আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চায়ের ভবিষ্যৎ ‘মহাজনদের’ হাতে

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চা ব্যবসার বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যতের সুরক্ষার জন্য একযোগে কাজ না করলে সামনে কঠিন সময় মোকাবেলা করতে হবে।   

পাঁচ হাজার বছর আগে চীনে প্রথম চা উৎপাদিত হলেও বর্তমানে বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশে চা হচ্ছে। বলা হয়, পানির পর চা-ই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়।

পৃথিবীর সাশত কোটি মানুষ প্রতিদিন অন্তত তিনশ কোটি কাপ চা পান করছেন এবং ১৯৯৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরেই চায়ের বিক্রি বেড়েছে ৬০ শতাংশ।   

এই প্রবৃদ্ধির পরও জলবায়ুর পরিবর্তন, পানির স্বল্পতা, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শহরমুখী প্রবণতা, শস্যের বহুমুখীকরণ এবং শ্রমমূল্যের মতো বিষয়গুলো চা শিল্পের জন্য হুমকি তৈরি করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

 

লিপটন, ব্রুক বন্ড অ্যান্ড পিজি টিপস, টুইনিংস ও ফিনলে ব্র্যান্ডের চা উৎপাদনকারী ইউনিলিভার এবং টেটলি চা উৎপাদনকারী টাটা গ্লোবাল বেভারেজেসের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো এককভাবে বাজার দখলের লড়াইয়ে রয়েছে।

চা-শিল্প রক্ষায় ‘টি ২০৩০’ নামে বিশ্বজুড়ে কার্যক্রম চালানো একটি প্রকল্পের সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘ফোরাম ফর দ্য ফিউচার’ এর প্রধান নির্বাহী স্যালি আরেন বলেন, “এ বিষয়টি নিয়ে কোম্পানিগুলো একসঙ্গে কাজ করতে না পারলে চা শিল্পের ভবিষ্যত কঠিন হয়ে পড়বে। ”

‘টি ২০৩০’ এর গবেষণায় দেখা যায়, চা শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা গিয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে অন্য কারণগুলো।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা এখনকার এক তৃতীয়াংশ বাড়বে। ফলে খাদ্যের চাহিদা বাড়বে বর্তমানের চেয়ে ৭০ শতাংশ।

জনসংখ্যার এই বিস্ফোরণ সবচেয়ে বেশি সামলাতে হবে চীন ও ভারতকে, যে দেশ দুটো থেকে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি চায়ের যোগান আসছে।

জনসংখ্যা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই আবাদি জমির চাহিদা বাড়বে। বাড়তি মানুষের জন্য বাড়তি খাদ্যের জোগান দিতে শস্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। ফলে চাপের মধ্যে পড়বে চা উৎপাদন, কারণ ভাল চায়ের জন্য বিশেষ ধরনের জলবায়ু এলাকার বিশেষ বৈশিষ্টের মাটি আর বিস্তির্ণ জমি লাগে।

আশঙ্কাগুলো যে মোটেও অমূলক নয়, তার প্রমাণ ইতোমধ্যে পাওয়া গেলে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কায়।

ইন্দোনেশিয়ায় ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ১৩ হাজার হেক্টর চায়ের জমি রাবার, পাম ও ফলের বাগানে রূপান্তরিত হয়েছে। একই সময়ে শ্রীলঙ্কায় চায়ের বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কাজু বাদাম চাষ।           

নগরায়নও চা উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী যারা এতোদিন কম পারিশ্রমিকে বংশানুক্রমে চা শিল্পে শ্রম দিয়ে আসছিলেন,  তাদের অনেকই অন্য কাজ নিয়ে শহরমুখী হচ্ছেন। আবার তাদের ধরে রাখতে মজুরি বাড়ানোর বড় কোনো উদ্যোগও দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে না।

 

শ্রমিকদের কম মজুরির বিষয়টি স্বীকার করে টাটা গ্লোবাল বেভারেজেসের পরিচালক ক্যাটি টুব বলেন, “আইনত শ্রমিকরা হয়তো সঠিক মজুরিই পাচ্ছে, কিন্তু তা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। শ্রমিকদের জীবন ধারণের জন্য একটি উপযুক্ত পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা উচিত। ”

সাম্প্রতিক সময়ে চা শিল্পের জন্য মারাত্মক হুমকি দেখা দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন।  

প্রাকৃতিকভাবেই চা অন্য ফসলের চেয়ে অনেক বেশি স্পর্শকাতর। চায়ের মান ঠিক থাকার বিষয়টি সঠিক উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাতের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।

ভারতে সবচেয়ে বেশি চা উৎপাদনকারী অঞ্চল আসামে গত ৬০ বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা বাড়ার পূর্বাভাস রয়েছে।

বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া অঞ্চলে চা চাষীদের বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে আবার সেচের পানির স্বল্পতাও তাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিতে শুরু করেছে।

আবহাওয়ার এই বিরূপ আচরণের কারণে চা উৎপাদন ও সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন ‘টি ২০৩০’ প্রকল্পের সহযোগী টেইলরস অব হ্যারোগেটের ভোগ্যপণ্য বিষয়ক পরিচালক কিথ রাইটার।

এদিকে বাংলাদেশসহ চা উৎপাদনকারী অনেক দেশই অভ্যন্তরীণ চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে রপ্তানি কমাতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে আমদানিনির্ভর দেশগুলোতে দেখা দিতে পারে চায়ের তীব্র সংকট।

এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে চায়ের বিশ্ব বাজারে পড়তে শুরু করেছে।  

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১ লাখ ১৫ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে মোট ১৬৩টি চা বাগান রয়েছে। গত বছর দেশে ৬ কোটি ৩৮ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে বাংলদেশ যেখানে ১৭৫ কোটি টাকার চা রপ্তানি করেছে, সেখানে ২০১২-১৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকার চা।

চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকায় ১৯৭০ থেকে ২০০০ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে চায়ের দাম ক্রমান্বয়ে কমেছে। কিন্তু এরপর চাহিদা ও সরবরাহের চিত্র উল্টে যাওয়ায় দাম বেড়েছে দিগুণেরও বেশি।

কঠিন এসব বাস্তবতাই বড় বড় কোম্পানিগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করছে।

স্যালি আরেন বলেন, “বড় কোম্পানিগুলো বুঝতে পারছে, তারা যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সেটি কঠিন এবং একার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব নয়।

এর মধ্যে স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষার বিষয় যেমন আছে, তেমনি মজুরি, চাষাবাদ, চা শিল্পে নারীর ভূমিকা ও শ্রমিকদের শিক্ষিত করে তোলার মতো বিষয়গুলোতেও কাজ করার তাগিদ রয়েছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বড় বড় কয়েকটি কোম্পানি একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব দিলেও তারা মনে করছে, ভবিষ্যতের হুমকি মোকাবেলায় এখনো যথেষ্ট সময় আছে। তবে তাদের ধারণা সঠিক না হলে একদিন হয়তো চা আর নিত্যদিনের ‘প্রয়োজনীয় পানীয়’ থাকবে না, পরিণত হবে বিলাসিতায়।


সোর্স: http://bangla.bdnews24.com     দেখা হয়েছে ১২ বার     বুকমার্ক হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।