আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বোকাখোকার বোকা বিষয়ক বোকা বোকা ভাবনা



কিছুদিন আগে একটা বিয়েতে গিয়েছিলাম। গেট ধরা শেষে কয়েকজন কিশোর-কিশোরীকে দেখলাম রাগে গড়গড় করছে। ব্যাপারটা কি? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বর পক্ষ তাদের ভালো মত বোকা বানিয়েছে। পরপর সুদৃ্শ্য তিন-তিনটে বক্স তাদের হাতে ধরিয়ে নিশ্চিত করেছে ভেতরে ৩০০! আছে। পিচ্চি গুলান মনে করেছে ৩০০ ডলার, খুলে দেখে ৩০০ বাংলাদেশী এক টাকার কয়েন।

ততক্ষণে বর মঞ্চে!!! বিয়েতে বর বা কনে পক্ষকে বোকা বানানো একটা আনন্দের বিষয় হয়ে গেছে। কিন্তু প্রবাসে বেড়ে ওঠা ইয়ুথদের মেঘ-কালো মন দেখে কেন জানি মনে হলো আমাদের বোকা বানানো এই সংস্কৃতিতে তারা একদম খুশি নয়, তাদের কেউ বোকা বানাক এটা বুঝি তাদের একদম না পসন্দ। আমরা সকলেই জীবনের বাঁকে বাঁকে কম-বেশী বোকামী করি। পরে আবার নিজের বোকামোর জন্য খুব লজ্জিতও হই। নিজের চুল নিজের ছিঁড়ি।

তারপরে আবার কখন-কিভাবে যেন একই বোকামো করে বসি। কেউ কিন্তু কখনো ইচ্ছে করে, ছক-কষে বোকামো করেনা। বোকামো হয়ে যায় । জীবনে বোকামো করেনি এমন লোকের সংখ্যা খুব কমই পাওয়া যাবে। বোকামি করা অপছন্দ হলেও অনেকেই আবার বোকা থাকতে বা বোকা হতেও ভালবাসেন।

আমিও মাঝে মাঝে কেন জানি ভাবি বোকা হওয়াইতো ভালো। আমরা যারা এমন বোকা হতে চাই, তারা আসলে বোকামী বলতে সরলতাকে বুঝি। মিথ্যা, ঠকবাজীর বিপরীতে সৎ ও সততাকে বুঝি। আজকের সময়ে কেন জানি বোকা থাকা মানে সৎ থাকা । বোকা হওয়া মানে মিথ্যার মারপ্যাঁচ ছাড়িয়ে সত্য-সরল হওয়া।

বিপরীতে চালাক মানেই বুঝি শঠতা, অপরকে ঠকানো, পাপে পূর্ণ জীবন। তাইতো শহরে এসে হঠাৎ চালাক হয়ে ওঠা ছেলেও মায়ের কাছ থেকে লুকোতে চায় তার চালাক হয়ে ওঠার গল্প। সবার মতো মায়ের কাছে সেও আজীবনের বোকা-খোকা হয়ে থাকতে চায়। " সুপের সাথে সসটা এখন তার ছেলেটা মেশাতে জানে কান্নাগুলো হাসির বুকে তার ছেলেটা লুকোতে জানে এই পাপগুলি সব গোপন করে আমার কথা বন্ধুরে তুই মাকে বলিস বাড়ি ফিরে বন্ধুরে তুই মাকে বলিস" কারণ মায়ের কোলটাই যে সন্তানের একমাত্র বিশুদ্ধ আশ্রয়। একদম কৃত্রিমতা-মুক্ত, সরলতা আর ভালবাসায় টইটুম্বুর।

যারা বোকা থাকতে চায় তারা কিন্তু আবার কেন জানি বোকা বনতে রাজী না। যারা তাদের বোকা বানায় কিংবা বানাতে চায় তাদের উপর সহজ-সরল বোকা মানুষগুলোর বেজায় রাগ। তারা চায় পৃথিবীর সকল মানুষ তাদের মতো বোকা হোক কিন্তু কেউ কাউকে বোকা না বানাক। যারা অপরকে বোকা বানাতে চান তার নিজেদের অতি চালাক ভেবেই কাজটি করেন। এতে সাময়িক সাফল্য এলেও আখেরে কিন্তু তাদের ক্ষতিই হয়, এ সত্যটুকুন আমাদের চালাক মাথারা কখনোই বুঝতে পারেন না।

এ ব্যাপারে বহুল আলোচিত রাখাল ছেলের গল্প কে না জানে? রাখাল ছেলে বনের ধারে গরু-মেষ চড়াতে যেত। একদিন তার মাথায় খেলে গেলো দুস্টু বুদ্ধি। সে গ্রামের মানুষকে বোকা বানিয়ে আনন্দ পেতে চাইল। এক দুপুরে বাঘ বাঘ করে জুড়ে দিল চিৎকার। গ্রামের লোকজন যার যা আছে তাই নিয়ে ছুটে এলো রাখালকে বাঘের হাত থেকে বাঁচাতে।

এসে দেখে রাখাল তাদের বোকা বানিয়েছে। গ্রামের মানুষের খুব রাগ হলো। তারা বোকা বলে কেউ তাদের বোকা বানাক এটা তাদের একদম পছন্দ হলোনা। একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এলো। রাখাল আগের মতোই চিৎকার করলো।

এদিন কেউ আর তাকে বাঁচাতে এলোনা। কেউ বোকা হতে চাইলোনা। কিন্তু সকলকে বোকা বানাতে চাওয়া বেচারা রাখাল হলো বাঘের খাবার। যারা অপরকে বোকা বানিয়ে আনন্দ পেতে চায় তাদের শেষটা বুঝি এমনি করুণ হয়। মানুষকে বোকা বানানোর ইতিহাস ততটাই প্রাচীন, যতটা প্রাচীন মানুষের ইতিহাস।

শয়তান আদমকে বোকা বানিয়ে নিষিদ্ধ ফল খাইয়েছিল। আদম নিজের বোকামী বুঝতে পেরে পরে ক্ষমা চেয়ে নিলেও শয়তান মানুষকে বোকা বানানোর চাকুরিতেই স্থায়ী হল। বোকামি করে ভুল করেও আদম হলো সৃস্টির সেরা জীব আর আদমকে বোকা বানিয়ে শয়তান হলো নিকৃস্ট কীট। শয়তানে সেই পথ ধরে যারা আদম সন্তানকে বোকা বানাতে চায় তারা শয়তান এন্ড কোং এর চাকুরে কিনা জানিনা, তবে তারা যে শয়তানের সাথে একই পেশায় নিয়োজিত এতে কোন সন্দেহ নাই। তারপরেও আমরা অপরকে বোকা বানিয়ে আনন্দ পাই।

অপরকে বোকা হতে দেখে খিলখিলিয়ে হাসি। যাকে বোকা বানানো হলো, তার বেদনা আমাদের স্পর্শ করেনা। তার দুঃখগুলো আমাদের কাঁদায়না। আমাদের নাটকগুলোও মাঝে মাঝে মানুষকে বোকা বানানো শেখায়। কোন একটা নাটকে অপি করিমকে দেখেছি ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যার কসরত করতে।

বুয়ার মুখে খবর শুনে বাবার চরিত্রে অভিনয় করা আবুল হায়াত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলে অপি হাসতে হাসতে নিচে নেমে এসে বলে বাবা তোমাদের বোকা বানাতে এটা করেছি। বাবা-মাকে বোকা বানাতে ফাঁসির মঞ্চ রূপায়ন? আমাদের শিশু-কিশোররা, ক্ষুদে দর্শকরা, এ থেকে কি শিখছে? কেউ যদি মজা করে একই কায়দা অনুসরণ করতে যায়, এতে অনাকাংখিত মৃত্যু হবেনা তার গ্যারান্টি দেবে কে? টেলিভিশন একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম। নতুন প্রজন্মের উপর টিভি নাটকের প্রভাব ও আবেদন অনেক বেশী। যারা নাটক লিখেন, পরিচালনা করেন, অভিনয় করেন তারা কি সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভাবেন, নাকি আমাদের বোকা বানিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করাতেই ব্যস্ত থাকেন? অনেকে আবার আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেও জাতিকে বোকা বানানোর প্রচেষ্টা করেন এবং এতে তারা এতটুকুন লজ্জাও বোধ করেন না। খবরে প্রকাশ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ২০০৭-০৮ সম্মান প্রথম বর্ষে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তি হচ্ছে ইচ্ছুক আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকার ছিল গতকাল শনিবার।

আবেদনকারী ছিল ১০০। এদের কাগজ পত্র দেখে কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হলে তাদের বলা হয় "যারা ভুয়া কাগজ পত্র জমা দিয়েছেন, তারা চলে যান, নাহলে পুলিশে দেয়া হবে। " এ ঘোষণার পরে ৯১ জন ভুয়া আবেদনকারী চলে যান। বাকি নয়জনকে ভর্তি করা হয়। সংখ্যাটি রীতিমত আঁতকে ওঠার মত।

১০০ জনে ৯১ জন ছাত্র-ছাত্রী ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হতে তৈরী ? জাতি হিসেবে কতটা দৈন্য হলে আমাদের প্রজন্ম এমন পথে পা বাড়াতে পারে। অপরকে বোকা বানানোর এ সংস্কৃতি থেকে কবে আমরা মুক্তি পাবো? (সংবাদটি ২০০৯ সালের ২৯শে মে'র প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত। ) বছর ঘুরে আমাদের দুয়ারে এখন পয়লা এপ্রিল, অথবা পয়লা এপ্রিলের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আমরা। এপ্রিল ফুল তেমনি অপরকে বোকা বানানোর আরেকটি দিন। অনেক মজা হয়তো হবে এ দিন, আবার বরাবরের মতো অনেক দুর্ঘটনার জন্মও দেবে।

ভাবি, মানুষকে বোকা বানিয়ে আনন্দ পাওয়ার এ চেস্টা কতটুকু মানবিক? এপ্রিল ফুল পালন করা আসলেই কতটা যৌক্তিক? আসুন, সবাই মিলে বোকা হই, অপরকে বোকা বানানো থেকে বিরত রই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.