মুক্তিযুদ্ধ এবং জিয়াউর রহমানের মৌলবাদ
বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর
(শিক্ষাবিদ, কবি, শিল্পকলা বিশ্লেষক ও কথাসাহিত্যিক)
আজকে দৈনিক কালের কন্ঠে প্রকাশিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে দুটি পরস্পরবিরোধী ধারা কাজ করেছে। প্রথম ধারাটি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং সেক্যুলার সেনাবাহিনীর মতাদর্শিক অবস্থান গ্রহণের ইতিহাস। দ্বিতীয় ধারাটি মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং মৌলবাদী সেনাবাহিনীর মতাদর্শিক অবস্থান গ্রহণের ইতিহাস। একটি নয়, বরং বহুস্তরের ইতিহাস চেতনা, আমাদের ইতিহাস বোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি পর্যালোচনা ঘিরে আছে।
মুক্তিযুদ্ধের আগে একমাত্র জামায়াতে ইসলামী মৌলবাদী রাজনীতি করেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে জিয়াউর রহমান প্রচ্ছন্নভাবে মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন এবং এই লেবাস প্রকাশ্য হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পরে, বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনীতির মধ্য দিয়ে। জামায়াতে ইসলামীর মৌলবাদী রাজনীতির সমর্থন এসেছে সেনাবাহিনীর মৌলবাদী মতাদর্শিক অবস্থান গ্রহণের মধ্য দিয়ে। রাজনীতির সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতাদর্শিক যোগাযোগ করিয়েছেন জিয়াউর রহমান। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস : যে ইতিহাস শক্তিশালী হয়েছে বঙ্গবন্ধু-মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ ও মোজাফ্ফর আহমদের রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্য দিয়ে এবং এই অবস্থানটি হচ্ছে সেনাবাহিনীর সেক্যুলার মতাদর্শিক অবস্থান গ্রহণের ইতিহাস।
জিয়াউর রহমান যেমন রাষ্ট্রক্ষেত্র থেকে সেক্যুলারিজমকে উৎখাত করেছেন, তেমনি তিনি সেনাবাহিনীর সেক্যুলার অবস্থানও উৎখাত করেছেন। দুই ক্ষেত্রেই তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক সমর্থন লাভ করেছেন। সে জন্য জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক চরিত্র হচ্ছে প্রচ্ছন্ন মৌলবাদ থেকে প্রকাশ্য মৌলবাদে উত্তরণের ইতিহাস। যে জন্য জিয়াউর রহমান থেকে গোলাম আযমের রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দূরত্ব কিছু নয়।
জিয়াউর রহমান থেকেই স্বাধীনতার লড়াই কিংবা জাতীয় আন্দোলনের আখ্যান হয়ে ওঠে কলোনি-উত্তর জাতিরাষ্ট্রে রাজনৈতিক-সামরিক শাসক গ্রুপদের ক্ষমতা বৈধকরণের উপায়।
এই প্রক্রিয়ায় জাতীয় বীরদেরও রূপান্তর ঘটতে থাকে, জিয়াউর রহমান এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির মধ্য দিয়ে মওলানা ভাসানী হয়ে ওঠেন মুসলিম জনসমষ্টির স্বার্থরক্ষার সবচেয়ে প্রধান রাজনীতিবিদ; মণি সিংহ হয়ে ওঠেন হিন্দু রাজনীতিবিদ; শেখ মুজিব ও মোজাফ্ফর আহমদ হয়ে ওঠেন ভারত অনুগৃহীত রাজনীতিবিদ। এভাবে জিয়াউর রহমান ও গোলাম আযম সাম্প্রদায়িক ইতিহাস তৈরি করা শুরু করেন। সাম্প্রদায়িক ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এক নয়। জিয়াউর রহমান সাম্প্রদায়িক ইতিহাসের মধ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভারতের হেজিমনি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে দেখেছেন, গোলাম আযমও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাকিস্তানের হেজিমনির বদলে ভারতের হেজিমনি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে দেখেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের কারণে দুজনই হত্যার রাজনীতি চালু করেছেন এবং ভেবেছেন হত্যাই তাঁদের রাজনীতিকে বৈধতা দেবে।
মুক্তিযুদ্ধ যে কলোনিবিরোধী রাজনীতি, এই বোধকে নষ্ট করেছেন জিয়াউর রহমান এবং একটি কলোনিয়াল সমাজে মুক্তিযুদ্ধ যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব, এই বোধকে জিয়াউর রহমান ও গোলাম আযম সাম্প্রদায়িকতা আরোপ করে ছিন্নভিন্ন করেছেন।
আমার কথাঃ আজকে কালের কন্ঠে নিবন্ধটি পড়লাম এবং লেখক মন্তব্য করেছেন এমন "সে জন্য জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক চরিত্র হচ্ছে প্রচ্ছন্ন মৌলবাদ থেকে প্রকাশ্য মৌলবাদে উত্তরণের ইতিহাস", কিন্তু আমি মনে করি এ ধরণের মন্তব্য করতে গেলে যে ধরণের যুক্তি এবং ইতিহাস সত্যতার দরকার হয় তা তিনি দেখাননি, যাই হোক আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।