নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই
১
ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের মেয়ে ম্যাগনোলিয়া । ফুলের নামে নাম। তার হওয়ার কথা ছিল ফর্সা পুতুল পুতুল মেয়ে। হাসিতে যার মুক্তো ঝরে। দৃষ্টিতে ফুলেরা মেলে দেয় পাপড়ি।
কিন্তু মেয়েটার গায়ের রঙ তামাটে । ভারী চশমার ঢেকে থাকে দৃষ্টি। হাসিটাও খুব সাধারণ!
ঝন্টু বরাবরই সুন্দরী মেয়েদের ভক্ত। সে স্কুলে যাবার পথে হা করে স্টুডিও ২৭ এর সামনে লাগানো মাধুরী কাজলের পোস্টার দেখতো! স্বপ্ন দেখতো এরকম একটা মেয়ে তার বউ হবে। সেই ছেলের পছন্দে ক্লাসের পারুল, জিনিয়া কিংবা খুব বেশি হলে তিসারা থাকতে পারে।
ম্যাগনোলিয়া নয়।
মেয়েটার সঙ্গে পরিচিত হতে না চাইলেও ঘটনাক্রমে হয়ে গেছে। কাছা কাছিও এসেছে । কথা বলার পর সে আশ্চর্য হয়েছে। মেয়েটা রুচি বেশ উন্নত ।
কথা বলে হিসেব করে, যদিও একটু গম্ভীর। ব্যবহারে বড় ঘরের মেয়ে বোঝা যায়। ঝন্টু তিন কামড়ে বার্গার খেয়ে ঢেকুর তোলে আর একটু পর পর টিসু দিয়ে মুখ মোছে। ঠিক পাশে বসেই মেয়েটা সুন্দর করে কাটা চামচ দিয়ে একটু একটু করে খায়।
কথায় বলে - নদীর পানি ঘোলা ভাল, আর জাতের মেয়ে কালোও ভাল।
ম্যাগনোলিয়া বিদ্বান জাতের মেয়ে। দাদা এমও গণি সেই আমলের ইংরেজিতে এমএ। তিনিই নাম রেখেছিলেন ম্যাগনোলিয়া।
পুরো নাম না ডেকে সবাই তাকে বলে "লিয়া"। তার দাদাও নাকি লিয়াই ডাকতেন।
ঝন্টু সেদিন ভদ্রতার খোলস ভেঙে খোচা দিয়ে বলেই ফেলেছিল,
“যদি পুরো নাম নাই ডাকে। তবে লিয়া রাখলেই হতো, ডিকশনারী ঘেটে ম্যাগনোলিয়া বানাতে গেলেন কেন?”
বৃটিশ আমলের আতেল যেহেতু তার জ্ঞানের দৌড় প্রমাণ করা জরুরী ছিল। নাতিপুতির নাম জুলকারনাইন, সবুক্তগীন, মেহজাবিন থাকলে এরিষ্টটলের ফ্যামিলি মনে হবে। দাঁত খসে পড়ুক । তবুও নবাবী বিষয়।
কুদ্দুস, যদু মধু, কুলসুমে জাত থাকেনা।
২.
ম্যাগনোলিয়া এখন কেঁদে ফেলবে । কারণ তার মরহুম দাদাকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। আমি স্বভাবসিদ্ধ পদ্ধতিতে বলে দিলাম, ঐকিক নিয়মে magnolia র lia হয়ে যাওয়া মানে ৬২.৫% অপচয়। চোখে মুখে প্রেশার কুকারের ছিপির মত বাস্প বের করে সে বলে উঠলো, "নাম নিয়ে যদি এত্ত আপত্তি তাহলে কুলসুমদের কাছে গিয়ে হাত ধরে ধেই ধেই নাচো?"।
সব ছেলেই একটু আধটু খুনসুটি পছন্দ করে। এরকম নিজে বিপদ ডেকে আনলে হয় কাঁদতে দিতে হবে । অথবা কান্না থামানোর বুদ্ধি বের করতে হবে। একটা সহজ সমাধান হলো নিজেকে ইচ্ছেমত গালি দেয়া যেমন, "আমি যে কী! নাম নিয়ে অভদ্রের মত কেউ মন্তব্য করে, তাও এরকম বয়স্ক মানুষ নিয়ে!"
যদি এতে কাজ না হয় তবে সাধু মানুষের মত বলতে হবে, "আমি কোথায় বলেছি তোমার নাম পছন্দ হয় নি? তোমার দাদা বেছে বেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফুলের নাম রেখেছে আর এত মিষ্টি একটা নাম রেখে তোমাকে ডাকছে লিয়া"।
এরকম হলে ম্যাগনোলিয়া খুব ডগমগ হবে।
বলবে, "হুম্ম, এতদিনে তাহলে মশাইয়ের নামটা বোধগম্য হয়েছে"। একটা আহ্লাদি হাসি দিয়ে বলবে, "এসব ঝগড়া বাদ দাও, চলোতো বাইরে কোথাও ফুচকা খাই" ।
৩.
ম্যাগনোলিয়ার সঙ্গে খুনসুটির পুরোটাই কল্পণা। মেয়েটা বাস্তবে তিনডবল সিরিয়াস। রাগ করলে সে কাঁদবে না, বরং ভারী গলায় বলবে, “নাম ছাড়া কি আর কোন বিষয় নেই কথা বলার? এই বয়সে এসে মুরুব্বীদের নিয়ে এ ধরণের মন্তব্য কেউ করে?“ বয়সে ছোট হলেও গম্ভীর ভাব দেখাবে।
কথায় কথায় কোট করবে শরৎচন্দ্র বা বঙ্কিম।
ঝন্টুর আফসোস হল সে যা চায় লিয়া তার বিপরীত। সে পছন্দ করতো লাফালাফি করা মেয়ে। যারা কথার পিঠে কথা বলে, হাত পা চালবে। স্টাইল করে বলবে, হাই, হ্যালো, ওয়াও, গুল্লি।
মাঝে মাঝে ফ্রেন্ডলীতে সে একাই খেতে যেত । লিয়া ওসব জায়গা পছন্দ করে না। ওর ধারণা ওটা পিচ্চিকাচ্চিদের ঢং করার জায়গা। স্কুল পালিয়ে গেলে তাও কথা, ধাড়ি ভার্সিটির মার্কেটিং এর ছাত্র যাবে কেন?
ফ্রেন্ডলীতে গিয়ে আফসোসই হতো। ম্যাগনোলিয়ার বয়সেরই সব মেয়ে।
কেউ পরে আছে স্কার্ট, উচু হীল, হাতে ব্রেসলেট । পাশের একটা মেয়ে ছেলেকে বসিয়ে দৌড়ে অনিয়ন রিং কিনে এনেছে। চোখ ঘুরিয়ে বলছে, "হু, বিলের সময় তো বসে থাকো, তু তু মনি আমি কি বুঝি না"।
লিয়ার সঙ্গে ঝগড়া করেও সুখ নাই। নিজেই বিল দিয়ে দেবে।
বলবে, “এসব ফাস্ট ফুড খাবার খাওয়ার চেয়ে বাসায় ভাল কিছু রান্না করে খাওয়া অনেক ভাল”।
৪.
ভালবাসার বয়স পার হয়ে যেতে থাকলে কার না অস্থির লাগে? ঝন্টু অনেক চেষ্টার পর শেষে ম্যাগনোলিয়ায় এসে থিতু হয়েছে।
কেন অন্য মেয়েরা তাকে পছন্দ করেনি সে এক বিস্ময়। হতে পারে তার চোয়ালের হাড়টা বড়, হতে পারে মেয়েরা পাঁচ ফুট চার পছন্দ করে না। কিন্তু তার চেয়েও দেখতে খারাপ ছেলেরাও ঐশ্বরীয়া রাই নিয়ে ঘোরে।
ঝন্টু যখন কলেজে পড়ে । মামাতো বোন শান্তার দিকে নজর যায়। বৃটিশ প্রবাদ আছে কাজিন ইজ দা বেস্ট টার্গেট । ঝর্ণাখালার বিয়ের সময় শান্তাকে ইসারায় আড়ালে ডেকে দম নিয়ে বলেছিল, "আই লাভ ইউ, শান্তা। "
শান্তা প্রথমে বুঝতেই পারেনি।
তারপর হো হো করে হেসে অস্থির । হাসি থামলে বললো, "জিন্দেগীতে আর কোন মাইয়া পাইলি না, আমার কাছে আইসস, আব্বে ফুট! শান্তা বহুত আগেই বুকড! পীরিতের বয়স তোর এখনো হয় নাই। যা যা ফিডারে দুদু খা" ।
ঝন্টু এরকম সহজ গেমে ধরা খেয়ে কয়দিন মন মরা ছিল। পাশের বাসার নতুন যে মেয়েটা এসেছিল তার জানালায় চিরকুট ছুড়ে দিয়েছিল।
পরে শুনেছে মেয়েটা আসলে সিক্স সেভেনে পড়ে। কী রকম লজ্জার বিষয়! প্রেমের ইচ্ছাটা অবিলম্বে ইন্তেকাল করেছিল।
৫.
ইউনিভার্সিটির ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত ম্যাগনোলিয়াই একমাত্র সাফল্য।
মাসখানেক আগে দাড়িয়েছিল শাহবাগের মোড়ে। সন্ধার আগে লিটল ম্যাগাজিনের দোকানে আড্ডা শেষে ফিরছে।
মেয়েটাকে দেখেই চিনতে পারলো। প্রায়ই দেখে টিএসসিতে বিতর্কের কি একটা গ্রুপের সঙ্গে।
অন্য মেয়ে হলে আগেই পরিচিত হতে চাইতো। সে দুরেই ছিল।
প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো দেখে ছাতায় এগিয়ে একটা রিক্সা ঠিক করে দিতে দিতে মিনিট পাচেক কথা হয়।
মেয়েটা কিছুক্ষনের মধ্যেই তাকে নরম গলায় বলতে থাকে, "আপনি কিন্তু সাবধানে যাবেন। ঝড় বাড়তে পারে। বাবা মাকে চিন্তায় রেখে এমন দিনে বাইরে ঘোরা কি ঠিক?"
হঠাত্ মেয়েটাকে একটু ভাল লেগে যায় । কী মনে করে সে বলে ফেলেছিল, "আপনি কি কাল এখানে আবার আসবেন??" । বৃষ্টিটা বাড়ছিল।
ম্যাগনোলিয়া রিকসায় উঠতে উঠতে বললো,
"আমাকে তুমিই বলবেন। কাল বিকেলে ফ্রি আছি ঘন্টাখানেক । আমরা একই ক্যাম্পাসের। আগে কথা হয়নি সেটাই তো অবাক! "।
৬.
লিয়া শাহবাগের সিলভানাতে আসতে রাজি হয়ে যায় একবারেই।
ঝন্টু বাসায় ফিরে প্রথমেই বিরক্ত হয়েছিল । এ কেমন মেয়ে? বললেই রাজি হয়ে যায়? অন্য যে কোন মেয়ে নিশ্চয়ই এভয়েড করতো। বলতো, "না ভাইয়া, আমার অনেক কাজ কালকে। আমি পরে একসময় জানাবো"।
সে রাতেই সেকেন্ড অপিনিয়নের জন্য মেয়েটার নাম গোপন রেখে জাহিদকে ফোন করলো,
"দোস্ত, ঘটনা ঘটছে, এক মেয়ের সঙ্গে বাসে পরিচয়, দেখা করতে চাই বলতেই রাজি হয়া গেল..এখন কী করি?".
"দেখতে কেমন?"
"মোটামুটি"
“পছন্দ না হইলে, তুই কইতে গেলি ক্যান? এখন ধরা খা"
"আরে আমি কি আর ভাবছি এত সহজে সিস্টেম হইবো?"
"শোন, যে মেয়ে ভাল, সে কোনদিনও একবারে রাজি হইবো না।
শিওর মেয়েটার বিয়াসাদী হয় না অথবা অন্য কোন প্রব্লেম আছে। "
এক উভয় সংকটে পড়ে গেছে। দীপ আছে শিখাও পাওয়া গেছে এখন আলো জ্বালতে দেখে সলতা ভিজা!
জাহিদ ঝানু ছেলে। মেয়ে পটাতে তার জুড়ি নাই। তবুও তার কথা ঝন্টু শোনে না।
মনে হয়, এটা অন্যায় । লিয়া ভাল মেয়ে বলে রাজী হয়েছে। আর কেন এটাকে সে দুর্বলতা হিসাবে নিচ্ছে । আর এতই যদি কনফিউশন তো সে বলতেই বা গেল কেন?
লিয়াকে একটু করে ভাল লাগে । লিয়াও তাকে সময় দেয়।
অনেক কথা বলে। কিন্তু ঝন্টু অনেক ভেবেও পুরো একমত হতে পারেনা।
মাঝে মাঝে নিজেকে বঞ্চিত মনে হয়। রাগ হয়। লিয়া যদি পারুলের মতো একটু ফর্সা হতো? স্নিগ্ধার মতো হরিণী চোখ ! আবেগটাই সর্বনাশ ।
প্রেম নিবেদন করে এখন সে না পারে গিলতে না পারে ফেলতে।
আবার মনে হয় লিয়া সত্যিই তাকে ভালবাসে। জীবনের প্রথম এমন একটা সুন্দর সম্পর্ককে গলাটিপে মারতে তার খারাপ লাগে। অনেক ভেবে লিয়ার সম্পর্কের কথাটা চুপচাপেই রাখে।
৭.
ইউনিভার্সিটিতে ধর্মঘটের পর ক্লাস খুলেছে।
লাইব্রেরীতে বসে ছিল ঝন্টু । ভাবছিলো একটা বুদ্ধি দরকার। জাহিদ অথবা বাবুভাইয়ের মত অভিজ্ঞলোকদের খোলাখুলি বললে হয় ঘটনাটা।
জাহিদকে ক্যাম্পাসে খুজে খুজে অবশেষে হাকিম চত্বরে পাওয়া গেল। জাহিদ হঠাৎ দুর থেকে চেঁচিয়ে বললো, "দোস্ত তোরে আমি খুজে অস্থির"
"আরে! আমিও তো তোরে হারিকেন দিয়ে খুজতাছি"
"একটা কান্ড হইছে ।
ম্যাগনোলিয়া নামের একটা মেয়ে আসছে জুনিয়র ব্যাচে দেখসস? হেভী ট্যালেন্ট। আর চেহারাটার মধ্যে কী যেন একটা আছে। দেখলেই মায়া লাগে। ফিগার জটিল। ঠোট দুইটা একেবারে মাখ্খন! "
আমি তার শব্দ ব্যবহারে পরিচিত।
কিছু বলার আগেই সে বললো,
"এইবার তুই আমারে বুদ্ধি দে। কী করি। "
আমি একটু স্তব্ধ হয়ে গেছি। শুনছি,
"মেয়েটার ভাবই আলাদা। সেইদিন মেয়েটারে ডাকলাম কাছে, বললাম চলো না মধুতে দুই মিনিট কথা বলি"।
সে পুরা এভয়েড করলো। বললো, "ভাইয়া, আজকে না, ইউনিভার্সিটির বাসের টাইম হয়ে গেছে । মা চিন্তা করবে। "
অথচ আমি জানি ধর্মঘটের জন্য সেদিন সব বাস বন্ধ ছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।