যখন থামবে কোলাহল
অসুস্থ স্ত্রী কল্যাণীর (৫৫) সকল পাপ স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে নিয়ে চিরতরে মুক্তি দিতে স্বামী সুনীল চন্দ্র মজুমদার (৬৬) তাকে ভাসিয়ে দিলেন কর্ণফুলীর জলে। তিনি দেখছেন কল্যাণী ভেসে যাচ্ছেন, হাত এগিয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের প্রত্যাশায়। কিন্তু না, হাত বাড়িয়ে দেননি সুনীল, উল্টো তাকে ধাক্কা দিয়ে আরো গভীরে তলিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। গত ২ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মাহ্বুবুর রহমানের আদালতে স্ত্রী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত স্বামী সুনীল ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এ কথা বলেন। তার মুখে স্ত্রী হত্যার কারণ, পরিকল্পনা ও পদ্ধতি শুনে ম্যাজিস্ট্রেট মাহ্বুবুর রহমান, অফিসার ইনচার্জ (ওসি) পতেঙ্গা আবুল কালাম এবং এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আজাদের অভিমত ছিল তাদের কর্মজীবনে এ ধরনের ঘটনা প্রথম।
স্ত্রীর প্রস্তাব, স্বামীর সম্মতি :-
জানা গেছে, সন্দ্বীপ মগধরা ইউনিয়নের মৃত স্বপ্নচরণ মজুমদারের পুত্র সুনীল চন্দ্র মজুমদার (৬৬)। বর্তমানে অবসরে আছেন। তাঁর স্ত্রী কল্যাণী দীর্ঘ আট বছর ধরে অসুস্থ ও শয্যাশায়ী। তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও মনো বৈকল্যে ভুগছিলেন। তাঁদের ২ ছেলে ১ মেয়ের সবাই বিবাহিত।
বড় ছেলে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় কর্মরত। ছোট ছেলে প্রকৌশলী। ঢাকায় থাকেন। অবসরের পর সুনীল ও তাঁর স্ত্রী ঢাকায় ছোট ছেলের বাসায় থাকতেন। আদালতে তিনি জানান, মাস ছয়েক আগে একদিন তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলছিলেন, “তুমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার আগে আমার একটা গতি করে যেও।
সুনীল জানতে চান, কী করতে হবে? তার নামে টাকা বা বাড়ি লিখে দিতে হবে? কল্যাণী বললেন, ওসব কিছু নয়, আমি তোমার হাতেই মরতে চাই। সুনীল চন্দ্র এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবতেন। তাঁর মাথায়ও বিষয়টি গেঁথে গেল, তিনি ভাবছিলেন, তাঁর ছেলে ও ছেলের বউদের কেউই তাঁর অবর্তমানে তাঁর স্ত্রীকে দেখা শোনা করবে না। তিনি থাকতেইতো করছে না। ছেলে বউরা শাশুড়ির জন্য কিছু করলে এ বয়সে তাঁকে অসুস্থ স্ত্রীর কাপড় ধুতে হতো না, মলমূত্র পরিষ্কার করতে হতো না।
তিনি নিজেও স্ত্রীর প্রস্তাবের সাথে একমত হলেন।
মৃত্যুর পূর্বে আদিনাথ মন্দির দর্শন :-
সুনীল চন্দ্র আদালতকে জানায়, ঐদিনের পর থেকে কল্যাণী প্রায়ই তাকে অনুরোধ করতেন পৃথিবী থেকে বিদায় করার জন্য। স্ত্রীর মন পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করে স্বামী-স্ত্রী দু’জন মহেশখালি আদিনাথ মন্দির ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঢাকাস্থ ছোট ছেলের বাসা থেকে ট্রেনযোগে তাঁরা ২৮ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম আসেন। বহদ্দারহাট থেকে বাসে কক্সবাজার যান।
সেখান থেকে স্পীডবোটে চেপে মহেশখালী পৌঁছেন। আদিনাথ মন্দিরের বারান্দাতেই তারা রাত যাপন করেন। পরদিন ২৯ মার্চ সকালে বহদ্দারহাট চলে আসেন। আনোয়ারাস্থ সিইউএফএল জেটিতে সুনীলের এক ভাই থাকেন। ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে আনোয়ারা রওনা হন।
কিন্তু গিয়ে শোনেন তার ভাই সপরিবারে ঢাকা গেছে। ক্লান্ত স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে একটি চায়ের দোকানে বসেন তিনি নাস্তা করতে। স্ত্রীর ইচ্ছেতে সিইউএফএল জেটিতে যান এবং নৌকা যোগে তাঁরা ১৫ নং ঘাটে পৌঁছেন।
ভাসিয়ে দে রে প্রাণের স্বজনেরে :-
পাড়ে যখন সুনীল দম্পতি পৌঁছেন তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। নদীতে তখন পূর্ণ জোয়ার।
এ সময় কল্যাণী তাকে বলেন, তুমি আমাকে জোয়ারের পানিতে ভাসিয়ে দাও। সুনীলের দাবি, তখন তার ক্লান্তি, স্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ-বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল। দুজন নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন। এক বুক পানিতে নামতেই, কল্যাণী নিজেই জোয়ারের পানিতে ভাসিয়ে দেন নিজেকে। সুনীলও তাকে হাত দিয়ে ঠেলে দেন।
তিনি ভাবছিলেন যেতে যখন চায়, চলে যাক্। সেও শান্তি পাবে, আমিও শান্তিতে থাকবো। আমার আগে তার চলে যাওয়ার ইচ্ছেটাও পূর্ণ হবে।
কল্যাণী ভেসে যাচ্ছেন, সুনীল দেখছেন :
কল্যাণী জোয়ারের টানে ভেসে যাচ্ছেন। হঠাৎ বলেন, তুমিও চলো।
সুনীল বলেন, তুমি যাচ্ছ যাও, আমিও চলে গেলে ছেলে মেয়েরা অসহায় হয়ে পড়বে। আমার আগে গিয়ে যদি উদ্ধার পাও, তবে যাও। আমি তোমার সব পাপ মাথায় নিলাম। তিনি আরো বলেন, অন্ধকারে তার হাত নাড়া দেখছিলাম। তার মাথা নড়ছিল।
ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। সুনীল উঠে আসেন।
মানুষের কাছে মিথ্যে বলেছিলেন :
সুনীলের ভেজা-কর্দমাক্ত শরীর দেখে সেখানকার মানুষ কারণ জানতে চায়। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীকে বাসে তুলে দিয়েছি। এ সময় হঠাৎ দু’জন লোক দুই পাশ থেকে তাকে জোর করে ধরে পানিতে ফেলে দেয়।
এ কথা শুনে স্থানীয় এক দোকানদার তাকে লুঙ্গি ও শার্ট দেন। তিনি সেগুলো পরে প্রথমেই বড় ছেলেকে এ সংবাদ জানান। তিনি বলেন, তোমার মা আধা ঘন্টা আগে পর্যন্ত ছিল, এখন নেই। খবর দেয়া হয় উত্তর নালাপাড়ায় থাকা তার মেয়ের জামাইকে। জামাই তাকে শহরে নিয়ে আসেন।
এর মধ্যে ১৫নং ঘাটে মহিলার লাশ খুঁজে পেলে পতেঙ্গা থানা পুলিশকে জানানো হয়। সাব ইন্সপেক্টর শামীম আজাদ লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন।
নিজেই নিজেকে দায়ী করেন :
মেয়ে জামাই একটু একটু করে শ্বশুরের কাছ থেকে পুরো তথ্য জেনে নেন। অতঃপর দু’জন পতেঙ্গা থানায় গিয়ে কল্যাণীর লাশ শনাক্ত করেন এবং পুরো ঘটনা খুলে বলেন ওসি (পতেঙ্গা) আবুল কালামকে।
পুলিশের বক্তব্য :
ওসি আবুল কালাম বলেন, আমরা ধারণা করছি, নানাভাবেই তিনি সংসার ও স্ত্রী পুত্র কন্যাদের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।
একই সাথে তাঁর অবর্তমানে স্ত্রীর কী দুর্গতি হবে, তা ভেবেও হতাশ হয়ে পড়েন। এ থেকে তিনি ঘটনাটি ঘটাতে পারেন। ওসি আরো বলেন, তার দুই ছেলে উচ্চ শিক্ষিত। কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে তারা বেশ স্বাভাবিক ছিল। বড় ছেলে হাসছিল, অনেকটা যা হবার হয়ে গেছে এ ধরনের।
এ থেকে ধারণা করা যায়, সুনীল চন্দ্র কতোটা আপসেট ছিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এস আই শামীম বলেন, সুনীল চন্দ্র আদালতে কোন কিছুই লুকানের চেষ্টা করেন নি। উল্টো তাকেও মেরে ফেলতে অনুরোধ করেন। আদালতে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, যতদিন বাঁচবো মনের আগুনে পুড়বো। আইনে যদি খুনের বদলে খুন দেয়া থাকে, তবে সেই শাস্তি আমাকে দেয়া হোক।
আমি মুক্তি চাই।
সুত্র: দৈনিক আজাদী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।