সবুজের বুকে লাল, সেতো উড়বেই চিরকাল
(মা এর কাছে শুনেছি, আমার প্রথম জন্মদিন পালন করা হয়েছিল বেশ ধুমধাম করে। অনেকটা বিয়ে বাড়ির আদলেই। আর ঐতিহ্য পালন করতে উপহার পেয়েছিলাম প্রচুর স্বর্ণের উপহার। বড় হয়ে এই রকম একটা উপহার দেখেছিলাম। আমার দাদির দেয়া একটা আংটি।
আসল নীলা পাথরের উপর আমার নামের অদ্যাক্ষর স্বর্ণ দিয়ে লেখা। আংটিটা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। এ নিয়ে বাবা মা এর মনে অনেকদিন কস্ট ছিল।
এর পর সবাই আস্তে আস্তে ভুলে গিয়েছে আমার জন্মদিন। মা ভোলেননি যদিও।
আজ লিখতে গিয়ে দেখি সামুও ভোলেনি। কেক টেক না হোক, ফুল না হোক, কয়েকটা বেলুন দিয়ে জানান দিয়ে গিয়েছে যে আজ আমার জন্মদিন। )
চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার এখনই সময়। পর্ব ১
যে ভুখন্ডটা আমরা আজকের বাংলাদেশ বলে জানি, সেটি পরিচিত ছিল অখন্ড বাংলার পুর্বাংশ বলে। যুগে যুগে আমরা শোষিত হয়েই ছিলাম।
কখনো স্বাধীন সুলতানদের দিয়ে, কখনো মোগলদের দিয়ে কখনো ইংরেজ এবং সর্বশেষ পাকিস্থানিদের দিয়ে।
বিধাতার অকৃত্রিম দানে আমাদের এই ভুমি ছিল এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উর্বরা। ফলে আমাদের এই অঞ্চলই হয়ে উঠে কৃষির লীলাভুমি।
নদীমাতৃক বলে খাওয়ায় আমিষ হিসাবে যুক্ত হয় মাছের প্রচলন। তাই একদল পেশাজীবির দলও যুক্ত হয় শ্রমজীবি মানুষের।
কৃষক কামার কুমার জেলে তাতি, বেচে থাকার তাগিদেই একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে ছিল।
ফলে ধর্মের ভিন্নতা এদের কোনদিন স্পর্শ করেনি কোন আমলেই। আজ পর্যন্ত তাই অসাম্প্রদায়িকতার বিষে বাংলাদেশ নীল হয়নি।
আর এই কৃষক কামার কুমার জেলে তাতী এদের সম্মিলিত সমাজের মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল স্বতন্ত্র এক ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির।
সোহরার্দি এবং শরত বোসের সব চেস্টাকে বিফল করে ভারতীয় কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভার কারণে অখন্ড বাংলা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় ১৯৪৭ সালেই।
এর আগে বৃটিশদের একান্ত বংশদবদ হয়ে অখন্ড বাংলার হিন্দুদের অনেকেই শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে গিয়ে ভাই থেকে প্রভু হয়ে বসিয়েছিল। যাদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিল পশ্চিম বাংলার।
বৃটিশদের বদন্যতায় একশো বছরের উপরে কোলকাতা ছিল অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক রাজধানি। আর পুর্ব বাংলা ছিল কৃষি জলজ এবং তন্তু বস্রের কাচামালের উৎপাদক মাত্র।
লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের কারণে পুর্ব বাংলার কৃষক সমাজ, হিন্দু জমিদারদের দাসে পরিণত হয়।
অত্যাচার অনাচারে বিপর্যস্ত এই কৃষক সমাজের পক্ষ্যে কথা বলার মানুষ এসেছিলেন অনেক অনেক পড়ে। যাকে আমরা শেরে বাংলা একে এম ফজলুল হক বলেই চিনি।
বছরের পর বছর শোষিত বঞ্চিত হয়ে পুর্ব বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্য প্রায় নিঃশেষ হয়ে পড়েছিল। তবে আশার কথা ছিল যে, ধর্মীয় বন্ধনটি নানা রকম কুসংস্কারে বাধা পড়লেও, মোটামুটি ধর্ম টিকে ছিল।
বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হবার জন্য পুর্ব বাংলার মানুষদের সামনে দুটি মাত্রই পথ খোলা ছিল।
হয় ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্থানের সাথে যোগ দেয়া, কিংবা ভারতের সাথে যোগ দেয়া।
হিন্দু জমিদারদের শত বছরের নিদারুন অত্যাচারের কারণে পুর্ব বঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কৃষকরা ছিলেন বিতশৃদ্ধ এবং ক্ষুব্ধ। তাছাড়া লেখা পড়া করে "জাতে" উঠা পশ্চিম বাংলার মানুষদের উন্নাসিকতাও তারা সহজভাবে নেননি। এছাড়া ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধে হিন্দু জাতিয়তাবাদের কট্টর ব্যাবহারও ওই পারের মানুষদের সাথে আমাদের সুস্পস্ট পার্থক্য গড়ে দেয়।
এ কারণেই পাকিস্থানে যোগ দেয়াটা ছিল স্বতঃস্ফুর্ত।
(ইদানিং ভারত প্রেমে অন্ধ কিছু বুদ্ধিজীবি জ্ঞানপাপি ইতিহাসকে বিকৃত করে, পশ্চিম বঙ্গের মানুষদের পাপস্খলনের বৃথা চেস্টা করছে। )
ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ এ ভারত থেকে আলাদা হলেও পুর্ব বঙ্গের মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ একে তো নিম্ন বর্ণের হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়ার কারণে পশ্চিম পাকিস্থানের মানুষেরা তাদেরকে নীচু জাতের মুসলমান বলে গণ্য করতো। তার উপর শিক্ষা দীক্ষায় ব্যাপক পশ্চাদপদ হবার কারণে কি রাজনীতি কি প্রশাসন কোথাও বাঙ্গালিদের শক্ত ভিত্তি ছিল না।
(এ কথা ওই আত্মস্বীকৃত আশরাফ পাকিস্থানিরা ভুলে গিয়েছিল যে, ইসলামে আতরাফ আশরাফের ব্যাপার নেই কোন।
আর শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে থাকাতেও বাঙ্গালিদের দোষ ছিল না। যেখানে হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে কোন রকম বেচে থাকাটাই দায় ছিল, সেখানে শিক্ষা দীক্ষার চিন্তা তো অনেক দুরের কথা ছিল। )
ফলে সম অধিকারের দাবীতে যখন বাঙালি সোচ্চার হয়েছিল, তখন সামন্ততান্ত্রিক চেতনা ধারণকারি পাকিস্থানিরা স্বভাবতই সেই দাবিকে শক্তি দিয়ে দমন করতে চেয়েছিল। অথচ তারা ইতিহাস ভুলে গিয়েছিল যে, প্রকৃতির সাথে লড়াই করে করেই বাঙ্গালিরা হয়ে উঠেছিল লড়াকু প্রকৃতির। এজন্য মোগল হোক কিংবা বৃটিশ, অথবা হিন্দু জমিদার, এদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুগে যুগে তারাই বিদ্রোহ করেছিল।
ইতিহাস ভুলে যাবার কারণেই গণহত্যা আর নারী ধর্ষনের চরম খেসারত দিয়ে হয়েছিল পাকিস্থানিদের। সেই সময়ের সুসজ্জিত এবং দুধর্ষ চৌ্কষ পাকিস্থানুই সেনাবাহিনীকে, বাংলাদেশে সাধারণ কৃষক শ্রমিক ছাত্র সাধারণ মানুষদের হাতেই চরম লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের আমাদের স্বাধীনতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। একারণেই বঙ্গবন্ধুর কর্ম বা আদর্শের সমালোচক হলেও, ব্যাক্তি বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বলে মেনে নিতে কোন দ্বিধা নেই দ্বন্দ নেই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল এক অস্বাভাবিক শুন্যতায়।
অর্থনৈতিক, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক শুন্যতা মেটানোর জন্য দুরদৃস্টি সম্পন্ন উপযুক্ত লোক ছিল খুব কম।
বৃটিশ আমলে, যৎ সামান্য যে সব বাঙালি উচ্চ শিক্ষা করতে চাইতেন, তাদের যেতে হতো কোলকাতায়। যেখানে উচ্চ শিক্ষা তো তারা পেতেন, কিন্তু সাথে হীনমন্যতাও তাদের গ্রাস করতো। রাতে কুপির আলোয় বেড়ে উঠা একজন, কোলকাতার চাকচিক্পয, চাপাবাজি আর নাগরিক সুবিধা দেখে ধাক্কা খেতেন। ফলে নিজের অজান্তেই কোলকাতার ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্যকে উচ্চমার্গ জ্ঞান করে ফেলতেন।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর, যে সব বাঙালি নতুন প্রাদেশিক রাজধানি ঢাকায় বুদ্ধিজীবি যারা এলেন, তারা কোলকাতার আদলে শহর ভিত্তিক একটা সংস্কৃতি গড়লেন।
শহরকে গড়তে গিয়ে ভুলে গেলেন গ্রাম, মাটি ও মানুষের কথা। ভাষাটিও হয়ে গেলো শান্তিপুর বা নদীয়ার অপভ্রংশ। বাংলাদেশের প্রাণ গ্রামের মানুষদের ভাষা ও সংস্কৃতি হয়ে গেলো "গেও"
এভাবেই তথাকথিত শিক্ষিত স্বজনদের হাতেই সবচেয়ে আগে অপমানিত আর অবহেলিত আমাদের লোকজ সংস্কৃতি।
স্বাধীনতার পর সেই কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবিতাই সিদ্ধান্ত নিতে থাকলেন কোথায় কি হবে না হবে।
যে বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে কোনদিন সাম্প্রদায়িকতার নাম গন্ধ ছিল না, তাদের চাপে তৎকালিন সরকার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করলেন।
বিদেশি শাসনের কারণে কোনদিনই আমাদের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি মাথা উচু করে দাড়াতে পারেনি। স্বাধীনতার পরেও কোলকাতাকে অনুসরণ করা বুদ্ধিজীবিদের কারণেই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি জাতিয় পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা পেতে ব্যার্থ হয়েছিল।
ফলে যা হবার তাই হয়েছিল। সেদিনের তরুণ সমাজ বিদেশকে অনুসরন করতে শিখেছিল।
এজন্যই বাংলা ভাষায় পশ্চিমবঙ্গের গান, নাচ, নাটক, সিনেমা ব্যাপক আদরনীয় হয়েছিল। অথচ আমরা চেস্টা করলেই তাদের ছাড়িয়ে যেতে যে সক্ষম, সেটা আমাদের গান আর নাটক দিয়ে প্রমান করা হয়েছিল অনেক আগেই।
স্বাধীনতার ৯ মাস, বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন দেশের ভেতরে রণাঙ্গনে। আর নিরাপত্তার জন্য প্রবাসি সরকারকেও থাকতে হয়েছিল কোলকাতায়। তাদের সাথে আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবি লেখক সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বও ছিলেন।
তারুণ্য মানেই প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তবে সেই বিদ্রোহি শক্তিকে যথাযথ কাজে লাগাতে পুরাপুরি ব্যার্থ হয়েছিলেন আমাদের সে সময়ের রাজনীতিবিদ কিংবা বুদ্ধিজীবিরা।
ফলে তরুণরা অন্ধের মত ভারতীয় + পশ্চিমাদের অনুসরণ করা শুরু করলো। বেল বটম প্যান্ট, বড় বড় জুল্পি, লম্বা লম্বা চুল, নাভির নীচে শাড়ি আর বগল বের করা ব্লাউজ ইত্যাদি শহরে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে গেলো।
অবশ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার এই কিম্ভুতকার অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন।
কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উলটো তরুণদের উস্মা আর সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল সরকারকে।
সেই থেকে শুরু বিদেশপ্রীতি। বিদেশি কাপড়, বিদেশি ফ্যাশন , যা কিছু বিদেশি তাকেই পুজা করা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমনকি আমার চলচিত্রও ইন্ডীয়াকে নকল করে বানানো শুরু হয়ে গিয়েছিল।
বস্তুত কোন সরকারই এই অপসংস্কৃতির রাশ টেনে ধরার কাজটা করেননি। তবে সারিক বাহিনী থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের শাসনামলে সেই অবক্ষয়ের গতিটা অতিমাত্রায় প্রবাহিত হতে পারেনি।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।