সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
প্রসংগ ছাত্র রাজনীতিঃ প্রয়োজন মেধা ও মনন
ক্ষমতার পালাবদলের শুরুথেকেই দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার, তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে সহিংসতা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। উত্তপ্ত হয়ে আছে প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ক্যাম্পাস। যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও শান্ত আছে সেখানেও চলছে ষড়যন্ত্র যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অশান্ত করে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করা যায়। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া না হলে শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জাতি। এসব দিক বিবেচনা করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
মনে রাখতে হবে, বর্তমান সরকার দিন বদলের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। সরকারীদলের সকল স্তরের রাজনীতিবিদদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে, তা না হলে শিক্ষাক্ষেত্রে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়।
স্বাধীনতার পরবর্র্তী সময় বিশেষ করে ষাট ও সত্তরের দশক থেকে ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতি শব্দ দুটোর ব্যাপক প্রচলন হয়েছে আমাদের দেশে। আমরা জানি, অধ্যয়ন ও জ্ঞানার্জনই ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা। আজ সে ধ্যান-ধারণার আমূল পরিবর্তন হয়েছে বলা যায়।
এ ছাত্র নামধারী ক্যাডাররা গোল্লায় যেতে বসেছে। লেজুড়বৃত্তি সর্বস্ব ছাত্র রাজনীতির কর্মীদের কাছে খোদ অধ্যয়ন নামক শব্দটির অবস্থা আজ ত্রাহি মধুসূদন। পবিত্রতার সঙ্গে অতুলনীয় এবং মানব সম্পদ সৃষ্টির উৎপত্তিস্থল হিসেবে পরিগণিত কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ দূরাচার এবং অপরিপক্ক রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বিষয়টি সচেতন মহলের কাছে যথেষ্ট পীড়াদায়ক। ক্ষমতালোভী ও কালিমালিপ্ত রাজনীতির ব্যবসায়ীরা নিজেদের আখের গোছাতে দুর্বার প্রাণশক্তির অধিকারী ছাত্রদের কুতসিত ভাবে ব্যবহার করছেন। রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের নামে কোন কোন ক্ষেত্রে দেশের ভবিষ্যৎ ছাত্রসমাজকে বেপথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
ক্যাম্পাস ও তৎসংলগ্ন এলাকায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া, ভাঙচুর, মারামারি এবং খুনোখুনির ঘটনা অহরহ ঘটছে। এটি একটি উন্নয়নশীল দেশের ছাত্রসমাজের কাছ থেকে সাধারণ জনগণ মোটেই আশা করেন না।
বলা নিষ্প্রয়োজন, ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতি সমার্থক নয়। রাজনীতিবিদদের স্বৈরাচার, ভ্রষ্টাচার অথবা সমাজে দেখা দেওয়া বিশৃঙ্খলা, কুসংস্কার প্রভৃতি দূর করে রাষ্ট্র ও সমাজের পুননির্মাণের ক্ষেত্রে ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা পালনের ক্ষমতা রাখে। এভাবে যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করে, সে প্রক্রিয়াকেই বলা যায় ছাত্র আন্দোলন।
সমস্ত বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছাত্র কল্যাণ তথা রাষ্ট্রকল্যাণের যে ক্ষমতা ছাত্ররা রাখে, সেটার প্রকৃত মূল্যায়নই হচ্ছে ছাত্র আন্দোলন কথাটার প্রকৃত অর্থ। অথচ এ প্রকৃত অর্থটাকে আজ বিভিন্নভাবে বিকৃত করে তোলা হচ্ছে। দেশপ্রেম, রাষ্ট্রীয় ঐক্য, শিক্ষা প্রভৃতি উপাদান ছাত্র রাজনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে না। ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি নিয়ে সুসংহতভাবে ছাত্র আন্দোলনকে পরিচালিত করার বদলে এটা শুধুমাত্র মতলববাজ রাজনীতির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। ফলে এখনকার ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলন ব্যর্থ ও দিক ভ্রান্ত হচ্ছে।
এটা সমাজের বিস্তর অমঙ্গল ডেকে আনছে।
নবজাগরণের বিচার-বিশ্লেষণযুক্ত ও যুক্তিগ্রাহ্য আলোকপাত যখন সারাবিশ্বকে উদ্ভাসিত করে তুলল, তখন বিশ্বের ছাত্রসমাজের কাছে এসে গেল নতুন করে ভাববার যুগ। ছাত্রদের করণীয় ও শিক্ষণীয় ক্ষেত্রের পরিবর্তন সাধিত হতে থাকলো আপনা-আপনি। কিন্তু এই পরিবর্তনের ঢেউ ছাত্র রাজনীতিতে লাগেনি। আজ সারাদেশে অঞ্চলভিত্তিক অসংখ্য ছাত্র সংগঠনের শাখা-প্রশাখা ডানা মেলেছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কোন অশুভ শক্তির ইঙ্গিতে ছাত্রসমাজ আজ খন্ড-বিখন্ড হয়ে একে-অপরের প্রতি লড়ে যাচ্ছে। এ যেন নিজের গালে নিজেই কষে চড় মারার মত করুণ ও হাস্যকর অবস্থা। ব্যাপক অর্থে রাজনীতি হচ্ছে মানব আচরণের একটি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত দিক। সে অর্থে কেউই রাজনীতির বাইরে নয়। সরকারী দলের অংগ ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররা অতিমাত্রায় বেপরোয়া ভাবে প্রত্যক্ষ ও অসুস্থ রাজনীতিনির্ভর হয়ে পড়ায় সমাজের পরিবর্তনকামী ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসে লজ্জাকর অধ্যায় সংযোজিত হচ্ছে।
পরাধীন দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্ররা যদিও আলাদাভাবে ছাত্র আন্দোলন তেমনভাবে গড়ে তোলেনি তবু তারা মুক্তি সংগ্রামে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করতে পেরেছিল নিঃসন্দেহে। শুধু তাই নয়, সে সময়ের নব্য শিক্ষার্র্থীরাই সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মান্ধতা দূর করে শিক্ষার ও পরিবেশ সৃষ্টিতে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছিল। তাই আজকের আধুনিক দেশ গঠনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। সব থেকে বড় কথা, এ সব গঠনমূলক কাজ বা সদর্থক ছাত্র আন্দোলনে মনোনিবেশ করার পূর্বে ছাত্রদের চরিত্র গঠনের যেসব গুণাবলী অর্জন করতে হয় বা সুনাগরিক হওয়ার পাঠ গ্রহণ করতে হয় সে মানসিকতা তখনকার ছাত্রদের মধ্যে থাকলেও আজকের ছাত্রদের মধ্যে তার সিকি ভাগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সুনাগরিক নির্মাণের কেন্দ্র হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাপ ও সংস্কার মুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ সরাসরি সরকারের রাজনীতিতে জড়িয়ে আছে। শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে চরম বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্র রাজনীতির চোরাপথ দিয়ে। উল্লেখ, ষাটের দশকে সারা বিশ্বে ছাত্র আন্দোলন বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। বিশেষ করে দক্ষিণ ভিয়েতনাম, বলিভিয়া, সুদান, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, চীন প্রভৃতি রাষ্ট্রে ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ দেশের শাসন কর্তাদের দুরভিসন্ধিকে সংযত রাখতে সক্ষম হয়।
এতে শুধু জনপ্রিয়তা নয়, ছাত্র শক্তির প্রকৃত মূল্যায়নের দিনটিরও উন্মোচন ঘটে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভাষাকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল, পরবর্তীকালে (১৯৭১ সালে) তা মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি বা অধিকার আদায়ের প্রাকশর্ত হিসেবে ছাত্রদের যে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিপুষ্টি ও সাংবিধানিক যুক্তি গ্রাহ্যতার উপাদান আহরণ করতে হয়, সে কথাটি তারা এক সময় বেমালুম ভুলে যায়। তাই হর-হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়, অন্যায়-অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আব্দারসুলভ দাবি-দাওয়া নিয়ে অকারণেও তারা মেতে উঠে, যা কি না রাষ্ট্রের কাছে, রাষ্ট্রের জনগণের কাছে, বিশেষ করে অন্য সংগঠনভুক্ত জনসাধারণের কাছে অনেক সময় শঙ্কা ও শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির প্রধান কাজই হচ্ছে-ক্যাম্পাসে প্রতিপক্ষের উপড় সশস্ত্র আক্রমন, ভর্তি বানিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি যাবতীয় কুকর্ম।
নৈতিক অধঃপতনের শেষ সোপানটিও অতিক্রম করেছে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনটির দ্বারা। বিশয়টি এতটাই স্পর্শকাতর যে, এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতেও ঘৃণা হয়। একটি রক্ষণশীল সমাজের শিক্ষাংগনের মতো যায়গায় এঘটনা শুধুই লজ্জার, ঘৃণার। এসব ঘটনা দেখে বলতেই হচ্ছে-দেশের শিক্ষাব্যাবস্থা এবং শিক্ষাংগনের অবস্থা এখন গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। এপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।
এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া উচিত।
ছাত্ররা রাজনীতিতে অপাঙক্তেয় নয়। তারা যে কোনও গঠনমূলক কাজের জন্য সংঘবদ্ধ হোক, আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ রাখুক তা সকলেই কামনা করেন। কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দলের ঘোষিত-অঘোষিত এজেন্ট কিংবা যন্ত্রের মত আজ্ঞাবাহী হয়ে কাজ করে গেলে জনমানসে তাদের আর বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। পরিতাপের বিষয় আমরা দেখতে পাচ্ছি কোন কোন ছাত্র সংগঠনের বার্ষিক অধিবেশনে জটিল রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে।
কিন্তু কোনও ছাত্র সংগঠনই ছাত্রকল্যাণ কিংবা শিক্ষামূলক কর্মসূচী নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করছে না। তাদের কর্মসূচীতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল কিভাবে শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। কিভাবে লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো যাবে, কিভাবে বিজ্ঞানাগারে মান উন্নত করা যাবে। কিভাবে ছাত্র সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিরোধ করা যায়, কিভাবে শিক্ষাঙ্গনে সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ রচনা করা যায়, শিক্ষকদের অভাব হলে কিভাবে তা পূরণ করা যায়, এসব নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলির কোন দিক-নির্দেশনারই থাকে না। এ ব্যাপারে সচেতন ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের তৎপর হতে হবে বলে আমরা মনে করি।
একমাত্র সরকারের সদ্বিচ্ছাতেই আজকের যুগের দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির পুষ্টিবিধানে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু লেজুড়বৃত্তি নির্ভর হয়ে ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতি সফল হতে পারে না। আবার শিক্ষাকে বাদ রেখে ছাত্র আন্দোলন একটি হাস্যকর ব্যাপার মাত্র। কাজেই ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি-দাওয়া, ক্যাম্পাস পরিস্থিতি ও সময়ান্তরে জনগণের প্রকৃত সমস্যা ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে হবে। তবেই ছাত্র আন্দোলন যথার্থভাবেই আন্দোলনের মর্যাদা লাভ করবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।