আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহাদেব সাহার কবিতা : মানব প্রেমচৈতন্যের দীপ্রশিখা / সমীর আহমেদ



মহাদেব সাহার কবিতা : মানব প্রেমচৈতন্যের দীপ্রশিখা সমীর আহমেদ ------------------------------------------------------------------ মহাদেব সাহা মানবতাবাদী কবি। মানুষের দুঃখবেদনা দেখে তিনি কাতর ও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এ জগতে ফুল, পাখি, অরণ্য, পাহাড়, সাগর, নদীর চেয়ে মানুষকেই তার সবচেয়ে বেশি অসহায় ও দুঃখশীল মনে হয়। কেন মানুষ এতো অসহায় ও দুঃখী? মহামতি বুদ্ধের মতো তিনিও প্রত্যক্ষ করেছেন মানুষের ভেতর অনন্ত তৃষ্ণা। কোনো কিছুতেই তার সুখ নেই, শান্তি নেই, পরিতৃপ্তি নেই।

অনন্ত তৃষ্ণা মেটাতে না পেরেই সে অসুখী। ব্যর্থতা, পাপ, জরা, মৃত্যু, শোক তাকে ক্লান্ত ও নিঃশেষ করে ফেলে। তৃষ্ণার কাছে মানুষ বড় বেশি অসহায়, ব্যর্থ, পরাজিত ও দুঃখী। সামাজিক অস্থিরতা, স্বাধিকার আন্দোলন ও রাজনৈতিক ঝড়ঝাপ্টায় বিক্ষুব্ধ ছিল ষাটের দশক। আর এর গভীর প্রভাব পড়েছিল সে সময়ের তারুণ্যদীপ্র কবিদের মনে।

পাক শাসক ও শোষকদের অন্যায়, দমননিপীড়ন ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে মুষ্ঠিবদ্ধ উদ্ধত হাতে মিছিলে শ্লোগানে সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে তারা যেমন সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন, তেমনি এক জ্বলন্ত দ্রোহীচেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের কবিতায়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সেই সত্তরের দশকের অস্থির জনজীবন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়ও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ষাটের দশক কিংবা তারও আগে থেকে দেখে আসা এসব অন্যায়, নিপীড়ন, যুদ্ধবিগ্রহ, মারামারি, হানাহানি, রক্তপাত ইত্যাদি ষাটের দশকের কবিদের মন বিষিয়ে তুলেছিল। নানা ঘাতপ্রতিঘাতে তাদের কোমল মনে প্রেমের পরিবর্তে জ্বলে উঠেছিল দ্রোহের আগুন। ইন্দ্রিয়জ চৈতন্যে ছড়িয়ে পড়েছিল বিপরীত বোধ ও মনন।

এতোটাই বিপরীত যে গোলাপের সুবাসের পরিবর্তে তারা পেতেন বারুদের গন্ধ। প্রেমের পরিবর্তে ঘৃণা ও ক্ষোভ জমে উঠেছিল তাঁদের মনে। আর এ কারণেই নির্মলেন্দু গুণের উচ্চারণ প্রেমাংশুর রক্ত চাই, আবুল হাসানের রাজা যায় রাজা আসে, যে তুমি হরণ কর রফিক আজাদের অসম্ভবের পায়ে কিংবা সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে, আব্দুল মান্নান সৈয়দের জন্মান্ধ কবিতা গুচ্ছ, আল মুজাহিদীর হেমলকের পেয়ালা এবং ধ্রুপদ ও টেরাকোটা কিন্তু মহাদেব সাহা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। লালনের মতো ধ্যান ও বৈরাগ্যচেতনা ধরা দিল তার কাব্যে। সমাজে সম্পর্কবদ্ধ মানুষের চিরায়ত প্রেমের বাণী নানা রূপ ও রঙে, রস ও গন্ধে, বিচিত্র অনুভবে, আশ্চর্যরকম গীতলতায়, হৃদয়ের গভীরতম থেকে উচ্চারিত হলো এই গৃহ এই সন্ন্যাস-এ।

আর কোনো অন্যায় অনাচার নয়, যুদ্ধবিগ্রহ ও বিদ্রোহ নয়, নয় আর কোনো রক্তপাত ও হানাহানি। মানুষের কানে কানে তিনি ঢুকিয়ে দিতে চাইলেন প্রেমের মন্ত্র। তারপর কোমলস্বরে তিনি উচ্চারণ করলেন মানব এসেছি কাছে। হ্যাঁ বারবার তিনি মানুষের কাছেই ছুটে গেছেন। কারণ মানুষের ওপরই রয়েছে তার গভীর আস্থা ও বিশ্বাস।

মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে পারলেই দূর হবে দুঃশাসন। এ বিশ্বাসে মানবপ্রেমকেই তিনি করেছেন তার কাব্যসাধনার অন্বিষ্ট। তার আরো কয়েকখানা কাব্যগ্রন্থের নাম যেমন তোমার পায়ের শব্দ, ধুলোমাটির মানুষ, মানুষ বড়ো ক্রন্দন জানে না, বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ দেখলেই এ সত্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাবনার ধানগড়া গ্রামে ১৯৪৪ সালে মহাদেব সাহার জন্ম। পিতা গদাধর সাহা, মাতা বিরাজমোহিনী।

পড়াশোনা করেন, ঢাকা কলেজ, বগুড়া কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। অধ্যয়ন শেষে জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকা শহরে এসে মহাদেব গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন তার চারপাশের মানুষের অমানবিকতা, হিংসা, মতবিরোধ, ঝগড়াঝাটি ও নিষ্ঠুরতা। ‘মিউনিপ্যালিসিটির বড় বড় ট্যাঙ্কের তলায়’ জমে থাকা ‘বালি আর কাঁকরের মতো’ কেবলই ক্রোধ ও নির্মমতায় ভরে উঠছিল মানুষের মনের তলা। ভালোবেসে মানুষকে বুকে টেনে নেয়ার মতো কেউ ছিল না।

‘একবিন্দু শীতল জলের স্বাদ দিতে পারে এমন প্রকৃত কোনো হ্রদ নেই কাছে কিংবা দূরে যেখানেই তাকাই কেবল আজ চোখে পড়ে ধোঁয়ার কফিন’ [জলসত্র : এই গৃহ এই সন্ন্যাস] মানুষ যখন নির্দ্বিধায় হাতে তুলে নিচ্ছিল মারণাস্ত্র, অবাধে ঘটাচ্ছিল রক্তপাত, শোনা যাচ্ছিল না কোথাও ‘হৃদয়ের ভাষা’, চারদিকে শুধু বেজে উঠছিল যুদ্ধের দামামা-‘মার্চপাস্ট, কুচকাওয়াজ, লেফট রাইট’ অর্থাৎ ফুলহীন ‘অস্ত্রের উল্লাস’ তখন মহাদেব সাহা মানব প্রেম চৈতন্যে দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে উঠে দূর করতে চেয়েছেন তার চারপাশের এ অমানবিকতার গাঢ় অন্ধকার। ছড়াতে চেয়েছেন প্রেমের আলো। ‘আমার এখন বুঝি ভালো লাগে প্রতিদিন নিজের করতলের গাঢ় অন্ধকারে জ্বালাতে আগুন, ...’ [বৈশাখে নিজস্ব সংবাদ : এই গৃহ এই সন্ন্যাস] কিন্তু এ আগুন জ্বালানো কি এতোই সহজ? মানুষকে ভালোবাসতে গিয়েও তিনি তাদের কাছে থেকে অহর্নিশি পেয়েছেন যাতনা, ঘৃণা, বিদ্রুপ আর প্রত্যাখ্যান। এতে রক্তাক্ত হয়েছে তার বুক। তারপরও মানুষের শক্ত বুটের তলায় ভালোবেসে পেতে দিতে চেয়েছেন নিজের বুক।

তাদের ‘উপেক্ষার মাটি ভেদ করে’ তুলে আনতে চেয়েছেন বা এনেছেন চারাগাছ। পরম মমতায় তা পরিচর্যা করে তাতে ফুটিয়েছেন ভালোবাসার সুবাসিত কুসুম। ‘হে মানুষ, দর্পিত মানুষ, তোমাদের কুৎসা আর ঘৃণার বদলে আমি সহিষ্ণু বৃক্ষের মতো দেখো বুক চিরে এখনো ফোটাই ফুল, আজো আরক্তিম ভালোবাসা তোমাদেরই সমর্পণ করি’ [ঘৃণার উত্তরে চাই ক্ষমা : মানুষ বড় ক্রন্দন জানে না] মহাদেব সাহার মনে হয়েছে একমাত্র ভালোবাসার অভাবেই ‘সবখানে সব দেশে মানুষ আজ’ পরাধীন, নির্জীব; নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে পিষ্ট মানবতা, তাদের কারণেই যুগে যুগে ধ্বংস হয়েছে বা হচ্ছে সমাজ ও সভ্যতা। এ ধ্বংস থেকে পরিত্রাণের জন্য খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিনের- হে মানুষ আমাকে মানবতা ভিক্ষা দাও-এর মতো তার কণ্ঠেও বেজে উঠতে দেখি মানবতার অনুরূপ অমর সঙ্গীত : ‘আমি অভিমান ভুলে এসেছি মানুষ তোর কাছে আমাকে তুই তুলে দে একটু মাটি, মাটি দে মাটি দে আমাকে মন্ত্র দে, ধুলোয় ছড়ানো বীজ তুলে দে তুলে দে’ [মাটি দে, মমতা দে : মানব এসেছি কাছে] আদিকাল থেকে মাটির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক। বীজ ফেললে সোনার শস্য ফলে মাটিতে।

যে মানুষ মাটি ভালোবাসে, সে কখনো নির্মম হতে পারে না। পারে না অমানবিক ও দানব হতে। কারণ তার বুকের গভীর থেকে ওই শস্যের মতো উৎপাদিত হয় মানবিক ভালোবাসার অমূল্য শব্দমালা কিংবা নির্মিত হয় বিশ্বাস ও ভালোবাসার বিশুদ্ধ মৌচাক। এ ‘শোভাহীন’(!) মধুর শব্দমালাই তিনি তুলে দিতে চান মানুষের কানে। ‘আমি শুধু দিতে পারি শোভাহীন একগুচ্ছ গান।

’ [কিছুই দেয়ার নেই : কী সুন্দর অন্ধ] এ জন্যই তিনি হাতের মুঠোয় তুলে নিতে চান মাটি, ‘ধুলোঘ্রাণ’ আর ‘ধুলোভারসুদ্ধ বুকে নিয়ে’ মানুষের আরো কাছে যেতে চান, হতে চান ‘পুণ্যাত্মা সন্ন্যাসী’ কিংবা প্রেমিক। প্রেমিকের বুকে থাকে অভিমান। আর এই অভিমানের কারণ বিচ্ছিন্নতাবোধ। বর্তমান বিশ্বের মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। মহাদেব সাহার বিশ্বাস এভাবে বিচ্ছিন্ন হতে হতে একদিন এ মানুষের মনে জন্ম নেবে অভিমান।

তখন তারা আবার একদিন পরস্পরের কাছে চলে আসবে। ‘এই অভিমানই একদিন মানুষকে পরস্পর কাছে এনে দেবে’ [মানুষের মধ্যে কিছু অভিমান থাকে : মানব এসেছি কাছে] ইতিবাচক দৃষ্টিতে অভিমানের স্বাভাবিক বোধ ভেঙে ফেলেছেন মহাদেব সাহা। ফলে আমাদের বিশ্বাস ও চৈতন্যে প্রত্যাশার ডঙ্কায় টোকা লেগে মিলনের এক নতুন সুর বেজে ওঠে। সেই সুরে আমরা চমকিত হই। মহাদেব সাহার সত্তাজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে আকাশের মতো উদার এক মানবতা বোধ।

ধ্যানী বুদ্ধের মতো তিনি গভীরভাবে অবলোকন করেন মানব ও প্রকৃতির রূপ ও রহস্যময়তা এবং এ দুয়ের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করেন এক অচ্ছেদ্য বন্ধন। ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ এবং ‘জগতের সকল জীবের মঙ্গল হোক’ বুদ্ধের এ উদারমন্ত্রে দীক্ষিত মহাদেব সাহার চৈতন্যে তাই আমাদের চারপাশের প্রকৃতি অর্থাৎ গাছপালা, পাহাড়, নদী, সাগর, আকাশের মেঘমালা, বৃষ্টি ও বাতাস জীবের মতো অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে। মানুষের হাতে এসব ধ্বংস ও দূষিত হতে দেখে তিনি আঁতকে ওঠেন। ক) ‘...আহা ও কালো কুঠার, ঘাতকের বিষমাখা ফলা, আহা এ বড় নিষ্ঠুর, উহাদের করো না আঘাত উহাদেরও ভিতরে আছে প্রাণ’ [একটি ভ্রমর তার সাতটি পরান : মানব এসেছি কাছে] খ) ‘...অরণ্যও আমাদের লোক, তাকেও এভাবে চিনি’ [যেতে যেতে অরণ্যকে বলি : চাই বিষ অমরতা] গ) ‘... গোলাপ তোমার খুনখারাপি, হত্যাকা- এসব আমার একটু সয় না’ [আমার হাতে দুঃখ পাচ্ছো : চাই বিষ অমরতা] এতো কোমল যার হৃদয়, এতো গভীর যার অনুভব কীভাবে সইবে সে মানবসমাজের এসব নিষ্ঠুরতা? সে তো সাধারণ কোনো মানুষ নয়। ফকির লালনের মতো তিনি সহজ মানুষ, রুমীর মতো সুফিসাধক আর বুদ্ধের মতো সন্ন্যাসী।

সাধক রুমী তার শিষ্যদের বলেন, ‘হৃদয়কে পাথর করো না, পাথর শক্ত, নিষ্প্রাণ। এতে কিছুই ফলে না। হৃদয়কে কাদামাটির মতো নরম করো তাহলেই পাওয়া যাবে স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভ। ’ অর্থাৎ সাধনা সার্থক হবে। সাধনাবলেই মহাদেব সাহা তার হৃদয়কে প্রেম ও পুণ্যে কাদামাটির মতো নরম করে ফেলেছেন।

কাব্যসাধনার ধ্যানে শিল্পিত প্রয়াসে খুঁজে বেড়িয়েছেন মানবকে-মানুষই মহৎ শিল্প। আর মানবের অস্তিত্ব তিনি অনুভব করেছেন প্রকৃতির মধ্যেও। এজন্য ‘খ’ নাম্বার পঙ্ক্তিতে তিনি মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে ভেদরেখা মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। মহাদেব সাহা মানবতাবাদী কবি। মানুষের দুঃখবেদনা দেখে তিনি কাতর ও ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

এ জগতে ফুল, পাখি, অরণ্য, পাহাড়, সাগর, নদীর চেয়ে মানুষকেই তার সবচেয়ে বেশি অসহায় ও দুঃখশীল মনে হয়। কেন মানুষ এতো অসহায় ও দুঃখী? মহামতি বুদ্ধের মতো তিনিও প্রত্যক্ষ করেছেন মানুষের ভেতর অনন্ত তৃষ্ণা। কোনো কিছুতেই তার সুখ নেই, শান্তি নেই, পরিতৃপ্তি নেই। অনন্ত তৃষ্ণা মেটাতে না পেরেই সে অসুখী। ব্যর্থতা, পাপ, জরা, মৃত্যু, শোক তাকে ক্লান্ত ও নিঃশেষ করে ফেলে।

তৃষ্ণার কাছে মানুষ বড় বেশি অসহায়, ব্যর্থ, পরাজিত ও দুঃখী। এ থেকে মুক্তিলাভের জন্য বুদ্ধ বেছে নিয়েছিলেন নির্বাণের পথ। আর মহাদেব সাহা মানুষকে বলেন ‘সঙ্গমে সৎকারে, প্রেমে’র দিকে ধাবিত হতে। তার প্রত্যাশা এর মধ্যেই অর্জিত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণ ও বিজয়। ‘তোমরা প্রার্থনা করো হে মানুষ, নগ্ন নতজানু সঙ্গমের সহিষ্ণু মানুষ সৎকারের সন্তপ্ত মানুষ, তোমরা প্রার্থনা করো আসন্ন মানুষ যারা তোমাদের সঙ্গমে সৎকারে জন্ম নেবে তারা যেন জয়ী হয়, তারা যেন না হয় এমন আর বারবার তোমাদের মতো ব্যর্থ পরাজিত, ব্যর্থ পরাজয়ে নত।

’ [যাও সঙ্গমে সৎকারে, প্রেমে : চাই বিষ অমরতা] মানব মঙ্গল ভাবনায় মগ্ন মহাদেব সাহার কাব্যচেতনার কেন্দ্রে বারবার ভাস্বর হয়ে ওঠে মানুষের মুখ। দেশকাল, জাতি, ধর্ম ও বর্ণের ভেদরেখা মুছে ফেলে তিনি মানুষের ন্যায্য অধিকার ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেন। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের বিস্তার, সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুর থাবায় রক্তাক্ত, অভুক্ত, স্বাধীনতাবঞ্চিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মানুষের হাহাকার তাকে ক্লান্ত করে, বুকের ভেতর নীরবে রক্তক্ষরণ ঘটায়। তাদের অমঙ্গল আশঙ্কায় বারবার তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আফ্রিকা, প্যালেস্টাইন, ইরাক প্রভৃতি দেশের নির্যাতিত ভাগ্যাহত মানুষের দুঃখ, দুর্দশা দেখেও যখন বিশ্ববিবেক জাগ্রত হয় না, সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা কেবল নিষিদ্ধ হয় ‘হৃদয়ের তর্জমা’, গড়ে ওঠে ‘মননের সম্মুখে প্রাচীর’ আর ‘মানবিক উৎসমুখে’ পড়ে থাকে ‘শিলা ও পাথর’ তখন তাদের কথা অবলীলায় উঠে আসে মহাদেব সাহার কবিতায়।

এখানে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। তিনি স্বপ্ন দেখেন, একদিন অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষ রুখে দাঁড়াবে, সেদিন ‘রঙমহল, মিনার, গম্বুজ, পাথরের প্রাণবন্ত পাখি প্রজ্ব¡লিত প্রকোষ্ঠে’ ‘দাউ দাউ’ করে জ্বলে উঠবে। ধসে পড়বে সাম্রাজ্যবাদ। মুক্তিকামী মানুষের জন্য খুলে যাবে নক্ষত্রপুঞ্জের মতো বিশাল তোরণ। তখন সেই চিরবঞ্চিত মানুষ ফিরে পাবে তাদের অধিকার, স্বাধীনতা ও স্বদেশ।

তাই বর্তমান সাম্রাজ্যবাদীরা বড় ভীত তার এ স্বপ্নে। কারণ তার এ ‘একগুচ্ছ সোনালি স্বপ্নের ডালাপালা’ তাদের জন্য ‘মাইনের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর’। এজন্য আতঙ্কিত সাম্রাজ্যবাদীরা স্বপ্নচারী মহাদেব সাহার মানবতাবাদী উচ্চকিত কণ্ঠকে চিরতরে রুদ্ধ করে দিতে চায়। তিনি কি ভয় পান তাদের রক্তচক্ষুকে? একজন শুদ্ধবাদী কবির কণ্ঠস্বর কি আদৌ রুদ্ধ করা সম্ভব? ক) ‘...তাই আমার স্বপ্নের পিছে লেলিয়ে দিয়েছে এতো সশস্ত্র প্রহরী বুটের আওয়াজ ঘন ঘন কানে এলে যাতে এই স্বপ্ন অন্তির্হিত হয়; কিন্তু ওরা তো জানে না এই স্বপ্নকে আমি কতোদিন শত্রু ছাউনির পাশে রেখে কতোদিন সশব্দ কামানের মুখে ফেলে কতোদিন যুদ্ধের মহড়া দিয়ে তাকে করেছি প্রস্তুত এতোখানি। ’ [স্বপ্নপ্রোথিত সত্তা : তোমার পায়ের শব্দ] খ) ‘যতোই চাও না কেন আমার কণ্ঠ তুমি থামাতে পারবে না, যতোই করবে রুদ্ধ ততোই দেখবে আমি ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময়।

’ [আমার কণ্ঠ কেউ থামাতে পারবে না : মানুষ বড় ক্রন্দন জানে না] ষাটের দশকে কাব্যজগতে প্রবেশের সময় রফিক আজাদ, আল মুজাহিদী, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান প্রমুখ কবিদের মতো মহাদেব সাহার কণ্ঠ এতো দ্রোহী ও উচ্চকিত ছিল না। ছিল শান্ত, কোমল ও প্রেমময়। কিন্তু শাসক শোষকদের হাতে প্রতিনিয়ত মানুষকে লাঞ্ছিত হতে দেখে ভেতরে ভেতরে তিনিও জ্বলে উঠেছেন দ্রোহের আগুনে। তারপর এক সময় নিজের অজান্তেই মানবতার জন্য গিয়ে দাঁড়িয়েছেন উপর্যুক্ত কবিদের কাতারে। মহাদেব সাহার দৃষ্টি স্বচ্ছ ও গভীর।

দক্ষ ডুবুরির মতো ডুব দিয়ে তিনি মানবমনের গভীর তলদেশ অবলোকন করে সহজেই তুলে আনতে পারেন মুক্তা ও নুড়িপাথর। এ জন্যই বিচিত্র মানবচরিত্রের কদর্যতা ও কোমলতা, সঙ্কীর্ণতা ও উদারতা, ভালোবাসা ও নির্দয়তা বারবার শিল্পসুন্দর ব্যঞ্জনায় তুলে ধরতে সক্ষম হন তার কবিতায়। তিনি মনে করেন, প্রকৃতির মতো মানুষ কখনোও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, অসম্পূর্ণ বা উদ্ভিন্ন। দোষে-গুণে, পাপে-পুণ্যে হিংসা ও ভালোবাসায় মানুষ। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে এরকমই।

তাই মহাদেব সাহার অন্তর সর্বদাই উদার, ক্ষমাশীল। মানুষের সব নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতাকে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাসুন্দরদৃষ্টিতে দেখেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও’ মানুষের ‘পাশে এসে মানুষই দাঁড়াবে’। যদিও তার কবিতায় অনেকবার অনেকভাবে অমানবিকতার বিপরীতে দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রকৃতির অসীম উদারতার কথা এসেছে, মহৎ মানুষের প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে প্রকৃতি, কিংবা মানুষের চেয়েও উদার ও মানবিক হয়ে উঠেছে প্রকৃতি, তারপরও তার শেষ আশা মানুষই। অরণ্যপাহাড়, নদ-নদী, সাগর, মহাসাগর কিংবা আকাশ নয়, মানুষই মানুষের পরম বন্ধু।

‘মানুষের হৃদয়ই’ তার ‘শ্রেষ্ঠ আশ্রয়’। তাই মানুষ তাকে যতোই আঘাত দিক, যতোই ঝরাক তার অশ্রুজল, তবু এ মানুষের জন্যই তিনি সারাটি জীবন ভালোবাসার গোলাপ ফোটাতে চান। ‘তোমরা অমৃত নাও, আমি নেবো সংসারের বিষ, যতোদিন বাঁচি এই অগ্নিতেও গোলাপ ফোটাবো’ যতোদিন বাঁচি গোলাপ ফোটাবো : তুমিই অনন্ত উৎস] আমৃত্যু মানবকল্যাণকামী মহাদেব সাহা মানবপ্রেমের মধ্যেই জীবনের সার্থকতার সারসত্য উপলব্ধি করেছেন। জীবনের পরিশুদ্ধতা, আত্মার পবিত্রতাবোধ করেছেন মানবপ্রেমে। চন্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ এ বাণীকে তিনি জীবনের ধ্রুবসত্য বিবেচনা করেছেন।

মৃত্যু অব্দি মানবকল্যাণ কাজেই তিনি মগ্ন থাকতে চান। ‘ঝরা বকুলের মতো পথে পথে নিজেকে ছড়াতে পারি আমি ছেঁড়া কাগজের মতো এমনকি যত্রতত্র ফেলে দিতে পারি, এইভাবে ফেলতে ফেলতে ছড়াতে ছড়াতে এটুকু জীবন আমি পাড়ি দিতে চাই-’ [মগ্নজীবন : বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ] প্রকৃতি ও জীবভাষ্যের গভীরতম অনুভূতিপ্রবণ উচ্চারণ তার কবিতা। জীবন ও প্রকৃতির অতলে আলো ফেলে তিনি সহজেই তুলে আনেন আড়ালে ফুটে থাকা অচেনা মনোরম ফুল এবং এর রূপ, রস ও গন্ধে আমাদের বিভোর করে তোলেন। তার কবিতার রহস্যময় জগতে প্রবেশ করে আমরা কেবলই চমকিত হই এর আশ্চর্য কোমল গীতলধর্মী মায়াময় স্বরে, দৃষ্টিনন্দন দ্যুতিময় চিত্রকল্পে। তার কবিতা প্রকৃতি ও শিশুর মতো খেয়ালি, সহজ সরল, হৃদয়স্পর্শী; স্বতঃস্ফূর্তভাবে, প্রকৃতির মতো ভেতর থেকে যেন আপনিই হয়ে ওঠে।

তারপর গভীর আবেগে আমাদের মনন ও বোধে নাড়া দেয়। তখন আমরা আনন্দে কখনো কখনো উদ্বেলিত হই, কখনো দুঃখবেদনা, বিরহ ও শোকে হই কোমল, অশ্রুসিক্ত। প্রায় চার দশকেরও অধিককাল ধরে তিনি বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। জীবন ও প্রকৃতির বিচিত্র বিষয় নানা রূপে, বর্ণে, গন্ধে, স্পর্শে উঠে এসেছে তার কবিতায়। উঠে এসেছে আমাদের আবহমান গ্রামবাংলার সমাজসংস্কৃতি, জীবনধারা; ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাণের নানা অনুষঙ্গ।

কিন্তু, তারপরও বাস্তবে মানবপ্রেমে তিনি যেমন অধিকতর নত, তার কবিতা তেমনি সংহত, উজ্জ্বল। --------------------------------------------------------------------- দৈনিক যায়যায়দিন। ৩১ জুলাই ২০০৯ প্রকাশিত

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।