আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: প্রিয়তম দুঃখ

ডুবোজ্বর

বিরহী সিঁদুরের রূপ ধরে জেগে ওঠে অকাল গোধূলি। মেঘ সরে গেলে এইভাবে কিছু ধূলিকণা দৃশ্য হয় গোধূলিবেলার হাওয়ার রথে চড়ে। সে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে ফেলে পরিচিত গাছপালা, পুকুর, লতা, সোনালু, পারিজাত, অকালবৈরী স্রোতাধীর রোদ। তার ডানহাতের মুঠোয় ধরা আছে দিগন্তের রঙ। যেনো বা তার চোখের মধ্যেই নিভে যাচ্ছে সূর্য।

সে ভোরবেলা ঘুম ছেড়ে দেখে তাদের কবরের উপর ছায়াবতী বকুলের ডালে বাসা বেঁধেছে দুইজোড়া নাম না জানা পাখি, পাখিরা কান্নার মতো ডেকে উঠছিলো। সে ছুঁতে গিয়ে ছোঁয় নি নীড়; পাখিদের বলেছে, শুভ ভোর, কেঁদো না রাত এলে... ইত্যাদি। সে চোখে মুখে অনেকক্ষণ পানি দিলো; পানিটা ছিলো তখন জল। ভোরবেলা সমস্ত পানিই জল। সে বালিকাবেলার মতো মুখে জল নিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে কুলকুচি করলো; তার কুলকুচির জল হলো রামধনু।

আর সে হলো সূর্যমুখী। বেগুনি-নীল-আকাশী-সবুজ-হলুদ-কমলা-লাল রঙে পরিণত ভোর। একটু পরেই ভোর ধরলো সকালের আধকোমল হাত (মধ্যে মধ্যে তাকে আমার সকাল নামেও ডাকতে ইচ্ছে করে)। সকাল তাকে নিয়ে এলো একটি ধূসরগেরুয়া রঙ ইস্টিশনে; ওখানে রথের মতো ছাড়ে স্বপ্নযান, কিন্তু সে স্বপ্নযানে না উঠে ভিড় টেলে উঠে পড়ে একখানি ট্রেনে। ইহা শাটলট্রেন নামে আমাদের এবং তাহাদের কিংবা সকলের কাছে পরিগণিত।

এই ট্রেন তাকে রোজ পৌছে দেয় একটি বেগুনি অরণ্যে। তারপর তার চলাচল। তারপর সে চরাচর। সে মানে সে। সে মানে তুমি।

তার কথা, তোমার কথা এইসব ভেবে রোদ নামে আকাশের রূপবতী স্বেদ। সে তোমাকে চেনে, তার রঙ তোমার দেহের রঙ। সে শরীরে ধারণ করেছে স্বর্ণচাপা। তুমি নির্বাসন, আমি নির্বাসিত; জানতে পারো নি কিছুই। তুমি অভিমান, আমি নতজানু প্রণয়Ñ এইসব প্রণয় প্রলাপ শুনতে পাও না।

তুমি টগরÑ শাদাফুল। তুমি আমাকে বলেছিলে, শাদা ফুল নিজের ইচ্ছায় ফোটে। আর রঙিন ফুলসব ফোটে অন্যের ইচ্ছায়। আচ্ছা, প্রজাপতি তোমার এতো প্রিয় কেনো? তুমি শুধালে। প্রজাপতি আমার ভালো লাগে, হাজার হাজার হলুদ প্রজাপতি।

এইসব কথা আমি তোমাকে বলেছি বেগুনি অরণ্যে। এই অরণ্য বর্ষার গ›েধ বেগুনি হয়, বৃষ্টির দংশনে সারাটি বর্ষা বেগুনি থাকে। জারুল বৃষ্টির কাছে মর্ষকাম সুন্দর। আমি কেউ নই নিজের কাছে, আমি কেউই নই তোমার কাছে। আমার স্মৃতি আছে রোমন্থনের জন্যে; সবার আছে, আছে তোমারও।

তোমার স্মৃতি আমি জানি না, সায়ন্তনীল স›ধ্যা। এখানে বেশ কয়েকটা পানকৌড়ি ছিলো আগে, ইদানীং দেখা যায় না। এই কথা তুমি শাটলট্রেনের দরজায় আমার পাশে বসে বলেছিলে। তখনো আমি পানকৌড়ি চিনি না, সত্যি। তারপর একদিন চিড়িয়াখানায় পাখির খাঁচার সামনে ঘুরে ঘুরে পানকৌড়ি চিনেছি; সলিম আলির কাছে জেনেছি পানকৌড়ি পাখিটির আদি অন্ত সুন্দর।

এবং পুনর্বার ভুলে গেছি। তুমি আমাকে চিনিয়ে দাও, আমি আর কখনো ভুলবো না। তুমি আমাকে একটা লেবুপাতা দিয়েছিলো একদিন শূন্য দুপুরবেলা, মনে আছে; ওটা আমি গীতবিতানের দুইশো এগারোপৃষ্ঠায় রেখে দিয়েছি। আমাদের আলোকবর্ষগুলি এখন পার হয়ে যায় বুকের মধ্যে। তুমি প্রতিদিন পাথরের ভূমিকায় অভিনয় করো, কিন্তু পাথর হতে পারো না।

তুমি হচ্ছো সে, সে হচ্ছে তুমি, তুমি দুঃখ, প্রিয়তম দুঃখ। আমরা আগে কেনো কথা বলি নি? এই কথা বলে তোমার দুটি চোখ প্রশ্ন হয়ে ছিলো। আমরা পরস্পরকে চিনতাম কিন্তু কথা বলতাম না। প্রিয়তম দুঃখ, এইসব কথা তুমি আমাকে বলেছো, আমি মনে রেখেছি। তুমি বলে ফেলেছো।

ফেলেছো মানে ফেলে দিয়েছো। রেখেছি মানে আমি রেখে দিয়েছি। বুকের তোরঙ্গে রেখেছি বিনীত অরণ্য, স্মৃতিসত্য কুসুম। তুমি মানে সে। সে সুখের সারাৎসার ঘেঁটে উঠে আসে দুর্বিনীত দুঃখ।

সে কাটাপাহাড় ধরে হেঁটে আসে আমার পাশাপাশি। আমরা কথা বলি। আমাদের কথাগুলি ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। ওটা নীলকান্তপাখি। সে তাকায় এবং অস্বীকার করে।

আমি তাকে একটা কল্কি বের করে দিই, হাতির দাঁতের। আমি তাকে একটা কল্কি বের করে দিই, পোড়ামাটির। ওইসব এখন ডেকোরেশনের কাজে ব্যবহৃত হয়। সে হাত পেতে নেয়। যতœ করে রাখতে হবে।

আনমনে সে বলে। এবং কল্কি দুইটি ব্যাগে রাখে। আমরা দেয়ালের উপর বসি। সে গান করে, দোলে পলাশের নোলক... ইহা শচীন কর্তা। পলাশের নোলক দেখতে কেমন? জানি না।

এটাই তোমার দুধশাদা জামা? না। তোমার হাতে ভগবদ গীতা! গীতা সবাই পড়তে পারে। খেয়েছো? খেতে চাই। মান্দার গাছে যে ফুল ফোটে, রক্তের মতো, ওটা পারিজাত। মেঘদূতে লেখা আছে।

স্বর্গে মান্দারের নাম পারিজাত। আমি যা নিজে করি না, তা অন্যকে করতে বলি না। যথারীতি বৃষ্টি হয় বনাঞ্চলে... তোমার জন্যে আমার মায়া হয়। মায়া মানে করুণার ভদ্র নাম, প্রেম যেমন কামের... তোমাকে আমি করুণা করি? আমি করুণা চাই না, আমি ছুঁতে চাই সরক্ত। সে উঠে চলে যায়।

আমি উঠে চলে যাই। সে মানে তুমি; আমি মানে আমিÑ ইদানীং সত্যের মতো সুন্দরের রূপ পরিগ্রহ করি... আর বাঁশিতে বাজে বিলম্বিত লয় বসন্ত। স্যালাইন বানাবে? কথাটা তুমি মন থেকেই বলো, কিন্তু নিতে পারো না, সাথে। তুমি যেহেতেু সে। আর যেজন সেÑ তার একটা পরিচিতি এবং সৌজন্যিক পরিমণ্ডল আছে ধূসর প্রতিবেশের মতো, ওখানে আমি বড় বেশি বেমানান, অযাচিত ইত্যাদি।

তোমার কাছে প্রধান কথা বন্যার্তদের স্যালাইন দরকার। আর আমার কাছে প্রধান কথা তোমার সঙ্গ দরকার। কিন্তু নৈসঙ্গকে ধারণ করে ছায়ার সাথে কথা বলি জারুলের বনে। আমি পাশ কাটিয়ে চলে গেলে ডাক দিয়ে বলো, অ্যাই! চোখ নেই? দেখতে পাও না! আমি তোমাকে দেখে আমার দৃষ্টি ফিরে পাই আর তুমি দৃষ্টি হারাও; পাশ কেটে চলে যাও অন্যকাজে। তেইশহাজার ব্যাগ স্যালাইন বানানো দরকার; দেবীদ্বারে পাঠাতে হবে, ওখানে পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে... তারপর এসে বসো মুখোমুখি, চা নাও।

আমি আর তুমি গরম চা খেতে পারি না, আমি চায়ের কাপ সামনে রেখে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, তখন দুপুর। তোমাদের টি কিংবা টিফিন ব্রেক। কী দ্যাখো? তোমাকে। না, তোমাকে দেখি না। কী দেখি জানি না।

অস্বস্তিকর। আমি চুপচাপ। সে আবার অরণ্যে মুভিটার কথা বলে, পুতুলটার মধ্যে ছিলো ইলমাসের প্রাণ... তার মানে তোমার হাতে ছিলো ঘাসফুল। আমি তাকালাম তৃষ্ণার্ত। তুমি বললে, নট ফর য়্যু।

চাই না। তার হাতে একদিন একটা গোলাপ ছিলো সূর্য। সে বললো, নেবে? না, আমি ফুল নিই না। মনে মনে বললাম, আমার কাছে ফুল রাখার জায়গা নেই। সে চলে গেলো।

তারপর কোনো এক রাজকুমারের বিচ্ছিরি নাকের কাছে ফুলটা গ›ধহীন কুসুম। হাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহ... অন্য আরেকদিন আসে। সেইদিন পৃথিবী যেনো টগরের মতোই শাদা। সে এসে বসে সমুখে। আমার কাছে একটা টগরফুল আছে।

কই, দেখি! তুমি বললে, না, দেখাবো না। তখনো আমি কোনোদিন টগর চোখে দেখি নি। জেনেছি টগর শাদারঙ ফুল, তোমার হাতের মতো শাদা। আমি তোমার কাছে একটা চিঠি লিখেছি। সে নিঃশব্দে হাত পাতলো।

অনেকদিন সে আসে না। অনেকদিন আমি আসি। আর তার স্পর্শ যেখানে যেখানে আছে আমি যাই, ছুঁয়ে দেখি; প্রতিটি কিছু আমাকে তার মতো করে বলে তারই কথাগুলি। আমার কানে বাজে, তোমার চিঠি পড়েছি খুব মনোযোগ দিয়ে... অথবা আমার জিনিশ কই... অথবা ছি! নিজের জিনিশ অন্যের হাতে পাঠাতে লজ্জা লাগে না!... অথবা আমি ওরকম হবো না... অথবা কাজ না করে আমি থাকতে পারি না... অথবা কাজ না করলে আমার ক্লান্তি লাগে... অথবা পরশু তোমার সাথে দেখা হয় নি... ইত্যাদি। আমি পরশুর কথা ভাবতে থাকি।

আমার ঘর নেই। আমার খড়ও নেই। শুধু চঞ্চু আছে। তোমার কাছে চাঁপাফুল? না, আমার শরীরে তো অন্য এক গ›ধ থাকার কথা... আমি বিমুগ্ধ বসেছিলাম তার সামনে। সারাদিন খালি ঘোরাঘুরি রোদে রোদে, খাওয়া-দাওয়া করার দরকার নেই? আমি চুপিচাপ শুনতে থাকি তার কথা।

অনিয়ম করবে না। আচ্ছা। তোমাকে আমি সংস্কৃত ছন্দ শেখাবো। কখন? আগে আমি শিখে নিই; তারপর। সে বলেছিলো এইসব কথা।

তার কথা আমার চারপাশে হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে কুসুমিত। সে নেই; তার কথা আমার নিঃশ্বাসের বাতাসÑ আমার শিরায়, উপশিরায়, অলিন্দে রক্তের নদে স্রোতের উপর গান হয়ে বাজে। একদিন তার মুখোমুখি বসেছিলাম। শাটলট্রেন চলছিলো স›ধ্যার দিকে। স›ধ্যার রঙ হরিতকীর ফুল।

আর সমস্ত কথা আমাকেই শুরু করতে হয়। তো, কী প্ল্যান তোমার? মানে! ভবিষ্যতে কী করবে ঠিক করলে? একা থাকবো। তার এই কথা আমি রক্তের ভিতর শুনতে পাই। আমার শূন্যতার আধার হতে ইচ্ছে করে। একটা কলেজে মাস্টারি করবো।

আমি শুনতে থাকি। আমার একটা কলেজ হতে ইচ্ছা করে। সমুদ্রের দিকে কোথাও চলে যাবো... আমার সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয় হতে ইচ্ছা করে। আমি বলি, তার কথা বলো। ব্যাপারটা হচ্ছে, সেও আমার জন্যে কষ্ট পায়।

আমি মনে মনে বলি, না, প্রিয় দুঃখ, সে তোমার জন্যে কষ্ট পায় না। তবে তোমার সঙ্গ তার ভালো লাগে। যখন তার প্রেমিকা থাকে না সাথে তখন সে তোমার সাথে সময় কাটায়। তুমি ব্যবহৃত হও, না জেনে। আমিও যেমন ব্যবহৃত হই।

তবে আমি বুঝতে পারি। আমার এইসব কথা সে শুনতে পায় না। সে চুপ করে থাকে কিছুকাল। তারপর বলে, আর আমি শুধু শুধু কষ্ট পাই। সে যেনো নিজের সাথেই কথা বলে।

তোমার সমস্ত ভালো না লাগা নিয়ে বাজি আমি অন্তহীন বাঁশি, তুমি ভালো থেকো। তার জন্যে আমার খুব কষ্ট হয়, ভীষণ কষ্ট। সে দুখানি পা আমার পাশে সিটের উপর রেখে সামনের সিটে বসে আছে। না, একদিন বসেছিলো। ইচ্ছে হলো তার পা ছুঁয়ে দিই।

কিন্তু পারি না। তবে মনে মনে ছুঁয়ে দিই ঠিকই। সে টের পায় না। আমি লিখে দিতে পারি, তোমার মায়ের আগে তুমি মরে যাবে। এমন কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।

তাই তার কাছে যাই। সে বলেছিলো। তাকে আর খুঁজে পাই না। একদিন তার ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা খুলে গেলো হাওয়ার ধাক্কায়, কেউ নেই ঘরে।

তখন স›ধ্যা ছিলো। স›ধ্যারতির সময় ধূপের গ›েধ বিহ্বল চারপাশ। তার মা বললো, সে চলে গেছে। আমি ফিরে এলাম। দুইদিন পর আবার গেলাম, ভোরবেলা।

মা বললো, সে চলে গেছে। মা যেনো পাথরের ভূমিকায় অভিনয় করছে তারই মতো। তারপরও আমি বারংবার ওর ঘরের অদূরে গিয়ে বালির উপর বসে থেকেছি। মাথার উপর ছায়া মেলে ছিলো সীমাহীন রোদের আকাশ: আমার কল্পনার ভীষণ ছাতিমগাছ। ওর ঘর সমুদ্রের পাড়ে।

ঘরের উঠান পার হলেই হাতের বামপাশে কবর, কবরের উপর বকুলের গাছ। কবরের পাশে ঠাকুরঘর, জীবাত্মা আর পরমাত্মার সঙ্গমের ঘ্রাণ ওই ঘরে; সে কখনো ওই ঘ্রাণ পায় নি... প্রতিদিন আমার দিনগুলি কেটে যায় জল, নুন, ফুল, ঠাকুরঘর, কবর, স্মৃতি এইসবের গ›ধ মেখে মেখে। সে আসে না। সে চলে গেছে হয়তো। ওর মা আমাকে দেখে প্রতিদিনই, কিন্তু ডাকে না।

আমার একান্নতম দিনে ঠিক করলাম রাতটাও কাটাবো এইখানে। রাত তখন এগারোটা তেরো। মা ঠাকুর ঘরের সিঁড়িতে পা রেখেই আমাকে দেখলো বসে আছি জোছনাপ্লাবিত অ›ধকারে। হাতের ইশারায় আমাকে ডাকলো। আমি প্রণাম করলাম।

মায়ের পায়ে চাঁপাবনের গ›ধ পেলাম। সে আর ফিরবে না। এই কথা বলে মা আমার মাথায় হাত রেখে হিজিবিজি চুলগুলি আরো এলোমেলো করে দিলো। পুনর্বার বললো, সে আর ফিরবে না; তুইই ফিরে যা। আমি শুনলাম চাঁপাবনের কণ্ঠস্বর মায়ের কণ্ঠে।

কিন্তু আমি ফিরবো কার কাছে। আমার তো ঘর নেই। একদিন ভোরবেলা আমি লঞ্চঘাটে গিয়ে একটি বিশালাকার ইস্টিমারে উঠে পড়ি। তিরিশঘণ্টা ধরে ডেকের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশের সকল তারা, চাঁদ, মেঘ, সপ্ত আকাশ সমস্ত গুনে ফেলেছি, মেঘের ভাঁজে ভাঁজে রাস্তাগুলি জনাকীর্ণ পৃথিবীর মতো মনে হয়েছে। রামধনু গুনেছিÑ বৃষ্টি বিরতির রাঙা পোস্টার।

সেদিন আমাকে ঘিরে আমার চোখে, মুখে, চুলে, বুকে, আঙুলে, নখে সমস্ত সবিশদ শরীরে যতোটা বৃষ্টির ফোঁটা পড়েছে ঝরে, ঠিক ততোটাই চুল গুনেছিলাম একদিন তার মাথার এলোমেলো মেঘে। এটা কি তবে কাকতাল? তারপর আকাশে নদীর প্রতিচ্ছদ দেখে গুনেছি এক একটি জল, তার চোখের মতন সরল, আমার চোখের মতন সরল। এইভাবে কেটেছে নদীর সময়, জলের বিহার আমার। তার চোখের তলে আমি দেখতাম একটা সমুদ্র প্রশান্ত, চোখের জলের মতো। কিন্তু তাকে আমি একদিনও বলি নি, প্রিয়তম দুঃখ, তোমার চোখে জল... শেষবার ওর সমুখে গিয়ে বসেছি।

চা খাবে? বললাম, খাবো। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কী দ্যাখো? আমি চুপিচাপ তাকিয়ে থাকি শূন্যতা। আমার সত্যিই অস্বস্তি লাগে। তুমি যখন পথ দিয়ে হেঁটে যাওÑ গাছপালা, ফুল-পাখি, লতা-গুল্ম, ধূলি-কাকর, বালি যে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে তখন অস্বস্তি লাগে না? বিশ্বাস করো, এইসব ভাবের কথা আমি সত্যিই বুঝি না।

আমি তার পায়ের তাকিয়ে থাকি নতমুখ দুপুর। সেও গরম চা খেতে পারে না, আমিও পারি নাÑ এতোক্ষণে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াই। অভিমান, তুমি সত্যিই দেয়ালের ওপাশে থাকো, স্ফটিক দেয়াল। তোমাকে ঝুঝি না চিলের ডানার অন্তর্গত অস্থিরতা। এইসব মনে মনে বলে তারপর বলি, আমরা এইখানে আর দুইতিনবছর আছি।

হ্যাঁ। তারপর কী করবে? এনজিওতে কাজ করার ইচ্ছা আছে। কিন্তু তুমি তো এনজিওর বিপক্ষে। কেনো? কিছু এনজিওতো ভালো লাগে। তুমি ব্যবসা করলে মানাবে।

যেমন, প্রকাশনা ব্যবসা। ব্যবসা করতে টাকা লাগে। না, তুমি ব্যবসা করলে তো আমাকে একটা চাকরি দিতে পারবে। চাকরি করবে কেনো? তুমি তো আমার পার্টনার হবে। কিন্তু আমার তো টাকা নাই।

আমি দেবো। পরে লাভ থেকে কেটে রাখবো। কিংবা না দিলেও চলবে। আমি মুগ্ধচোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সে হাসে ভোরের প্রথম রোদ।

তাহলে আমি তোমার মুখের দিকে আর তাকাবো না, শুধু পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবো। আমার পা কাঁথা দিয়ে ঢেকে রাখবো। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শোয়ার পরও মশা যেমন করে কাঁথার ওপর দিয়ে কান খুঁজে বের করেÑ তেমনি আমার চোখও তোমার পা খুঁজে নেবে... একটা মোমবাতি নিমিঝিমি, চায়ের দোকানে; একসময় দোকানের সমস্ত চা শেষ হয়ে যায়। সে উঠে পড়ে। আমি উঠে পড়ি।

হাওয়া উড়ে জারুলের বনে। আমি ইস্টিমার থেকে নেমে তাকে খুঁজলাম অভিমানÑ মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। তাকে খুঁজলাম টগরÑ শাদাফুল। তাকে খুঁজলাম নির্বাসনÑ আলোকবর্ষের পথ। তাকে খুঁজলাম দুঃখÑ প্রিয়তম; খুঁজলাম চাঁপাবনÑ গ›ধবহ।

তাকে খুঁজলাম সকাল... এইসব পথ জলের গ›েধ মোহন যাপন। আমি প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে তাকে খুঁজে ফিরি শিরীষের ডালে, পাতায় পাতায়, গোলপাতার বনে, কেয়া-নিশিন্দার কাঁটায়, নারিকেলের ছায়ায়, খুঁজে ফিরি ডাহুক, শালিক, কাক, ঘুঘু, মরাল, হরিয়াল, কানাকুয়া, হাঁস আর চিলের উড়ালে, খুঁজে ফিরি শিশিরে, মাঠে, ধানক্ষেতে চিরদিন বাতাসে... পাই না তাকে, পাই না কিছুই। অবশেষে তাকে না পেয়ে আমি নিজেই হয়ে যাই শিরীষ, গোলপাতা, কেয়া, নিশিন্দা, ফুল, পাখি, মাঠ, শিশির, অভিমান অথবা আলোকবর্ষের সুদূরতম পথরেখা... গোপন তোমাকে খুঁজে ফিরি; পাই না কিছুই। আমি তখন সমুদ্রের পায়ের কাছে কেয়া-নিশিন্দার বন; আমার উদ্ভিদজন্মে নিজেকে চিনতে চিনতে আমার কাঁটায় খুন হয়েছে প্রজাপতিদল, ফড়িং, ছোটোপাখি, ছোটোপাখি... একদিন জোয়ারের বেলা ভেসে আসে বকুল, গাছসহ। আমি চমকে উঠিÑ বকুলের গ›েধ।

না, বকুলের গ›েধ নয়; বকুলে আছে চাঁপার গ›ধ। তোমার কাছে কি চাঁপা ফুল? মনে আছে বকুলগাছটা ছিলো তাদের কবরের উপর। আর কবর ছিলো অনিবার্য ঘর। এইবার আমি তাকে বলেই ফেলি, প্রিয়তম দুঃখ, তোমার চোখে জলের কাজল।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.