এ বছর নমিনেশন চাইবে জাতীয় সংসদ ইলেকশনে। কাজেই হুডিকে হাত করা ছাড়া এমপি সাহেবের আর কোন উপায় নেই।
গোপনে হুডিকে ঢাকায় ডেকে পাঠায় এমপি সাহেব। এমপি সাহেবের ফ্লাটে গিয়ে হুডির মাথা ঘুরে যায়। এত চাকচিক্য- এত আভিজাত্য- এত ঐশ্বর্য্য।
“শোন রবিন, তুমি আমার ভাইয়ের মত। আমার এলাকার মানুষ তোমার প্রশংসায় পাগল।
এটা আমার জন্যেও গর্বের। আমিতো সেদিন সংসদেই তোমার কথা বললাম। ম্যাডাম পর্যন্ত তোমার কথা শুনে অবাক হল। আমি ম্যাডামকে বলেছি, তোমাকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানাতে চাই। ম্যাডাম রাজি।
আরে, আমরাতো সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্যেই পলিটিক্স করি। যে গরিবের বন্ধু সে আমাদেরও বন্ধু। ”
চাকচিক্য-আভিজাত্য-ঐশ্বর্য্যে বিমুগ্ধ রবিনের কাছে এমপি’র বাণী দ্বৈব্যবানীর চেয়েও দামী মনে হয়। ঠোট নড়ল বটে কিন্তু কি বলল বোঝা গেল না। শুধু দেখা গেল হুডির মাথাটা ডানদিকে বাক নিয়ে ডান কাধ ছোয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
পারছে না। না পারুক, যতটুকু ডানদিকে টার্ণ নিয়েছে এমপি সাহেব তাতেই খুশি। তারপর আরও কিছু গায়েবী বাণী নিয়ে হুডি ফিরে এল গ্রামে। এই বাণীতে মানব জাতির কতটা কল্যাণ হবে তা অনিশ্চিত হলেও আমাদের রবিন হুড যে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসতে যাচ্ছে তা নিশ্চিত। অবশ্য গায়েবী পরিকল্পনা যদি সফল হয়!
রবিন হুডরা কি কখনও সিংহাসনে বসতে পারে? না, রবিন হুডরা বিপ্লবী, সিংহাসনে বসলে তারাও কিং জন হয়ে যায়।
কাজেই অধিকাংশ সময় রবিন হুডরা সিংহাসনে বসতে চাইলে প্রকৃতি তাদের মেরে ফেলে।
কিছুদিন পর একটা মিষ্টির প্যাকেটে করে তিনটা আর্জেস গ্রেনেড এল হুডির কাছে। সুযোগ বুঝে উপজেলা চেয়ারম্যানের উপর ছুড়ে মারতে হবে। তারপর সোজা চাকচিক্য-আভিজাত্য-ঐশ্বর্য্য। মাইক্রোবাস রেডিই আছে।
শুক্রবার সকালে মটর বাইকে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন চেয়ারম্যান। একটা মাইক্রো তাকে ক্রস করার সময় ছুড়ে মারে একটা গ্রেনেড। ব্যাস সব শেষ। লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই মাইক্রো গায়েব। কিন্তু হুডির কপাল খারাপ।
বাকি দুটি গ্রেনেড তার কাছেই ছিল। পথে ধরা পড়ল রবিন হুডি, পুলিশের কাছে। এমপি সাহেবের আর কোন খবর পাওয়া গেল না।
দরিদ্র বাবা-মা যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন রবিনকে জামিনে মুক্ত করতে। পারলেন না।
রবিন তখন তার বাবা-মাকে বলল, এতদিন যাদের সে উপকার করেছে, সেই গ্রামবাসীকে নিয়ে একটা মিছিল বের করতে পারলে রাজনৈতিক প্রভাবে জামিন করানো যাবে।
রবিনের মা-বাবা ছুটে গেল সেই সব মানুষের কাছে এতদিন যারা হুডিকে ঈশ্বরের চেয়েও মহান ভাবত, হুডির দয়া-দাক্ষিণ্যে যাদের জীবন চলত, যারা হুডিকে প্রাণ ভরে আশির্বাদ দিত। কিন্তু হায় প্রকৃতি বড়ই বেঈমান। রবিনের বিপদে আজ কেউ তাকে চেনে না। অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হল বাবা-মা।
একেক জন একেক কথা বলে এড়িয়ে গেল-
Ñদেখ বাপু এই সব পলিটিক্সে জড়ায়ে আবার কোন বিপদ ডেকে আনি!
Ñএই সব মিছিল টিছিল করে লাভ নেই, এমপি সাহেবের পা ধর গিয়ে।
Ñএই জন্যেই গরিব মাইনষের পলিটিক্সে যাইবার নাই। কি দরকার আছিল।
Ñআহারে বেচারা আমাদের কত উপকারটাই না করেছিল। কিন্তু কি করব বল, জমির মামলাটা নিয়ে এত ব্যস্ত, নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পর্যন্ত পাচ্ছি না।
উপায় না দেখে বাবা-মা এমপি সাহেবের কাছে গেল। কিন্তু গ্র“প ফোর্সের দাড়োয়ান তাদের ভিতরে ঢুকতে দিল না। আমি কি ঈশপ? তাহলে এই গল্পের শেষ বাক্যটি হবে “সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়। ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।