আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উগ্রবাঙালের ‘আদিবাসী চেতনা’ ও এক আদিবাসীর মর্মবেদনা (২য় পর্ব)

নীরব বয়ান

লেইপেদার সাথে ফোনে কথা চলছে। কথা বলতে বলতে ফোন গরম হয়ে উঠল । ফোন রেখে দিতে চাইলাম, কিন্তু সে কিছুতেই ছাড়তে চাচ্ছিল না । তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, আমাকে বল আদিবাসী প্রশ্নে কী লিখতে হবে”। সে তৎক্ষণাত বলল, “তোর ব্লগে কত কিসিমের মন্তব্য পড়ছি, গা জ্বলে যায়।

উপজাতিরা কেন আদিবাসী হবে; উপজাতিরা বহিরাগত; জাতিসংঘের টাকা খাওয়ার ধান্ধায় তারা ইদানিং আদিবাসী পরিচয় দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথা তো একেবারেই সহ্য করা যায় না। এসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তুই কি একটা লেখা দিতে পারিস না?” বললাম, “আরে মিঞা, এসব কথা শুনে মাথা গরম করে কোন লাভ নেই। যারা এসব কথা বলে, তারা হলো ‘সূর্যের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত বালু’। ব্লগে এসে একটু লেখালেখি চর্চা করে।

নিজেদের মনগড়া কথা বলে ব্লগ গরম করে রাখতে চায়। এই আর কি?তাদের লেখা নিয়ে মাথা গরম করার কোন মানে আছে?” লেইপেদা বলে, “আলবৎ মানে আছে। আজকে একথা বলবে, কালকে সেকথা বলবে। এমনি করতে করতে তাদের স্বভাব খারাপ হয়ে যাবে। উগ্র বাঙালদের এ বদস্বভাব বদলে দিতে হবে”।

“কীভাবে?” “তা জানিনা, কীভাবে বদলে দেবো। কিন্তু চুপ করে তো বসে থাকা যায় না। উগ্র বাঙালরা সবসময় সুড়সুড়ি দেবে, খোঁচা মারবে, তা তো হতে পারে না । এই দেখ না, এখানে ঢাকায় চাকরী করছি, সুখে নেই। ছোটখাটো চাকরী।

বাঙালদের মত তো বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করতে পারিনি; লেখাপড়া করার সুযোগ ও পরিবেশও পাইনি। বড় চাকরী করার সুযোগ এই জীবনে তো আর হবে না। আমার বস, বাইরের মেহমান এলে আমাকে ‘উপজাতি’ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। উচ্চারণ করে ‘ট্রাইবাল’, ‘বাল’ শুনতে তো আর ভাল লাগে না”। “হা হা হা, ‘বাল’ বললে অসুবিধা কোথায়? ‘বালে’র আগে তো ট্রাই আছে, তোরে ট্রাই করতে বলেছে।

তোর ওখানে কত বাঙালের ‘বাল’ আছে, তুই কী ট্রাই করতে পারিস না! হা হা হা…!” “ছি! ছি! তুই নষ্ট বাঙাল ছেলের মত কথা বলছিস! সিরিয়াসলি বলছি, এরকম ইয়ারকি মারিস না”। “ওকে ওকে, ঠিক আছে। ভেরি সরি । আর এরকম ইয়ার্কি মারবো না”। ইতোমধ্যে ফোন গরম হওয়ায় আমার কানও গরম হয়ে যাচ্ছে।

লেইপেদাকে বললাম, “দাঁড়া, একটু হেড ফোনটা লাগিয়ে নিই”। হেডফোন লাগিয়ে নিয়ে বললাম, “লেইপেদা শোন, আদিবাসী বিষয়ে বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। অনেক ইতিহাস আছে, অনেক রাজনীতি আছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যাপার আছে। আমার কান গরম হয়ে যাচ্ছে। ফোন কানে লাগাতে পারছিনা।

ইতোমধ্যে আধ ঘন্টার চেয়ে বেশি হয়ে গেল। পরে একসাথে সামনাসামনি বসে আলাপ করা যাবে”। লেইপেদা বলল, “সিরিয়াসলি বলছি। আমারও অনেক বিষয় জানার আছে। যেমন, দ্যাখ না আমারও মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে আসলে আমি কে? আমি জন্মসুত্রে চাকমা।

নামের শেষে লিখি লেইপেদা চাকমা। কই, বাঙালরা তো নিজেদের নামের শেষে বাঙালি লেখে না। কেন শুধু আমরা আদিবাসীরাই নামের শেষে লিখি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, ম্রো ইত্যাদি?কাগজে কলমে লিখি চাকমা, নিজেদের মধ্যে পরিচয় দিই চাঙমা। ধর্মে হলাম বৌদ্ধ। সমষ্টিগতভাবে পরিচয় দিই পাহাড়ী, উপজাতি, জুম্ম, আদিবাসী, বাংলাদেশী আরো কত কী! চাকমা গোত্রের মধ্যে হলাম আগুনপুন গোত্তীর লোক।

এতগুলো পরিচিতি, কোন ফেলে কোনটা রাখি! সাধারণ বাঙালদেরও কী আর বলার আছে? মাঝেমাঝে আমিও ঘুরপাক খাই পাহাড়ী, উপজাতি, জুম্ম ও আদিবাসী-এসব শব্দের মধ্যে পার্থক্য কী? বাঙালরা জাতি আর আমরা কেন উপজাতি?” “হুম, লেইপেদা, তোরে এ বিষয়ে বললে অনেক লম্বা ইতিহাস বলতে হবে। এই ইতিহাসের পেছনে রয়েছে ক্ষমতা ও রাজনীতি। আমরা আদিবাসীরা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারিনি, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে অনেক দূরে ছিলাম। আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল, কিন্তু সেসব আমরা তুলে ধরতে পারিনি তথাকথিত সভ্যজগতের মানুষের কাছে। কারণ, আমাদের সংস্কৃতি ছিল নিরক্ষর সংস্কৃতি (illiterate culture)।

আমাদের গৌরব ঐতিহ্য লিখে রাখতে পারিনি। কেবল মুখে মুখে ধরে রেখেছি যতটুকু পারি । আমাদের ইতিহাস লিখে দিয়েছে অন্যরা। তাই তো বাঙালরা প্রশ্ন করে, ‘তোমরা যে আদিবাসী তার প্রমাণ কী?” তারা পড়ে আব্দুস সাত্তার লিখিত ‘আরণ্যক জনপদে’। সেই সাত্তার নাকি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম দিককার সমাজবিজ্ঞানী।

হোমমেড ডাটা দিয়ে বই লিখেন, আর সেই তথ্য নিয়ে উগ্র বাঙালরা তর্ক করতে আসে। যাক, তারপরও ইতিহাস যা আছে, তাই দিয়ে বাঙালদের সাথে বিতর্কে নামতে অসুবিধা নেই। তুই একটা প্রশ্ন করলি, আমরা নামের শেষে আমাদের পরিবার বা গোত্রের পরিবর্তে জাতির নাম চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, খুমি ইত্যাদি লিখি কেন? এটার পেছনেও ছিল রাজনীতি। উপনিবেশকারীরা আমাদের এখানে এসে এই নিয়ম চালু করেছিল যাতে সহজে আদিবাসীদের চিনতে পারে, বিভক্ত করতে পারে। ‘উপজাতি’, ‘পাহাড়ী’ এসব শব্দও উপনিবেশকারীরা ও উপনিবেশিক চিন্তাধারার সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানীরা এসব শব্দ ব্যবহার করেছিল তথাকথিত উপজাতিদের সমাজ কাঠামো ও জীবনধারা বিশ্লেষণের জন্যে।

ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে বিভিন্ন আইন যেমন ভারত সরকার আইন ১৯৩৫-এ এসব শব্দ অন্তর্ভুক্ত করে আদিবাসীদের বিশেষ অধিকার সংরক্ষণ করার জন্যে। অন্যদিকে আদিবাসী শব্দটিও ‘উপজাতি’, ‘পাহাড়ী’ ‘আদিম অধিবাসী’, ‘জনজাতি’ ইত্যাদির সমার্থক হিসেবে ১৯৩০-এর দিকে বিভিন্ন আইনে প্রয়োগ করা হয়। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী শব্দের প্রয়োগ আরো অনেক আগে ছিল। যেমন ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্ট্রগাম শাসনবিধিতে আদিবাসী পাহাড়ী, ইংরেজীতে indigenous hillmen লেখা আছে। বাংলাদেশের বর্তমান আয়কর সংক্রান্ত আইনগুলোতে এখন indigenous hillmen লেখা আছে।

মতলববাজ উগ্র বাঙালরা এসব আইন হয় কখনো পড়ে দেখেনি না হয় দেখেও না দেখার ছল ধরে আছে”। লেইপেদা বলে উঠল, “দোস্ত, এসব ইতিহাস তুলে ধরার জন্যে তো তোরে খোঁচা মারছি। আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দে আদিবাসী শব্দটা বাংলাদেশে নতুন আমদানী না”। বললাম, “লেইপেদা, শোন আদিবাসী শব্দ নিয়ে আরো অনেক ইতিহাস আছে। তবে এটা সত্যি এ শব্দটা আমাদের দেশে ইদানীংকালে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

তার পেছনেও রয়েছে পাহাড়-সমতলের সব আদিবাসীর এক মঞ্চে এসে এক হতে পারা, এক কন্ঠে দাবী তুলতে পারা। বাঙালরা মনে করে তারাই এদেশে প্রথম অধিবাসী, তাই তারা আদিবাসী। তাদের এ যুক্তি মেনেও বিতর্ক করা যায়। তবে এই ইতিহাস খুঁজতে হলে ইতিহাসের আরো অনেক দূরে যেতে হবে - আর্যদের এই উপমহাদেশে আগমণ পর্যন্ত। অনেক বিতর্ক আছে।

তারপরও ইতিহাস বলে, আর্যরা এ ভারত উপমহাদেশে এসে বিভিন্ন জায়গায় বসতিস্থাপন করেছিল। এখন প্রশ্ন হলো, বাঙালরা নিজেদের কী বলে দাবী করে? আর্য নাকি অনার্য? কিন্তু তারা আর্য-ভারতীয় ভাষায় কথা বলে। অর্থাৎ বাংলা ভাষা আর্য-ভারতীয় ভাষার গোত্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই আর্য-অনার্য বিতর্কের সাথে ধর্মও একটি আলোচ্যবিষয়; যদিও এ বিতর্কে ইসলাম ধর্মকে আনা যাবে না। কেননা, এ উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচলন ঘটে অনেক পরে”।

কথা বলতে বলতে আমার আরো এক বন্ধু তারেঙ চিৎকার করে বলে উঠল, “এই অডং, সন্ধ্যা নেমে আসছে। তোঁর আঁতেলগিরি বাদ দে। এখন বাড়ী ফিরতে হবে”। এরপর লেইপেদাকে বললাম, “দোস্ত, অন্ধকার নেমে আসছে। তারেঙ বাড়ী ফেরার জন্যে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে।

তোর সাথে পরে কথা হবে। প্রয়োজনে তোরে চিঠি লিখে বিস্তারিত ইতিহাস জানাবো নে। তবে মূল কথা হলো, আদিবাসী প্রশ্ন জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে আর্যদের আগমণ, এরপর ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন, ব্রিটিশদের আইন প্রণয়ন ও আদিবাসী/উপজাতিদের জন্যে বিশেষ অধিকার সংরক্ষণ ব্যবস্থা, আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলন এবং সেই সাথে আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক আদিবাসী অধিকার আন্দোলন। এসব বিষয়ে তোরে পরে জানাবো। তখন পরিস্কার হয়ে যাবে কে উপজাতি, কে পাহাড়ী, কে জুম্ম এবং কে আদিবাসী? এবং কোন পরিচিতিটাই আমাদের সামষ্টিক পরিচিতির জন্যে মুখ্য আর কোনগুলো গৌণ।

এর সঙ্গে এটাও বলে রাখি, উগ্র বাঙালদের আদিবাসী চেতনা হলো স্বব্যাখ্যাত অলীক কল্পনা যাকে ইংরেজীতে বলে self-defined imagination. সেই অলীক কল্পনাকে তারা গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠা করতে চাই”। “লেইপেদা, আজ এখানে রাখি। ভালো থাকিস”। “দেখা হবে কোন এক সময়। ঢাকায় আসলে আমার এখানে আসবি।

বাই”। চলবে...

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।