বাংলায় কথা বলি,বাংলায় লিখন লিখি, বাংলায় চিন্তা করি, বাংলায় স্বপ্ন দেখি। আমার অস্তিত্ব জুড়ে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ।
আজ এসে আমাদের এক নজর দেখেই সে চিনে ফেললো। হেসে বললো, ও আপনারা। তারপর আমাদের মুখোমুখি বসে বেয়ারা ছেলেটাকে হাক দিলো, এই নাস্তা।
দেখলাম তার চেহারা বেশ মলিন। চোখ দুটো লাল। জিজ্ঞেস করলাম, ঘুমান নি রাতে? সে নিয়াশ ফেলে বললো, আর ঘুম! এই থানায় আসার পর ডিউটি করতে করতে একেবারে অতিষ্ঠ হইয়া গেছি। কবে থেকে যে ঘুমাই না, হিসাব নাই। একটু সুযোগ পাইলেই ঘুমে শরীরটা একেবারে অসার হইয়া পড়ে।
বসদের ধাতানি খেয়ে চোখ খুলতে হয়। কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে যে শালার কনস্টবল পদে চাকরি নিছিলাম, আল্লাহাই জানে। পড়ালেখা করলে এই চাকরিতে আর আসতে হতো না। এসএসসিতে কী ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট ছিলো আমার। চারটা লেটারসহ স্টার মার্কস।
আপনাদের ইচ্ছে হলে একদিন আমার মার্কসিট আর সার্টিফিকেটটা দেখাতে পারি।
হোটেলে ভিড় জমতে আরো প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি। তবু আমরা প্রায় প্রতিদিনই সকাল সকাল এসে কোণের এই নিরিবিলি টেবিলটাতেই বসি। নাস্তা খাওয়া শেষ করে আজ চা খাচ্ছিলাম। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে, কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললাম, পড়ালেখাটা করলেন না কেন?
সে মুচকি হেসে বললো, প্রেম, বুঝলেন প্রেম।
ক্লাশের একটা সুন্দরী মাইয়ারে ভালোবাইসা ফালাইছিলাম। এসএসসি পরীক্ষার পর পরই ওর বিয়া ঠিক হইয়া গেছিলো। একদিন দুপুরে আমার কাছে আইয়া কাইন্দাকাইট্টা কইলো, আমারে হয় মাইরা ফেলো, না হয় আইজই বিয়া করো। বুঝেন ঠেলা, আমার তখন বয়সই বা কতো? উঠতি যৌবন। প্রেমে একেবারে দেওয়ানা।
মাইয়া লোকের চোক্ষের পানিতে নাকি ভগবানও মোমের মতো গলে যায়। কী আর করবো বিয়া কইরা হালাইলাম।
তারপর?
তারপর পড়লাম মহা ফ্যাসাদে। ওর বাবামা আগাইয়া আইলো না। আমার বাবা ছিলো খুব ঘাড় ত্যাড়া মানুষ।
তার এক কথা, বিয়া করছো, ভালো কথা এখন বউরে খাওয়াও। বউ নিয়া আমার বাড়িতে জায়গা নাই।
রাগেক্ষোভে সবার বাবামাই ও রকম বলে।
হ্যাঁ বলে। তারপর আবার মেনেও নেয়।
কিন্তু আমার বাবা ও রকম কেউ ছিলো না। সে যা বলছে তো বলছেই।
কী বলেন আপনি?
হ্যাঁ। তয় আর বলছি কি আপনাদের।
আমরা কয়েক সেকেণ্ড কনস্টবল আনোয়ার আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কী করলেন?
কী আর করবো।
মামা বাড়িতে উঠে গেলাম। মামা কিছুদিন অনেকভাবে বোঝালো বাবাকে। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। বাবার এক কথা, ও মাইয়া ছাইড়া দিলে আমার কাছে আসতে পারবো। নতুবা ওর রোজগার ওকেই করতে হইবো।
ওই কুলাঙ্গার পোলার আমার বাড়িতে জায়গা নাই।
আপনার বাবা তো সাংঘাতিক মানুষ!
সে ঠোঁট ফাঁক করে কিঞ্চিত হাসলো। আমরা বললাম, তারপর কী করলেন?
মামাবাড়িতে বউ নিয়া আর কদ্দিন থাকা যায়? লেখাপড়া লাটে তুলে চাকরির ধান্দা করতে লাগলাম। একদিন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেইখা কনস্টবল পদের জন্য খাঁড়ায়া গেলাম লাইনে। ব্যস হইয়া গেলো চাকরি।
এখন তো ভালোই আছেন মনে হয়।
এতো ভালো মনে করছেন কেন? পুলিশের চাকরি, এই জন্য?
আমরা চুপ করে রইলাম। পুলিশের সাথে বেশি কথা বলা ভালো না। কোন কথায় কখন কী মনে করে কে জানে! শেষে সুযোগ পেলেই শোধ নেবে। গতকালই তো এই হোটেলে কনস্টবল আনোয়ার আলীর সাথে আমাদের প্রথম পরিচয়।
আজ আবার নাস্তা করতে এসে দেখা। আমরা অবশ্য কথা বলতে চাইনি। সে-ই শুরু করেছিলো। যাহোক এখন চা শেষ করে এখান থেকে কেটে পড়তে পারলেই ভালো। আমরা চায়ের কাপে আবারো একটা চুমুক দিলাম।
সে বললো, সবারই ধারণা দু’দিনেই পুলিশরা আঙুল ফুলে একেবারে কলাগাছ হইয়া ওঠে। তাদের ধারণা যে একেবারে বেঠিক তাও না। কিন্তু আমার মতো কনস্টবলরা ইচ্ছা করলেও সারাজীবনে তেমন কিছু করতে পারে না। নুন আনতে কেবল পানতাই ফুরায়। যে বেতন পাই তা দিয়া বাসাভাড়া আর দুই জন পোলামাইয়ার পড়ালেখার খরচ চালাইতেই হিমশিম খাইতে হয় স্যার।
বেয়ারা ছেলেটি রুটি ডিম পোচ আর ভাজি তার সামনে দিয়ে গিয়েছিলো। সে একটুকরো রুটি আর ভাজি মুখে পুরে চিবাতে লাগলো। আমরা আবারো চায়ে চুমুক দিলাম। রুটির সেই টুকরোটা গিলে আরেক টুকরো ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে বললো, রাতদিন এতো ডিউটি, এতো অমানুসিক পরিশ্রম, সেই তুলনায কয় টাকাই বা আর বেতন পাই বলেন? সংসারের আর সব খরচের জন্য এইদিক ওইদিক থেকে দুই চার টাকা না হাতাইয়া আমাদের উপায় আছে? আপনারা কী মনে করছেন জানি না। ভাজিসহ রুটির টুকরোটা সে মুখে পুরলো।
চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আমরা দেখলাম, চা প্রায় অর্ধেক শেষ হয়ে গিয়েছে। রুটির টুকরোটা কয়েকবার চিবিয়ে গিলে ফেলে সে বললো, সংসার বলেন, চাকরি বলেন, খুব সুখে নাই আমরা। বিশেষ কইরা কনস্টবলরা। সারাক্ষণ বসদের ঠেলা খেয়ে খেয়ে চাকরি সামলাইতে হয়। ডিউটির কোনো মা বাপ নাই।
ডাকাত ধরপাকড়ের পেছনে সারাটা রাত নির্ঘুম ছোটাছুটি করে সকালে থানায় ফিরতে না ফিরতেই মুন্সী হাতে ধরিয়ে দেয় আরেকটা উিউটির সিসি। আসামী তুলতে হবে আদালতে। ছোটো এবার জেলা সদরে। সেখান থেকে আগে ভাগে ফিরে বাসায় গিয়ে লাঞ্চ করে একটু ঘুম দেবা, সেই উপায় নাই, শালার মুন্সী প্রায় দুই তিনটা ফাইল হাতে ধরিয়ে দেয়, অছি স্যার এই মামলাগুলো ফাইলে তুইলা দিতে কইছে। মন চায় শালার মুন্সীর নাকে জোরে একটা ঘুষি বসাইয়া দেই।
কিন্তু মন চাইলেই তো আর দেয়া যায় না। ঘুমটা মাটি করে কাজগুলো করে দিতেই হয়। তারপর সন্ধ্যায় ছোটো আবার রাতের ডিউটিতে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মনে হয় ২২ ঘণ্টাই ডিউটি। নিজের পরিবার পরিজন আছে বইলা মনে হয় না।
মাঝে মাঝে নিজেকে একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবতে পারি না, স্যার। এতো ডিউটির পর তবু যদি কিছু টাকা হাতে আসতো। রাতদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়া আসামী ধরে এনে থানার লকারে ভরতে না ভরতেই কাঁচা পয়সায় অছির পকেট ভারী হয়। আমার সামনেই চলে টাকাপয়সার লেনদেন। আমরা কনস্টবলরা কলুর বলদের মতো খাড়াইয়া চাইয়া চাইয়া দেখি।
আর বলদের মতো দাঁত বাইর কইরা হাসি। ইচ্ছে হইলে অছি স্যার কোনো কোনোদিন দশ বিশ একশ’ টাকা গুঁজে দেয় হাতে, না হলে এক ধমক দিয়ে রুম থেকে বাইর কইরা দেয়, এই এইখানে কি? এইখানে কি? কী আর করবো, বসের হুকুম তো মানতেই হবে। নিরূপায় হয়ে রুম থেকে বাইর হইয়া আসি।
সে রুটি ছিঁড়ে চিবাতে লাগলো। আমাদের একজন মুখ ফসকে বলে ফেললো, কিছু মনে করবেন না, প্লি¬জ।
অনেকের ধারণা ফিল্ডে আপনারা মওকা মারতে পারেন।
রুটি গিলে আরেক টুকরো ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে বললো, আপনাদের ওই ধারণা পর্যন্তই। কিন্তু ভেতরের খবর তো আপনারা জানেন না। অছি স্যারের নিচের অফিসারগুলো বিশেষ করে আমরা যাদের সাথে ডিউটি করি তারা আরো হারামি। যেখানে যা পায় রাক্ষস্যা মাছের মতো খালি গিলতে থাকে।
তার আশপাশে আর যে কেউ আছে, তা সে বুঝতেই চায় না। আপনারা হয়তো জানেন, কিছুদিন আগে একরাতে রাস্তায় টহল দিয়া অনেক কষ্টে আমরা কুখ্যাত ডাকাত জমিরকে পাকড়াও করেছি। সেদিন আমাদের বস ছিলো এস আই মানিক। সে কী করলো জানেন? এসব কথা বলা উচিত না, তবু বলছি, জমির শালার ব্যাগ হাতিয়ে তিনটি দামি মোবাইল সেট পেলো। সাথে সাথে সে তা ঢুকিয়ে রাখলো প্যান্টের পকেটে।
আমি জমিরের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে চেন খুলতেই দেখি পাঁচশ টাকার নোটে বোঝাই। তার থেকে একটা নোট কেবল সরাচ্ছিলাম। শালার মানিক্যার চোখ হইলো গিয়া শকুন্যার চোখ। কীভাবে যে দেইখা ফেললো আল্ল¬াহ মালুম। ছোঁ মেরে নোটটাসহ মানিব্যাগটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো।
ভাবছিলাম পরে দু একশ টাকা হাতে গুঁজে দেবে। না, তার কোনো নাম নাই। সকালে নাস্তা খাবার সময় টাকাটার ইঙ্গিতটা দিতেই একেবারে পাগলা কুত্তার মতো ঘেউ ঘেউ করে উঠলো, এতো খাইচ্চরা স্বভাব কেন আপনার? যা কইছেন কইছেন আর না। একটি টাকাও শালায় দিলো না।
রুটি ছিঁড়ে সে আবারো মুখে পুরলো।
আমাদের চা শেষ। উঠে যাবো, ভাবছি, উঠার আগেই আনোয়ার আলী কথা জুড়ে দিলো, গতকালের একটা ঘটনা বলি। দুপুরে সংবাদ পেলাম ভুলতার কাছাকাছি বাস ট্রাক সংঘর্ষ হয়েছে। কেউ নিহত না হলেও মারাত্মক আহত হয়েছে অনেকে। এস আই সালাউদ্দিনের সাথে গাড়ি নিয়ে ছুটে গেলাম সেখানে।
বাসট্রাকের কাউকে পেলাম না। স্থানীয় লোকদের কাছে শুনলাম, মারাত্মক আহতদের মেডিক্যালে নেয়া হয়েছে। সংঘর্ষের যে বৃত্তান্ত শুনলাম তাতে ট্রাক চালকের দোষই বেশি। শালায় মনে অয় ফেন্সি টাইনা চোখের মাথা খাইয়া চালাইতেছিলো। ট্রাকভর্তি তরকারি।
আমরা আসার আগেই শালার চতুর পাবলিক করলা, বেগুন, বরবটি আর কচু যে যার মতো লুট করেছে। ট্রাকের অর্ধেক খালি করে ফেলেছে। আশপাশে অনেকদূর পর্যন্ত দেখলাম মানুষের পা, রিকশা, ভ্যান কিংবা গাড়িরতলায় পিষ্ট হওয়া তরকারি। তরকারির যে দাম! শালার পাবলিকের ওপর মেজাজটাই খারাপ হইয়া গেলো। নিছিলি নিছিলি, শালারপোতরা ফালাইছোস ক্যান?
তার রুটিভাজি শেষ।
এবার ডিম পোচটা সে চামচ দিয়ে একবারেই মুখে পুরে ফেললো। কয়েকবার চিবানোর পর গিলে ফেলে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে বেয়ারা ছেলেটাকে বললো, এই চা দে। আমরা বললাম, তারপর কী হলো সেই বাস ট্রাকের?
সে বললো, ট্রাক আর বাস নিয়ে থানায় এলাম। ভাবলাম, এতো তরকারি তো আমার উপরের বসরা খাইয়া শেষ করতে পারবে না। বাসায় কয়দিন কাঁচা বাজার নাই।
ব্যাগে ভইরা কিছু তরকারি বাসায় নিয়া যাই। এই দুর্মূল্যের বাজারে অন্তত কয়টা দিন কাঁচা বাজারের খরচা বাঁচবো। ব্যাগে কেবল কিছু করলা ভরছি, অমনিই শালার সালাউদ্দিন চোখ রাঙিয়ে তেড়ে এলো। আপনি দেখি শালা পুলিশরে ডুবাইবেন। এমন স্বভাব কেন, অ্যা? জিনিশ দেখলে আর ত্বর সয় না।
হাত খালি নিশপিশ করে, না? গিলতে ইচ্ছা অয়? পুলিশে না আইলে আপনি শালা নির্ঘাত চুরিডাকাতি, ছিনতাই করতেন। সবগুলো করলা ঢেলে রেখে ব্যাগটা যতোদূর সম্ভব ছুঁড়ে ফেলে দিলো দূরে। রাগে চান্দিডা গরম হইয়া গেছিলো। কিচ্ছু বলতে পারি নাই। শেষে ব্যাগটাই কুঁড়ায়া নিয়া প্যান্টের পকেটে পুরলাম।
পরে তো আমার সামনেই দেখলাম, বাসায় নেবার জন্য বসরা যে যার মতো তরকারি ব্যাগে ভরলো। আর বাদবাকি তরকারি, গোপনে কাঁচা বাজারের দোকাদারদের ডেকে এনে নিলামে চড়ালো। সেই নিলামের একটি টাকাও যদি হাতে পেতাম! শালারা কত্তো হারামি, চিন্তা কইরা দেখেন। এজন্যই পুলিশের নাম শুনলে পাবলিক শুধু নাক সিঁটকায় বুঝলেন। কোনোকিছু না পাইয়া দোষের ভাগী হয় আমার মতো কনস্টবলরা।
ওই যে কথায় বলে না, মজা মারে ফজা ভাই আমার শুধু ঘুম কামাই, সেই রকম আর কি। পাবলিকের কথা বাদ দিলাম। আমারই মাঝে মাঝে বসদের ছোটলোকী কাণ্ড দেখে সহ্য হয় না।
বেয়ারা ছেলেটি চা দিয়ে গেলো। সে চায়ের কাপে পর পর দুটো চুমুক দিয়ে বললো, গতরাতের ঘটনা বলি স্যার শোনেন।
একটু মজাও পাইবেন। রাত দুইটার মতো বাজে তখন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে একচোট ভারি বর্ষণ হইয়া গেছে। আমরা চারজন আধভেজা হইয়া আশ্রয় নিছি একটি ভাঙাচুরা স্কুলঘরের ভেতর।
ঘরটার দরোজা জানালা তো নাই-ই। সামনের বেড়াটাও নাই। বাইরের অন্ধকার সেখানে গিয়া বেশি গাঢ় হতে পারে নাই। অন্ধকারে মশার কামড়ে একেবারে অতিষ্ঠ। বসে থাকার মতো অবস্থা না।
তবু না বসেও তো উপায় নাই? পুলিশের চাকরি বলে কথা। বস এক পায় খাঁড়াইয়া থাকতে কইলে তা-ই থাকতে হয়।
চায়ে আবারো কয়েক চুমুক দিলো সে। তারপর কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললো, জানেন তো, ডাকাতের উৎপাত বেড়ে গেছে এলাকায়। প্রায় রাতেই এক দুইটা ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
উপর থেকে চাপ দিছে, যেকোনো ভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে ডাকাতি। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা চাই। শান্তিতে তাদের ঘুমাইতে দিতেই হবে। আমাদের শালা রাতের পর রাত ঘুম থাক বা না থাক, অসুবিধা নাই। আমরা হইলাম গিয়া জনগণের জানমালের রক্ষক।
জীবন দিয়া হইলেও তা রক্ষা করতে হইবে। সুতরাং কী আর করবো? মশাদের কাছে শরীরটা জমা রেখে রাইফেলটা দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে মাটিতে গোড়াটা রেখে, নলটা কাঁধে ঠেকিয়ে হাই বেঞ্চে একটু হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছি। দুনিয়ার ঘুম দু’চোখে নেমে আসছে। কিন্তু ঘুমানোর কোনো উপায় নাই। আমাদের বস এস আই খালেক এখানে আসার পর বেঞ্চে সটান শুয়ে বলেছে, একটু ভালোমতো খেয়াল রাখিস।
আমি একটু রেস্ট নেই। তারপরই ঘুম। মৃদু নাক ডাকছে। কনস্টবল সাদেক বেঞ্চে হেলান দিয়েই ঘুমাচ্ছে। এস আই খালেক আর ওই শালা কনস্টবলের ধূমপানের কোনো বালাই নাই।
আমার আর রহমানের সিগ্রেট ছাড়া চলে না। কিছুক্ষণ পাশে থাকলে সবাই আমাদের চেন স্মোকারই বলবে।
সে একটু হাসলো। তারপর বললো, এখন অবশ্য সিগ্রেটের খুব নেশা পেয়েছে। কিন্তু আপনারা কলেজের স্যার।
আপনাদের সামনে ধরাবো না।
আমরা বললাম, তাহলে উঠি আজ। কিছুক্ষণ পর ক্লাশও আছে।
আনোয়ার আলী হেসে ফেললো, এতো সুন্দর ঘটনাটা না শুনেই যাবেন? আরেকটু বসেন স্যার। এই ধরেন তিন চার মিনিট।
কী আর করবো। বসে রইলাম। আনোয়ার আলী চায়ে বোধহয় শেষ চুমুক দিলো। তারপর কাপটা রেখে বললো, চোরডাকাত ধরার জন্য রাতবিরাতের ডিউটিতে এলে সিগ্রেট টানা একদম নিষেধ। সিগ্রেটের আগুনের আলো অনেকদূর থেকেও বোঝা যায় কিনা! সহজেই মানুষের গতিবিধি অনুমান করা যায়।
অনেকক্ষণ সিগ্রেট টানি নাই। বুকটা একেবারে চৌচির হইয়া গেছে। রহমান উসখুস করছে। আমি বললাম, যা হবার হইবো। ধরাও একটা।
ও সিগ্রেট ধরিয়ে যমের মতো তিন চার টান দিয়ে আমার হাতে দিলো, আমি সবে মাত্র লম্বা একটা টান দিছি, এমন সময় পাশের গ্রাম থেইকা ডাকাত! ডাকাত! বলে বেশ হৈ চৈ পড়ে গেলো। সাথে সাথে আমি সিগ্রেটটা মাটিতে ফেলে বাঁ পায়ের বোটে পিষ্ট করতে না করতেই বস আমচকা জেগে উঠে বসলো, কী হইছে?
আমি বললাম, এইমাত্র গ্রামে ডাকাত পড়েছে।
উম্মাহ সিগ্রেট টানোন চুদাইয়া ঘরটা একেবারে দোজখখানা বানাই হালাইছোস শালারা। তাড়াতাড়ি বাইর অ।
টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে তার পিছে পিছে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
কোথায় যাবো না যাবো বুঝতে পারছিলাম না। রাস্তায় উঠে সেও দাঁড়িয়ে পড়লো। ফিসফিসিয়ে বললো, এই অন্ধকারে ডাকাত যদি এইদিক দিয়া পালায়া যায় আর গ্রামবাসী যদি তাদের পিছে পিছে ছুটে আসে আর আমরা যদি তাদের দিকে আগায়া যাই, তাইলে আমরা যে পুলিশ, রাতেরবেলা ডিউটি করছি, ডাকাত ধরার জন্য তাদের দিকে এগিয়ে এসেছি, তারা তা বুঝতেই চাইবে না। উল্টো আমাদের ডাকাত ভেবে মারধোর শুরু করবে। সুতরাং অন্যদিক দিয়ে ঘুরে পিছে গিয়ে গ্রামবাসীর সাথে মিশতে হবে।
জোরে দৌড় লাগাইলাম। সাত আট মিনিট পরই পৌঁছে গেলাম অকুস্থলে। দূর থেকে টর্চ জ্বালিয়ে বললাম, আমরা পুলিশ। পুলিশ। ঘটনাস্থলে গিয়ে বললাম, কোথায় ডাকাত, কোনদিকে গেছে বলুন।
তাদের অনেকে আমাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। কথা বলে না। ওই গ্রামের লোক, থানায় যারা ঘনঘন যাওয়া আসা করে তাদের প্রায় সবাই আমাদের চেনেজানে। তারা সড়কের পাশে ধইনচ্যাক্ষেত দেখিয়ে আমাদের বলে, এই যে এই দিকেই ডাকাতদল নাইমা গেছে।
সড়কের দু’পাশে বৃষ্টিবন্যার পানি।
এক হাটুর কম হবে না। কেউ সেই পানির মধ্যে নামতে সাহস পাচ্ছে না। টর্চ জ্বালায়া আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিচ্ছে ধইনচ্যাক্ষেতের দিকে, ওই যে ওই দিকে। ধইনচ্যাক্ষেতটা বেশ বড়ো আর ঘন ধইনচ্যাতে ঠাসা। আমরা টর্চ জ্বালায়া ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু টর্চের আলো সেই ঘন ধইনচ্যার বেশি ভেতরে গিয়া পৌঁছলো না। একজন বললো, ওই তো ডাকাত পালায়ে যাচ্ছে। পানিভাঙার টভটভ শব্দ হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছেন স্যার?
হ্যাঁ, তাই তো! পানিভাঙার টভটভ দুরাগত শব্দ আমাদের কানে আইসা বাজলো। একজন বললো, ধইনচ্যাক্ষেতের ওই পাশে খালি ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। অনেকদূর পর্যন্ত।
তারপর গ্রাম। ডাকাইতরা বেশিদূর যাইতে পারবো না।
আমরা বললাম, তাহলে আর দেরি কেন? তাড়াতাড়ি নাইমা পড়েন সবাই। কিন্তু সবাই নামলো না। সড়কে দাঁড়ায়ে রইলো।
অনেকে এদিক ওদিক আস্তে আস্তে কেটে পড়তে চায় আর কি। কিন্তু ডাকাত যদি সত্যি ধরা পড়ে, এজন্য যায়ও না। চার পাঁচজন লোক নাইমা আইলো আমাদের সাথে। হাটুসমান পানি ভাইঙা, ঘন ধইনচ্যা ঠেলে ঠেলে, টর্চ জ্বেলে জ্বেলে আমরা আগাইয়া চললাম। যতোই যাই ততোই টভটভ শব্দ আরো বাড়ে।
ডাকাত ভেবে আমরা আরো বেপরোয়া হইয়া উঠি। আমরা আরো জোরে পা চালাই। অনেক কষ্টে শেষে সেই শব্দউৎসের কাছাকাছি যাইয়া লাইট জ্বালতেই ছোট্ট বলের মতো গোল গোল কয়েকটা আলো জ্বলে উঠলো। তার মানে কী, বুঝলেন স্যার? শেয়াল! চার পাঁচটা তাগড়া শেয়াল গ্রামবাসীর ধাওয়া খাইয়া উপায়ন্তর না দেইখা পানিতে নাইমা ধইনচ্যাক্ষেতের ভেতর ঢুইকা পড়ছে। রাগেক্ষোভে দুঃখে সেই ধইনচ্যা আর পানি ভেঙে ভেঙে সড়কে উইঠা আইলাম।
ভিজে একেবারে একশা। সড়কে যারা তখনো ডাকাত দেখার জন্য অধীর আগ্রহে দাঁড়ায়ে ছিলো বস জোরে তাদের একটা ধমক লাগালো, কার বাড়িতে ডাকাত পড়েছিলো, কে দেখেছে ডাকাত বলেন। কেউ কোনো রা করে না। শেয়ালের পিছে এতোখানি ধকল গেছে দেইখা অনেকে চাপাস্বরে খিক খিক করে হাসে। তারপর আস্তে আস্তে কেটে পড়তে থাকে।
কী আর করবো, রাত পোহাতে তখনো ঢের দেরি, ভিজে একশা হলেও এতো তাড়াতাড়ি তো থানায় যাওয়া যাবে না। হাঁটতে লাগলাম সেই স্কুল ঘরটার দিকেই। যেতে যেতে পেছন থেকে শুনলাম, রইস্যার বউ, বুঝছিস রানা, এই এক্ষণ শুনলাম, ঘুমের মধ্যে সে-ই নাকি স্বপ্ন দেখছিলো, বাড়িতে ডাকাত আইছে। তারপর ঘুম ভাইঙা যাইতে না যাইতেই ডাকাত ডাকাত বলে চিল্ল¬াই উঠছে। কোনো কিছু বুইঝা উঠতে পারে নাই।
হিঃ হিঃ হিঃ...। একবার ইচ্ছে হচ্ছিলো বাড়িটার খোঁজটোজ নিয়া মাগিরে একটা ঠেঙানি দিয়া আসি।
সে মুচকি মুচকি একটু হাসলো। আমরা হাসি চেপে রাখতে গিয়াও পারলাম না। নিঃশব্দে হেসে ফেললাম।
সে বললো, সকালে থানায় আইয়া ভাবছিলাম একটু বাসায় যামু। ঘুমাইয়া অনেকটা বেলা পার করবো। কিন্তু নয়টার দিকে ডিউটি দিয়া রাখছে। একটা মার্ডার কেসের তদন্তে যাইতে হবে। বুঝেন ঠ্যালা।
আমরা উঠলাম। সে কিছু বললো না। পকেট থেকে একটা সিগ্রেট বের করলো। তারপর বেয়ারা ছেলেটার উদ্দেশ্যে হাঁক দিলো, এই, একটা ম্যাচ দে।
--------------------------------------------------------------------------------------------
(আমার বন্ধু সমীর আহমেদ-এর "একটি স্কেচ অথবা জনকের মুখ" বইয়ের একটি গল্প এটি ।
লেখকের ই-মেইল:
ফোন- 01190878263)
প্রোফাইল: সমীর আহমেদ
জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯৭৩। ঢাকা জেলার দোহার উপজেলায়। প্রয়াত মুহাম্মদ চাঁন বেপারী এবং হাজেরা বেগমের কনিষ্ঠ সন্তান।
শিক্ষা : জয়পাড়া পাইলট হাই স্কুল থেকে ১৯৮৯ সালে মাধ্যমিক এবং জয়পাড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৯১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ১৯৯৪ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৯৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশা : সরকারি কলেজে শিক্ষকতা।
গ্রন্থ : মরা কটালের জোছনা (উপন্যাস) ২০০২, জলভাঙার কাল (গল্প) ২০০২, বৃষ্টিবুনোট রাত (গল্প) ২০০৫, অতিক্রম অনতিক্রম (উপন্যাস) ২০০৭, অন্ধকার হয়ে আছি (কাব্য) ২০০৭, কবি কিংবা অকবি (গল্প) ২০০৮, উড়ে যায় নীলকণ্ঠ পাখি (উপন্যাস) ২০০৯, এই বিষ এই অমৃত (উপন্যাস) ২০১০, একটি স্কেচ অথবা জনকের মুখ (গল্প), ২০১০।
প্রকাশিতব্য : জোছনার অন্ধকারে নির্ঘুম কয়েকজন লোক (উপন্যাস), প্রেমের গল্প। নিবিড় পাঠ : কবিতা, গল্প, উপন্যাস (প্রবন্ধ)
পুরস্কার : প্রথম উপন্যাস মরা কটালের জোছনার জন্য ২০০০ সালে অধুনালুপ্ত কাগজ কথাসাহিত্য পুরস্কার এবং গল্পের জন্য ২০০৮ সালে লেখাপ্রকাশ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।