আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চোখটা এত পোড়ায় কেন?

যদি আমি ঝঁরে যাই একদিন কার্তকের নীল কুয়াশায়

মা ভাবতেই পারেন না, আবু বকর ফিরে আসবে না। বাড়ির পাশের পথ দিয়ে পড়ুয়া ছেলেরা গেলেই তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কখনো ছেলের ছবি বুকে নিয়ে হেঁটে বেড়ান উঠানে। ছোট ছেলেটা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে। তার পড়া দেখলেই মা চিৎকার করে ওঠেন।

ভয়ে কাঠ হয়ে যান। তাকেও যদি হারাতে হয়![/si একটা কুকুর মারলেও বিচার হয়; আমার আবু বকররে মাইরা ফেলল, কোনো বিচার হইল না। কারা মারল হেইডাও কেউ জানার চেষ্টা করল না। কোন দেশে আমরা বাস করি? সরকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাইছি নিরাপদে পড়াশোনা করতে। সেখানেই আমার বাবারে মাইরা ফালাইল! বাবা আমার ক্ষেতে কাজ করলেই ভালো ছিল, মরতে অইত না।

' চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন রাবেয়া বেগম। গ্রামের সহজ-সরল এই মা অসময়ে চলে যাওয়া আবু বকরকে জন্ম দিয়েছিলেন আজ থেকে ২৩ বছর আগে। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ি গ্রামের রুস্তম আলীর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলে মাথায় কাপড় দিয়ে অনেকটা সংকোচেই সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই দুই চোখে পানি ঝরতে থাকে। ছেলেহারা এক মায়ের বুকফাটা কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

অভাবের সংসারে মানুষ রাবেয়া বেগম। মা-বাবা পালতে না পেরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মামাদের কাছে। দুনিয়ার হিসাব-কিতাব জানার আগেই বউ হয়ে এসেছেন রুস্তম আলীর ঘরে। এখানেও নিত্যসঙ্গী অভাব। রিকশাচালক স্বামী দুজনের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতেন।

এক এক করে সন্তান আসতে লাগল ঘর আলো করে। তাদের খাবার জোগাতে রাবেয়া চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। অবস্থা এতই শোচনীয়, এমনকি সন্তানদের পরনের কাপড়ও দিতে পারেন না ঠিকমতো। দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে আবু আব্বাস ও আবু বকর। একসঙ্গে দুই সহোদর অন্যের জমিতে কামলা দেয়।

চুক্তিতে কাজ করে, পুকুরে মাছ ধরে বাজারে নিয়ে বেচে। মায়ের দুঃখ অনেকটা কমে যায়। বড় ভাই দেখে, ছোট ভাইটির পড়ার প্রতি আগ্রহ অনেক। এই ছেলেটিকে শিক্ষিত করে তোলার ইচ্ছা মায়ের মনেও উঁকি দিয়ে যায়। যদিও ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে আটজনের সংসার কোনোভাবেই চলছে না।

কিন্তু আবু বকর পড়বেই। নিজ হাতেই তৈরি করেছে সে পড়ার টেবিল। দেড় ফুট বাই সাড়ে তিন ফুট। এমন বেখাপ্পা টেবিলে বসেই পড়ত আবু বকর আয়েস করে। রাবেয়া ছেলের তৈরি টেবিল ধরে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন, 'আমার বাবা বাড়ি আইসা এই টেবিলে আর বসবে না।

' কাঁদতে কাঁদতেই মূর্ছা যান মা। প্রাইমারি থেকেই ভালো ফল করতে শুরু করেছিল ছেলেটি। কিন্তু তাই বলে কাজ করা একটুও থামিয়ে দেননি আবু বকর। কাজ থামালে যে পড়া হবে না, জুটবে না খাবার। স্কুল থেকে ফিরে কামলা খেটে লেখাপড়ার খরচ চালাতেন।

টাকা তুলে দিতেন মায়ের হাতে। এই ফাঁকে দুই ভাই মিলে বাবাকে রিকশা চালানো থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। বসিয়ে দিয়েছেন ছোট্ট মুদি দোকানে। একের পর এক ভালো ফল করা ছেলেটি ইন্টারমিডিয়েট পাস করে সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। অবুঝ মা ফ্যাল ফ্যাল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন, 'এইডা কইরা আমাগো কী অইব?' ছেলে বোঝায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে জীবনের উন্নতি হবে।

মা জানেন, ছেলে তাঁর ছোটবেলা থেকে কখনো মিথ্যা বলেনি, কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করেনি, যায়নি কোনো আড্ডায়। সে যা করবে ভালোর জন্যই করবে। অনেকটা দুঃসাহস করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটে পরীক্ষা দেন আবু বকর সিদ্দিক। অজপাড়াগাঁয়ের ছেলেটি ইউনিয়নের প্রথম মানুষ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। খবরটি দশ গ্রামে ছড়িয়ে গেল।

মাকে ছেলে বোঝান, 'পাস করে বের হলেই বড় চাকরি পেয়ে যাব। আমাদের আর দুঃখ থাকবে না। ' গর্বে মায়ের বুক ভরে যায়। আশার আলো পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত তিনি। 'আমার চাকরি পাওয়ার আগে ভাইকে বিয়ে করাব না, বোনকেও বিয়ে দিব না।

ঘরগুলো আগে ঠিক করি। তারপর অন্য কাজ। ' মাকে সাফ বলে দিয়েছিলেন ছেলেটি। ঘরের পাটখড়ির বেড়া। খরচ বাঁচানোর জন্য হালকা করে বাঁধা।

বাতাস আসা-যাওয়া করে অনায়াসে। ঝড়ের দিনে ঘরে থাকাই দায়। এই ঘরে বসেই লেখাপড়া করতেন আবু বকর। ছোট্ট চৌকিতে তিন ভাইবোনের শোয়ার জায়গা হয় না বলে সুপারি গাছ কেটে নিজ হাতে মাচা বানিয়েছেন। খুঁটি দিয়েছেন বাঁশ দিয়ে_এসব এখন কেবলই স্মৃতি, মায়ের কান্নার সঙ্গী।

রাবেয়া বেগম সারাক্ষণ কাঁদেন। বলেন, "আমার বাবা কোরবানির ঈদে বাড়ি আসছিল। ১১ দিন থাইকা গেছে। এই কয়দিন বাড়িতে থাইকা ধান কাটছে, ভাইয়ের সঙ্গে জমি সাফ করছে। আসার সময় আমাকে বলেছে, আর কয়টা দিন মা, রেজাল্ট বেরোলেই চলে আসব।

তারপর একটা চাকরি হয়ে যাবে। আর দুঃখ থাকবে না। " মা আশায় বুক বেঁধে পথ চেয়ে থাকেন। ৩ ফেব্রুয়ারির ঝড় তার সব আশা-ভরসা দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে শেষ হয়ে যায় রাবেয়া বেগমের তিল তিল করে সাজানো স্বপ্ন।

মায়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বারবার মূর্ছা যান তিনি। যে ছেলের সাহেব হয়ে বাড়ি ফেরার কথা, সে আসে কফিনে। কফিনটি এখনো আছে। একটা জামা দিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন দুই বছর।

জামাগুলোর বেশির ভাগই বাঁধনসহ হলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাওয়া। মা ব্যাগ থেকে জামা বের করেনু আর কাঁদেন। কান্নায় তাঁর শাড়ি ভিজে যায়। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'সকালে নাশতার জন্য চিঁড়া কিনেছিল আমার বাবা। সেই চিঁড়াও খেয়ে যেতে পারেনি।

বাড়িতে এনে মানুষকে দিয়েছি। ' তিনি স্মৃতি হাতড়ান, 'আমার বাবার টাকার দরকার ছিল। কারওয়ান বাজারে পরিচিত একজনের কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিতে বলেছি। সে নিয়েছে ৬০০। ২০০ খরচ করেছিল।

৪০০ টাকা আমার আবু বকরের পকেটেই ছিল। ' তিনি ছেলের পোশাক বুকে চেপে ধরেন, 'আমি কী করব এসব দিয়ে, তোমরা আমার বাবাকে এনে দাও। ' বলেই হাউমাউ করে কাঁদেন। মা ভাবতেই পারেন না তাঁর আবু বকর আর ফিরে আসবে না। বাড়ির পাশের পথ দিয়ে পড়ুয়া ছেলেরা গেলেই তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

কখনো ছেলের ছবি বুকে নিয়ে হেঁটে বেড়ান উঠানে। ছোট ছেলেটা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে। তাকে পড়তে দেখলেই মা চিৎকার করে ওঠেন। ভয়ে কাঠ হয়ে যান। যদি তাকেও হারাতে হয়!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।