বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
বিকেলে অফিসে বসে কাজ করছি। জলতরঙ্গ বেজে উঠল। জহিরুলের ম্যাসেজ।
লিখেছে: ‘জরুরি কথা আছে, সন্ধ্যার পর রহমানিয়ায় আসিস। ’ আমার ভুরু কুঁচকে ওঠে। জহিরুলের সঙ্গে অনেকদিন আমার দেখা হয় না। জরুরি কথা আছে লিখেছে। ও কোনও সমস্যায় পড়ল কি? সামান্য অস্বস্তি বোধ করতে থাকি।
সন্ধ্যার পর পৌঁছলাম রহমানিয়ায় । রেস্তোঁরাটি আমাদের অনেক দিনের পুরনো আড্ডার জায়গা। কলেজে পড়ার সময় থেকেই রহমানিয়ায় আড্ডা শুরু। এই রেস্তোঁরাটি আছে বলেই আজও কলেজ জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক টিকে আছে। গত কুড়ি বছরে রেঁস্তোরার পরিবেশ খুব একটা বদলায়নি।
ঢোকার মুখে ভিড়। মসলার গন্ধ মাখানো ধোঁয়া, শিক কাবাবের ম ম তুর্কি গন্ধ।
ভিড় ঠেলে পিছনের দিকে বসলাম। যাঃ, গরম। মুহূর্তেই সেদ্ধ হয়ে গেলাম।
জহিরুল এখনও এসে পৌঁছায়নি। বসতেই ইসমাইল ছুটে এল। পুরনো পরিচিত বেয়ারা। ওকে এক লাচ্ছি দিতে বললাম। এখান থেকে ফার্ম গেটের ওভারব্রিজটা চোখে পড়ে।
বিল বোর্ডের আলো জ্বলে উঠেছে ... একটা গান বাজছে ...হিন্দী ...
ইসমাইল লাচ্ছি দিয়ে গেল। জিনিসটা রহমানিয়ার স্পেশাল। ঠান্ডা মিষ্টি তরলে চুমুক দিই। হঠাৎই চোখে পড়ল উলটো দিকের টেবিলে শ্যাওলা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা ভারি মিষ্টি চেহারার শ্যামলা মতন একটা মেয়ে বসে আছে। বয়স সতেরো-আঠারোর বেশি হবে না বলে মনে হল।
মেয়েটির বসার ভঙ্গিটা কেমন আরষ্ঠ। তার মুখোমুখি কালো টি-শার্ট পরা একটি বাইশ-তেইশ বছরের ছেলে বসে । ছেলেটি মেয়েটিকে কী যেন বোঝানোর চেষ্টা করছে। মেয়েটির শ্যামলা গম্ভীর মুখে একমুঠো রাগ জমে আছে। ছেলেটির মুখেচোখেও দিশেহারা ভাব।
ছেলেটি কি জানে- মেয়েরা যখন বুঝতে চায় না ... তখন বুঝতে চায় না।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ঠিক ওই টেবিলে কত বছর আগে আমার মুখোমুখি বসে ছিল জলি। ইয়াসমিন নাহার জলি। কত কথা হত জলির সঙ্গে।
স্বপ্নের কথা। জলি আমার ওপর রাগও করত। তখন জলির শ্যামলা গম্ভীর মুখে একমুঠো রাগ জমে থাকত। তখনই শিখেছিলাম: মেয়েরা যখন বুঝতে চায় না ... তখন বুঝতে চায় না। পরে রাগ কেটে গেলে সম্পূর্ন উলটো আচরণ করবে।
শুনেছি জলি এখন কানাডায়; ঘরসংসার করছে ... এও সত্য। অনেক বছর আগে জলি যখন ওই টেবিলে আমার মুখোমুখি বসে স্বপ্নের জাল বুনত ... সেও তো সত্যিই ছিল। আমি আমার বউ তুলিকে নিয়ে মোটামুটি সুখি, তবু মাঝে-মাঝে জলির কথা মনে পড়ে। তখন মনটা উদাস হয়ে ওঠে।
আহা, এ জীবনের আকাশে-বাতাসে কত বিরহ।
হঠাৎ জহিরুলকে ভিড় ঠেলে আসতে দেখলাম। অনেকদিন পর দেখছি ওকে। শ্যামলা রঙের মাঝারি উচ্চতার স্বাস্থ্যবান একটা ছেলে, ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল । কালো প্যান্ট আর মেরুন রঙের শার্ট পরেছে। আগের চেয়ে খানিকটা শুকিয়ে গেছে মনে হল, মুখচোখে ক্লান্তির ছাপ স্পস্ট।
জহিরুল আমার মুখোমুখি বসল । শ্যামলা মুখে ঘাম জমে আছে। পকেট থেকে রুমাল বার করল। ও একটা কোরিয়ান বাইং হাউসে চাকরি করে। গুলশানে অফিস।
বছর দুই হল বিয়ে করেছে -ওর বউ নীপা- রাজশাহীর মেয়ে, দেখতে শুনতে ভালেই, বাড়ির কাছেই একটা কিন্ডারগার্ডেনে পরায়-জহিরুলরা থাকে নাখালপাড়ায়।
ইসমাইল এল।
লাচ্ছি। বললাম।
ইসমাইল অর্ডার নিয়ে চলে যায়।
আমি বললাম, বল, কী সমস্যা।
সাদা একটা রুমাল বের করে মুখ ও কাঁধের ঘাম মুছে নিল। মুখে মিহিন না-ছাঁটা দাড়ি, নিয়মিত নামাজ পরে। বিয়ের পর সিগারেট ছেড়েছে, আমাদের মধ্যে জহিরুল-যাকে বলে আইডিয়াল বয় । একটু পর ঝুঁকে ফিসফিস করে জহিরুল বলল, নীপা আমাকে সন্দেহ করে।
হোওয়াট! সন্দেহ করে মানে! আমি অবাক। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে জহিরুলই সবচে ক্লিন। রিলিজিয়াস। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নিয়মিত কাকরাইল মসজিদে যেত। ওর তুলনায় আমাদের চরিত্রের ইতিহাস ততটা সুবিধের নয়।
এমন ছেলেকে নীপা সন্দেহ করে। আশ্চর্য!
জহিরুল বলল, নীপার অভিযোগ- আমি নাকি চরিত্রহীন, লম্পট, আমার নাকি অন্য মেয়ের সঙ্গে সর্ম্পক আছে।
আমি বজ্রাহত! ওহ্! না! নীপার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! আমি সিগারেট ধরালাম। হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে। বন্ধুরা সবাই জহিরকে ভালোবাসে।
ওর কাছে এলে কেমন শান্তি পাওয়া যায়। শান্তশিষ্ট সুবোধ একটি ছেলে। সবার বিপদ-আপদে এগিয়ে আসে। এরকম একটি ছেলে কীসে মধ্যে পড়ল।
ইসমাইল লাচ্ছি দিয়ে গেল।
জহিরুল অন্যমনস্ক হয়ে চুমুক দেয়। তারপর বলে, গত সপ্তাহে কাজের মেয়েটাকেও তাড়াল। এখন মাঝবয়েসি একটা ছুটা ঝি রেখেছে, সকাল ন’টার পর দু-ঘন্টার জন্য আসে, দশটার পর। সকালে
নাশতার দেরি হয়ে যায়। সংসারের বাকি কাজ নীপাই করে।
কাজের মেয়ে নাকি রাখবে না।
হুমম। ভাবনার কথা। নীপার হল কি? ভাবছি। নীপার অভিযোগ যে সত্যি নয় তা জানি।
তাহলে? নীপা এসব উদ্ভট কথা বলছে কেন? কেন ও বিশ্বাস করছে জহির চরিত্রহীন? কেন? শুনেছি নীপা প্রেগনেন্ট ... এমন একটা সময়ে ...
জহিরুল চুপ করে আছে। লাচ্ছিতে মাঝেমধ্যে চুমুক দিচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে সুস্বাদু তরলটা উপভোগ করছে না। ওর মুখে এই ২/১ বছর আগেও এক ধরনের খুশির আভা দেখেছি। এখন সেটা নিভে গেছে।
চাকরিটা ওর জীবনীশক্তি শুষে নিচ্ছে। ঘরের বউয়ের আদর-সোহাগ পেলে না-হয় পুষিয়ে যেত। সেটা হচ্ছে না। কিন্তু নীপা এমন অ্যাবনরমাল আচরণ করছে কেন? ওর সঙ্গে কি আমার কথা বলা উচিত?
আড়চোখে দেখলাম শ্যাওলা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি আর কালো রঙের টি-শার্ট পরা ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়েছে। চলে যাচ্ছে।
দুজনের রফা হয়নি মনে হল। জলির সঙ্গে আমারও রফা হত না প্রায়ই। তারপরও আমরা সুখিই ছিলাম। হঠাৎই আমার মনে হল ওই মেয়েটি দেখতে ঠিক জলির মত। (মহাকাল এ দৃশ্যটি আজ আমাকে দেখাল-যা কাউকে বলা যাবে না) জলিও শ্যাওলা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরত, সাদা শিফনের ওড়না ।
জলির কথা মনে পড়লে মনটা উদাস হয়ে ওঠে। আহা, এ জীবনের আকাশে-বাতাসে কত বিরহ ...
জহিরুলের ফোন আসে। কার সঙ্গে যেন ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলল কিছুক্ষণ। তারপর ফোন অফ করে চাপা ক্ষোভের সুরে বলল, শালার চাকরি। এখন আবার অফিস যেতে হবে।
শিপম্যান্ট চলছে। অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে কখনও রাত এগারোটা বেজে যায়। নীপা বলে আমি নাকি অন্য প্রেমিকার বাড়ি সময় কাটাই ...
হঠাৎ আমার জলির একটা কথা মনে হল। অনেক দিন আগের কথা, যখন জলিকে নিয়ে এই রেস্তোঁরায় বসতাম। জলি একদিন আমায় বলল- আমাকে ‘বেগ’ করতে হবে।
কথাটা শুনে আমি অবাক। কেন তোমাকে বেগ করতে হবে? বেগ মানে অনুনয় বিনয় করা। তো সেটা আমায় করতে হবে কেন? জলি চুপ করে থাকে। বুঝলাম ও অপেক্ষা করছে। আমি হেসে বললাম, আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি বেগ করলাম।
জলির শক্ত মুখটা নরম হয়ে এল, খুশিতে ভরে উঠল সে মুখ। সে সময় আমি ভারতীয় ‘তন্ত্রের’ ওপর একটা বই পড়ছিলাম। এক কথায় তন্ত্র মানে নারীর রহস্যময় শক্তিকে স্বীকার করে নেওয়া। তন্ত্রের সাধনা যারা করে তারাই তান্ত্রিক। সংসারে সুখ-শান্তি বজায় রাখার জন্য সব পুরুষকেই কখনও না কখনও তান্ত্রিক হতেই হয়, নারীর রহস্যময় শক্তিকে স্বীকার করে নিতে হয়।
সে সব মনে করে আমি বললাম, আচ্ছা জহির, তুই এক কাজ কর।
বল।
তুই নীপার কাছে ক্ষমা চেয়ে নে।
আমি ক্ষমা চাইব? প্রায় চিৎকার করে ওঠে জহির। শ্যামলা মুখটা গনগনে হয়ে উঠেছে।
বলে, কেন? আমি তো কোনও অন্যায় করিনি।
আমি হাত তুলে বললাম, আহা, সে তো বুঝলাম। তুই সংসারে সুখশান্তি চাস কি না বল?
চাই।
তাহলে তুই আজই নীপার কাছে ক্ষমা চেয়ে নে। তুই অন্যায় করিসনি বলে ক্ষমা চাইবি না-এটা হল যুক্তির কথা।
মেয়েদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হলে কখনও-কখনও যুক্তি বিসর্জন দিতে হয়। তুই ক্ষমা চাইলে দেখবি নীপা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
জহির চুপ করে থাকে। একটু পর বলল, এতে কাজ হবে? তুই তো অনেক বইটই পড়িস।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হবে।
জহিরের আবার ফোন এল। ও তাড়াহুড়ো করে উঠে চলে গেল।
কয়েক দিন পর জহিরুলের মেসেজ পেলাম। লিখেছে ...ক্ষমা চাওয়ার পর নীপার আচরণ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।