আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবিতার বিভাসূত্রঃ কবির চোখে দেখা মেঘের কিরণ / রাহিদ রায়েনীন



আমার লেখা ''কবিতার বিভাসূত্র'' প্রবন্ধগ্রন্থটি 'ঠিকানা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পুরস্কার-২০০৯ ' পেয়েছে। এই বইটির একটি আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে, বেঙলিটাইমস ডট সিএ তে। Click This Link লেখাটি আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম । কবিতার বিভাসূত্র : কবির চোখে দেখা মেঘের কিরণ রাহিদ রায়েনীন ------------------------------------------------------------------- ভেসে যাচ্ছে মেঘ। আবছায়া আলোয় বসে রোদ পোহাচ্ছেন কবি।

যে পথ, এই পথে হেঁটে গেছেন অনেকেই এর আগে। তারা আজ নেই। আছে তাদের পদছাপ। এই ছাপ দেখে দেখেই সনাক্তিকরণ সম্ভব হয় প্রেমের, বিরহের , প্রত্যাশার। ফকির ইলিয়াস মূলত: কবি।

তিনি লিখেন নক্ষত্ররাজিকে পাশে রেখে। কারণ তার আলোর প্রয়োজন খুব। এই আলো তার জন্য। তার প্রতিবেশ-পরিবেশের জন্য। ২০০৯ এর একুশে বইমেলায় কবি ফকির ইলিয়াস এর একটি বই বেরিয়েছে।

'' কবিতার বিভাসূত্র''। না, অংকের কোনো সূত্র নয়। এই সূত্রগুলো কবিতার। কবিতার জন্মলগন , কবিতার জন্মপ্রেক্ষাপট, কবিতার বেড়ে ওঠা, কবিতার সাজমন্ত্র, - সবকিছু নিয়ে কবিতা কিভাবে কবিতা হয়ে উঠে সেই চিন্তনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই সংকলনটিতে। এই গ্রন্থে মোট আঠারোটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে।

সূচি টি একবার পড়ে নেয়া যাক। ১। কবির আত্মকথন , কবিতার সুষম সাম্রাজ্য ২। মূলধারা , কালিক চিত্রকল্প ও চেতনার চারদিক ৩। কবিতার দৃশ্যান্তর , অন্তর্ভেদী দিগন্তের বিস্তার ৪।

কবিতার শিল্পকথা ও প্রান্তিক প্রকৃতির যাত্রাপথ ৫। শহীদ কাদরীর কবিতা : উৎস ও দ্যোতনার উত্তরাধিকার ৬। কবিতার বৃত্ত , অনুগামী স্বপ্নের বিভাস ৭। কবির পরিভ্রমণ , কবিতার জন্মপরিভাষা ৮। কবিতার অভিবাসন, সময়ের সূত্রসম্পর্ক ৯।

কবিতায় আধ্যাত্মিকতা , পর্দার আড়ালে খোঁজা জাতিনূর ১০। কবির অন্তর্দৃষ্টি , কবিতার যোজন গ্রহপথ ১১। কাব্য সংসারে কবির দায়, পাঠকের দায়িত্ব ১২। বাউল কবি শাহ আব্দুল করিম : স্বরূপের অন্বেষনে দূরগামী মরমী পরাণ ১৩। কবিতার দ্রাঘিমা , ধ্রুপদী সামন্তবাদ ১৪।

উত্তরাধুনিক বাংলা কবিতায় লোক সাহিত্যের প্রভাব ১৫। নরটন এন্ড কোম্পানী : যুক্তরাষ্ট্রের একটি সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ১৬। আলোকিত কবিতার প্রান্তরে ১৭। কবিতায় বেঁচে থাকা , না থাকা ১৮। সমসাময়িক কবিতার চিত্রকল্প : প্রেক্ষাপট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বইয়ের প্রতিটি প্রবন্ধই বর্ণনা করেছে কবিতার আলোসূত্র।

আর তা বলতে কিংবা লিখতে গিয়ে কবি নিজেই হয়ে উঠেছেন কবিতার স্রোত , কবিতার কিরণ। কবির জবানি থেকেই শোনা যাক কিছু অংশ ----- ''অনেক সময় কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়েও তাই ছুটে যাওয়া হতো অসমাপ্ত গ্রন্থটির পাঠ শেষ করবার জন্য। এতে লাভ এবং ক্ষতি দুটোই যে হয়েছে তা এখন খুব ভালো করে বুঝতে পারি। কিন্তু সব লাভ-ক্ষতি কি জীবনকে তুষ্ট করতে পারে সমানভাবে? কোনও অতৃপ্ত আত্মার সাথে কথা বলতে-বলতে-বলতে কিংবা উপন্যাসের কোনও চরিত্রের মাঝে ডুবে যেতে যেতে মনে হয়েছে আমিই সেই চরিত্র। লেখক কিংবা লেখিকা যা বলতে চেয়েছেন আমি যেন তারই প্রতিচ্ছায়া।

একজন কবি তার ছায়া দেখা কখন শেখেন? কোন মূর্তপ্রতীক কবিকে নিয়ে যায় প্রেমের নিখিল বাগানে? জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতার কথা’ পড়তে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি অনেকবার। বোঝা হয়ে ওঠেনি। তাই পড়েছি, ভেবেছি, পড়েছি। রাতের আলোতে ডুবে গিয়ে সমৃদ্ধ করেছি নিজেকে। '' ( কবির আত্মকথন, কবিতার সুষম সাম্রাজ্য ) দুই এই গ্রন্থে দুজন বিশিষ্ট কবিকে নিয়ে দুটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ আছে।

একজন কবি শহীদ কাদরী। অন্যজন কবি শাহ আবদুল করিম। একজন সমকালীন আধুনিক কবি। অন্যজন সমকালীন আধ্যাত্মিক কবি। তাঁদের কবিতা , গান নিয়ে প্রাণখোলা আলোচনা করেছেন ফকির ইলিয়াস।

যা যে কোনো পাঠক-পাঠিকাকে বিশদ খোরাক দেবে, ভাবনার। এই সংকলনটির বিভিন্ন প্রবন্ধে কবিতার চিত্রকল্প,অনুপ্রাস, উৎপ্রক্ষা , গঠনশৈলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে খুব সাবলীলভাবে। উঠে এসেছে অভিবাসী জীবনে লেখা কবিতাগুলোর কথাও। এর কিছু অংশ এখানে তুলে ধরতে চাই। ''আমরা যারা অভিবাসী তাদেরকে একটি যোগ-বিয়োগের মধ্যেই প্রহর গুনতে হয়।

তা হচ্ছে বাংলাদেশে ফেলে আসা শিকড়ের টান। আর দ্বিতীয়ত এই বসতিতে আগুয়ান প্রজন্মের ভবিষ্যত এবং মৌলিক সংস্কৃতির অন্বেষণ। অভিবাসী জীবন সম্পর্কে একজন খ্যাতিমান অভিবাসী কবি জোশেফ ব্রড্স্কির জবানীতে কিছু কথা শুনলে এই যোগ-বিয়োগ সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে আসা কবি ব্রডস্কি যুক্তরাষ্ট্রের ‘আটলানটা জার্নালে’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাদের এই জীবনটা দীর্ঘ সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে চলেছে। বৃষ্টিকে যেমন ভেদ করে ওঠে সূর্য, দুপুরের দুঃখগুলো হারায় বাতাসে, আমরা অনুভব করি এই জীবনকে ঘনিষ্টভাবে মেঘহীন দূরত্বের পথে।

’ '' ( কবিতার অভিবাসন, সময়ের সূত্র সম্পর্ক ) তিন বিশ্বকবিতার মাঠে বাংলা কবিতার অবস্থান, তা নিয়ে ব্যাপক আশাবাদ ও প্রজন্মের স্বপক্ষে প্রত্যয় লক্ষ্য করা যায় বেশ কিছু প্রবন্ধে। এছাড়াও কবিতা যে প্রযুক্তিকে বরণ করে এগুচ্ছে তার জানান ও দিয়ে যায় ক'টি লেখা। দৃশ্যকবিতা, কবিতার মূলধারায় চেতনার প্রতিফলন, কিংবা প্রকৃতির যাত্রাপথে কবিতার অবস্থান আমরা সহজেই জেনে নিতে পারি বিভিন্ন প্রবন্ধে। লোক সাহিত্য কিংবা ফোকলোর নিয়ে সমকালীন কবিতায় যে বিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তার উদাহরণ , বর্ণনা গ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছে। কবিতায় কে বেঁচে থাকবেন ,কে থাকবেন না - তা কি খুব বিবেচ্য বিষয় ? কারো কাছে হয়তোবা।

কারো কাছে নয়। ''কবিতায় বেঁচে থাকা , না থাকা'' - লেখাটিতে ফকির ইলিয়াস তেমন কিছু বিতর্ক তুলে ধরতে চেয়েছেন। ''একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কবিতাকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে ‘উপলক্ষের কবিতা’ বা ‘অকেশনাল পোয়েট্রি’ আর অন্যটি হচ্ছে ‘কবিতা, উপলক্ষগুলোকে নিয়ে’ বা ‘পোয়েট্রি অন অকেশনস্’। হতে পারে, কোনও ঘটে যাওয়া ঘটনা, স্মৃতি কিংবা গতির বর্ণনাই একটি কবিতা।

আবার কোনও লৌকিক সৃষ্টির স্তুতি বর্ণনাও হতে পারে একটি কবিতার সারাংশ। জীবনের যেমন আলো আছে তেমনি আলোরও একটি জীবন আছে। জীবন এবং আলোর সমন্বয় সাধন করেই কবি এঁকে যান যে চিত্রকল্প, তাই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন এবং ভালবাসার চেতনা বহন করে চলে। একটি কবিতার সব কটি পংক্তি একজন পাঠকের প্রিয় নাও হতে পারে। যে লাইনগুলো প্রিয় হতে যায় তা মুখে মুখেই ফিরতে থাকে।

বাংলা সাহিত্যেও ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, প্রভৃতি উপলক্ষে যে সব কবিতা লেখা হয়েছে তা বেশ কজন কবিকে স্মরণীয় করে রাখবে। দেবে তাদের কর্মের অমরতা। '' ( কবিতায় বেঁচে থাকা , না থাকা ) চার কবিতারই শুধু নয় যে কোন সাহিত্যের অন্যতম সহায়ক শক্তি হচ্ছে প্রকাশনা শিল্প। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রকাশনা সংস্থা ''নরটন এন্ড কোম্পানী'' নিয়ে একটি চমৎকার প্রবন্ধ আছে এই গ্রন্থে। আমরা অনেকেই মানি কবিতার সামন্তবাদ শাসন করে হৃদয়ের প্রেমকে।

কবিতার প্রান্তর ফিরে কবি ফকির ইলিয়াস সেই সত্যটি প্রতিষ্টিত করতে চেয়েছেন তার প্রতিটি প্রবন্ধে। তিনি বলেছেন, ''কবিতায় সামন্তবাদ কথাটি শুনলেই আমরা দুটি ভাবনাভুবনে নিক্ষিপ্ত হই। প্রথমটি, কবিতায় কি সামন্তবাদের কথা বলা হচ্ছে? দ্বিতীয়টি, নাকি কবিতাই সামন্তবাদি হয়ে উঠতে পারে! হওয়ার প্রয়োজনও হয় বটে শক্তির মৌলিকতায়। কবি যদি নিগুঢ় স্রষ্টা হন তবে তিনি তার কর্ম নিয়ে একক সামন্তবাদি হবেন না কেন? ছোট, বড় যে কোনও একটি কবিতার একটি স্পষ্ট চিত্রকল্প থাকে। থাকে বক্তব্য।

তিনশ’ পৃষ্ঠার একটি উপন্যাসে একটি ঘটনার পরিক্রমণ, পরিভ্রমণকে বর্ণনা করা হয়। তা বিভিন্ন চরিত্রের আলোকে প্রজ্জ্বলিত করা হয়। আটচল্লিশ পৃষ্ঠার একটি কাব্যগ্রন্থে কবিতার সংখ্যা থাকে হয়তোবা চল্লিশটি। আর ঐ চল্লিশটি কবিতা চল্লিশটি নিজস্ব অনুষঙ্গেই নির্মিত। তাদের বক্তব্য ভিন্ন।

দেখা যাবে হয়তো ঐ চল্লিটি কবিতা নিয়ে চল্লিশটি উপন্যাসই লিখতে পারবেন কোনো উপন্যাসিক। '' ( কবিতার দ্রাঘিমা, ধ্রুপদী সামন্তবাদ ) পাঁচ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে - ভাষাচিত্র , ঢাকা। নান্দনিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন তৌহিন হাসান। মূল্য রাখা হয়েছে ১২০ টাকা/ ৬ ইউএস ডলার। অত্যন্ত ঝকঝকে ছাপায় সংকলনটিতে মুদ্রণপ্রমাদ নেই বললেই চলে।

আর তা উৎসর্গ করা হয়েছে এ সময়ের এক কীর্তিমান সাহিত্যিক,বুদ্ধিজীবি ,দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম কে। ফকির ইলিয়াস লিখছেন তিন দশকের কাছাকাছি সময় ধরে। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা -নয় । এই সংকলনের লেখাগুলো আরো দীর্ঘ হতে পারতো। তারপরও ৯৬ পৃষ্টার বইটিতে বাংলা কবিতা ও বিশ্বের অন্যান্য ভাষার কবিতা নিয়ে লেখক যে মনমুগ্ধকর আলোচনা, নিরীক্ষণ করেছেন - তা যে কোনো পাঠক-পাঠিকার ভালো লাগবে নি:সন্দেহে।

জানা যাবে , কবিতার সমকালের এগিয়ে যাবার পদছাপগুলোর কথা। #

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।