আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: পুনর্জন্ম

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

সাত সকালে মঞ্জু খালার ফোন। জলদি আয়। তোকে এক জায়গায় যেতে হবে।

মঞ্জু খালারা থাকেন লালমাটিয়ায়। আটটার মধ্যে সিরামিক ইটের ঝকঝকে দোতলা বাড়ির কাছে পৌঁছে যাই। একতলার পোর্টিকোয় সাদা রঙের ঝকঝকে একটা টয়োটা এলিয়ন। গাড়ির সামনে তৈমুর দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে হাসল।

পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ঝকঝকে তরুণ । আমি ওকে অনেক দিন ধরেই চিনি, ও আমার চোখে কেবলই ড্রাইভার নয়- ভারি মজার এক মানুষ। চমৎকার বাঁশিও বাজাতে পারে, যে কারণে তৈমুরকে আমার শাহ্ বাগের বন্ধুদের কাছে প্রেজেন্ট করেছি। আমার কবি বন্ধুরা সব তৈমুরের বিশাল ফ্যান। মঞ্জু খালা ড্রইংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।

আমাকে দেখে গম্ভীর মুখটা ভারি উজ্জ্বল হয়ে উঠল । বললেন, শোন, শান্ত। গতকাল আমেরিকা থেকে একজন গেষ্ট এসেছে, রুনুর প্রতিবেশি। ওখানকার এক ইউনিভারসিটিতে পড়ে। দু-তিন দিন থাকবে ঢাকায়।

তারপর ইন্ডিয়া চলে যাবে। পদ্মা নদীর নাম শুনেছে, নদীটা ঢাকার কাছে শুনে দেখবে বলল - এখন কী করি বল তো। এদিকে আমার ব্লাগ সুগার বেড়েছে, তোর খালুও ভীষন ব্যস্ত। রেহান-মুনিয়াদেরও সময় হচ্ছে না, পড়ালেখা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। তোর তো হাতে সময় থাকেই।

তুই বরং ওকে নদী দেখিয়ে নিয়ে আয়। বললাম, ওকে, নিয়ে যাব। তুমি কিছু ভেব না। মঞ্জু খালা খুশি হয়ে বললেন, চা খাবি? না। মঞ্জু খালার মেজ মেয়ে রুনু আমেরিকার ম্যারিল্যান্ড থাকে।

ও দেশে অনেক দিন ধরেই আছে। রুনুর পড়শি কি বাঙালি না আমেরিকান? না, অন্য কোনও দেশের? মঞ্জু খালা বললেন, ঠিক আছে। তা হলে তুই গাড়িতে গিয়ে বোস। স্টেলা ওপরে আছে। নিচে এলেই পাঠিয়ে দেব।

আমেরিকান গেস্টের নাম তাহলে স্টেলা! ইউনিভারসিটিতে পড়ে ...তার মানে তরুণী। বছর দুই হল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বসে আছি। একরকম বেকার জীবন কাটাচ্ছি। আসলে আমার চাকরি-বাকরি করবার ইচ্ছে খুব একটা নেই। শৈশব থেকেই লেখালেখি করি।

‘আউশ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করি। নানারকম দিবাস্বপ্নে ডুবে থাকি- একদিন আমার লেখা খুব হিট করবে, বই বেচে পুরনো ধ্যাড়ধেরা টয়োটা করলা কিনব। না, আসলে সে রকম আশা নেই। দু-চার লাইন যা কবিতার লিখতে পারি বটে, কিন্তু কবিতা লিখে আজকাল বিত্তবান লেখক হওয়ার সম্ভাবনা কম ... জীবনানন্দের মতো কবি যেখানে ভয়ানক সাফার করেছেন। এদিকে আমার জীবন থেকে বাস্তববাদী ক্যারিয়ারিষ্ট বন্ধু-বান্ধবরা সব যত সরে যাচ্ছে, তত আমার গোপন স্বপ্ন আরও গাঢ়তর হয়ে উঠছে।

এ রকম এক বিষাদিত সময়ে স্টেলা নামের এক মার্কিন তরুণীর সান্নিধ্য পেলে মন্দ হয় না! বাইরে বেড়িয়ে এসে ড্রাইভার তৈমুরকে বললাম, বিদেশি গেষ্ট নিয়ে পদ্মা নদীর পাড়ে যেতে হবে। মানিকগঞ্জের দিকেই যাওয়াই ভালো। কি বলো? তৈমুর খুশি হয়ে মাথা নাড়ে। ওর বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর। হরিরামপুর তো পদ্মা নদীর কাছ ঘেঁষে।

গাড়িতে উঠে বসেছি। ইচ্ছে করেই পিছনের সিটে বসেছি। তৈমুরের পাশে বসলে স্টেলা হয়তো পিছনের সিটে নিঃসঙ্গ বোধ করবে। অবশ্য আমার অবচেতনে অন্য ভাবনাও উঁকি দিতে পারে ... একটু পর স্টেলাকে আসতে দেখলাম। লম্বা, চশমা পরা ফরসা মুখ।

কাঁধ অবধি ঢেউ খেলানো ইষৎ লালচে চুল। কালো প্যান্ট আর সাদা রঙের টি-শার্ট পড়েছে। কাঁধে কালো রঙের ব্যাগ। গলায় একটা ক্যামেরা। মেয়েটির হাঁটার ভঙ্গিটা ভারি সিরিয়াস।

মনে হয় যেন মনে মনে অঙ্ক কষছে; ইন্টেলেকচুয়াল টাইপ বলে মনে হল। স্টেলার পাশে মোনায়েম। ওর হাতে কতগুলি খাবারের বক্স। তৈমুর বক্সগুলি সামনে সিটে রাখল। স্টেলা আমার পাশে বসল।

মুহূর্তেই সুগন্ধ ছড়াল। মোনায়েম দৌড়ে যায় গেটের দিকে। তৈমুর গাড়িটা ধীরে ধীরে ব্যাক করাতে থাকে। আমি স্টেলা রিজ। কন্ঠস্বরটা মিষ্টি।

আমি শান্ত শাফায়াত। হ্যাঁ। তোমার কথা মিসেস জাহানারার কাছে শুনেছি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে স্টেলা বলল। আশা করি সবই ভালো কথা।

আমার ইংরেজি আটকে যাচ্ছে। আসলে একেবারেই অভ্যেস নেই। অবশ্যই। তবে, তুমি হলে এক দূর্লভ প্রাণী। মানে? আমি রীতিমতো স্তম্ভিত।

মানে আর কি -স্টেলা হাসল। কবিরা এ যুগে দূর্লভ প্রাণী নয় কি? ওহ্ । আমি হাসলাম। যাক। তেমন মন্দ কিছু বলেনি।

বরং সত্যি কথাই বলেছে। গাড়ি বড় রাস্তায় উঠিয়ে এনেছে তৈমুর। দিনটা শুক্রবার বলে রাস্তায় ভিড়ভাট্টা কম। ঝকঝকে রোদ। তৈমুরের নিপুন হাতে পড়ে শব্দহীন ছুটছে এলিয়ন।

স্টেলা নিজের সম্পর্কে বলে যাচ্ছে। মিষ্টার অ্যান্ড মিসেস সাঈদদের (মঞ্জু খালার মেজ মেয়ে রুনু আর রুনুর হাজব্যান্ড শরাফত ভাই) প্রতিবেশি, ওদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। বাংলাদেশিরা নাকি ভালো, ভীষণ অমায়িক। বাংলাদেশি রান্না ভালো লাগে ... শিখেছে। ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথ মেজর নিয়ে পড়ছে।

গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাফল্যের কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে কৌতূহল আছে। স্টেলা নারী বলেই মুহাম্মদ ইউনূসের প্রকল্পটা বুঝতে পেরেছে, সমর্থনও করে। এবার হাতে সময় নেই, পরের বার সময় নিয়ে আসবে। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু আর পদ্মা নদী সঙ্গে যে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য তা স্টেলা জানে। স্টেলার সংগ্রহে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে।

ওদের সর্ম্পকে কমবেশি জেনেছে ইন্টারনেট থেকে। কাল রাতে মিসেস জাহানারা বললেন, পদ্মা নদীটা এ শহরের অত দূরে নয়। তাই একবার দেখার ইচ্ছে হল। আমি সঙ্গে যাচ্ছি বলে কৃতজ্ঞ বোধ করছে। আমি বললাম, পদ্মা নদী রবীন্দ্রনাথকে বদলে দিয়েছিল।

ওহ্ । আমি আরও বললাম, বঙ্গবন্ধু পদ্মার পাড়েই বেড়ে উঠেছিলেন। ওহ্ । এরপর স্টেলাকে নিজের সম্বন্ধে কিছু তথ্য দিলাম। যেমন, আমি জন্মগত ভাবেই ভাবুক।

আমৃত্যু সেরকমই থাকতে চাই। আমি এমন এক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করি যার বিক্রি-টিকরি কম ...তারপরও পরের সংখ্যা বের করতে চাই। আমি আরও বললাম যে, আমার চেয়ে আমার জন্মভূমির কাহিনী আরও আকর্ষণীয়। মহাকাব্যসম। যেমন? স্টেলা কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

বললাম, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্র“য়ারি কিংবা ১৪ কি ১৫ এপ্রিল এ দেশে থাকলে সেটা বোঝা যাবে। স্টেলা কি বলতে যাবে-ওর সেলফোনটা বাজল। মুখ ঘুরিয়ে কার সঙ্গে চাপা গলায় কী সব বলল। ফরসা সুন্দর মুখটার অভিব্যক্তি বদলে যাচ্ছে। একটু পর ফোন বন্ধ করে স্টেলা চুপ করে রইল।

কবি বলেই আমি টের পেলাম মেয়েটা সর্ম্পকের জটিলতায় ভুগছে। আমাদের নীরবতার ফাঁকে তৈমুর গান ছাড়ল। গান গাই আমার মন রে বুঝাই মন করে পাগল পারা আর কিছু চাই না আমি গান ছাড়া ... স্টেলা গানের কথার মানে জানতে চাইল। শাহ সাহেবের ‘ফোক’ গানের কথার অর্থ যথাসাধ্য বুঝিয়ে দিলাম । স্টেলাকে সামান্য চিন্তিত মনে হল।

ফোক গান মানে গ্রামবাংলার গান। গ্রামের একজন গীতিকার লিখেছেন ... আর কিছু চাই না আমি গান ছাড়া ...বাংলাদেশ কি দারিদ্রপীড়িত একটি দেশ নয়? তা হলে? তা হলে একজন গ্রামের গীতিকার ভাতের বদলে গান চাইছে কেন? বললাম, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন বাংলার শীর্ষস্থানীয় কবি সাহিত্যিকরা। তারা কি প্রত্যেকেই সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেছেন? না। আমি যাদের কথা বলছি তারা প্রায় সবাই স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। কেবল কাজী নজরুল ইসলাম বাদে।

অবশ্য যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি বোধবুদ্ধিহীন নির্বাক ছিলেন। সে কথা তোমাকে পরে বলব। আশ্চর্য! তুমি বললে তোমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন বাংলার শীর্ষস্থানীয় কবি সাহিত্যিকরা-যারা প্রায় সবাই স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। তা হলে? বললাম, আমার কথাটা বুঝতে হলে তোমাকে অন্তত এক ঋতু এ দেশে থাকতে হবে। অনেক কথা আছে যা বলে বোঝানো যায় না।

ওহ্ । স্টেলার মুখে গভীর ছায়া ঘনালো। তৈমুর দুপুরের আগেই আমাদের পদ্মার পাড়ে নিয়ে এল। বাঁধের এ পাড়ে বির্স্তীণ মরিচ ক্ষেতের পাশে গাড়ি থামালো । গাড়ির আওয়াজে মরিচের ক্ষেত থেকে সোনালি রৌদ্রে উড়ে গেল এক ঝাঁক সবজে রঙের টিয়ে পাখি।

এই প্রথম স্টেলার চোখে মুগ্ধতা আবিস্কার করলাম। উড়ন্ত টিয়ে পাখির ছবি তুলে নিল। তারপর বলল, ফ্লিকারে আপলোড করবে ... গাড়িতে বসেই খেয়ে নিলাম। মঞ্জু খালার রান্নার হাত চমৎকার। স্টেলা ভেজিটারিয়ান।

লুচি আর নিরামিষ করেছেন। আর সেই বিখ্যাত ঘোরের সরবত। এসব মুহূর্তে কেন যেন জীবন সার্থক মনে হয় । মনে হয় জীবনের মানে আছে। অনুভূতিটা বেশিক্ষণ থাকে না।

হয়তো কোনও দুঃসংবাদ পাই। স্টেলা চামচ দিয়ে নিরামিষ খেল, তবে হাত দিয়েই লুচি ছিঁড়ে খেল। বলল, মিসেস সাঈদ মানে রুনুর কাছে শিখেছে। এশিয়ার ধ্যান, জ্যোতিষ, তন্ত্র, নিরামিষ খাবার অনেক দিন হল ইউরোপ-আমেরিকায় খুব চল হয়েছে। হয়তো সেসব কার্যকরী।

আমি কখনও চেষ্টা করিনি। খাওয়ার পর আমি আর স্টেলা বাঁধের দিকে যেতে থাকি। তৈমুর গাড়ির কাছে বসে থাকে। এই মুহূর্তে আকাশে রোদ মিইয়ে গিয়ে সামান্য মেঘ জমেছে। বাঁধের ওপর তুমুল বাতাস; বাঁধের ওপাশে চর, তারপর বিস্তীর্ণ নদী।

যতদূর চোখ যায় ঘোলাটে রঙের অথই পানি। একখানা পালতোলা নৌকা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। পদ্মা দৃষ্টি সীমায় আসতেই স্টেলার চোখে গাঢ় বিস্ময় জমল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল- দারুন! তারপর জানতে চাইল, নদীটা ইন্ডিয়া থেকে এসেছে, না? হু। দারুন! বললাম, নদীটা যতক্ষণ ইন্ডিয়ায় -ততক্ষণ নদীটার নাম গঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকে নাম হয়েছে পদ্মা।

কেন? কেন আবার-এ দেশটা বাংলাদেশ বলে। ওহ্। স্টেলা যেন অর্ন্তগত মানেটা বুঝতে পারল। হয়তো আমার কথা মনে পড়েছে ... তখন আমি ওকে বললাম, আমার কথাটা বুঝতে হলে তোমাকে অন্তত এক ঋতু এ দেশে থাকতে হবে। অনেক কথা আছে যা বলে বোঝানো যায় না।

এখন বললাম, এ নদী আরও দক্ষিণে গিয়ে সমুদ্রে মিশেছে । সেখানে মেঘনা নামে আরও একটি নদী সমুদ্রে মিশেছে। মোহনা? মোহনা। আবার যেন মোহনা না। সেই জায়গাটা না- নদী -না সমুদ্র।

কী যে বিশাল, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। অনেক গুলি দ্বীপও আছে। এর পরের বার যখন আসব, তখন যাব। স্টেলা বলল। ঠিক আছে।

বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছে একদল ছিন্নমূল মানুষ। হয়তো নদী ভাঙনের শিকার। কোনও মতে ঘর তুলেছে। একদিন এদের ঘর ছিল দোর ছিল, ছিল সামান্য উঠান, উঠানে পুঁইমাচা, ছিল প্রিয় একটা গাভী ...সব হারিয়ে এরা নিঃস্ব ... কি সান্ত্বনা দেয় এরা নিজেকে? এখানে কেউ হিসেব করে না কেমন আছে। সেই হিসেব করে কোনও লাভও নেই।

এখানে সবাই ভাসছে। অনন্ত ঢেউয়ের দোলায়। কখনও ডুবছে কখনও ভাসছে। একটা কালো রঙের ছাগলছানার পাশে একটি ন্যাংটো শিশু দাঁড়িয়ে । কি এর ভবিষ্যৎ? দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কী হবে। স্টেলা নদী দেখছে। ইচ্ছে হয় ওকে জিগ্যেস করি, এখানে দাঁড়ালে কি তোমার মনে হয় যে তুমি একটা প্ল্যানেটে আছ? আমি জানি ও কি বলবে। সিগারেট ধরালাম। দেখতে দেখতে বিকেলও ফুরিয়ে এল।

আকাশে নানা রঙের খেলা। বাঁধের ওপর ক’টা সুপারি গাছ। পাতাগুলি পাগলের মতো কাঁপছে। স্টেলার মোবাইলটা বাজল। এবারও কার সঙ্গে চাপা গলায় কী সব বলল।

ফরসা সুন্দর মুখটার স্বাভাবিক এক্সপ্রেশন বদলে যাচ্ছে। সর্ম্পকের জটিলতায় পুড়ে যাচ্ছে একুশ শতকের একটি মেয়ে। স্টেলা যখন ফোনটা অফ করে ব্যাগে রাখল তখনও ওর মুখটা থমথম করছে। চাপা স্বভাবের মেয়ে। ঠিকই সামলে নিল।

কি হয়েছে -জিগ্যেস করা যায় না। আমরা দু’জন ঠিক এখনও বন্ধু হয়েও উঠিনি। আমি বড়জোড় একজন গাইড। হ্যাঁ, গাইড। যে কি না এই মার্কিনী তরুণীকে কৌশলে জানিয়ে দিচ্ছে এই পৃথিবীরই আশ্চর্য এক লোকালয়ের বিস্ময়কর উপকথা ...যে লোকালয়ের মানুষের জীবনধারা ও চিন্তাভাবনা নিয়ে পৃথিবীর লোকের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে ...ফ্রান্সের প্যারিসের লালনের ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে।

তারপরও কি এই মার্কিনী মেয়েটাকে সবটা বলা যাবে? যায়? যদি বলি এদেশে কীর্তনখোলা নামে একটি নদী আছে, যে নদী এই পদ্মারই আরেকটি আশ্চর্য প্রবাহ। একদা যে নদীর পাড়ের এক কবি লিখেছেন ...‘হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা। ’ এই বাক্যটির মানে কি স্টেলা কোনওদিনই বুঝতে পারবে? হঠাৎই আমার সাহিত্য পত্রিকা ‘আউশ’ -এর পরবর্তী ‘মিথ’ সংখ্যার সম্পাদকীয় মনে পড়ে গেল। যেখানে আমি লিখেছি: বিশ্বজগৎ সৃষ্টির আগে জিজ্ঞেস করা হল, কে কি নেবে? নানা জাতি নানা কথা বলল। কেউ চাইল হীরের খনি, কেউ-বা চাইল আকরিক সমৃদ্ধ পাহাড়।

একটি জাতি শুধু বলল, আমরা শুধু গান নেব, গান। আর কিছু চাইনে। সৃষ্টির দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে সেই জাতিকে গান দিলেন। সেই সঙ্গে খুশি হয়ে ধানও দিলেন। অবিরল সোনালি রঙের ধান।

তো, গান ও ধানে হল মান। সৃষ্টির দেবতা খুশি হয়ে একটি নদীও দিলেন, আর একজন কবিও দিলেন। তারপর সেই নদীতে আর সেই কবিতে মিলে হল সম্মান। এই কথাগুলির মানে কি স্টেলা বুঝতে পারবে? নদী থেকে স্টেলার চোখ গেল নদী ভাঙনের শিকার ছিন্নমূল মানুষের দিকে । থমকে গেল।

অনেকটা আপন মনেই যেন বলল, ওরা ... ওরা কেমন আছে? কি বলব ভাবলাম। তারপর বললাম, এখানে কেউই হিসেব করে না কেমন আছে। সেই হিসেব করে কোনও লাভও নেই। এখানে সবাই ভাসছে। অনন্ত ঢেউয়ের দোলায়।

কখনও ডুবছে কখনও ভাসছে। ওহ্। সহসা স্টেলাকে কেমন স্থির আর শান্ত মনে হল। কী যেন ভাবছে। শেষ বেলায় পৃথিবীর এক বিস্ময়কর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে যেন নিজের জীবনের হিসেব মিলিয়ে নিয়ে চাইছে।

যেন বহুদিন হল একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে, ঠিক এই মুহূর্তে পেয়ে গেছে। স্টেলা শ্বাস টানল। তারপর গভীর আবেগে বলল, আমিও এর অংশ হতে চাই। তুমি এরই মধ্যে এর অংশ হয়ে গেছ। বললাম।

টের পেলাম বাংলাদেশের জনসংখ্যা এই মুহূর্তে একজন বেড়ে গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। তৈমুর মিস কল দিল। সন্ধ্যার আঁধার জড়িয়ে আমরা ফিরে যেতে থাকি। এখন যত জলদি ঢাকায় ফেরা যায়।

কাল সকালের স্টিমারে চাঁদপুর যাব। কাল অপরাহ্নে ওখানকার সাহিত্য সংগঠন ‘মেঘনা পাড় ’-এর উদ্যোগে উদয়ন মহিলা কমপ্লেক্সে তিন দিনের কবিতা উৎসবের উদ্বোধন । চাঁদপুর থেকে যাব নোয়াখালীর সেনবাগ। ওখানে আমাদেরই দু-জন কবি বন্ধু সৌম্যদীপ্ত সাহা আর স্বাতী রহমান ওখানকার এক প্রাথমিক স্কুলে পড়ায়-এখানে-ওখানে ঘুরে ওদের স্কুলের গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু ফান্ড জোগার করেছি। সেনবাগ থেকে যাব বান্দরবান-এর রুমায়।

ওখানে আমার এক খুমি বন্ধু থাকে। লেলং খুমি । লেলং খুমি প্রায়ই বলে ওর রুমার বাড়িতে বেড়াতে যেতে ... লেলং খুমি অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের খুমি-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষনা করছে ; ও এখন দেশেই আছে। কাজেই এখন ওর আব্দার রক্ষা করাই যায়। রাত ন’টার দিকে স্টেলাকে কলাবাগানে নামিয়ে দিয়ে মগবাজারের বাসায় ফিরেছি।

সাড়ে দশটার দিকে ফোন এল। স্টেলা ইন্ডিয়া যাওয়া ক্যান্সেল করেছে। আরও কিছুদিন থাকতে চায় এ দেশে ... ঠিক করলাম কাল সকালের স্টিমারে স্টেলাকে চাঁদপুর নিয়ে যাব। ও আগে নদী দেখুক, তারপর নদী পাড়ের আর বনপাহাড়ের বিশাল হৃদয়ের মানুষকে ও সেই মানুষের জীবনদর্শনকে ঠিকই বুঝে নিতে পারবে ... এভাবে স্টেলা নামে মেয়েটির পুনর্জন্ম হবে ...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.