*****
আমার জানালা থেকে আকাশের ছোট্ট একটা টুকরো দেখা যায়। সময় পেলেই আমি মুখ তুলে ঐ এক টুকরো নীল দিকে চেয়ে থাকি। রাতের বেলায় আকাশের হাজারটা তারা আমি দেখি না। শুধু আমার জানালার ওপর বড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ণ হয়ে ঝুলে থাকে সপ্তর্ষীমন্ডল। আমি চোখ মেলে সেই প্রশ্নটা দেখতে পাই।
চোখ বন্ধ করলেও দুচোখের পাতায় প্রশ্নটা আঁকা হয়ে থাকে। মাথার ভেতর আমি প্রশ্নের চিৎকার শুনতে পাই।
কি? কি?? কি???
কেন? কেন?? কেন???
কিভাবে? কিভাবে?? কিভাবে???
জীবনটাই এক বিশাল প্রশ্নবোধক হয়ে গেছে। কতগুলো অর্থহীন মূহুর্তের সমষ্টি। কতগুলো অবান্তর প্রশ্ন।
প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে হুড়মুড় করে চলে আসে কত কথা। তারপর আরো প্রশ্ন, আরো আরো প্রশ্ন। সব মিলে কেমন একটা জট পাকিয়ে যায়। ভীষণ এলোমেলো লাগে তখন। ভীষণ অস্থির!
*****
মাঝে মাঝে হাপ ধরে গেলে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।
দৃষ্টি মেলে দিই সামনে............আমি সামনে তাকাই, ডানে তাকাই, বামে তাকাই। সব উঁচু উঁচু দালানে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে আমার দৃষ্টি। চারদিকটা এমন বদ্ধ হয়ে গেছে। যেন দৈত্যের প্রাণ ভরে রাখা কৌটোটা। চারদিকে বড় বড় দালানের মাঝখানে আমাদের দালানটা।
এর ভেতর আমাদের ছোট্ট বাসাটা। বাসার ভেতর তারচেয়েও ছোট আমার ঘর। আর ঘরের পাশে এক চিলতে একটা বারান্দা।
একটার পর একটা কৌটো খুললেইতো দৈত্যের প্রাণটা হাতের মুঠোয় চলে আসে, তাই ঐ কৌটো হারাতে দৈত্যের কত ভয়! আমারও কেমন ঐ এক চিলতে বারান্দা থেকে বের হয়ে, বাসা থেকে বের হয়ে, চারদিক ঘিরে রাখা বড় বড় দালানের বেষ্টনী ছেড়ে বের হয়ে খোলা মাঠে যেতে ভয় লাগে। যেখানে গেলে আমি যেদিকেই তাকাই না কেন, দৃষ্টি আটকে যাবে না।
তবু আমি ভয় পাই। দৃষ্টি আটকে না গেলেও আমার দম আটকে আসে। ভয়! ভয়! খুব ভয়!! বন্দী হয়ে থাকতে থাকতে এখন মুক্ত আকাশেই আমার ভয়।
*****
আজকাল খুব ইচ্ছে হয় ঝুমবৃষ্টিতে ভিজি। ছোটবেলায় কেমন হইহই করে ভিজেত যেতাম।
তাহলে নাকি গায়ের ঘামাচি মরে! এখনতো ভেজার নামই নেয়া যায় না। এই ধাড়ী মেয়ে সবার চোখের সামনে বৃষ্টিতে ভিজবে!
"কতজন কত কী বলবে!"
---"সবার মুখে স্কচটেপ এঁটে দিবো"
"কুদৃষ্টিতে তাকাবে যে!"
---"চোখ গেলে দিবো সব ক'টার"
"ছুটে আসবে অপমান করতে"
---"ঠ্যাঙ ভেঙে দিবো"
খুব বিদ্রোহী হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। কিন্তু কিছুই করা হয় না।
তাই যখন এসিড বৃষ্টি হবে শুনলাম, খুব খুশি লাগছিল। আমি ভিজবো, ভিজাবো সবাইকে।
বহু বছরে মনের সমতলে জমা হ্ওয়া নোংরামি, নীচতা, লোভ, লালসা, হিংসা, ঘৃণার ক্লেদ এসিডে গলে গলে ধুয়ে যাবে। কেউ তখন আর কুকথা বলবে না, কুদৃষ্টিতে তাকাবে না, কুকাজ করবে না।
কিন্তু আমার কিছুই করা হয় না। চাতকের মত ব্যাকুল হয়ে দূর থেকে বৃষ্টি দেখি। ছুঁতে পারি না।
*****
ফেসবুকে সবার স্ট্যাটাস দেখে বুঝলাম আজ পূর্ণিমা। বিশাল থালার মত চাঁদ আকাশে। জোছনায় ভেসে গেছে চারদিক। কি মায়াময়, কি মোহনীয় পরিবেশ! সবাই মুগ্ধ! আবেগে আপ্লুত! আমার জানালা থেকে ছোট্ট এক টুকরো আকাশ দেখা যায় শুধু। আমি সেই জানালা দিয়ে চাঁদটা দেখার কত চেষ্টা করলাম।
কাত হয়ে, চিৎ হয়ে, গলা বাড়িয়ে, চোখ বাঁকিয়ে। দেখতে পেলাম না। শুধু দুটো বিল্ডিং এর ফাঁক গলে জোছনার মরা সাদাটে একটুখানি আলো পিছলে নেমে এসেছে। সে আলো আমাকে ছুঁতে পারে না। আমি মুগ্ধ হই না, আবেগে আপ্লুত হই না।
কেমন নিরাসক্ত ভঙ্গিতে একবার হাত বাড়াই সাদা আলোটার দিকে। তারপরেই আবার টেনে নিই। সরিয়ে নিই মুখ।
আমার ছোট্ট অন্ধকার ঘরের এককোণে মুখ গুজে বসে থাকি চুপচাপ। আমার বন্ধ চোখের পাতায় সপ্তর্ষীমন্ডল ঝুলে থাকে প্রশ্নবোধক চিহ্ণ হয়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।