আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিতকার



আমার দারুন তৃষ্ণা পেয়েছে। কিন্তু আশেপাশে এমন কেউ নেই যে, যাকে বলে একটু পানি আনিয়ে তৃষ্ণা মেটাতে পারি। আর বলবোই বা কি। আমার মনে হয়, এ মুর্তে আমি কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি। আমার চিতকার করতে ইচ্ছে করছে।

মেরির মতো চিতকার-‘আজি, আমাকে বাঁচাও আজি, আমি যে মরে যাচ্ছি। ’ কিন্তু আমি যে চিতকার করতে পারছি না। আমার হাত-পা কাঁপছে। এই নরকে আমাকে আর কতদিন থাকতে হবে কে জানে। হয়তো মরেই যাবো ক্ষুধা আর তৃষ্ণার জ্বালায়।

তবু আমি শুয়োরের বাচ্চাদের কাছে কিছুই চাইবো না। মরে গেলেও না। আমি বারবার প্রতিজ্ঞা করতে থাকলাম, যদি কোনদিন মুক্তি পাই তবে, শুয়োরের বাচ্চাদের আমি নির্বংশ করে ছাড়বো। আজ কতোটি মাস হলো আমি এই অমানুষদের বন্দীশালায় এভাবেই পড়ে আছি। আলো-বাতাসের দেখা আমার একটিবারের জন্যও ভাগ্যে জুটেনি।

প্রতিদিন খাবারের পরিবর্তে চলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল। নিপীড়ন আর নির্যাতন। সামান্য কিছু খাবার এলেও, আমি তা গলধঃকরণ করতে পারি না। আমার পেট ফুড়ে বমি আসে। মাঝে মধ্যে তবুও কিছু খেতে হয়, জীবন রক্ষার তাগিদে।

আমাকে যে বাঁচতে হবে। প্রথম প্রথম আমার দারুন ভয় হতো। আমি চিতকার করতাম, কাঁদতাম। অনুনয়, বিনয় করে বলতাম, ‘ক্ষমা করো ভাই, আমাকে ক্ষমা করো। ’ কিন্তু আজ আমার কোন ভয় নেই।

মরণের ভয়, মরণ দেখে দেখে চলে গেছে বহুদূরে। আমার এখন কাঁদতে ইচ্ছে করে না। শুধু ইচ্ছে করে একটিবারের জন্য মুক্তি। আমার এই শীর্ণকায় দেহকে আমি আবার শক্ত-সামর্থ করে গড়ে তুলতে চাই। আমি চাই অস্ত্র।

আমি এ্যাটোমের মতো গর্জে উঠতে চাই। আমি এই কুকুরদের বিরুদ্ধে লড়তে চাই। আমি না খেয়ে মরতে চাই না। আমি চাই বীরের মৃত্যু। প্রতিশোধ চাই, চরম প্রতিশোধ।

আমার বাবার, আমার মায়ের, আমার বোনের আর মেরির মৃত্যুর প্রতিশোধ। আমার দেশকে স্বাধীন দেখতে চাই। আমার বাবাকে ওরা শালা শুয়োরের বাচ্চা বলে মেরে ফেলে। অথচ কি আমার অপরাধ আমি জানতাম না। আজ আমি জানি এবং ভালো করেই জানি।

সে রাতের কথা মনে হলে আমার আজও কান্না পায়। আমার নাম আজিমভ। আমরা এক ভাই এক বোন ছিলাম। বোনটি আমার পাঁচ বছরের ছোট। আমার বয়স পঁচিশ বছর।

আমার বাবা ইব্রাহীমভ সরকারি অফিসে চাকুরি করতেন। আমি এবং শারা লেখাপড়া করছিলাম। আমরা দু-ভাই বোন কলেজ পড়ছি। তবুও মায়ের কাছ আমরা সেই শিশু-ই। মা প্রতিদিন খুব ভোরে ওঠে আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতেন।

আমরা ভোরের আলো-বাতাসে বেড়িয়ে এসে পড়তে বসতাম। আমার দারুন ইচ্ছে হতো এই ভোরের আলোয় আরও কিছু সময় থাকি। কিন্তু মায়ের তাড়ায় ফিরতে হতো। বাবা অবশ্য একটু দেরিতেই বিছানা ছাড়তেন। এই নির্মল বাতাসে হাঁটতে কতই না ভালো লাগতো আমাদের।

আমরা পড়ার টেবিলে বসার পর মা আমাদের পাশে বসে পড়া দেখিয়ে দিতেন। কখনও কখনও আমরা ভাই-বোন ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলেই, মা Oh God! বলেই আমাদের থামিয়ে দিতেন। আমরা কলেজে যাবার পর মায়ের উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে যেত। প্রতিদিন কলেজে যাবার প্রাক্কালে মা আমাকে আদরে আদরে ভরে তুলতেন। আমার দুষ্ট বোনটি তাতে ঈর্ষায় জ্বলে মরতো- Oh Mammy! আমাকে...।

মা তাকেও জড়িয়ে ধরতেন। আমি এবং শারা কলেজ থেকে ফিরলেই মা আমাদের চুমু দিয়ে যেতেন। যেন অনেকদিন পর পেয়েছেন। রাতে বাবা-মার সাথে আমরা একত্রে খেতে বসতাম। মা আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে-আরো কিছু নাও বাবা, আরো কিছু নাও মা।

আমরা না-সূচক মাথা নাড়লেই মা হতাশ হয়ে আমাদের মুখের দিকে তাকাতেন। বাবা তা দেখে হাসিতে ফেটে পড়লে মার অনেকটা হতাশা বাড়তো। কলেজে ভর্তি হবার পর মেরির সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেরি আমাকে ভালোবাসার প্রতিশ্র“তি দেয়। আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরি।

গায়ে গা লাগিয়ে দুজন দুজনকে চুম্বন করে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ হই। আমরা কলেজ ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে দুজনে প্রেম বিনিময় করি প্রতিদিন। চুম্বন আর আলিঙ্গনে কেটে যায় প্রতিটি প্রহর। ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। আমরা দুজন প্রতিদিনই মিলিত হই।

আমার বোন যে সবে মাত্র যৌবনের আঙ্গিনায় পা বাড়িয়েছে-সে টের পেয়ে যায়। বাসায় এসে মায়ের কান ভারী করে তোলে। সন্ধ্যায় খাবার টেবিলে প্রতিদিনকার মতো খেতে বসি। আমি কারো কথা না ভেবেই খেতে থাকি। মা তা দেখে বিস্মিত হন।

তিনি জানতে চান আমার কি হয়েছে। আমি এড়িয়ে যাবার চেষ্টায় বলি-মা মা, কিছুতো হয়নি। মেরি মেয়েটা কে? মা একটু রূঢ় স্বরে একথাটা বলতেই আমি সলজ্জ চিত্তে ওঠে মাকে জড়িয়ে ধরি-Mummy, Oh, please, she is my love. আমি রাগতভাবে শারার দিকে তাকাতেই সে খাবার না খেয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে যায়। আমি মায়ের কানে কানে ফিসফিসনির সুরে বলি-মা শারা তোমাকে খু-উব লাগিয়ে বলেছে না? আমি শুধু ওকে...। মা আমাকে থামিয়ে বললেন, আর বলতে হবে না, ওকে বাসায় আসতে বলো।

বলা বাহুল্য, ইউরোপীয় প্রতিটি পরিবোরের চেয়ে আমাদের পরিবারিক বন্ধন সম্পূর্ণ আলাদা। মায়ের শাসন বাঁধন ছিঁড়ে স্বাধীনভাবে চলে যাবো তা ভাবিনি কখনও। মেরীকে আমি যথারীতি বাসায় নিয়ে আসি। মা তাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করলেন। আমি সাথে সাথে উৎকণ্ঠা মুক্ত হলাম।

মেরিরও ফ্যাকাশে মুখ রক্তাভ হয়ে উঠলো, মায়ের এ আচরণে। দিন গড়িয়ে যেতে থাকে। আমরা অনাবিল আনন্দ উল্লাসে জীবনকে উপভোগ করতে থাকি। প্রতিদিনই মেরি বাসায় এসে মায়ের সাথে গল্প করে যায়। বাবারও খুউব পছন্দ হয়েছে তাকে।

মেরির আচার-আচরণ, কথা-বার্তা পরিবারের সবাইকে আপন করে নিয়েছে। আজি, দরজা খোল আজি। একরাতে মেরির অপ্রত্যাশিত চিৎকার আর দরজায় নক শুনে আমি বিদ্যুৎ গতিতে দরজা খুলি। মেরি কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাকে জড়িয়ে ধরে বলি-কি হয়েছে মেরি, আমাকে বলো, I'm your love মেরি আমাকে আঁকড়ে ধরে বলে, আমার বাবা-মাকে মেরে ফেলা হয়েছে।

আমাকেও ওরা ছাড়তে চায়নি। হয়তো এক্ষুণি এখানে এসে পড়বে। আমরা কোনকিছু বোঝার আগে সত্যি সত্যি ওরা এসে পড়ে। বাবা রাগ সামলাতে না পেরে ওদের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলেন, Get out my house. তোমরা জানো এটা কার বাড়ি?... বাবার কথা থেমে যায় ওদের অট্ট হাসিতে। ওরা হাসতে হাসতে রাইফেলের নল উঁচিয়ে, শালা শুয়োরের বাচ্চা, স্বাধীনতা চাস? এই নে স্বাধীনতা।

বলেই গুলি করে। বাবা মেঝেতে পড়ে যান। আমরা সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠি। বাবার রক্তে সারা মেঝে লাল হয়ে যায়। আমি চিৎকার করে উঠতেই দুটি রাইফেলের গুতো আমার নাক বরাবর এসে পড়ে।

আমি হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে যাই। আমার নাক মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করে। মেরি আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে থাকে। মা ও শারা তাদেরকে অভিশাপ দিতেই তাদের রাইফেলের তর্জনীতে আমার মমতাময়ী মা ও আদুরিনী বোনের দেহ লুটে পড়ে বাবার নিস্তেজ দেহের পাশেই। আমি মেরির সাহায্যে কোন মতে মাথাটা তুলে চিৎকার করে বলি-শালা শুয়োরের বাচ্চারা।

কিন্তু আমার কণ্ঠে তেমন একটা শক্তি না থাকায় তাদের কানে তা পৌঁছলো কিনা জানিন। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে ঘরের মেঝে দিয়ে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আমি কিছু বোঝার আগেই ওরা আমাকে ও মেরিকে টেনে হেচড়ে তাদের গাড়িতে তুলে। গাড়ি চলতে শুরু করলে আমার মাথা চিমচিম করতে থাকে।

সারা শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। মেরি আমার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সে কাঁদছে। আমি ব্যথার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে বারবার কুকিয়ে উঠি। চারদিকে গভীর কালো অন্ধকার।

কোথাও একটি প্রাণীরও সাড়া শব্দ নেই। কালো পীচঢালা পথে গাড়ি তীব্র গতিতে চলছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি জানি না। মেরি কিছুক্ষণ পরপর আমার দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ তার চিৎকারে আমি কোন মতে মাথাটা তুলি।

আজি, ...। দেখি, ওরা নেড়া কুকুরের মতো তাকে ঝাপিয়ে ধরেছে। মেরি চিৎকার করছে কিন্তু চলন্ত গাড়ির আওয়াজে তেমন একটা শোনা যাচ্ছে না। পরে সামনের সীট থেকে কে একজন ইশারা করতেই ওরা তাকে ছেড়ে দেয়। মেরি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।

আমিও তার সাথে কাঁদি। বড় অসহায় মনে হয় নিজেকে। গাড়ি একটি বাড়ির গেইট দিয়ে প্রবেশ করে, আমি তা স্পষ্ট বুঝতে পারি। গাড়ি থামতেই ওরা মেরি ও আমাকে টেনে হেচড়ে নামায়। তার কণ্ঠ ছিড়ে বারবার ‘আহ, আহ’ শব্দ বেরিয়ে আসছে।

কিন্তু আমি কোন অনুভূতি প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। আমাদের দুজনকে ওরা বাড়ির দু-তলার একটি রুমে নিয়ে আসে। আমার নিস্তেজ দেহ মেঝে ছুড়ে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ পর আমি মেঝে পড়ে থেকে স্পষ্ট শুনতে পাই মেরির চিৎকার। আজি, আমাকে বাঁচাও আজি।

আমি যে মরে যাচ্ছি, আমি কোন মতে মাথাটা তুলে চিৎকার করতে চাইলেই ওদের রাইফেলের গুতো এসে পড়ে মাথার উপর। আমি সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জানিনা কতক্ষণ পর আমার জ্ঞান ফিরে। তবে পাশে মেরির নগ্ন, নিঃসাড় দেহের সর্বাঙ্গ থেকে রক্ত ঝরছে দেখে আমি অসহায়ের মতো শুধু চিৎকার করলাম ‘শুয়োরের বাচ্চারা’।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।