আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইতালীয় রেনেসাঁসের কালজয়ী চিত্রশিল্পী লেওনার্দো দা ভিঞ্চি

তাকেই ভালবাস যে তোমাকে কষ্ট দেয় তাকে কষ্ট দিও যে তোমায় ভালবাসে হয়তো পৃথিবীর কাছে তুমিই কিছুইনা... কিন্তু কারো কাছে হয়তো তুমি তার পৃথিবী

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ( ইতালীয় Leonardo da Vinci লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, পূর্ণ নাম Leonardo di ser Piero da Vinci লেওনার্দো দা সের পিয়েরো দা ভিঞ্চি (এপ্রিল ১৫, ১৪৫২ -মে ২ ১৫১৯)। বিশ্বসভ্যতার চিরস্মরণীয় মানুষদের তালিকায় অমোচনীয় কালিতে লেখা রয়েছে তাঁর নাম: লেওনার্দো দা ভিঞ্চি। কে ছিলেন এই লেওনার্দো দা ভিঞ্চি? পাল্টে বরং প্রশ্ন তোলা যাক, কী ছিলেন না তিনি? তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের বহুমুখী প্রতিভা: ভাস্কর, স্থপতি, উদ্ভাবক, গণিতবিদ, লেখক, সংগীতজ্ঞ, শারীরবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, ভূতাত্ত্বিক, ভ্রূণবিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী। উড়ন্ত যানের নকশা এঁকেছিলেন, আবিষ্কার করেছিলেন জলগতিবিদ্যার সূত্র, আন্দাজ করেছিলেন টেকটোনিক প্লেটের ধারণা, বের করেছিলেন সৌরশক্তি কেন্দ্রীভূত করার কৌশল, উদ্ভাবন করেছিলেন অভিনব সব সমরাস্ত্র, পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করেছিলেন রক্তের সঞ্চালন, দৃষ্টিশক্তির রহস্য ও হাড়ের সংস্থান। এত বিচিত্র সব কীর্তি, যেন একটি মানুষের নয়, অনেকগুলো মানুষের বর্ণনা।

মিকেলেঞ্জেলোর রেনেসাঁর অন্যতম প্রতিক লেওনার্দো দা ভিঞ্চি। তিনি ইতালীয় রেনেসাসেঁর কালজয়ী চিত্রশিল্পী। লেওনার্দো দা ভিঞ্চির সম্পর্কে না জানলে তার মহিমা আন্দাজ করা যাবে না। রেনেসাঁ সাংস্কৃতিক আন্দোলনটি জেগে উঠেছিল চতুর্দশ শতকের ফ্লোরেন্সে; এর পর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইয়োরোপে। এ আন্দোলন ইয়োরোপকে টেনে বের করে আনে এর মধ্যযুগীয় ধর্মতন্ত্রের অন্ধকার থেকে।

একঝাঁক লেখক-শিল্পী-ভাবুকের অভূতপূর্ব সৃজনশীলতায় চিন্তার কেন্দ্রে ঈশ্বরের জায়গায় অভিষেক ঘটতে শুরু করে মানুষের। যাঁদের হাতে এই রেনেসাঁর সূচনা, লেওনার্দো দা ভিঞ্চি তাঁদের একজন। জন্মও তাঁর ফ্লোরেন্সেই, ১৪৫২ সালের ১৫ এপ্রিল। লেওনার্দোর জীবন শুরু হয়েছিল তাঁর গল্পের পিঁপড়ার মুখে আটকে পড়া শস্যদানার মতোই। মেসের পিয়েরো ফ্রুয়োসিনো দি আন্তোনিয়ো দা ভিঞ্চি নামে আদালতকর্মী বাবা আর কাতেরিনা নামে কিষানি মায়ের তিনি ছিলেন অবৈধ সন্তান।

২৪ বছর বয়সে ফ্লোরেন্সের এক আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে সমকামের অভিযোগ ওঠে। শৈশবের মাত্র দুটি স্মৃতি উদ্ধার করতে পেরেছিলেন লেওনার্দো। একবার তিনি শুয়ে ছিলেন দোলনায়। আকাশ থেকে হঠাৎ একটি চিল নেমে আসে দোলনার ওপর। পাক খেতে খেতে চিলটির লেজের পালক ছুঁয়ে যায় তাঁর মুখ।

এই ঘটনাটির মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন অমঙ্গলের বার্তা। কিন্তু সমস্ত অমঙ্গল আর দুর্দশা ঝেড়ে ফেলে মানুষটি হয়ে ওঠেন মানবসভ্যতার অন্যতম নির্মাতা। ভ্যারিচ্চিও-র কাজে যোগদান(১৪৬৬-১৪৭৬) ১৪৬৬ সালে লিওনার্দোর বয়স যখন ১৪, তখন তিনি ভ্যারিচ্চিও (Verrocchio)-র কাছে শিক্ষানবীশ হিসেবে যোগ দেন। ভ্যারিচ্চিও-র পুরো নাম “আন্দ্রে দাই সায়ন”, তিনি ছলেন সে সময়ের একজন সফল চিত্রকর। ভ্যারিচ্চিও-র কর্মস্থলে তৎকালীন গুণী মানুষদের সমাগম হত।

আরও নামকরা যেসব শিল্পী ভ্যারিচ্চিও-র তত্ত্বাবধানে কাজ করত বা তার ওয়ার্কশপে যাতায়াত করত, তাদের মধে অন্যতম হলেন গিরল্যান্ডিও (Ghirlandaio), পেরুগন (Perugino), লরেঞ্জা দাই ক্রিডি (Lorenzo di Credi)। এখানে কাজ করে লিওনার্দো হাতে কলমে প্রচুর কারিগরি জ্ঞানার্জন করেছিলেন। তার সুযোগ হয়েছিল কারুকার্য, রসায়ন, ধাতুবিদ্যা, ধাতু দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানানো, প্রাস্টার কাস্টিং, চামড়া দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানানো, গতিবিদ্যা এবং কাঠের কাজ ইত্যাদি শেখার। তিনি আরও শিখেছিলেন দৃষ্টিনন্দন নকশাকরা, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি এবং মডেলিং। ভ্যারিচ্চিও-র ওয়ার্কশপে বেশিরভাগ কাজ করত তার অধঃস্তন কর্মচারীরা।

ভাসারীর বর্ননানুসারে লিওনার্দো ভ্যারিচ্চিও কে তার “ব্যাপ্টিজম অব ক্রাইস্ট” ছবিটিতে সাহায্য করেছিলেন। ছবিটিতে দেখানো হয়েছে একটি দেবদূত যীশুর লাঠি ধরে আছে। ছবিটি ভ্যারিচ্চিও কে এতটাই অভিভূত করেছিল যে তিনি নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কখনো তুলিই ধরবেন না, ছবিও আঁকবেন না। তবে খুব সম্ভবত ভাসারি ঘটনাটি অতিরঞ্জিত করেছিলেন। সূক্ষ্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ ছবিটির যে সব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তা হল- এটি বিশেষ পদ্ধতিতে তৈল রং দিয়ে আঁকা।

ভ্যারিচ্চিও বেশ কয়েকটি কাজে লিওনার্দো মডেল হিসেবে ছিলেন। যেমন- “ডেভিড” চরিত্রে “দি বার্জেলো”( Bargello) নামক ব্রোঞ্জ মূর্তিতে, “আর্চঅ্যাঞ্জেল মাইকেল” হিসেবে “টোবিস এন্ড অ্যাঞ্জেল“(Tobias and the Angel) এ। ১৪৭২ সালে ২০ বছর বয়সে লিওনার্দো “গির অব সেন্ট লুক” এর পরিচালক হবার য্যোগ্যতা অর্জন করেন। এটি চিকিৎসক এবং চিত্রকরদের একটি সংঘ্য। কিন্তু তার বাবা তাকে নিজেদের ওয়ার্কশপের কাজে লাগিয়ে দেন।

ভ্যারিচ্চিওর সাথে চুক্তি অনুসারে তিনি তার সাথেও কাজ চালিয়ে যান। লিওনার্দোর নিজের হাতে তারিখ দেওয়া সবচেয়ে পুরানো ছবি হল আর্নোভ্যালি, তারিখটি হল ৫ই আগস্ট ১৪৭৩। পেশাগত জীবন(১৪৭৬-১৫১৩) আদালতের নথি থেকে দেখা যায় একবার লিওনার্দো সহ আরও ৩ জন যুবককে সমকামীতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং তারা বেকসুর খালাসও পেয়েছিল। এরপর ১৪৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি কি করেছিলেন, কোথায় ছিলেন তার কিছুই জানা যায়নি। ধারনা করা হয় পরবর্তিতে ১৪৭৮ থেকে ১৪৮১ পর্যন্ত লিওনার্দো তার নিজের ওয়ার্কশপে কাজ করেছে।

তিনি ১৪৭৮ সালে চ্যাপেল অব সেন্ট বার্নার্ড ও “অ্যাডোরেশন অব দি ম্যাগি” এবং ১৪৮১ সালে "মঙ্ক অব সান ডোনাটো এ স্কাপিটো" আঁকার দায়িত্ব পান। ভাসারির মতে লিওনার্দো সে সময়ের সেরা সংগীতজ্ঞ ছিলেন। ১৪৮২ সালে তিনি ঘোড়ার মাথার আকৃতির একটি বীণা তৈরি করেছিলেন। লরেঞ্জো দ্য মেডিসি(Lorenzo de’ Medici) লিওনার্দো-র হাতে এই বীনা উপহার স্বরূপ মিলানের ডিউক লুদোভিকো এল মোরো(Ludovico il Moro) এর কাছে পাঠিয়েছিলেন শান্তিচুক্তি নিশ্চিত করার জন্য। এ সময় লিওনার্দো ডিউকের কাছে একটি চিঠি লিখেন, যাতে ছিল তার উদ্ভাবিত বিভন্ন চমকপ্রদ যন্ত্রের বর্ননা।

তিনি এ চিঠিতে নিজের চিত্রশিল্পী পরিচয়ের কথাও লিখেছিলেন। লিওনার্দো ১৪৮২ থেকে ১৪৯৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মিলানে কাজ করেছেন। এখানে তিনি ভার্জিন অব দ্যা রকস্ এবং দ্যা লাস্ট সাপার ছবি দুটি আঁকার দায়িত্ব পান। ১৪৯৩ থেকে ১৪৯৫ এর মধ্যে তার অধিনস্তদের মাঝে ক্যাটরিনা নামে এক মহিলার নাম পাওয়া যায়। ১৪৯৫ সালে এ মহিলাটি মারা যান।

সে সময় তার শেষকৃত্যের খরচ দেখে ধারনা করা হয় তিনি ছিলেন লিওনার্দোর মা। লেওনার্দো সম্পর্কে সারা বিশ্বে আলোচনার শেষ নেই। চিত্রাকররা তার নানা আলোচনা সমালোচনায় মুখর থাকে। তবুও এখনো পুরোপুরি তাকে জানতে পারেনি অনেকে। অনেকটা রহস্যময় থাকা লেওনার্দো বীণা বাজানোয় পারদর্শী ছিলেন ভিঞ্চি।

কেউ কেউ মনে করেন, ভিঞ্চি আসলে ‘মোনা লিসা’ এঁকেছেন নিজের আত্মপ্রতিকৃতির আদলে। ভিঞ্চি সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত বাঁহাতি। নোটবইয়ে সবকিছু লিখতেন উল্টো করে। কারও কারও অনুমান, এসব তিনি করেছেন তাঁর আবিষ্কার গোপন রাখার স্বার্থে। কেউ বলেন, চার্চের সঙ্গে বিরোধ বাধবে, এই আশঙ্কায়।

রাতদুপুরে কবরখানায় ঢুকে লাশ কেটে দেখতেন। লিখে ও এঁকে রাখতেন চোখের গঠন, হাড়ের বিন্যাস, ভ্রূণের অবস্থা, রক্তসঞ্চালনের উপায়। আর খুঁজতেন, আত্মা কোথাও থাকে কি না। বিচিত্র কৌতূহল ও মুদ্রাদোষ এবং প্রাণী-মানুষ-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের কিম্ভূত কাজকারবারের জন্য লেওনার্দোর চারপাশ ঘিরে আছে রহস্যের ঘন কুয়াশায়। কিন্তু বিখ্যাত মানুষটির আসল কীর্তির কথা তো বলাই হয়নি এখনো।

লেওনার্দো দা ভিঞ্চি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম চিত্রকরদের একজন। নোটবইয়ের এক জায়গায় লেওনার্দো লিখেছেন, ‘ছবি আঁকা কখনো শেষ হয় না, আঁকা একসময় ছেড়ে দিতে হয়। ’ তাঁর এ কথা ভিন্নতর অর্থে ফিরে এসেছে তাঁর নিজের জীবনে। তাঁর বিখ্যাত মুদ্রাদোষ ছিল ছবি অসমাপ্ত রেখে দেওয়া। বহু চিত্রকর্ম তিনি আঁকতে শুরু করেছেন, কিন্তু শেষ করেননি।

তাঁর সম্পূর্ণ চিত্রকর্মের সংখ্যা মাত্র ১৫টির মতো। এই সামান্য কয়টি চিত্রকর্মই তাঁকে আকাশচুম্বী খ্যাতি দিয়েছে। আনুমানিক ১৪৬৯ সালে রেনেসাঁসের অপর বিশিষ্ট শিল্পী ও ভাস্কর আন্দ্রেয়া ভেরোচ্চিয়োর কাছে ছবি আঁকায় ভিঞ্চির শিক্ষানবিশ জীবনের সূচনা। এই শিক্ষাগুরুর অধীনেই তিনি ১৪৭৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষত চিত্রাঙ্কনে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। ১৪৭২ সালে তিনি চিত্রশিল্পীদের গীল্ডে ভর্তি হন এবং এই সময় থেকেই তাঁর চিত্রকর জীবনের সূচনা হয়।

বিশ্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মের মধ্যে আছে তাঁর ‘দ্য লাস্ট সাপার’ আর ‘মোনা লিসা’। ‘মোনা লিসা’র হাসি সবার কাছে চির-রহস্যের উত্স। ‘ভিত্রুভিয়ান ম্যান’ এমন এক সাংস্কৃতিক আইকন, যা ইয়োরো থেকে টি-শার্টে ফিরে ফিরে আসছে নানা নতুন চেহারায়। ড্যান ব্রাউন যে ‘দা ভিঞ্চি কোড’ বইটি লিখে বছর কয়েক আগে দুনিয়া মাতালেন, তারও কেন্দ্রে লেওনার্দোর রহস্যমাখা চিত্রকর্ম। লেওনার্দো এখনো এমন প্রবলভাবে বারবার ফিরে আসছেন, যেন তিনি এ সময়েরই শিল্পী।

লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো মানুষের একবার জন্ম হলে আর মৃত্যু হয় না। বিবরণ দিতে গিয়েই তৈরি হয়েছিল ‘রেনেসাঁ-মানব’ শব্দটি। তবু রেনেসাঁর প্রতীক। এই রেনেসা মানব ২ মে ১৫১৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।