আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: দরজার ওপাশে



শাহানা চমকে উঠল অপুর কথাটা শুনে। বলে কি ছেলেটা? প্রচন্ড ধাক্কা লাগে বুকটাতে। এমন দিন বোধ হয় কমই আসে মানুষের জীবনে যখন আঘাতটা সহ্য শক্তির চেয়ে তীব্র হয়। শাহানা একটু অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞাসা করে, কি বলছিস বাবা? তুই দেশের বাইরে চলে যাবি? হ্যা, মা। নির্লিপ্ত জবাব অপুর।

তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে এভাবে চলতে? শাহানা জিজ্ঞাসা করে ছেলেকে। ব্যাপারটা তা না, মা। তাহলে? কষ্ট না হয় সহ্য করা যায়। কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকা! মা তুমিই বলো এভাবে বেঁচে থাকা যায়? বাবা আরেকটু ধৈর্য্য ধর। তোর কি টিউশনি করতে কষ্ট হয়? কষ্ট টিউশনিতে না মা।

কষ্ট তোমার জন্য, কষ্ট নন্দিতার জন্য। আচ্ছা মা, তোমার কি মনে হয়না নন্দিতাই বোধ হয় ঐ মেয়ে যার শখ বা কোনো স্বপ্ন বছরের পর বছর ধরে অপূর্ণ থেকে যায়। কথা শেষ করে চলে যায় অপু। ছেলের কথা শুনে চোখে পানি চলে আসে শাহানার। সত্যিই তো কি পেয়েছে মেয়েটা? আর এখন পর্যন্ত? মেয়েটার বিয়েও দেয়া যাচ্ছে না টাকার জন্য।

তাহলে কি মতটা পাল্টে ফেলবে সে? ভেঙ্গে ফেলবে স্বামীর কাছে করা ওয়াদাটা? শাহানার মনে পড়ে যায় সেই দিনটার কথা। শাহানা অপেক্ষায় আছে , হাসান ছুটিতে আসবে। সে বসে আছে খাটে। অপু ও নন্দিতা পাশে বিভোর ঘুমে। শাহানার ঝিমুনী ধরলেও সে খুব সতর্ক।

ঘুমানো যাবেনা কিছুতে। তার খুব দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। দেশের পরিস্থিতি খারাপ। ভয়ানক খারাপ । কি যে হচ্ছে? হঠাৎ দরজায় হালকাভাবে তিন বার শব্দ হলো।

ধরমর করে বিছানা থেকে নামল শাহানা। তার বুঝতে বাকী নেই কে এসেছে। হাসানের এই স্বভাবটা বড় অদ্ভুত। সে কখনোই শব্দ করে দরজা ধাক্কা দেয় না। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কে এর উত্তরে বলবে, কেউনা।

শাহানা তবুও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞসা করল কে ? ওপাশ থেকে উত্তর এল, কেউনা। শাহানা দরজা খুলল। হাসান ভুবন ভোলানো হাসি নিয়ে জিজ্ঞসা করল, কেমন আছো ? শাহানা নিরুওর। সে বুঝতে পারছেনা এর উত্তর কি হতে পারে? উওরের জন্য ক্ষানিক অপেক্ষা করে হাসান ঘরে ঢুকল। ঢুকেই ঘুমন্ত দুই নিস্পাপ সন্তান এক বছরের নন্দিতা ও তিন বছরের অপুর কপালে চুমু খেয়ে কিছুক্ষন তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

তারপর উঠে গিয়ে গায়ে জড়ানো পুলিশের পোষাক খুলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার ছেলে মেয়ের পাশে এসে বসল। কিছুক্ষন পর শাহানা পাশে এসে বসতেই হাসান কিছুটা অপ্রস্তুতভাবে বলে ফেলল, শাহানা আজ তোমাকে কিছু কথা বলব। বুকটা কেপে উঠল শাহানার। হাসানের কন্ঠে এমন সুর? অজানা বিষাদে মনটা ছেঁয়ে যায়। তবুও নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, বলো।

হাসান খুব ধীর গতিতে বলল, শাহানা আমাদের সময়টা বোধ হয় শেষ হয়ে এসেছে। দেশ ক্রমাগত যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। তুমিতো সবই বোঝ। এভাবে অমানুষদের সাথে বাস করা যায় না। আমাদের হয়তো হলোনা কিন্তু অপু, নন্দিতার জন্য একটা স্বাধীন আশ্রয় করে যাওয়াটা পিতা হিসেবে আমার দায়িত্ব।

তার উপর আমার মা, আমার এই দেশকে রক্ষা করতে হবেই শাহানা। পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা হয়তো মায়ের ঋণ শোধ করার এমন সুযোগ খুব কমই দেন। সেক্ষেত্রে হয়তো খুবই ভাগ্যবান আমরা। তাই তোমার কাছে আমার অনুরোধ আমি যদি না ফিরি , তুমি আমার অপু, নন্দিতাকে কখোনো চোখের আড়াল করো না। আর কোনো দিন যদি স্বাধীন হয় তবে এই দেশটাকে বুকে ধরে রেখো।

দেশের মূল্য শিখিও অপু ও নন্দিতাকে। তারা যেন কখনো এর অমর্যাদা না করে। তুমি আগলে রেখো আমার এই ভালোবাসাগুলোকে। আর প্রতিক্ষায় থেকো। হয়তো ফিরবো।

২. শাহানা গত ৩০ বছর ধরে চেষ্টা করেছে স্বামীকে দেওয়া কথাটা রাখতে। অমানুষিক পরিশ্রম ও নির্ভেজাল ভালবাসা দিয়ে সে চেষ্টা করেছে তিলতিল করে স্বামীর স্বপ্ন পুরণে। যেদিন হাসান আসবে হয়তো এসব দেখে সে অভিভূত হয়ে পড়বে। শাহানার আজও অনঢ় বিশ্বাস কোনো একদিন হাসান ফিরবে। সে বলেছে প্রতিক্ষায় থাকতে।

কিন্তু এখন সে কি করবে? মেয়েটার তো বয়স কম হলোনা। এবার না দিতে পারলে আর সম্ভবও হবেনা। আগামী মাসে মেয়ের বিয়ের কথা। নিজের যা টাকা আছে তা দিয়ে একটাই পথ আছে অপুকে বিদেশ পাঠানো। বিয়ের প্রতিশ্রুতি পুরণ করতে হলে অপুকে বিদেশ পাঠানোর কোন বিকল্প নেই।

কিন্তু এ তো আবার অসম্ভব। হাসানকে দেয়া ওয়াদা ভেঙ্গে যাবে। রাখতে পারবে না স্বামীর কাছে দেয়া শেষ প্রতিশ্রুতি। নিজের অজান্তেই কেঁদে ওঠে শাহানা। তিরিশ বছর আগের স্বপ্ন ও তিরিশ বছর পরের বাস্তবতা যদি হাসানকে দেখানো যেত! দেখানো যেত কিভাবে বেঁচে আছে হাসানের স্বাধীন দেশে।

আজ এই সময় কি আগলে রাখবে? হাসানের দেশ না সন্তান? চোখের আড়াল করতেই হবে অপুকে। হয়তো আগলে রাখা গেলনা কিছুই। ৩. নন্দিতার বিয়ে হয়ে গেছে তিন দিন হলো। কোনভাবে বিয়ে দেয়া গেল। আজ রাতে অপু বাইরে চলে যাচ্ছে।

কিছুই করার নেই তার। নন্দিতার বিয়েতে দেয়া প্রতিশ্রুতি ছ'মাসের মধ্যে পুরণ করতে হবে। অবশেষে সবই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সারাদিনই এসব অগোছালো ভাবনায় শাহানার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। বুকটা ভেঙ্গে কান্না আসছে।

হলো না কিছুই। পারলো না সে। ৪. সন্ধ্যা সাতটায় চলে গেছে অপু। নন্দিতা শ্বশুড় বাড়ীতে। একা ঘরে শুয়ে আছে শাহানা।

সব কিছুতে একই ভাবনা, পারলনা সে। হাসানের সন্তানকে চোখের আড়াল করতেই হলো। এখন যদি হাসান আসে তাহলে কি হবে? কি জবাব দেবে সে? কিভাবে বলবে অপুকে সে দেশে রাখতে পারেনী। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠে শাহানা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে তার।

হঠাৎ দরজায় তিনবার হালকাভাবে শব্দ হলো। শাহানা ঝড়ের গতিতে উঠে বসে। এ কি? কে এল? হাসান নয়তো! এতো দিন পর? যদি সত্যি হাসান হয় তাহলে কি জবাব দেবে আজ? কিভাবে বলবে তার ব্যর্থতার কথা। কি হবে এখন? তারপরও কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে শাহানা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে, অস্ফুটভাবে জিজ্ঞাসা করে, কে? ওপাশ থেকে জবাব আসে, কেউ না।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.