মিলে মিশে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ!
এই স্বার্থপর পৃথিবীতে এক স্বার্থপর মা আছেন, যিনি শাশ্বত মায়ের যে রূপটি আছে, আবহমান বাংলার যেসব একতরফা নীরব ত্যাগী মায়েদের যেসব গল্পগাঁথা আছে, সে ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চান, নতুন আদল দিতে চান। আজ সে মায়ের গল্প বলবো।
তিনি চান এ সমাজের কিছু পরিবর্তন, তিনি ভাঙ্গতে চান এ সমাজে মেয়েদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা কিছু নিয়মের বেড়াজাল। এ জন্য তিনি নিজের জীবনকেই গবেষণার একটা স্যাম্পল হিসেবে নিয়েছেন। নিজেকেই বসিয়েছেন গিনিপিগের আসনে।
সমাজের প্রচলিত নিয়মের বাইরে নতুন যা কিছু সঠিক বলে ভাবছেন, হওয়া উচিত বলে মনে করছেন তা প্রথমে নিজের জীবনেই পরখ করে দেখছেন।
তিনি চান এ সমাজে মায়েরা শুধু ত্যাগই করবে না, নিজের জন্যও কিছু পাওয়ার চেষ্টা করবে। যে মা নিজে প্রতি পদে মাথা নিচু করে থাকবে, তার সন্তানেরা কেমন করে মাথা উঁচু করা শিখবে? যে মেয়ে নিজে সমাজের সব অনাচার, সব অন্যায় আবদার বিনা বাধায় মেনে নিবে, তার মেয়ে কি করে প্রতিবাদ করা শিখবে? কেমন করে তার মেয়ে এ প্রতিকূল সমাজে পথ চলবে? কোথা থেকে শিখবে সে? কেন বুড়ো বয়সে এক মাকে স্বামীর জমানো টাকা আর সন্তানের দয়ার দিকে চেয়ে থাকতে হবে? যখন তার সন্তানেরা বড় হয়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, সারাটা জীবনের সময়গুলো ওইসব সন্তানের পিছনে ব্যয় করে ঐ মা কেন বুড়ো বয়সে একাকী দিন কাটাবে, কেমন করে কাটাবে? কে হবে তার বন্ধু-বান্ধব? কার সাথে দুটো কথা বলে তার সময় কাটবে? কেন মাদের শুধু সর্বংসহাই হতে হবে? মায়েরা কেন ঘরের বাইরের এ সুন্দর বিশ্বকে একটু উঁকি মেরে দেখবে না? কেন সারাজীবন ওই হেঁশেলের চার দেয়ালই তার ঠিকানা হবে? মায়েরা কি শুধু মা-ই, মানুষ নয় কি?
প্রতিনিয়ত এ পরীক্ষা চালাতে গিয়ে তিনি কখনো হয়তো সফল হন, কখনো কিছুটা বিফল হন, আবার ভুলগুলোকে সংশোধন করে পূর্ণদ্যোমে ঝাপিয়ে পড়েন। প্রতিদিনের শেষে তার মনের মাঝে চলে হিসাব-নিকাশ, কি করেছে, কি করা উচিত ছিল, ফলাফল কেমনটা আশা করেছিল, কেমনটা হচ্ছে।
আর নিজের জীবনকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাশুল দিচ্ছে তার পরিবার, তার বাচ্চারা।
এ মা মাঝে মাঝে নিজের কাজে এমনই ডুবে যান যে বাচ্চাদের খবর নিতেও তার দেরী হয়ে যায়। তখন তাকে অভিযোগ শুনতে হয় আম্মু অনেকদিন ফোন করে না, হয়তো সেটা ২/৩ দিন, কিন্তু সেটাও তো তার বাচ্চাদের জন্য অনে-কদিন। কারণ, তারা তো মায়ের কথা শোনার জন্য, মায়ের সাথে একটু গল্প করার জন্য, নিজেদের বন্ধুদের গল্প করার জন্য, ভাইবোনের ঝগড়াঝাটি, মারামারির যতরকমের নালিশ আছে সব করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকে। যখন দুই-তিন দিন খবর নেয়া হয় না, তখন তো তারা অপেক্ষা করতে করতে ভুলেই যায় তাদের সব গল্প। একসময় হতাশ হয়ে যায়, আশা ছেড়ে দেয়।
বাবার কাছে নালিশ, আম্মু ফোন করেনি। বাবা সাথে সাথে তাকে তটস্থ করেন, কি ব্যাপার, খুব ব্যস্ত নাকি? মাঝে মাঝে বাচ্চারা তাদের স্বার্থপর মাকে জিজ্ঞ্যেস করে কবে তার কাজ শেষ হবে, কবে ফিরে আসবে?
নিজের লক্ষ্যে অটল, সংকল্পে স্থির মা টা নিজের বুকের মাঝের কম্পিত আবেগটাকে দক্ষ হস্তে নিয়ন্ত্রণ করে নানারকম হাবিজাবি জবাব দিয়ে আশায় আশায় ভরিয়ে রাখে তার সন্তানদের, এই তো অমুক মাসেই এসে যাবে। মাত্র আর কটা দিন, একটু সবুর করো। এবার আসলে কি আবার যাবে? হ্যাঁ, আবার যাবো, তারপর একেবারেই ফিরবো, দেখো আর যাবো না। সে মা তার সন্তানদের নানারকম ভাল ভাল উপদেশ দেয়, পরামর্শ দেয় -- এ করো না, ঐ করো না, তোমাদের অনেক বড় হতে হবে, অনেক ভাল করতে হবে লেখাপড়ায়, অনেক কিছু শিখতে হবে, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে, দুষ্টমি বেশি করা চলবে না, আরো কত কি!
কিন্তু সে মা আপাতত পারেন না তার সন্তানদের একটু সময় দিতে।
জীবনের কিছুটা সময় স্বেচ্ছায় কঠিন করে নিয়েছেন তিনি। নাহ্, ষোলআনাই স্বেচ্ছায় নয়, নিয়তিতে যার আস্থা সে বোঝে নিয়ত আর নিয়তি সবসময় সমানতালে চলে না, চাইলেই সবকিছু পরিকল্পনামাফিক করা যায় না। তাই তো সেই দুর্ভাগা মায়ের পদে পদে সীমাবদ্ধতা, চাইলেই যে সব সীমা ভেঙ্গে ফেলতে পারে না। যদিও নিজস্ব গন্ডির অনেক সীমাই সে অবলীলায় ভেঙ্গে ফেলে কাউকে পরোয়া না করেই, কিন্তু ভিনদেশের সব নিয়ম সে ভাঙ্গতে পারে না। সব সাধ্য যে তার নেই!
তাই মাতৃস্নেহটা তার বুকের মাঝেই লুকিয়ে রাখতে হয়।
মা দিবসে চারিদিকে যখন সন্তানেরা সব ত্যাগী, নিঃস্বার্থ মায়েদের গল্পে মুখর, তখন সেই স্বার্থপর মা-টা সন্তানদের অনুযোগ নিয়ে মুখ লুকিয়ে রাখে, আত্মগ্লানিতে ভোগে। মাঝে মাঝে জীবনের ডেবিট-ক্রেডিটের হিসাব মেলাতে গিয়ে শংকিত হয়, খুব বেশি আগুন নিয়ে খেলা হচ্ছে না তো!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।