উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষে বাংলা পঞ্জিকার বিষয়ে বলা হয়েছে যে,বাংলা পঞ্জিকা পূর্বে জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ হিসাবে ব্যবহৃত হত। এখন পঞ্জিকায় বর্ষফল, মাসফল, রাশিফল প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। বাংলায় পঞ্জিকা প্রকাশের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধারণা করা হয় রঘুনন্দন প্রথম পঞ্জিকা গণনা করেন। এর পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে পঞ্জিকা গণনা আরো প্রসারিত হয়।
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা প্রথম মুদ্রিত হয়। ১৯৫৭ সালে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে পঞ্জিকার সংস্কার হয়।
বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতির ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাভাষী সর্বস্তরের মানুষ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দিনটি উপযাপন করে থাকে। নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব।
অধুনা বাংলাদেশে বাঙালির পরমপ্রিয় এ উৎসবটিকেও বিভক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে নববর্ষ পালন করা হয় ১৪ এপ্রিল। কিন্তু সনাতন বাংলা পঞ্জিকায় বর্ষ গণনা শুরু ১৫ এপ্রিল থেকে। উভয় ক্ষেত্রেই নববর্ষ মানে 'পহেলা বৈশাখ'। আমাদের এ অঞ্চলে তিন ধরনের পঞ্জিকার প্রচলন আছে।
গ্রেগরীয় পঞ্জিকা, ইসলামী পঞ্জিকা ও বাংলা পঞ্জিকা। পঞ্জিকা সংস্কারের নামে বাংলাদেশ একতরফাভাবে শুধু বাংলা পঞ্জিকাকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। অথচ একতরফাভাবে বাংলা পঞ্জিকা বিকৃত করার অধিকার কারো নেই। কেননা, বাংলা সন ও পঞ্জিকার একটি ইতিহাস আছে। সংস্কারের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলা পঞ্জিকা যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত নয়।
পঞ্জিকার বৈজ্ঞানিক সংস্কারের গুরুদায়িত্ব যেন বাংলাদেশের। তা যদি হয় তাহলে তো সর্বপ্রথম ইসলামী পঞ্জিকায় হাত দেওয়া উচিত ছিল। কেননা, সময় গণনার ক্ষেত্রে চান্দ্র পদ্ধতির ইসলামী পঞ্জিকা তা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। পঞ্জিকা সংস্কারকরা সে ক্ষেত্রে ইসলামী পঞ্জিকা সংস্কারের উদ্যোগ নিলেন না কেন। বাংলা পঞ্জিকা মোটেই অবৈজ্ঞানিক নয়।
নিউটনীয় বিজ্ঞানের নিরিখে বিচার করলে সামান্য গরমিল দেখা যায়। যে যুগে কোনো টেলিস্কোপ ছিল না, জ্যোতির্বিজ্ঞান বিকাশ লাভ করেনি, তখন শুধু আকাশ প্রাচীন ঋষিরা যে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান থেকে তিথি-লগ্নের হিসাব রেখেছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। পঞ্জিকা সম্পূর্ণরূপে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়। তাই বাংলা পঞ্জিকার বৈজ্ঞানিক সংস্কার সাধনই যদি উদ্দেশ্য হতো, তাহলে পঞ্জিকা সংস্কার কমিটিতে কোনো না কোনো বিজ্ঞানী অবশ্যই থাকতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের যে পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতে ভাষাবিদ, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, জ্যোতিষী অনেকে ছিলেন।
শুধু কোনো বিজ্ঞানীর স্থান হয়নি সে কমিটিতে। ভারতেও একবার পঞ্জিকা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তার জন্য কমিটি করা হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহার নেতৃত্বে। সেখানে আমাদের পঞ্জিকা কমিটি গঠিত হয়েছিল ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে। বিজ্ঞানীবিহীন এ কমিটির পক্ষে যতটুকু করণীয়, তা তাঁরা করেছেন।
পহেলা বৈশাখকে ১৪ এপ্রিলের সঙ্গে যুক্ত করে, বাংলা পঞ্জিকার মৌলিক কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে শুধু দিন-তারিখসংবলিত সাহা কমিটির কয়েকটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সুপারিশ করেই তাঁরা তাঁদের কর্তব্য সম্পন্ন করেছেন। সামান্য এ পরিবর্তনটুকুই কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বাংলাদেশের অধিবাসী হিসেবে আমরা ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশি নববর্ষ পালন করে থাকি। কিন্তু যারা ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালিত্বে বিশ্বাসী তাঁরা আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নববর্ষও উদযাপন করে থাকেন। অর্থাৎ নববর্ষ উদযাপনে আমরা খণ্ডিত।
জাতীয় সাংস্কৃতিক দিনগুলোতেও দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি। রবীন্দ্র জয়ন্তীর কথাই ধরা যাক_রবীন্দ্রনাথের জন্ম সনাতন বাংলা পঞ্জিকার ২৫ বৈশাখ, যে দিনটি বাংলাদেশি পঞ্জিকার ২৬ বৈশাখ। অর্থাৎ বাংলাদেশি ২৫ বৈশাখে আমরা বলতে পারি না 'আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন'।
যেমন সনাতন পঞ্জিকার ২৫ বৈশাখে যদি পূর্ণিমা হয়, তাহলে কি বাংলাদেশি ২৫ বৈশাখেও পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যাবে? নাকি তার জন্য ২৬ বৈশাখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? অর্থাৎ রবীন্দ্রজয়ন্তী হিসেবে বাংলাদেশি ২৫ বৈশাখের কোনো জৌলুশ নেই। অনুরূপভাবে বাংলাদেশি পঞ্জিকার ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২২ শ্রাবণ প্রভৃতি দিনও তাৎপর্যহীন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ব্যবহৃত হয় গ্রেগরির পঞ্জিকা। মুসলমানরা ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করেন ইসলামী পঞ্জিকা। হিন্দু-বৌদ্ধরা তাঁদের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে অনুসরণ করে থাকেন সনাতন বাংলা পঞ্জিকা। তাহলে বাংলাদেশি সংস্কৃত পঞ্জিকা কার জন্য? একমাত্র সংস্কৃতির বিভক্তিকরণ ছাড়া এ পঞ্জিকার কোনো ভূমিকা নেই। কাজেই এ পঞ্জিকা বহাল রাখা সময় ও কাগজের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমরা যদি অভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি ধরে রাখতে চাই তাহলে বাংলাদেশি কথিত সংস্কৃত পঞ্জিকা বাতিল করাই যুক্তিযুক্ত।
একটি স্বাধীন দেশের অধিবাসী হিসেবে আমরা আমাদের নিজস্ব বিজ্ঞানসম্মত যুগোপযোগী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি পঞ্জিকার অধিকারী হতে চাইতেই পারি। সনাতন পঞ্জিকা খণ্ডিত না করেই তা করা সম্ভব। বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং বাংলা ঋতু-বৈচিত্র্যের মতো সংগতি রেখে কিভাবে একটি আধুনিক পঞ্জিকা প্রণয়ন করা যায়, সে বিষয়ে বাংলা একাডেমীর বিজ্ঞান পত্রিকায় (১৯৯৮ সন, সংখ্যা ১) কিছু আলোচনা করা হয়েছে। তবে নতুন পঞ্জিকা প্রণীত হলেও সনাতন বাংলা পঞ্জিকা আমাদের সংরক্ষণ করতেই হবে, যাতে আগামী দিনের প্রজন্ম তাদের ঐতিহ্যকে জানতে পারে।
কেননা, যে জাতি নিজের ঐতিহ্যকে জানে না, সে জাতি কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।