নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই
১.
প্রায়ই অনেক রাতে মৃত্তিকা একাকী এসে দাড়ায় ছবিটার কাছে। তার মা ঘুমিয়ে থাকে অন্যরূমে। ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দ হয়, ডাক্তারী পরীক্ষার হাড়ের মানচিত্র মুখস্ত করতে করতে সে তখন ক্লান্ত । বাবার ছবিতে হাত রাখে। যদি কখনো কোন অলৌকিক উপায়ে ফ্রেমবন্দী মানুষটা উঠে এসে তার হাতটা ধরতো!
মেয়েটা জন্ম থেকেই জেনেছে বাবা মানেই দেয়ালের এই ছবি ।
ছবিটা কান্না, হাসি, উল্লাস, বিষাদ কোন কিছুতেই সাড়া দেয় না। তবু সে মনের কথাগুলো তাকে বলতে থাকে। যেন তার বাবা কথা না বললেও শুনতে পায়।
দেয়ালের উল্টোদিকে একটা কাঁচের আলমারী, একটা হাতল ওয়ালা সেগুন কাঠের চেয়ার। তার বাবা এখানে বসতো।
আলমারী খুলে বইগুলো পড়তো। আসবাবগুলো ঘুণের আক্রমণে পর্যদুস্ত। লেখার সেই টেবিলটা এখানে আর নেই। কিন্তু মানুষটার স্মৃতি যেন এতটুকুও কমেনি। মৃত্তিকা প্রায়ই বইগুলো পড়ে।
কাজী মাহমুদুল্লাহ বেঁচে থাকলে আজ খুশি হতো । তার মেয়েও তার মত বইয়ের পোকা। মার কাছে মৃত্তিকা শুনেছে তার বাবা বেতনের পয়সায় অন্তত: একটা নতুন বই হাতে বাড়ি ফিরতো। অনেক রাত পর্যন্ত ঘরের বাতি জ্বলতো। রাতজেগে পড়া ছিল তার নেশা ।
সন্তান হওয়ার পর খরচ বেড়ে গেলে জমিলা বই কেনার কারণে বিরক্ত হতো। কাজী সাহেব মুচকি হেসে অভয় দিতো, "দেখ জমিলা, অভাবে আল্লাহ একটা না একটা উপায় বের করেই । মানুষে চাইলেই রিজিক বদলাতে পারে না। অনেক কষ্টের মধ্যেও বইপত্র মনে একটা শান্তি দেয়"।
আল্লাহ ঠিকই উপায় দেয়।
কাজী সাহেব মারা যাবার পর একবছরের কন্যাসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে চরম বিপদে ছিল তার স্ত্রী। হাতে সঞ্চয় বলতে ছিল কয়েকটা প্রাইজবন্ড ছিল। জমিলার একমাত্র ভাই জামান খুলনায় ছোট একটা ব্যবসা করতো। সেই শুধু এককালীন কিছু পয়সা পাঠিয়েছিল। মৃত্তিকার চাচা ফুফুরা কিছুই দেয়নি।
তারা গ্রামের গরীব গেরস্ত। স্বাধীনতার পর পর দেশে কৃষকদের অবস্থা ছিল শোচনীয়।
সৌভাগ্যক্রমে কাজী মাহমুদুল্লাহ মৃত্যুর আগে পৈত্রিক জমি বিক্রি করে সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকায় সস্তায় কিছু জমি কিনেছিল। তার এক বিশ্বস্ত চাচাতো ভাই ধান চাষ করে একতৃতীয়াংশ টাকা পাঠাতো । এটুকু না হলে নিয়মিত আয়ের আর কোন পথ থাকতো না।
এমনই এক দিনে জমিলার পুরনো এক বান্ধবী শামসুন্নাহারের সঙ্গে দেখা। শামসুন্নাহারের স্বামীর নিজের বাড়ি ছিল জিগাতলা চায়না বিল্ডিং এর গলিতে। সে জিগাতলা প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার কে বলে একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তখন থেকেই বিধবা জমিলা মৃত্তিকাকে নিয়ে জিগাতলায় ভাড়া থাকে।
নিম্নমধ্যবিত্তের সংসারে মেয়ের দ্রুত বুঝতে শেখে।
চাইলেই জমিলা অন্য মেয়েদের মত তার সন্তানকে নিয়মিত নতুন জামা কাপড় দিতে পারতো না। স্কুলের পোষাক ছাড়া উৎসবে যাবার মত একটা দুটো পোষাক থাকতো মৃত্তিকার। ঈদের সময় তার মামার কাছে পেত একজোড়া জুতা অথবা জামা । তার মা যদি কখনো চুলের ক্লিপ বা কানের পাথরের টব কিনে দিতো মৃত্তিকা তাতেই এত খুশি হতো যে পুরনো সাজার টেবিলের আয়নায় দাড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা নিজেকে দেখতো।
মৃত্তিকার ঘরে একটা পড়ার ডেস্ক ছিল।
ভাঙা এবং নড় বড়ে। কাঠে ফাটল ধরা। এটা দিয়েই মৃত্তিকা কলেজ পার করেছে। স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার সময় জমিলা শামসুন্নাহারকে বলে রাখতো তার ছেলে রায়হানের পুরনো বইগুলো রেখে দিতে। নাস্তায় সুজি-রুটি, আর বাকি দু বেলা নিরামিষ, ডাল আর সাদা ভাত ছিল নিয়মিত খাবার।
কখনো স্কুলের এটা ওটা কেনার জন্য মৃত্তিকার পয়সা লাগতো। কিন্তু নিজে থেকে কিছু চাইতে লজ্জা লাগতো মৃত্তিকার। সে জানতো মা নিজেও পুরনো শাড়িগুলো গোপনে সেলাই করে, মাড় দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরে।
তারপরও মৃত্তিকার কিছু সুখের ঘটনা আছে। চায়না বিল্ডিং এর গলিতে তার শৈশব এবং কৈশোরটা ছিল খুব আনন্দের।
বাসিন্দারা সবাই স্থায়ী এবং কমবেশি শিক্ষিত। নিজেদের মধ্যে দারুণ বোঝাপড়া ছিল। একুশে ফেব্রুয়ারী, পহেলা বৈশাখ সহ নানান রকম অনুষ্ঠান করতো গলির ছেলেমেয়েরা। মৃত্তিকারা শহীদ পরিবার বলে খুব সম্মান পেত।
পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্য স্কুলে এবং কলেজে টীচার রেখে পড়াতো সবাই।
ঘরে টিউটর রেখে পড়ানোর সামর্থ ছিল না তাদের। মৃত্তিকা শামসুন্নাহার খালার ছোট ছেলে রায়হানের কাছে সময় অসময় সাহায্য নিতো। রায়হান ইন্টারে যেভাবে তাকে গাইড করেছে পেশাদার প্রাইভেট টিউটর এতটা করতো না।
মৃত্তিকাকে দেখলে বোঝা যায় না সে এতটা চাপা! কথা বলে কম, নিচু গলায়। হয়তো তার বাবার মতই কথা বলার আগে চিন্তা করে নেয়।
এরকম মেয়েদের সাধারণত: বন্ধু থাকে কম। রায়হান ছিল ঠিক তার বিপরীত। খেলাধুলা করতো, আড্ডা দিতো, কথা বলতো অনেক। মৃত্তিকা যেদিন খুব মন খারাপ হতো, বই নিয়ে পড়লেআসলে রায়হান তার দিকে তাকিয়ে বলতো, "কী হয়েছে তোর? আজকে আবার কি নিয়ে মন খারাপ?"
প্রতিবছরই পাড়ার ছেলেমেয়েরা ছোটখাটো বনভোজনে যেত। বনভোজন মানে পাড়ার বড় বোন, ভাবীরা আর স্নেহধন্য ছেলেরা সবাই মাইক্রোবাস নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়া আর খাবার দাবারের আয়োজন।
মৃত্তিকার মা এমনিতে মেয়েকে একলা কোথায় যেতে দিতো না। কিন্তু শামসুন্নাহারের বড় ছেলে বউ, তার বিবাহিত মেয়ে কাকলী - এরা যেহেতু যেত, সে মানা করতো না।
এটা কয়েক বছর আগের ঘটনা, সুনামগঞ্জের জমি হঠাৎ পাহাড়ী ঢলে প্লাবিত হয়েছিল। মৃত্তিকার ফজলচাচা বিশ্বস্ত লোক । কিন্তু সে বার ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে অর্থ পাঠায়নি।
মৃত্তিকার বাসায় গুনে গুনে পয়সা খরচ হয়। পিকনিকে যাওয়াটা এড়ানোর জন্য মৃত্তিকা তখন পরীক্ষার অজুহাত দিয়েছিল। কাকলি অনেক বলেও রাজি করাতে পারে নি।
রায়হান যে আগে থেকেই মৃত্তিকার ভিতরটা বুঝতে পারে তার একটা প্রমাণ। মৃত্তিকা সেদিন রিকশায় বাড়ি ফিরছিল।
বিকেল বেলা। মাঠে ক্রিকেট খেলা থামিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে রায়হান তাকে বলেছিল, "কি রে এটেল মাটি , আপার কাছে শুনলাম পড়াশোনার জন্য নাকি পিকনিকে যাচ্ছিস না? তা পড়তে পড়তে কি বটগাছ হয়ে যাবি? আমি যে পিকনিকের চান্দা দিয়েছি তা তুই জানতি না? না গেলে তো টাকাটা এমনিতেই নষ্ট হবে"।
মৃত্তিকা জানতো রায়হান আগে আগে চাঁদা দেয়নি। সে অন্যের পয়সায় বনভোজনে যাওয়ার মতো মেয়ে না । কিন্তু রায়হানের দিকে চেয়ে সে কিছু বলতে পারে না।
ছেলেদের চোখ দেখলে বোঝা যায় কোনটা লোভ আর কোনটা মুগ্ধতা। রায়হান অনেক সময়ই মনে হতো তার ভাইয়ের মতো। যে তাকে শাসাচ্ছে, পড়ার জন্য বলছে, কখনো বন্ধুর মতো, কখনো যেন তার বাবার মত, যেন মমতার একটা ছায়া থাকে সব সময়। কখনো মৃত্তিকা নিজের কাছেই জানতে চেয়েছে সে কি রায়হানকে বন্ধুর চেয়ে বেশী কিছু ভাবতো? তার কাছ থেকে অন্য কিছু শুনতে চাইতো?
কিন্তু ইচ্ছে হয় এক বিধাতা চায় আরেক। রেশমপোকার গুটির মত তার অবচেতন স্বপ্নগুলো কেটে নির্মম একটা বাস্তবতা বেরিয়ে আসে।
দু বছর আগে ইমিগ্রেশন পেয়ে মিসেস শামসুন্নাহার তার স্বামীছেলে সহ কানাডায় চলে যায়।
প্রিয় কেউ দুরে গেলে পুকুরের ঢেউয়ের মতো ইচ্ছেটা বড় হয়, মৃত্যুর মতো শূন্যতা জন্মায় বুকের ভেতর। উড়োজাহাজটা যখন অনেক স্মৃতিগুলোকে বন্দী করে উড়াল দিয়েছিল, সবার অলক্ষে মৃত্তিকা আঙুলের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছেছিল। মৃত্তিকা জানে ডাক্তারদের ইমোশন নিয়ন্ত্রণ শিখতে হয়।
বাড়ি ফিরে কষ্টটা কমাতে সে ড্রয়ার খুলে বের করে এনেছিল বাবার অবশিষ্ট স্মৃতিগুলোকে।
একজোড়া চশমা, প্যাকেটে মোড়ানো সেন্ডেল, কিছু বই, কাপড়ের মলাটের ডায়েরী আর লেখালেখির একটা ঝরণা কলম। মা তখন অন্যরূমে। মৃত্তিকা ডায়েরীটা খুলে পাতা উল্টাচ্ছিল।
কাজী মাহমুদুল্লাহ বিয়ের পর মহাখালী টিবি গেইটে থাকতেন। সত্তুরের দিকের কথা।
একটা ব্যাঙ্কে চাকুরী করার পাশা পাশি পাকিস্তান আমলে তিনি পত্রিকায় লিখতেন। লিখে বেশ নামও করেছিলেন। লিটল ম্যাগাজিন ছাড়াও দৈনিকে তার গল্প ছাপানো হতো। ডায়েরির একটা পাতা পড়লে মৃত্তিকার মন শক্ত হয়ে যায়,
২৯ জুন ১৯৭১, রাত ৩.১০
...মাঝে মাঝে দুনিয়াটাকে বড়ই নির্মম লাগে। জন্তু জানোয়ারের ন্যায় এই মানুষও নিজের স্বার্থের জন্য কত কিছুই না করিতে পারে।
একে অন্যের রক্তপান করে, দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে, মানুষ হইয়া অন্য মানুষকে হত্যা করে। এই দেশটিতে গরীব মানুষদের উপর ঝাপাইয়া পড়িয়াছে পাঞ্জাবী সৈন্যেরা। ইয়াহিয়ারা কী মানুষ না? নিরিহ এই পথের মানুষের কী দোষ করিল? ইতিহাসে যোদ্ধারা সমুখ সমরে রক্তপাত করিয়াছে।
কিন্তু যাহারা দিন আনিয়া দিন খায়, কুলি, মজুর, যাহারা উদরে খাদ্যের যোগান দেয়, তাহারা কেহই যোদ্ধা না। তাহাদের উপর ঝাপাইয়া পড়া কাপুরুষতা নয়তো কি?
চতুর্দিকে অনিশ্চয়তা, ভীতি, ডামাডোল।
পথের পাশে রক্ত দেখিতে হয়। কত রক্ত হইলে ময়লা ফেলিবার স্থানটিও উপচাইয়া পড়ে!
আমরা যাহারা অসহায়, পথের ধারে শকুনের উড়াউড়ি দেখিয়া নাক চাপিয়া ঘরে ফিরি, তাহাদের নিরবতা আত্মহত্যার ন্যায়। আমিও ঘরে থাকিতে চাই না। শরীর অসুস্থ হইয়াছে গত কয় মাস। পুর্ণ সুস্থতার অপেক্ষায়।
এরই নামে ছদ্মনামে পত্রিকায় কিছু লেখা পাঠাইয়াছি। আমি ফরিজুদ্দিনকে বলিয়াছি শরীর ভাল হইলে চুপিসারে চলিয়া যাইবো।
বাবার অনুভুতিগুলো ছিল খুব স্পষ্ট আর ধারালো। তার গর্ব হয় তাকে নিয়ে, আবার কষ্টও হয়। মা ইদানিং বিছানায় পড়ে থাকে ।
বলে, "তোর বাবা নাই, বিয়ে দেয়ার মত জমানো টাকাও নাই, আমি চলে গেলে কে দেখবে? "
মৃত্তিকা হন্যে হয়ে একটা চাকরী খুঁজছে। সে বলেছিল, "মা, আগে একটা চাকুরী পাই। টাকা পয়সা কিছু জমুক। তারপর অন্যকিছু। ডাক্তারী পাশ করেছি একটা উপায় হবেই।
চাকুরির জন্য আবেদন করেছি অনেকগুলো। "
মৃত্তিকা আবারও ডায়েরীর পাতায় ফিরে আসে। তাকে নিয়ে লেখা একটা অংশ আছে এরকম
আমার শিশুকন্যা মৃত্তিকার চেহারা আমার মায়ের মত হইয়াছে। আল্লাহ কী সময়ে আমার এই মাকে ফেরত পাঠাইল! পিতা হিসাবে অভিশপ্ত লাগে। কোথাও নিয়া যাইতে পারিনা।
ঘরেই বন্দী থাকি।
চতুর্দিকে শুধুই দুর্বিষহ হাহাকার আর মৃত্যু। আগরতলা গিয়াছে মনিরুল, সুবহান ও রতন। মৃত্তিকা আমাকে দুর্বল করিয়াছে। দশটি মাসের সন্তান ছাড়িয়া পৃথিবীর কোন পিতা দুরে থাকিতে পারে? গতকাল কপালে কাজলের টিপ দিয়া কন্যাটিকে জমিলা আমার কোলে দেওয়া মাত্র কন্যাটি আমার গাল স্পর্শ করিযা হাসিয়া দিল।
ইহা বড় কঠিন বন্ধন। আমার শরীর কিঞ্চিত ভাল। কিন্তু এই অবুঝ শিশু সন্তানটিকে রাখিয়া দুরে থাকিব কি করিয়া?"
ডায়েরীটা পড়ে মৃত্তিকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে, "কিন্তু বাবা, সেই দুরে তুমি তো ঠিকই গেলে"।
২.
আজকে বাড়িতে ফেরা মাত্র একটা সুখবরটা এসেছে। একটা খামে একটা ইন্টারভিউয়ের ডাক এসেছে।
এরকম সাধারণত: হয় না, তারা যেভাবে লিখেছে চাকরীটা প্রায় নিশ্চিতই । ইন্টারভিউয়ের আগে বেতন সহ জানিয়ে দেয়া সে কখনো শোনেনি।
ডাক্তার হিসেবে এটা প্রথম অফার না। এর আগে দু একটা ডাক পেয়েছিল। বেসরকারী হসপিটালগুলো যেন প্রায় বিনা পয়সায় কাজ করাতে চায়।
মাসে পাঁচ হাজারের বেশি রাজি হয় না। কখনো রাতের শিফটে কাজ। বেতন দেয় দেরীতে।
সে এতটাই উত্তেজিত হয়ে ছিল যে হাসপাতাল না ক্লিনিক না অন্যকিছু সেটাও খামের উপর পড়েও দেখেনি। খুলে সে অবাক হয়,
May 30, 1999
Dear Ms. Mrittika Mahmudullah
We are happy to inform you that IBN Khaldun Hospital is going to offer you the position of... We are excited that your qualifications greatly match with our expected criteria and we request you to contact us by June 11, 1999.
On the basis of scheduled interview, you will get cumulative package of TK 45,000.00 per month including other benefits.
HR
IBN Khaldun Hospital
Gulshan, Dhaka
৪.
বড় অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের নাম দেয়না বিজ্ঞাপনে।
যাতে পরিচিতরা তদবির করতে না পারে। ইবনে খালদুনের প্রস্তাবটিও পত্রিকার বিজ্ঞাপনে আড়াল করা ছিল। বলা হয়েছিল "একটি প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল"। মৃত্তিকা ভাবতেই পারে না তার আবেদনপত্র পৌছেছে ইবনে খালদুনের অফিসে।
কিন্তু এই খালদুনের ইতিহাস মৃত্তিকার অজানা না।
এটা প্রকাশ্য গোপন! হাসপাতালের মালিক জামালমুন্সী ঢাকার কুখ্যাত রাজাকার, সে এখন এমপি, হাতে অনেক পয়সা। এই লোক নিজের হাতেই সে খুন করেছে পচিশজন মুক্তিযোদ্ধা। লুন্ঠন, ধর্ষন সহ হেন কাজ নেই সে করেনি। একাত্তরে যারা নারী নির্যাতন আর হত্যা করে দেশকে নরকে পরিণত করেছিল, পাকিস্তানী হানাদারদের সহায়তা করেছিল, তারাই এখন ব্যবসা করছে। ইসলামের নামে ব্যবসা করছে, নিয়মিত টিভিতে আসছে।
তার মনে হয় এত বড় বেতনের অফার সে পাবে কেন? তাও নামমাত্র ইন্টারভিউতে? তবে কি তারা ঠিকই তার সম্মন্ধে খোঁজ নিয়েছে?
স্বাধীনতা বিরোধীরা এখন মেইনস্ট্রীমে। তবে কি তার বাবার মত পরিবারের সদস্যদের পয়সা দিয়ে কিনে নেয়া তাদের উদ্দেশ্য? মৃত্তিকার গলা দিয়ে পানি নামে না। মনে হয় তাকে কেউ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করছে। শরীরে অপবিত্রের স্পর্শ দিচ্ছে!
মৃত্তিকার একবার মনে হলো, সে অতিরিক্ত ভাবছে। চাকুরী চাকুরীই।
চাকুরীতে সে কাজ করবে বেতন পাবে, ব্যাস! টাকার কি কোন রঙ থাকে? বরং এই মুহুর্তে টাকাটা অনেক দরকার। মায়ের চিকিত্সার জন্য টাকা দরকার। বাড়িভাড়া জমে গেছে অনেক, উচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য টাকা দরকার। এক দু:সম্পর্কের মামা থাকে মগবাজারে, যারা কখনো খোঁজ নেয়না। পড়াশোনার খরচ চালাতে তার কাছেও ধার জমে আছে অনেক।
দুর্মুল্যের বাজারে কে এত ভাবে? যদি অর্থের অভাবে পথে বসে তাহলে মুক্তিযোদ্ধা কী আর রাজাকারই কী? অন্যরা হয়তো এতো ভাবেও না। রাজাকার মালিকের বঙ্গজ বিস্কুট কোম্পানীর অনুষ্ঠানে গান গায় স্বাধীন বাংলার শিল্পী, আদবদরের নেতার সম্বর্ধনায় বক্তৃতা দেয় একজন প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা। এমন কি মুক্তিযোদ্ধা কল্যান তহবিলও চাঁদা নেয় ঘাতক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে।
স্বাধীনতার এত বছর পর, ১৯৯৯ এ এসে এত কিছু মনে রাখা কি বাড়াবাড়ি না? ইন্টারভিউতে না যাওয়ার কি আসলেই কোন যুক্তি আছে?
৫.
আগের দিন রাতেও বাবার ডায়েরীর শেষদিকের একটা পাতা পড়ছিল। লাইনগুলো যেন তার মুখস্ত।
২৪ মে ,১৯৭১ দিবাগত রাত ২:৩০
সকালে "দৈনিক সংগ্রাম" পত্রিকার সাবএডিটর আইনুল ইসলাম খবর দিয়েছিল একটি কাজের জন্য । আমি আইনুলের সহিত সাক্ষাৎ করিলে আমাকে বলা হইলো, অনেক পত্রিকায় পাকিস্তানের স্বাধীনতা বিরোধী কথাবার্তা বাহির হইয়াছে। তাহারা বাড়াবাড়ি করিয়াছে।
করাচী হইতে নির্দেশ আসিয়াছে যাহাতে পাঞ্জাবী সৈনিকদের বীরত্বকে খর্ব না করা হয়। উর্দুতে তথ্যাবলী প্রেরণ করা হইবে।
বাংলা এবং উর্দুতে ইহাকে সুলিখিত আকারে প্রকাশ করিতে হইবে। সেই কাগজ খানি লিফলেট আকারে বিলি এবং পত্রিকা আকারে প্রকাশ করিবার জন্য তাহার লোক খুজিতেছে।
জানিতাম না আমার প্রাক্তন সহকর্মী আইনুল ইসলাম ইতিমধ্যে সেই প্রকল্পে যোগদান করিয়াছে। তাহার ডেস্কে যাহা দেখিতে পাইলাম তাহার কিয়দংশ এইরূপ :
পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম বিরোধী দুস্কৃতিকারীদের ধবংশলীলা,
------------------------------------------
গতকাল ঢাকার হাজারীবাগে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মনসুর আজম এবং ল্যান্স নায়েক ইউছুফ শাহাদাত ফরমাইয়াছেন। কতিপয় মুসলিম নাম ধারী ভারতীয় অনুচর এবং হিন্দুত্ববাদী পুর্ব পাকিস্তানে নৈরাজ্যের শাসন কায়েম করিতে চাহিয়াছে ।
..কী ভয়ংকর মিথ্যাচার। আমার মনে হইয়াছে এই আইনুল কী করিয়া এই কর্মটি করিতে পারিল। পয়সার পরিবর্তে ভাতৃহত্যাকারীর গুণগান কি করিয়া সম্ভব?
এই আইনুল ইসলাম নামটা মৃত্তিকার খুব পরিচিত। এই লোক কি সেই আইনুল যে গত সরকারের আমলে তথ্য মন্ত্রী ছিল? স্বাধীনতার পক্ষে বক্তৃতা দিয়েছিল?
তার মা বলেছিল ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখ বিকেলে আইনুল ইসলাম তার বাসায় আসে। পত্রিকায় কাজের বিষয়ে জরুরী কথা বলার জন্য কাজী মাহমুদুল্লাহকে ডেকে নিয়ে যায়।
তার পর কাজী সাহেব আর ফিরে আসেনি।
ডিসেম্বরে শেষে বধ্যভূমিতে জংলা কাদায় কাজী মাহমুদুল্লাহর আধ পঁচা দেহটা পাওয়া গিয়েছিল। চোখ উপড়ানো। জীভ দ্বিখন্ডিত। ক্ষতবিক্ষত।
শেয়াল খেয়েছিল হাত আর পা।
ভাবতে ভাবতে মৃত্তিকার নিজের দিকে প্রচন্ড ঘৃণা হয়। নিজেকে চড় দিতে ইচ্ছে হয়। বমি আসে। ছি! অভাব থাকুক।
দরকার হলে সে না খেয়ে মারা যাক। কিন্তু কী করে ভুলে হলেও এমন একটি প্রতিষ্ঠানে যোগদানের জন্য সে ভেবেছে?
মৃত্তিকা কী ভুলে গেছে সে সেই মানুষের সন্তান যে কখনোই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। তার বাবা যদি আইনুলদের মতো বিশ্বাসঘাতক হতো, পিশাচদের সঙ্গে হাত মেলাতো তবে কি সে পিতৃহীন হতো?
৬.
চাকুরীর চিঠিটাকে সে প্রথমে পদদলিত করে। তারপর কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে থুথু দিয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়।
সে জানে এতে ঐ জামালমুন্সী কিংবা আইনুলদের কিছুই হবে না।
কিন্তু অন্তত: এই ঘৃণাটুকু তো ঐ লোক গুলোর প্রাপ্য ।
সে দেখতে পায় চিঠির ঘৃণিত কাগজের টুকরাগুলো যেন অনেক ভয়ে ভয়ে নামছে এই স্বাধীন দেশের মাটিতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।