আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: ‌'তোমার বীণা আমার মনোমাঝে'

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

সকালের দিকে এ বাড়িটা নীরব হয়ে থাকে। সুলতান আহমেদ সে সময় নিজের ভিতরে অদ্ভূত এক বিষন্নতার উত্থান টের পান। তার জীবনের কর্মকোলাহল থেমে গেছে, দীর্ঘদিন ধরে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন।

কাজের মধ্যে দুপুরের আগে স্কুল থেকে নাতনী কে নিয়ে আসা। অবশ্য মীম একাই আসতে পারে। স্কুলটা বাড়ির খুব কাছেই। সকালের দিকটা কাটে খবরের কাগজ আর বই-টই পড়ে । আজ সকালে বইয়ের আলমারীর সামনে দাঁড়িয়ে হাতে শরৎসমগ্র তুলে পৃষ্ঠা ওল্টাতেই মাথা টলে উঠল ।

মলাটের এক কোণে নীল কালিতে রেহনুমার লেখা: ‘তোমার বীণা আমার মনোমাঝে’। তারপর স্বাক্ষরের ওপর চোখ আটকে যেতেই চোখ ঝাপসা হয়ে এল, বুকে কেমন এক চাপ টের পেলেন, হু হু কাতর দীর্ঘশ্বাস উঠে এল। কত বছর আগের কথা? রেহনুমা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বাবার রেলের চাকরির সবাদে সুলতান আহমেদরা তখন পূর্ব পাকিস্তানের ছোট্ট একটি মফস্বল শহরের রেলওয়ে কলোনীতে থাকতেন। রেহনুমারাও ওই একই কলোনীতে পড়শী ছিল।

তখন রেহনুমার তরুণী-হয়ে-ওঠা কিশোরী বয়স । ধবধবে ফরসা গোলপানা মুখের শ্রীছাঁদ অপূর্ব। বেনী-দোলানো চশমা পরা উচ্ছ্বল এক কিশোরী। রেহনুমা চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গাইত। বিশেষ করে এই গানটা- তোমার বীণা আমার মনোমাঝে কখনো শুনি, কখনো ভুলি, কখনো শুনি না যে।

। আকাশ যবে শিহরি উঠে গানে গোপন কথা কহিতে থাকে ধরার কানে কানে তাহার মাঝে সহসা মাতে বিষম কোলাহলে আমার মনে বাঁধনহারা স্বপন দলে দলে। সুলতান আহমেদ টের পেলেন তার হাত দুটো ও শরীর অল্প অল্প কাঁপছে। এই বয়েসে অধিক উত্তেজনা সহ্য হয় না। শরৎসমগ্র অসম্ভব ভারী ঠেকছে।

চোখের ঝাপসা ভাবটা কাটছে বলে মনে হল। চোখের পলকে ঘরের রোদটুকু মুছে গিয়ে মেঘ জমে ওঠে। ... সেই ছোট্ট মফস্বল শহরটাতেও মেঘ জমত, রেলওয়ে কলোনির মাঠে আঁধার ঘনাত, আঁধার ঘনাত মাঠের ওপারের হলুদ দেওয়াল, কলাঝোপ, কচুরি পানায় ভর্তি খাল আর রেল লাইনের ওপর । সেই সব দিনের স্মৃতির সঙ্গে রেহনুমা কেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। তা ছাড়া রেহনুমা জীবনের প্রথম প্রেম।

বিয়ের আগে শরৎসমগ্র উপহার দিয়েছিল রেহনুমা। শেষ উপহার। সুলতান আহমেদ তখনও ছাত্র, স্বাধীনতার পরপর রেহনুমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর কই যে হারিয়ে গেল রেহনুমা -আর দেখা হয়নি। উনিশ শ তিয়াত্তুরে সুলতান আহমেদ-এর বাবার পোস্টিং হল ঈশ্বরদী।

জানালার কাছে একটি কাক তারস্বরে ডাকছিল। সম্বিৎ ফিরে পেলেন সুলতান আহমেদ। বইটা তাকে গুঁজে ডাকলেন, জোছনা, জোসনা। রান্নাঘর থেকে জোছনা বেরিয়ে এসে বলল, কি নানা, ডাতাছেন ক্যান? ততক্ষণে পাঞ্জাবি পরে নিয়েছেন সুলতান আহমেদ । বললেন, দরজা বন্ধ কর।

আমি মীম কে আনতে যাচ্ছি। ২ সন্ধ্যায় মীম ওর মায়ের কাছে পড়তে বসে। ফরিদা এসব ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস। সুলতান আহমেদও নাতনীকে পড়ান মাঝে- মাঝে, তবে ঠিক পড়ানো হয় না, মজার মজার সব কথাগল্পই হয়। মাগরিবের নামাজের পর আধো-অন্ধকার বারন্দায় এসে বসে থাকেন।

বারান্দায় টবের সারি। তার স্ত্রী মমতা মারা যাওয়ার আগে গাছগুলির যতœ নিতেন। এখন সুলতান আহমেদ যদ্দূর পারেন দেখাশোনা করেন। দেখাশোনা ঠিক হয় না, তবে ফুলেদের সঙ্গে মনে মনে কথাবার্তা হয়। সন্ধ্যার মুখে ফুলের ঘ্রান অতি তীব্র হয়ে ওঠে।

জীবনের এই সব আশ্চর্য সুন্দর দিকগুলির প্রতি এতকাল লক্ষই করা হয়নি, কেবল সংসার আর অফিস-আদালত নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। আজকাল অস্তগামী সূর্যের আলোর দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে থাকেন অবসরপ্রাপ্ত এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক, অপলক চোখে তাকিয়ে থাকেন আকাশপথে উড়ে যাওয়া ঘরমুখো পাখিদের ঝাঁকের দিকে ...তখন পুরনো গানও মনে পড়ে ...তোমার বীণা আমার মনোমাঝে/কখনো শুনি, কখনো ভুলি, কখনো শুনি না যে। । সন্ধ্যার পর বারান্দায় বসে এক কাপ চা খান তিনি। জোছনাই চিনি ছাড়া ‘র’ চা দিয়ে যায় ।

আজ আর জোছনা চা নিলে এল না। ওর বদলে চা নিয়ে এল ফরিদা। শ্বশুরকে চা দিয়ে পাশে বসল। বলল, বাবা? বল। আমার খালাতো ভাইয়ের মেজ মেয়ে ইয়াসমীনের- আপনি শুনেছেন তো? কার কথা বলছ? সুলতান আহমেদ রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেন।

কেন-মিলন ভাই আপনাকে গত পরশু ফোন করল না? ফরিদার কন্ঠে সামান্য ঝাঁঝ ফুটল যেন। ওহ্ হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। সুলতান আহমেদ কেমন সঙ্কোচ বোধ করলেন। ফরিদা বলল, আমরা ক’দিনের জন্য কটিয়াদি যাচ্ছি। আপনি কি যাবেন আমাদের সঙ্গে? যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ...শরীর ভালো না।

সুলতান আহমেদ কন্ঠস্বর কেমন শুকনো শুকনো ঠেকল। চায়ে চুমুক দিলেন। ফরিদা বলল, ভাবছি, জোছনাকে নিয়ে যাব, মীমকে কে দেখবে। আপনার খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে হবে ক’দিন... সুলতান আহমেদ চুপ করে রইলেন। নিচের গলি থেকে রিকশা টুংটাং শব্দ উঠে এল ওপরে।

খানিক মেঘও জমেছে, হাওয়াও শীতল হয়ে উঠছে, তবে আজ রাতে বৃষ্টি হবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। বাবা? বল। শম্পা এবার এইচ এস সি পাস করল। সুলতান আহমেদ এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বললেন, ওহ্। শম্পা, মানে তোমার সেই খালাতো বোনের বড় মেয়ে তো, বগুড়া থাকে।

হ্যাঁ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিবে শম্পা। মেধাবী ছাত্রী। সবাই বলছে টিকে যাবে। সুলতান আহমেদ মাথা নাড়লেন।

আজকাল চারিদিকে স্কুল-কলেজে ভালো রেজাল্টের ধুম, সেকালের মতো ‘বি.এ ফেল’ কথাটা আর আজকাল শোনা যায় না। শম্পার মা নাসরিন আবার মেয়েদের হলে থাকা একেবারেই পছন্দ করে না। শম্পা আমাদের এখানেই থাকবে। আপনার ছেলেও রাজী। ওহ্।

আসন্ন ভবিষ্যতের কথা বলে বুকের ভিতরে হিমস্রোত টের পেলেন সুলতান আহমেদ। কলিং বেল বাজল । ‘আবার কে এল’-বলে ফরিদা উঠে চলে যায়। সুলতান আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি সবই বোঝেন।

তিনি এখন সংসারের বোঝা হয়ে গেছেন। তখন ফরিদা বলল, ভাবছি, জোছনাকে নিয়ে যাব, মীমকে কে দেখবে। আপনার খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে হবে ক’দিন...আমি এ বাড়ি থাকায় এদের অস্বস্তি হচ্ছে। কর্মক্ষমতাহীন একজন অর্থব মানুষকে কে পুষতে চায়। বড় ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে, বেতন ভালোই পায় ।

আজকাল সংসারে তেমন কনট্রিবিউট করতে পারেন না সুলতান আহমেদ। টাকা-পয়সা যা জমিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা আর বিয়ের পিছনে খরচ হয়ে গেল। চোখে অল্প ছানিও পড়েছে। অপারেশন করাতে হবে, ছেলে বা বউমা কারও সময় হয়ে উঠছে না, তা নয়। চোখে ছানি পড়ার কথাটা বাড়িতে জানান নি।

এসব ভেবে গভীর শ্বাস টানলেন আটষট্টি বছরের বৃদ্ধ। নিজের ভিতরে অদ্ভূত এক বিষন্নতার উত্থান টের পাচ্ছেন। আধো-অন্ধকারে চুপচাপ থাকা ফুলগুলির মিষ্টি গন্ধ আর টের পেলেন না। নিচ থেকে উঠে আসা পোড়া ডিজেলের গন্ধ পেলেন। সিদ্ধান্ত এক রকম নেওয়াই ছিল।

আগে থেকেই খোঁজখবর করে রেখেছেন। ওল্ডহোমটা শহরের বাইরে। একটা আধা-মফস্বল এলাকায়। ৩ তেইশ তারিখ সকালে ফরিদারা কটিয়াদি চলে গেল। তারপর সুলতান আহমেদ যখন নবীনগর বাসস্টপে বাস থেকে নেমে একটা রিকশা নিয়ে খয়েরি রঙের একটা লোহার গেটের সামনে এসে নামলেন- তখনও সকালের রেষ পুরোপুরি কাটেনি।

এমনিতেই শহরের বাইরের সময় অনেক শ্লথ। আজ ছুটির দিন বলেই রাস্তা ফাঁকাই ছিল, অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছনো গেল। খয়েরি রঙের লোহার গেটের দু’পাশে সাদা দেওয়াল। ভিতরে সুপারি গাছে ঘেরা অল্পখানি সবুজ মাঠ। মাঠের চারধারে ছড়ানো-ছিটোন টিন সেডের ঘর সকাল বেলার রোদের আলোয় ঝলমল করছে।

লাল সিমেন্টের মেঝে, এক পাশে সার- সার ঘর। অফিসে আনুষ্টানিকতা সেরে নিজের ঘরে এলেন। ঘরটি ছোট, তবে ছিমছাম। ধীরেসুস্থে সুন্দর করে গুছিয়ে নিলেন। শরৎ সমগ্র রাখলেন বিছানার ওপর বালিশের পাশে, বালিশের নিচে রাখলেন অনেক পুরনো মা-র একটা সাদাকালো ফটোগ্রাফ।

চারধার কি অটুট নির্জন! শীতের দুপুরের মতো, অথচ এখন বর্ষাই কাটেনি। ঘরের জানালাটি বেশ বড়। বিছানায় বসে সেদিকে তাকালেন। আজ সকালেই টের পেয়েছেন, শহর ছাড়তেই চোখের ঝাপসা ভাবটি আর নেই। জানালায় তাকালে দূরের সবুজ মাঠ, নাড়কেল আর সুপারি গাছের সারি আর সাদা রং করা দেওয়াল চোখে পড়ে।

মাঠের এক পাশে একটা দোলনা। বৃদ্ধনিবাসে কে দোলনা তৈরি করল? টের পেলেন মীমের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মৃত্যু অবধি এই যন্ত্রণা থাকবে। তিনি তো আর কোনওদিনই শহরে ফিরে যাবেন না। যে শহরে মীমকে একবার ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলেন ... মাস খানেক আগের ঘটনা।

স্কুলে এসে দেখেন যে ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে মীম নেই। বুক ধক করে উঠল। মুহূর্তেই শরীর ঘেমে উঠল। মীম কই গেল। এদিক-ওদিক তাকালেন।

ইদানিং চোখে ঝাপসা দেখেন। স্কুলের উল্টোদিকে একটা কনফেকশনী । সেদিকে চোখ গেল। মীম কনফেকশনী থেকে বেরুচ্ছে, হাতে আইসক্রিম। ধড়ে প্রাণ ফিরে এল।

দ্রুত হেঁটে মীমের কাছে পৌঁছলেন। তুমি কোথায় ছিলে দাদু? এই তো তোমার জন্য দোকানে আইসক্রীম কিনতে গেলাম। টের পেলেন শরীরের রক্ত চলাচল আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। মজা করে বললেন, আমি তো আইসক্রিম খাই না দাদু। মীম ফিক করে হেসে বলল, তা হলে আমিই খাই।

খাও। ৪ দুপুরে খানিকটা তন্দ্রার ভাব এসেছিল। বিকেলে ঘর থেকে বেরুলেন। টানা বারান্দায় শেষ বেলার নরম আলো ছড়িয়ে আছে। কেমন অপরিচিত লাগছে জায়গাটা।

কেমন সাদাকালো স্বপ্নে দেখা সাদা রং করা হাসপাতাল ... যেন এ জগতে নয়, অন্য কোথাও ... সবুজ লনে ছাই রঙের পায়রার ভিড়। খুঁটে খুঁটে কী যেন খাচ্ছে। দূরে দেওয়া ঘেঁষা নাড়কেল পাতায় এখনও মৃয়মান রোদ লেগে আছে-একটা টিয়ে পাখি দোল খাচ্ছে। হঠাৎইকে কানে এল ... যেন রবীন্দ্রসংগীত গাইছে তোমার বীণা আমার মনোমাঝে কখনো শুনি, কখনো ভুলি, কখনো শুনি না যে। ।

সুলতান আহমেদ চমকে উঠলেন। তারপর খানিকটা এগিয়ে যেতেই সবুজ পারের শাদা সুতির শাড়ি পড়া ধবধবে ফরসা চেহারার চশমা পরা এক বৃদ্ধাকে বসে থাকতে দেখে দ্বিতীয়বার চমকে উঠলেন। এত বছর পর প্রসন্ন ভঙ্গিতে বেতের সোফার ওপর বসে থাকা রেহনুমাকে ঠিকই চিনতে পারলেন ...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.