আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিআন্দোলন, ‘জনমানুষের করণীয়’

benjinkhan06@yahoo.com

ভূমিকা :  একক মহাজাগতিক শক্তিই নিত্য। এ জগৎ সংসার তা থেকে পৃথক না। ক্স সেমেটিক দর্শনমতে  আল্লাহ্ই নিত্য। ক্স ভারতীয় দর্শনমতে  অদ্বিতীয়ম ব্রহ্ম। ক্স ইউরোপীয় দর্শনমতে  জগতের কোনোকিছুই পরষ্পর বিচ্ছিন্ন নয়।

ক্স বিজ্ঞানের দর্শনমতে  একমাত্র শক্তিই (ঊহবৎমু) নিত্য। সৃষ্টি ও বিবর্তন :  জগৎ সংসারে কোটি কোটি নক্ষত্র পরিবারের একটি সূর্য।  সূর্য পরিবারের সদস্য-গ্রহ আমাদের পৃথিবী।  পৃথিবীতে পানি থেকে প্রাণের উৎপত্তি।  ‘মানুষ’ প্রাণীজগতের বিবর্তনের পরিণতি বা ফসল  লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই প্রাণীমানুষ যাযাবর ছিল আপন অস্তিত্বরক্ষার্থে খাদ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে।

 মানুষের প্রথম যাযাবরি জীবনের অবসান ঘটে ভূমধ্যসাগর উপকূলে আজকের প্যালেস্টাইন-লেবাননে, মৎস্যশিকারের মাধ্যমে। আর সেই সাথে মানুষ রপ্ত করলো পশুপালন।  মানুষের দ্বিতীয়বার যাযাবরি জীবন শুরু হয় পশুখাদ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে।  এভাবেই যাযাবর মানুষ দুনিয়ার পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে নদীঅববাহিকা অঞ্চলে গড়ে তোলে বসতি। নীলনদের তীরে গড়ে ওঠে মিশরীয় সভ্যতা, ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রিস নদীর তীরে ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, এমনিভাবে সিন্ধুনদের তীরে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে গড়ে ওঠে সিন্ধু সভ্যতা তথা ভারতীয় সভ্যতা।

 প্রকৃতির সাগরে ভাসমান যাযাবর মানুষ কোথাও কোথাও জমাট বেঁধে প্রধানত চার মহাজাতিতে পরিণত হয়  (ক) নিগ্রোয়েড, (খ) অস্ট্রালয়েড, (গ) ইউরোপিঅয়েড, (ঘ) মঙ্গোলয়েড।  জীবনের তাগিদে এই মহাজাতিও যাযাবরি জীবন গ্রহণ করায় সৃষ্টি হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের। এমনি অনেক জাতির মধ্যে কতগুলি জাতিসত্ত্বা কালপ্রবাহে জড়ো হতে থাকে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো অঞ্চলে যেমন : (ক) নিশাত, (খ) কোল, (গ) ভীল, (ঘ) দ্রাবিড়, (ঙ) অস্ট্রিক, প্রভৃতি। এই সব জাতিসমূহই সিন্ধুসভ্যতার নির্মাতা ও উত্তরাধিকারী।  প্রকৃতির বিরূপতা মোকাবিলা ও জীবন-অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনে মানুষ ছিল যুথবদ্ধ।

উৎপাদন সম্পর্ক ছিল মালিকানার ও সমবন্টনের। জাত-পাত, ব্রাহ্মণ-চন্ডাল, আশরাফ-আতরাফ এসবের অস্তিত্ব ছিল অসম্ভব। ‘মানুষ’ ভিন্ন অন্যকোনো পরিচয় ছিল না ঐ প্রাণীর।  আধুনিক মানুষের ‘স্মৃতি’ বলে যদি আজ কিছুর অস্তিত্ব থেকেই থাকে তা হলো ‘সাম্য’। মালিকানার ক্ষেত্রে স্মৃতি হলো সারাজাহান তার (মানুষের)।

 এর পর মানুষ আবিষ্কার করে কৃষিসভ্যতা। মানুষ নিজে নিজের খাদ্য পুনরুৎপাদন করা শিখলো। আর এখানে মানুষ প্রাণীকূল থেকে পৃথক হয়ে গেল। সংগ্রহ ও শিকারনির্ভর জীবন থেকে মানুষ চলে গেলো উৎপাদননির্ভর জীবনে।  এই পুনরুৎপাদনই মানুষকে যেমন প্রাণী থেকে পৃথক করে আশরাফুল মাখলুকাতের আসনে অধিষ্ঠিত করে, তেমনি এই পুনরুৎপাদনের ‘ক্ষমতা’ মানুষকে আবার শ্রেণীতেও পরিণত করে।

মানুষে-মানুষে বিভক্তি আনে। মানুষকে মানুষের অধিনস্ত করে। দাস ও প্রভু সম্পর্ক সৃষ্টি করে। একক মহাজাগতিক শক্তির পরিবর্তে মানুষ মানুষের প্রভুতে পরিণত হয়। আর এখানেই থেমে যায় মানুষের ইতিহাস এবং শুরু হয় শ্রেণীর ইতিহাস।

ভারতে জাত-পাত ও বিবর্তন :  শ্রেণী বা বর্ণপ্রথা ভারতবর্ষে বা সিন্ধু সভ্যতায় প্রথম প্রবেশ করে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ২৫০০ বছর পূর্বে। বলা হয়ে থাকে মধ্য এশিয়া থেকে আর্যসভ্যতার নামে এই শ্রেণী বা বর্ণের ধারণার অনুপ্রবেশ।  আর্যরা বহন করে আনে ‘বেদ’ বিশেষত ‘রিগে¦দ’ যার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে ভারতবর্ষে রচিত হয়েছে ‘মনুসংহিতা’, যেখানে মানুষকে ৪টি শ্রেণীতে বা বর্ণে বিভক্ত করা হয়েছে : যথাÑ (ক) ব্রাহ্মণ, (খ) ক্ষত্রীয়, (গ) বৈশ্য, (ঘ) শূদ্র। বলা হলো- ব্রাহ্মণের জন্ম দেবতার মুখ থেকে, ক্ষত্রীয়ের জন্ম দেবতার হাত থেকে, বৈশ্যের জন্ম দেবতার পেট থেকে আর শূদ্রের জন্ম দেবতার পা থেকে। এছাড়াও দলিত, হরিজন বা নমঃশূদ্রকে তো তারা মানুষই জ্ঞান করতো না, এখনও না।

 ভারতের বা সিন্ধুর একশ্রেণীর মানুষ এই ‘বেদ’ বা ‘আর্যধর্ম‘ গ্রহণ করলো। এরাই বর্ণহিন্দু বা হিন্দু। (সিন্ধু  হিন্দু)। সমাজে নিম্নশ্রেণীর জনগোষ্ঠর ওপর চলতে থাকলো বর্ণনিপীড়ন ও শোষণ।  আর্যদের এহেন আদর্শের বিরুদ্ধে আদি সিন্ধুবাসীরা (নিশাত, কোল, ভীল, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক) বিদ্রোহ করে।

মহামতি গৌতম বুদ্ধও এই আর্যধারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এই শুরু হয় আর্য বনাম অনার্যের লড়াই।  ভারতবর্ষে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত ছিল সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানাহীনতা। অর্থাৎ সামাজিক মালিকানা। সকলের মালিকানা।

বৌদ্ধ শাসনামলে (পাল আমলে) ভারতবর্ষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের পীঠস্থানে পরিণত হয়। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়। দুনিয়ার বহুদেশ থেকে ছাত্ররা এখানে লেখাপড়া শিখতে আসতো। তাদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থাও ছিল। আজও বৌদ্ধবিহারের প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশনসমূহ তারই স্বাক্ষর বহন করে (যার অধিকাংশেরই অবস্থান আজকের বাংলাদেশ ভূখন্ডে)।

 ভারতবর্ষ ছিল প্রাচুর্যে ভরপুর। পরিব্রাজক মেগাস্থিনিস, ফা-হিয়েন সাং, টা বার্ণিয়ার, ফ্রাঁসোয়া বার্ণিয়ের, ইবনেবতুতা, আল-বিরূনী প্রভৃতির বিবরণে সেই চিত্রই উঠে এসেছে। টা বার্ণিয়ার তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে বলেছেন, ‘ভারতের মালবাহী গাড়ির কাফেলা যখন রপ্তানি পণ্য নিয়ে রওয়ানা হতো আমাদের তখন সে রাস্তা শূন্য রাখার জন্য রাস্তার পাশে ৭-৮ দিনের জন্য তাঁবু ফেলতে হতো’। এখানকার রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে  তা ছিল পৃথিবীর দৃষ্টান্ত। (ঢা.বি. প্রকাশিত ‘বাংলার আর্থিক ইতিহাস’ এবং ওয়াকিল আহাম্মদের ‘বাংলায় বিদেশী পর্যটন’ পড়তে পারেন)।

ক্যাম্ব্রিজের শিক্ষক ড. তপন রায় চৌধুরীও সেদিন তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আজ যেমন আমাদের দেশের মানুষ ইউরোপের গল্প বলে, সেসময় ইউরোপের মানুষ ভারতের গল্প বলতো’।  এরপর বর্ণহিন্দু সেনদের শাসনে ভারতবর্ষে রক্তগঙ্গা বইতে থাকে। বিশেষকরে বাংলা অঞ্চলে বৌদ্ধরা কচুকাটা হতে থাকে। জীবিতরা দলে দলে মাতৃভূমি ছেড়ে পালাতে থাকে। অন্ত্যজ (হরিজন গান্ধীর দেয়া নাম) নিপীড়িত দলিত নমঃশূদ্ররা চরম নিষ্পেষণের শিকার হতে থাকে।

মুসলমানদের আগমন ও প্রসার :  এমন এক সন্ধিক্ষণে ভারতবর্ষের বাংলায় প্রবেশ করে তুর্কি মুসলমানেরা।  এখানে বিশেষভাবে বলে রাখা দরকার বাংলায় তুর্কিদের আগমনের বহুপূর্ব হতেই আরব ব্যবসায়ী ও সুফি সাধকদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম ভারতে প্রবেশ করে।  এই ইতিহাসও আছে যে, আরবের মানুষদের সাথে বাংলা অঞ্চলের মানুষ বিশেষতঃ পূর্ববাংলার অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল তথা দক্ষিণের মানুষরা অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আরব বণিকরা তখন আরব সাগর, ভারত মহাসাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরে (জাজিরাজিঞ্জিরা দ্বীপ) অর্থাৎ সেন্টমার্টিনে অবস্থান করে রেঙ্গুনে (বার্মা) ব্যবসা করতো। এখান থেকে যেতো চীনে।

এ সময় আরবরা বাংলার মূল ভূখন্ড টেকনাফ হয়ে চট্টগ্রামে অবস্থান করতো। আরবে যখন ইসলামের আবির্ভাব ঘটে এবং মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে, সে সময়ই চট্টগ্রামে অবস্থানরত আরব বাসিন্দাদের সাথে বাংলা অঞ্চলের মানুষও ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। (এ ক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদের ‘বাংলাদেশের কালচার’ পড়া যেতে পারে)।  ফলে তুর্কিরা যখন ভারতে শাসকের বেশে প্রবেশ করে তখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর মত বহু মুসলমান আগে থেকেই এখানে ছিল। আর নতুনদের মধ্যে যারা তাদের পাশে জড়ো হয় তারা হলো হিন্দু শাসনে অতিষ্ঠিত বৌদ্ধরা ও অন্ত্যজ দলিত শ্রেণী, নিপীড়িত নমঃশূদ্ররা (এ জন্য শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন‘ পড়া যেতে পারে)।

যে কারণে আজও বর্ণহিন্দুরা ভারতের মুসলমানদেরকে অচ্ছুৎ, যবন বলে গালি দেয়। ধর্মান্তরিত নিচুজাত বলে গালি দেয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে কেবলমাত্র নিপীড়িত নিচুজাতই না বরং সিন্ধুসভ্যতার উত্তরাধিকারীরাই এই ধর্ম গ্রহণ করেন। কারণ তার অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য হলো জাত-পাতহীনতা, সম্পত্তির যৌথ বা সামাজিক মালিকানা, যা এই নবধর্মের (ইসলাম) অন্যতম মৌলনীতি। যাদের বিশ্বাস বিশ্বজগতের সকল সম্পত্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ্, মানুষের অধিকার আছে তা সমভাবে ভোগ করার।

 আমরা অধ্যয়ন করে দেখতে পারি নদীয়া বা নবদ্বীপের ইতিহাস। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ’র শাসনামলে মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ তথা শ্রীচৈতন্যের আন্দোলনের ইতিহাস। (দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ও কুমুদনাথ মল্লিকের ‘নদীয়া কাহিনী’ পড়ে দেখতে পারেন)।  মুসলমানদের রয়েছে সাড়ে ৭শ’ (৯৯৯-১৭৫৭) বছরের ভারত শাসনের ইতিহাস। এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামল পর্যন্ত ভারতবর্ষে সম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানা ছিল না।

মালিক ছিল সম্্রাট তথা রাষ্ট্র। ব্যক্তি নয়। এ সম্পর্কে পড়া যেতে পারে ফ্রাঁসোয়া বার্ণিয়ের ‘বাদশাহী আমল’, যে গ্রন্থ মার্কস এবং এঙ্গেলসকে ভারতের উৎপাদন সম্পর্ক বুঝতে সহায়তা করেছিল।  মুসলিম শাসনামলে ভারতের শাসনকার্যে নানা ধর্মের নানা জাতির মানুষের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন, সম্রাট আকবরের দ্বীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন, সম্রাট বাবরের ভারতে পশুকোরবাণী রাষ্ট্রীয়ভাবে বর্জনের লক্ষ্যে ছেলে হুমায়ূনের কাছে ‘অসিয়তনামা’ ইত্যাদি প্রমাণ করে মুসলিম শাসনের ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস।  সংগীত, নৃত্য, পোশাক, আইনের প্রয়োগ, খাদ্যাভ্যাস ও স্থাপত্যশিল্পে নিপুণতা প্রমাণ করে মুসলিম শাসনের উৎকর্ষতা ও রুচিবোধ।

 মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য হাজির করা হয় রামমন্দিরের স্থলে বাবরি মসজিদ নির্মাণের কাহিনী। দয়া করে আপনারা সম্রাট বাবরের ‘তুযুঘ-ই-বাবরী’ পাঠ করে দেখুন। বাবর জীবনে কখনোই অযোধ্যায় যাননি। বরং এই রামমন্দির বিতর্কের জন্ম দেয় ইংরেজরা। ‘ভাগ কর এবং শাসন কর’ নীতির ভিত্তিতে।

তারা ইংরেজ লেখক মাদাম বিভারিজকে দিয়ে তুযুঘ-ই-বাবরী’ অনুবাদ করানোর সময় এই কাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটায়। যার বর্ণনা ভারতের ‘অনীক’ পত্রিকায় বিস্তারিত আছে। রাম এবং মুসলমান বিষয়ে আরও আছে সুকুমারী ভট্টাচার্যের ‘প্রাচীন ভারতে সমাজ ও সাহিত্য’ গ্রন্থে, সুকমল সেনের ‘ভারতের সভ্যতা ও সমাজ বিকাশে ধর্ম, শ্রেণী ও জাত-ভেদ’ এবং আমার লেখা ‘দ্বন্দ্বে ও দ্বৈরথে’ গ্রন্থের ‘মিশরীয় রাম এখন ভারতীয় ভগবান’ অধ্যায়ে।  এক্ষেত্রে রবিঠাকুরের একটি মন্তব্যই যথেষ্ট  ‘রাম মহাকবি বাল্মীমিকির মনোজাগতিক পুরুষ ছাড়া আর কিছু না’।  মুসলমানরা ভারতকে কখনোই পররাজ্য ভাবেনি।

সুখে-দুঃখে ভারতেই থেকেছেন। অর্থসম্পদ কোনো কিছুই ভারতের বাইরে পাচার করেননি। মুসলমানদের ইতিহাস তাই ভারতের মানুষের ইতিহাস। ভারতে ইংরেজদের আগমন ও শোষণ :  ভারতে ইংরেজদের আগমন। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে ব্যবসার নামে ভারতে প্রবেশ, প্রথমে ১৭৫৭ সালে নবাব সিরজোদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলা দখল।

পরবর্তীতে ২শ’ বছর ভারত দখল ও শাসন। যেহেতু মুসলিম শাসকশ্রেণীর হাত থেকে তারা ক্ষমতা দখল করে। ফলে মুসলিমদের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক ছিল বৈরিতার। আর শত্রুর শত্রু বন্ধু এই সূত্রে বর্ণহিন্দুরা ইংরেজদেরকে স্বাগত জানায়। অনেক কবি শিল্পী ইংরেজদের বন্দনা করেন।

‘ভারত-ভাগ্য বিধাতা’ বলে কবিতাও লেখেন।  ইংরেজরাও হিন্দুদেরকে উপঢৌকন স্বরূপ দখলীয় ভারতের বিভিন্ন স্থানে জমিদারিত্ব দেয়। তারা অর্থবিত্তের মালিক হয়। লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণীর জন্ম হয়। ইংরেজদের শাসন-কার্যে শরিক হয়।

 মুসলমানরা সেই ক্ষেত্রে বিশেষত বাংলায় হতদরিদ্র কৃষকে পরিণত হয়। এই কৃষককূলের দাবি ছিল ভূমির মালিকানার, খাজনা মওকুফের ইত্যাদি।  লড়াই ছিল কৃষকের সাথে জমিদারের। জমিদার ছিল হিন্দু আর কৃষক প্রধানত মুসলমান। ইংরেজরা এই লড়াইকে সহজেই হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ হিসেবে চিহ্নিত করে।

 তথাপিও ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘটে যায় অসংখ্য বিদ্রোহ, যথা :- ফকির মজনু শাহর নেতৃত্বে সন্যাসী বিদ্রোহ, হায়দার আলীর আন্দোলন, মহিশূরের টিপু সুলতানের লড়াই, তেলেঙ্গানায় বিদ্রোহ, তিতুমীরের লড়াই, সিধু-কানু-চাদের সাঁওতাল বিদ্রোহ, প্রভৃতি। সর্বোপরি ১৮৫৭ সালে বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে মহাবিদ্রোহ  যাকে মার্কস বলেছেন, ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’। কেননা হিন্দু-মুসলমান-সিপাহী-জনতা সকলেই সে লড়াইয়ে অংশ নিয়ে শত শত শহীদ হয়েছিলেন। সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা :  এই অভিজ্ঞতা থেকেই ইংরেজ বড়লাট লর্ড ডাফ্রিন অপর ইংরেজ অক্টাভিয়ান হিউমকে দিয়ে ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের জন্ম দেন। ভারতের নির্যাতিত মানুষের লড়াই যেন শ্রেণীগতভাবে নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ে পরিণত না হয় সেই উদ্দেশ্যে।

আর ভারতে নিপীড়িত অথচ লড়াকু জাতি তো ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুসলমান ও দলিতশ্রেণী। ডব্লিউ.এ. হিউম জীবনের বাকি ২৩টি বছর আমৃত্যু কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ইংরেজ বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণই বহাল থাকলো।  এরপর মুসলমানরা বাধ্য হলো নিজেদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন করতে। বড় লাট উইলিয়াম মিন্টোর সময় ১৯০৬ সালে তৎকালীন পূর্ববাংলার এই ঢাকায় গঠন হয় মুসলিম লীগ।

 উল্লেখ্য যে, “দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফেরার পর গান্ধীকে প্রথম ‘রিসিভ’ করতে যান জিন্নাহ্। গান্ধীর যে প্রথম সংবর্ধনা সভা হয় তারও সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্” (ড. তপন রায়চৌধুরী - কালি ও কলম)। অথচ গান্ধী-নেহেরুর চাণৈক্য রাজনীতির বলি হয়ে সেই জিন্নাহ্ই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলেন (১৯২৮ সারের পর) সরে যেতে আর ইতিহাসের নিদারুণ পরিহাস! ইংরেজবিরোধী লড়াই পরিণত হলো হিন্দু-মুসলমানের লড়াইয়ে। তারই পরিণতি ভারত ও বাংলা বিভক্তি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে পর পর তিনবার মুসলমান প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় এবং শ্যামাচরণদের বে-ফাস মন্তব্যে বাংলা বিভক্তি তরান্বিত হয়।

পাকিস্তানের জন্ম :  ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ তথা পাকিস্তানের জন্ম হয়।  গান্ধী উভয় ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা রেখেছেন। জিন্নাহ্ বিভক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন। সরোজিনী নায়ডু, এল.কে আদভানী, যশোবন্ত সিং ও বিজেপি‘র বর্তমান সম্পাদক সকলেই জোর দিয়ে সে কথা উল্লেখ করেছেন।  ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের জন্ম।

লাহোর রেজুলেশন অনুযায়ী পূর্বপাকিস্তান পৃথক রাষ্ট্র হতে পারতো। মুসলমান ভাই ভাই এই বোধে তারা এক পাকিস্তানে পরিণত হলো। হায়দরাবাদ, জুনাগড় ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের সিদ্ধান্ত ছিল ‘শাসকের ইচ্ছাই চূড়ান্ত’। ভারত হায়দরাবাদ ও জুনাগড়ের ক্ষেত্রে  শাসক যেহেতু মুসলমান সে কারণে জনগণের মতামতের গুরুত্ব দিল, কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে জনগণ যেহেতু মুসলমান সে কারণে শাসক হরি সিং এর মতামতকে গুরুত্ব দিল। কাশ্মীর আজও তাই রক্তউপত্যকা হয়ে আছে।

বাংলাদেশের জন্ম :  পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সাথে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের বিরোধ শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষার প্রশ্নে। ১৯৫২ সালে সেই বিরোধ রক্তক্ষয়ী পর্যায়ে উপনীত হয়। ‘৬৮, ’৬৯, ’৭১-এ সেই বিরোধের সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা কারণ যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের জন্ম দেয়।  ১৯৫২ সালের আগ পর্যন্ত ভাষার প্রশ্নে যৌক্তিকতা ছিল। কোনো সুনির্দিষ্ট নৃ-জাতির ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে বরং সকল জাতির মানুষের সম্মিলনে নির্মিত উর্দুভাষার পক্ষে হয়তো যুক্তি ছিল।

কিন্তু ‘৫২-তে ছাত্রদের উপর গুলি চালনা বাংলার কৃষক মেনে নিতে পারেনি কারণ এই গুলি তাদের কলিজায় বিঁধেছিল। কারণ, এই প্রথম বাঙালি মুসলমানের সন্তান শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী হয়ে বেড়ে উঠছিল।  ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানকে ভাঙ্গার পরিকল্পনা করে। বিশেষত জুলফিকার আলী ভূট্টো। শেখ মুজিবের ওপর পাকিস্তান ভাঙ্গার দায় কোনোভাবেই পড়ে না।

২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি শাসকগোষ্ঠীর সাথে নেতৃত্বের আলোচনা চালিয়ে তার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি তো হীনম্মন্য ছিলেন না। কারণ দুই পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ভোটের যুদ্ধে পূর্বপাকিস্তান থেকেই প্রধানমন্ত্রী হবে এটা অনেকটা নির্ধারিত ছিল। ফলে একজন জাতীয় নেতা কেন আঞ্চলিক নেতা হতে যাবেন? সেকারণে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রয়োজন ছিল ভূট্টো সাহেবের, শেখ মুজিবের না। বরং শেখ সাহেব স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন।

 ভূট্টো সাহেবের এহেন আকাক্সক্ষা ভারতীয় রাজনীতির জন্য সাপেবর হয়ে যায়। ভারত নেত্রী ইন্ধিরা গান্ধী এ মওকা যথাযথ কাজে লাগিয়েছেন।  পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার নিরিহ মানুষের ওপর আক্রমণ এ অঞ্চলের মানুষকে চূড়ান্ত লড়াইয়ের মুখোমুখি করে দেয়। ভারত সেখানে আপন প্রয়োজনে না চাইতেই দেবতারূপে এগিয়ে আসে। এদিকে মনে রাখা দরকার ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত যুগপৎ দুটি যুদ্ধ হয়েছিল।

প্রথমত: ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তানের (পূর্ববাংলার) মুক্তিকামী মানুষের লড়াই। দ্বিতীয়ত: ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ। ভারতের এই অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হারিয়ে গেল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মধ্যে। মুক্তিবাহিনী পরিণত হলো ভারতীয় বাহিনীর সহযোগি শক্তি হিসেবে। আর সে কারণেই কথিত ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের পর পরাজিত বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর কাছে আত্মসমর্পণ না করে তারা আত্মসমর্পণ করে ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল অরোরার কাছে।

 ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।  একঢিলে একাধিক পাখি ভারত শিকার করে। (১) ভারত-পাকিস্তানের দুই ফ্রন্ট্রের যুদ্ধের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে। (২) ভারতের কাছে পাকিস্তানের পরাজয় হয়েছে এই ইতিহাস তাদের মনোজাগতিক বল বাড়িয়ে দিয়েছে। (৩) ধীরে ধীরে আজকের বাংলাদেশকে সে তার বিরাট বাজারে পরিণত করেছে।

(৪) হতদরিদ্র বাংলাদেশকে ভারত তার অভ্যন্তরে স্বাধীনতাকামীদের সামনে উদাহরণ হিসেবে হাজির করে।  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সহজেই ভারতের পকেটস্থ হওয়ার কারণ হলো : (১) এই যুদ্ধ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত তথা পূর্বপরিকল্পনাহীন। (২) বামপন্থী শক্তিগুলোর অনৈক্য ও দুর্বল সংগঠন।  ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ২৫ মার্চ রাত্রি থেকেই শুরু হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী অংশ ও নিপীড়িত জনগণই এই যুদ্ধের নায়ক।

এ সময় মেজর জিয়ার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে সকলের অংশগ্রহণের আহ্বান হতাশ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করে। সেই শক্তিও একপর্যায়ে ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এসময় একাধিক ধারা এই যুদ্ধে ক্রিয়াশীল ছিল। বিশেষকরে কমিউনিস্টদের মধ্যে পিকিং ধারা যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানের বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীর উচ্ছেদের মতান্তরে পাকিস্তানি উপনিবেশ উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে জনগণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য। ইসলামী ধারার রাজনীতির বড় অংশ নিরব ছিল।

একটি ক্ষুদ্র অংশ পাকিস্তান রক্ষার পক্ষে অংশ নেয়। কমিউনিস্টদের মধ্যে মস্কো ধারা আওয়ামী লীগের সাথে ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে নিতেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। বরং এই অংশ ও আওয়ামী লীগের একটি অংশ ভারতে বসে মুজিববাহিনী গঠন করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার কাজে নিয়োজিত হয়। যুদ্ধ যেন সমাজতন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণে চলে না যায়, ভারত সে কারণে তড়িঘড়ি যুদ্ধে অংশ নিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং পুতুল আওয়ামী লীগ সরকারকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসায়।  যুদ্ধ চলাকালীন তাজউদ্দীন সরকার (প্রবাসী সরকার) ভারতের সাথে ৭ দফা চুক্তিতে সই করে।

যার একটি দফা ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠন করতে পারবে না। উল্লেখ্য যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই চুক্তিতে সই করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।  শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে তাজউদ্দীন-নজরুলদের ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত অধীনতামূলক চুক্তি মেনে নিতে পারেননি। এখানেই তাজউদ্দীনের সাথে তাঁর বিরোধ। এদিকে ভায়া ভারত না হয়ে সরাসরি রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে - উচ্চাভিলাষী শেখ ফজলুল হক মনি ভারতপন্থী তাজউদ্দিনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন এবং এই বিরোধে শেখ মনি শেখ মুজিবকে জড়িয়ে ফেলেন।

শেখ মুজিব ইন্দিরা গান্ধীর বিরাগভাজন হন। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পরবর্তীতে শেখ সাহেবকে দেশের স্বার্থের পরিপন্থী বহুকিছুই দিতে হয়  শেষপর্যন্ত দিতে হয় পরিবারশুদ্ধ জীবন। বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতি :  দুনিয়ায় আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একচেটিয়া শাসন চলছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।  পারমাণবিক অস্ত্রে বলিয়ান সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবেলা করতে গিয়ে আমেরিকাকে গ্রহণ করতে হয় অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও একাধারে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা।

 আর গ্রহণ করে ‘রেড ফ্লাগ অপোস্ট দ্যা রেড ফ্লাগ’ নীতি। কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙতে থাকে, দল-উপদলের জন্ম দিতে থাকে। পোল্যান্ডের শ্রমিক নেতা লেস ওয়ালেসাকে কমিউনিস্ট দুর্গে ফাটল সৃষ্টি করার জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করে।  আপর দিকে ধর্মীয় শক্তি বিশেষত মুসলমানদেরকে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে জেহাদে লিপ্ত করে।  এই বহুমুখী ফ্রন্টের যুদ্ধে পরাস্ত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

১৬ ভাগে খন্ডবিখন্ড হয়ে যায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন।  একটি গুলি ফুটলো না। গুলিতে একজন মানুষ মারা গেল না। গোডউন ভর্তি পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ থাকলো অথচ কাঁচের ঘরের মত ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল ওয়ার্স জোটের নেতা সোভিয়েত ইউনিয়ন।  কেন ?  কারণ রাষ্ট্র্রের সমস্ত অর্থ ব্যয় হয়েছে মারণাস্ত্রের পেছনে।

হাহাকার সৃষ্টি হয়েছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে, খাবারের ক্ষেত্রে, গম, দুধ ও ওষুধের ক্ষেত্রে।  মনে রাখতে হবে সমপরিমাণ অর্থনৈতিক সংকটও সৃষ্টি হয় আমেরিকার কোষাগারে। ফলে তার প্রয়োজন ছিল পররাষ্ট্র দখল। যুদ্ধ। অছিলা ...  এদিকে সোভিয়েতের পতনের পর আমেরিকার সামনে নতুন প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয় ‘ইসলাম’।

ইসলামের অর্থনীতি, নৈতিকতা ও জীবনবোধ। ইসলাম তাদের ‘ওয়ে অফ লাইফ’ এর পরিপন্থী। সুতরাং তাদের সামনে হাজির হয় নতুন সঙ্কট (শত্রু) ইসলাম তথা মুসলমান।  ৯/১১ এ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা টুইন টাওয়ার ধ্বংস আমেরিকার সংকট নিরসনের উপায়ের সাথে জড়িত। আর সে অজুহাতে আমেরিকা কর্তৃক আফগানিস্তান দখল।

ইরাক দখল। বিশ্বব্যাপী হজ্জ্ব যাত্রীদের কাছ থেকে টুইন টাওয়ার ট্যাক্স আদায় ও আন্তর্জাতিক বিমান রুটে লাদেন ট্যাক্স আদায় সে সন্দেহই প্রমাণ করে।  এবং একই সাথে মৌলবাদের ধূয়া তুলে পররাষ্ট্র গ্রাস করার অধিকার সবই সে আদায় করে ৯/১১ এর অছিলায়।  ৯/১১ এর পরে এক নতুন দুনিয়ায় আমরা বসবাস করছি। ৯/১১ এর তাৎপর্য বোঝাটা সে কারণে খুবই জরুরি।

 প্রশ্ন উঠতে পারে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধে গেল না কিন্তু আফগানিস্তান বা ইরাকের সাথে যুদ্ধে গেল কেন আমেরিকা?  কারণ ব্যবসা। অস্ত্র ব্যবসা। সম্পদ আহরণ। বীজ ও প্রাণ সম্পদ দখল। সর্বোপরি পুনর্গঠনের ঠিকাদারি কাজ অর্জন।

 আফগানিস্তানে ১৩ লাখ, ইরাকে ৭ লাখ মানুষ হত্যা হয়েছে। আমেরিকায় যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের মধ্যে গড়ে প্রতিদিন ১৮ জন আত্মহত্যা করছে। মারছে ও মরছে উভয়ই গরীব মানুষ। বলা চলে কৌশলে শ্রেণীনিধন চলছে।  এই সশস্ত্র যুদ্ধ ‘বেশি দামে কম ক্রয়’-এর উদাহরণ।

 আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে এখন ৫০০ লঙ্গর খানা খোলা হয়েছে। এই শহরে ১০ হাজারের উপরে শিশু লঙ্গরখানায় বড় হচ্ছে। বর্তমান এশিয়া পরিস্থিতি :  ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যেও অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।  ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পাকিস্তানের হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিণতি। ইতোমধ্যে পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।

বহুধাভাগে বিভক্ত হওয়ার সমস্ত বাস্তবতা এখন বিদ্যমান।  ভারতও বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার জন্য আমেরিকার মত মরিয়া হয়ে উঠবে। কেননা ইতোমধ্যেই সেদেশে শুধুমাত্র কৃষিঋণ পরিশোধ না করতে পেরে এবং খরার কারণে গড়ে প্রতিবছর ১৮১০২.৯০ জন কৃষক আত্মহত্যা করছে। এখনো সেদেশের কোটি কোটি মানুষ ঘুটো দিয়ে প্রতিদিনের রান্না-বান্না করছে। কোটি কোটি মানুষ অনাহার, অর্ধাহারে বস্তি জীবনযাপন করছে।

 ভারতকে নতুন সংকটে পড়তে হবে চীনকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে। এখানে ভারতের পরিণতিও হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো।  বিশ্বব্যাপী চূড়ান্ত লড়াই হবে চীনের সাথে আমেরিকার আর ইরানের সাথে ইসরাইলের।  এ ক্ষেত্রে চীনের সাথে ইরানের হবে মিত্রতা, আর আমেরিকার সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক তো আছেই। জনমানুষের করণীয় : ১. ‘বেশি দামে কম ক্রয়’র উদাহরণ মাথায় রেখে আজ বিশ্বব্যাপী ছোট ছোট দেশগুলোর জনমানুষের জন্য মুক্তির পথ হবে লক্ষ-কোটি মানুষের ঐক্যবদ্ধ নিরস্ত্র মিছিলের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করা।

সেই অভ্যুত্থানে একদিন একসাথে ৫ হাজার নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুই যথেষ্ট গোটাজগৎকে বদলে দিতে। ২. আজকের যুগে সাম্রাজ্যবাদ হলো  বহুজাতিক কোম্পানি এবং বিদেশী অর্থ-নির্ভর এনজিও। সাম্রাজ্যবাদ ফাংশন করে এই দুই শক্তির মাধ্যমে। যুদ্ধ ও ব্যবসার মাধ্যমে। জগতের সকল রাষ্ট্রের শাসকেরা আজ এই দুই শক্তির চাকুরে এবং সেবাদাসে পরিণত হয়েছে।

সুতরাং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে বহুজাতিক কোম্পানি ও এনজিওর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুধুমাত্র রাজপথের শ্লোগানের মধ্য দিয়ে শেষ করা যাবে না। এমনকি জনবিচ্ছিন্ন সশস্ত্র লড়াই দিয়েও না। বরং এই দুই শক্তিকে ‘লাল পতাকা’ জ্ঞান করে তার বিরুদ্ধে লাল পতাকার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ৩. দুনিয়াব্যাপী কৃষিতে চলছে নৈরাজ্য।

খাদ্য এখন রাজনীতির বড় হাতিয়ার। জি.এম.ও. এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে খাদ্যকে এখন অ-খাদ্যে পরিণত করা হচ্ছে। এর পেছনেও রয়েছে গভীর রাজনৈতিক দর্শন। এহেন অবস্থার বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচার, প্রসার ও বাস্তব উৎপাদনমুখী কর্মপ্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। ৪. খাদ্য নিরাপত্তা বনাম খাদ্য সার্বভৌমত্ব বিতর্ক এখন বিশ্বব্যাপী খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

এর আদ্যপান্ত আজ মানুষকে বুঝতে হবে। বোঝাতে হবে এবং দেশীয় বীজ, দেশীয় পদ্ধতিতে উৎপাদনে যেতে হবে। ৫. এই লড়াইয়ের প্রথম কাজ হলো জনগণের উৎপাদনের উপায়ের মালিক হওয়া ও উৎপাদন বাড়ানো। কেননা, অভাবি মানুষ মাত্রই পরাধীন। ৬. মানুষের ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

এ লক্ষ্যে মানুষের গ্রহণ করা উচিত রেইনবো কোয়ালিশন বা রংধনু পদ্ধতি। যার মাধ্যমে বিভিন্ন মত ও পথের মানুষের সাথে ডায়ালগ/সংলাপ চালানো যেতে পারে। কৃষি ক্ষেত্রে মানুষের স্বনির্ভর হওয়ার কর্মসূচি : ক) মফস্বলের মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে : * প্রতিটি মানুষকে খাদ্য উৎপাদনের উপায়ের মালিক হতে হবে। মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র পরিবারিকভাবে না বরং প্রতিটি মানুষকে মালিক হতে হবে তথা স্বাধীন হতে হবে। এবং তা সম্ভব হবে ব্যক্তির চিন্তা-পদ্ধতির পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

নিম্নে কতিপয় প্রতিকী ধারণা বা আইডিয়া তুলে ধরা হলো, যেমন- ১. বিবাহ বার্ষিকীতে স্ত্রীকে গরু/ছাগল উপহার (মেয়ে গরু/মেয়ে ছাগল) দেয়া যেতে পারে। ২. সন্তানের জন্মদিন বা ভালেে রেজাল্টের উপহারস্বরূপ ছাগল/হাঁস/মুরগী/কবুতর/ কাঁঠাল গাছ/ আমগাছ প্রদান করা যেতে পারে। ৩. পিতা মাতার মৃত্যুতে খানা/চল্লিশার পরিবর্তে অথবা খরচ কমিয়ে এনে গরীব দুই/তিনটা পরিবারকে (নিকটাত্মীয়) ছাগল/গরু দান করা যেতে পারে। ৪. বন্ধু-বান্ধবের বিয়েতে সম্মিলিত বন্ধু-বান্ধব মিলে গরু/ছাগল/হাঁস/মুরগি/কবুতর/ কাঁঠাল গাছ/আম গাছ দান করা যেতে পারে। খ) শহুরে (ভাড়াটিয়া) মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে : ১. শহুরে ভাড়া বাড়িতে থেকে যেহেতু গরু/ছাগল পালন করা সম্ভব হয় না সেহেতু গ্রামে নিকট গরীব আত্মীয়দের মধ্যে গরু/ছাগল ভাগে দেয়া বা পোষানী দেয়া এবং তাকেও একটি করে কাঁঠাল গাছ/আম গাছ লাগাতে বলা।

গ) ভূমিহীন-দরিদ্র কৃষকদের ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে : ১. সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত বা লিজ নিয়ে এবং স্থানীয় অবস্থাসম্পন্ন জমি মালিকদের কাছ থেকে জমি তে-ভাগা শর্তে ভাগ (বর্গা) নিয়ে ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের সমবায় কৃষিখামার গড়ে তোলা। ২. এই ধরণের সমবায় কৃষিখামারে একটি সমবায় কমিটি থাকবে। খামার উৎপাদনের প্রয়োজনীয় ব্যয়নির্বাহের জন্য কমিটি সরকারের কাছ থেকে অনুদান বা সুদমুক্ত ঋণ নেয়ার ব্যবস্থা করবে। এ ধরনের অনুদান বা সুদমুক্ত ঋণ তারা একবারই নেবে। ৩. ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকরা কৃষিসমবায়ের পাশাপাশি গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি পলন করবে।

প্রত্যেক কৃষিপরিবার নিজ ভিটেমাটিতে দু-চারটা করে দেশীয় আম ও কাঁঠাল গাছ এবং সেই সাথে প্রত্যেক পরিবার ২০-২৫টি করে কার্পাস তুলা গাছ লাগাবে। ৪. ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকরা গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হয়ে বুদ্ধি এবং শ্রমের মাধ্যমে উপরোক্ত কাজগুলো করতে পারলে তারা চরম দারিদ্র থেকে এবং তথাকথিত ‘দারিদ্রবিমোচনের’ নামে এনজিওদের কবল থেকে স্বাধীন হতে পারবে। আর সেটিই হবে সাম্রাজ্যবাদ ও বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে সত্যিকারের লড়াই। ঘ) শিল্পউপাদনে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে : ১. পাশ্চাতের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থায় ‘শিল্পসভ্যতা’ বা ‘নগরসভ্যতার’ ধারণা থেকে প্রাচ্যের বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়ন ও সভ্যতা সম্পর্কে মুক্তিআন্দোলনের ধারণা ভিন্ন। সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদেরকে যে ‘শিল্পোন্নয়ন’ ও ‘নগরসভ্যতার’ স্বপ্ন দেখায় তা কেবল মানুষকে ভোগবাদী করে তোলে, শিরা-উপশিরায়-ধমনীতে বিকৃত লালসা জাগায়।

আমরা এখন পশ্চিমা নগর সভ্যতাকে ‘আধুনিক’ ও ‘প্রগতিশীল’ বলি, আর আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী কৃষি-শিল্পসভ্যতাকে সেকেলে ও পশ্চাৎপদ মনে করি। মানুষ, জীব, প্রাণবৈচিত্র ও প্রকৃতিধ্বংসকারি পশ্চিমা শিল্প ও নগর সভ্যতার চাকচিক্কে বিভোর হয়ে আমাদের নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছি। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব ধ্বংস করে ফেলছি। আমরা শিল্পোন্নয়ন চাই, সভ্যতাও বিনির্মাণ করতে চাই, কিন্তু তা হবে আমাদের নিজস্ব জীবন-জীবিকা, প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে, ধর্মবোধ-নীতিনৈতিকতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা করেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।