নীরব বয়ান
পার্বত্য এলাকার লোকজন মোবাইল ফোন-এর সেবা থেকে বঞ্চিত ছিলাম অনেক বছর। মোবাইল নেটওয়ার্ক আসার আগে অনেক লোক বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও বিডিআরে কর্মরত লোকজন আলুটিলা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে সমতলে ফেলে আসা পরিবার পরিজনের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলতে যেতো। পাহাড়চূড়া থেকে মাঝেমাঝে নেটওয়ার্ক পাওয়া যেতো। চুপিসারে গিয়ে কথা বলার কাজটা সেরে আসতে হতো। তাদের মর্মবেদনা অনুভব করতাম তীব্রভাবে।
পরিবার পরিজন থেকে অনেক দূরে। টাকা পয়সা পাঠাতে হয়। কিন্তু কী করার আছে! তারপরও মনে মনে বলতাম, “দেখ, তোমাদের কর্তাবাবুরা কতই না সমান অধিকারের কথা বলে। বুঝ, পাহাড়ে সমান অধিকার কাকে বলে”।
একদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আলু টিলার চূড়ায় অবস্থিত মন্দির প্রাঙ্গণে উঠেছিলাম।
নিতান্তই বিকেল ভ্রমণের জন্যে। কিন্তু সেদিন সেসব অসহায় সেনা-বিডিআর সিপাহীদের আর চোখে পড়ল না। এখন মোবাইল নেটওয়ার্ক এসেছে। মনে হয়, মোবাইল করার জন্যে তাদের আর এখানে আসার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু তাদের আগের দিনের কথাগুলো, মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া না পাওয়ার বেদনাগুলো আজো মনে পড়ল।
প্রাণান্তকর চেষ্টার পর কথা বলতে না পেরে তখন অনেকে গালি দিতো, “শালার খানকি পোলারা যতসব সুবিধা ভোগ করছে, আর আমাদের মরণ হচ্ছে…”। বুঝতে অসুবিধা হতো না, এই গালি ছিল তাদের কর্তাবাবুদের উদ্দেশ্যে। কারণ কর্তাবাবুরা রাজার হালে থাকতো, আর সাধারণ সিপাহীরা খেটে-খুটে মরতো পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় অবস্থিত ক্যাম্পগুলোতে। আজও সেসব সেপাইদের কথা মনে মনে স্মরণ করছিলাম। এমন সময় হঠাৎ আমার মোবাইল বেজে উঠল।
“হ্যালো, অডং তুই কোথায়?” লেইপেদা ফোন করেছে ঢাকা থেকে।
বললাম, “আলুটিলায় বেড়াতে এসেছি। বিকেল বেলার হাওয়া খেতে”। এ কথা বলতে না বলতে সে বলে উঠল, “খা খা, মুক্ত হাওয়া খা। এখানে ঢাকায় গলির ভিতর ইটের দেওয়ালের মধ্যে থেকে পচা হাওয়া খেতে খেতে আর বেশি দিন এ দুনিয়ায় বাঁচবো না রে”! বললাম, “ঢাকায় আরামে আছিস, চাকরী করছিস, যতসব নাগরিক সেবা ভোগ করছিস…” কথা শেষ করতে পারিনি।
লেইপেদা বলে উঠল, “থামা, থামা, তোর আজেবাজে কথা, জান বাচেঁ না, আবার নাগরিক সেবা”! সে বলল, “অডং, তোরে ফোন করছি একটা বিষয়ে কথা বলার জন্যে”।
এ প্রসঙ্গে লেইপেদা সম্পর্কে একটু বলা প্রয়োজন। লেইপেদাসহ ভারতের শরণার্থী শিবিরে একসাথে ‘খোলা আকাশের নীচে’ পদাংতাং (বাংলায় ফকফকা) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুলে লেখাপড়া করেছিলাম। স্কুলের নাম পদাংতাং হওয়ার কারণ হলো, স্কুলের চারদিকে কোন বেড়া নেই, গাছের নীচে হালকা শনের ছাউনি ছিল। মূলত শরণার্থী শিবিরের ছেলেমেয়েরা যাতে লেখাপড়া ভুলে না যায়, পড়ালেখার চর্চা একটু হলেও করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে শিক্ষিত কয়েকজন অভিভাবক বিনা পয়সার পড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
সেই পদাংতাং স্কুলে লেইপেদার সাথে পরিচয়। তারা এখন আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু। পার্বত্য চুক্তির পরে দেশে ফিরে আসার পরও তারা তাদের আসল গ্রামের বাড়ী মাটিরাংগার অযোধ্যা এলাকায় ফিরে যেতে পারেনি। সেটেলার বাঙালরা তাদের গ্রাম ও জায়গা জমি দখল করে নিয়েছিল ’৮০-৮১ সালে। সেই থেকে তারা বাস্তুহারা যাযাবর জীবন যাপন করে আসছে।
’৮২ সালে দীঘিনালায় গিয়েছিল। সেখান থেকেও তারা সেটালার বাঙালদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে ’৮৬ সালে জীবন বাঁচার তাগিদে শরণার্থী হতে হয়েছিল ভারতে। অনেকদিন পর ফেসবুকের সূত্রে লেইপেদার সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। তাই সে মাঝে মাঝে ফোন করতো।
তাকে বললাম, “কি বিষয় নিয়ে আমার সাথে আলাপ?”
“ব্লগ নিয়ে।
সামহোয়ারইনব্লগ। তোর লেখা পড়লাম। তুই নিয়মিত লেখা দিচ্ছিস না কেন?”
বললাম, “কর্মব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে লেখার জন্যে সময় মেলানো খুব কঠিন”। লেইপেদা সঙ্গে সঙ্গে বললো, “সময়-তময় বুঝি না। দেখলাম, উগ্রবাঙালরা তোর ব্লগে আদিবাসী প্রশ্ন নিয়ে লাফালাফি করছে।
এ বিষয়ে তোর দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিতে হবে”।
“যাদের চোখ অন্ধ, বাঙ্গালী বাদে যারা অন্যকিছু চিন্তা করতে পারে না, ‘উপজাতিরা বহিরাগত’, বাঙালরাই এ দেশে প্রথম বসতিস্থাপন করেছিল - এ রকম বদ্ধমূল ধারনায় যারা আবিষ্ট তাদেরকে তত্ত্বকথা বলে বুঝানো যাবে কি? যারা জেগে জেগে ঘুমায় তাদের জাগানো যাবে কি?” তখন লেইপেদা বলে, “তোর এতসব কথা বুঝি না। আদিবাসী প্রশ্নে তোর লেখা দিতে হবে। আমি সেটা চাই। উগ্র বাঙালদের চোখ খুলুক আর নাই খুলুক আমি তোর লেখা চাই”।
লেইপেদার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বললাম। বললাম, “তোর ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাবে তো”। সে বললো, “ব্যালেন্স নিয়ে চিন্তা করিস না। তোর সঙ্গে সারাদিন কথা বলতে পারবো”।
চলবে…..
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।