পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
রাতে আলো ঝলমলে টুইন টাওয়ার
পায়ের নীচের সর্ষে আমায় বেশীদিন স্হির থাকতে দেয়না । শুধু ছেলে আর তার বাবার ছুটির দিকে পথ চেয়ে থাকা। কোথাও বেরিয়ে পরার জন্য মনটা অস্হির হয়ে যায় ,সেটা দেশ বিদেশ কোনো ব্যাপার না। এটা আমি অবশ্য আগের পোস্টগুলোতে ও বলেছি।
মালেয়শিয়া এবার আমাদের গন্তব্য।
আট দিনের জন্য, আর এটাই ছিল আমার ছেলের জন্মদিনের উপহার। ভ্রমন আমাদের পরিবারের তিন জনেরই অত্যন্ত প্রিয়।
যাক এসব কথা। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স ভোর চারটায় আমাদের পৌছে দিল কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে। প্লেনটা ল্যান্ড করার জন্য যখন নীচে নামছিল রাতের আধারে তখন মনে হচ্ছিল সোনার মালায় জড়িয়ে থাকা আলো ঝলমলে এক শহরে নামতে যাচ্ছি
আলোয় ঝলমলে কুয়ালালামপুর প্লেনের জানালা দিয়ে তোলা
একজন যোগ্য নেতার হাতে পড়লে অল্প দিনেই একটি দেশ কোথায় যেতে পারে মালয়েশিয়া তার একটি জলন্ত উদাহরণ।
ঘুরতে যাই ঠিকই কিন্ত সারাক্ষনই আমার দুঃখিনী দেশের সাথে তুলনা করতেই থাকি।
ভাবলাম এত ভোরে হোটেলে যাব ? হোটেল বুকিং দেয়াই ছিল। আকাশ তখনও অন্ধকারে ঢাকা। এয়ারপো্র্টেই অপেক্ষার চিন্তা করছি ,ঘুমে দুচোখ ভেঙ্গে যাচ্ছে। শহর অনে-ক দুরে।
এর মধ্যে সিকিউরিটির এক লোক আমাদের কাছে জানতে চাইলো আমরা কোথায় যাবো, ট্যাক্সী ঠিক করে দিলে আমরা যাবো কি না ? আমরা একটু দ্বিধা করছি দেখে উনি অভয় দিয়ে বল্লেন, মালয়েশিয়া পুরো দেশটাই যেমন ডিউটি ফ্রী, তেমনই crime free.
আমাদের গন্তব্য ছিল বুকিত বিনতাং, একদম ট্যুরিস্ট সেন্টার। একজন ট্যুরিস্টের জন্য যা প্রয়োজনীয় সব হাতের কাছে। হোটেল খুজতে হলোনা, ট্যাক্সী ড্রাইভার একেবারে হোটেলের সামনেই থামালো। রূমে ঢুকেই সোজা বিছানায় গিয়ে গভীর ঘুম।
মালয়েশিয়ার সরকারী ট্যুরিস্ট ভবন
বাংলাদেশ টাইম নটায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে ট্যুরিস্ট অফিসের খোজে বের হোলাম।
এই কাজটা আমরা যেখানে যাই সেখানেই প্রথম করি এবং চেষ্টা করি তা যেন হয় সরকারী ট্যুরিষ্ট অফিস। কারণ তারা কখনই ফাঁকি দেয়না।
একবার দিল্লী সিটি ট্যুরে আমাদের এই তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। অনেক কিছুর মধ্যে লোটাস টেম্পলও ছিল লিস্টে। গাইড এক মাইল দুরে বাসে বসিয়েই দুরে ইশারা করে বল্লো : 'ও হ্যায় লোটাস টেম্পল, ফটো খিচো, ফটো খিচো'।
ঘন গাছের ফাক দিয়ে টেম্পলের মাথাটা দেখা যাচ্ছে কি যাচ্ছেনা! প্রতিশ্রুত ভ্রমন তালিকার অর্ধেকই বাদ দিয়েছিল।
মালয়েশিয়ান সরকারী ট্যুরিস্ট কোম্পানী থেকে আমরা পাঁচটা ট্যুর বেছে নিলাম। তারমধ্যে একটা ছিল ফায়ার ফ্লাইস শো। বাংলায় এর নাম যে জোনাকী পোকা তা জানি, কিন্ত পাঠক ভ্রমনের সাথে জোনাকীর সম্পর্ক্ কি বুঝতে পারছিলামনা। ভিন্ন ধরনের যে কোন কিছুর প্রতি আকর্ষনই আমাদের যাবার কারন।
কথা হলো দুপুর দুটোয় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোবাস যাকে ওরা ভ্যান বলে থাকে আমাদের ফেডারেল হোটেল থেকে তুলে নেবে। গন্তব্যে পৌছাতে ঘন্টা দেড়েক লাগবে। সেদিন ছিল ২৫শে ডিসেম্বর বড়দিন। পাঁচদিন ধরেই দেখছি তার জন্য অল্প বয়স্ক যুবক যুবতীদের প্রস্ততি।
ঠিক সময়ে ভ্যান আসলো আর আমরা উঠে বসলাম ।
আমাদের সাথী পর্যটক ছিল দুটো মেয়ে হংকংয়ের আর তিনজন বৃটিশ নর নারী। এই তিনজনই একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে, পুর্ব পরিচিত নন। এদের মধ্যে একজন ভদ্রমহিলা ছিলেন যার বয়স কমপক্ষে আশি বছর।
ডিনার এবং এর সাথে সংযুক্ত নৌকা ভ্রমনের জন্য আমাদের দিতে হয়েছে মাথাপিছু ১৮০ রিংগিত করে। যাক ভ্রমন পালা শুরু হলো ,শহর ছাড়িয়ে আমরা ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছি।
রবার আর পাম বাগানের মধ্যে দিয়ে কুয়ালা সেলাংঘর নেচার পার্ক পার হয়ে অবশেষে এসে পৌছালাম বুকিত মেলাবতী পাহাড়ে।
ওলন্দাজ বাতিঘর মেলাবতী পাহাড়ে
সেখানে বিশাল বিশাল কড়ই গাছে ছাওয়া ছায়া ছায়া মসৃন পিচঢালা রাস্তা। উচু রেলিং দিয়ে ঘেরা রাস্তার একদিকে অনেক নীচে সেলাংঘর সমুদ্রের তট দেখা যায় । রেলিং এর উপর রয়েছে বেশ কিছু কামান সাজানো। অন্য দিকে পাহাড়ের গা ঘেষে রয়েছে ওলন্দাজদের নির্মিত লাইট হাউস, রয়েল মসোলিয়াম, বাচ্চাদের পার্ক।
তবে সেখানে সবচেয়ে মজার ছিল রূপালী পাতার মতন কানওয়লা বানর। বানরগুলো কাউকেই ভয় পাচ্ছিলনা। নীচের ছবির বানরটা আমার হাত থেকে একটা একটা করে খুটে খুটে বাদাম খাচ্ছিল।
মেলাবতী পাহাড়ের বানর
সন্ধ্যা হয়ে আসছে , গাইড আমাদের এখান থেকে অল্প দুরেই নিয়ে গেল ডিনার পর্ব সারার জন্য। উল্লেখ্য কুয়ালা অর্থ শহর।
আমাদের আসল গন্তব্যের যে জোনাকী দর্শন তার একটু আগে নদীর উপরেই বার্জের মধ্যে লোকাল রেস্টুরেন্ট। ভীষন মজার এবং বহু রকম সামুদ্রিক খাবারের আয়োজন। সন্ধ্যা তখন রাতে পরিনত। নদীতে দুলছে রেস্টুরেন্ট ।
চারিদিক খোলা শুধু উপরে ত্রিপল দেয়া বার্জটিতে, নদী থেকে ভেসে আসা মিষ্টি বাতাস আমাদের গায়ে মিষ্টি পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে।
একটা ভেসে থাকা গাছের ডালে একটা সাদা বক দেখতে পেলাম সেই অন্ধকারেও। নদী দেখতে দেখতে আমরা গল্প করছি আর খাচ্ছি। ততক্ষনে আমাদের সবার মধ্যেই একটু একটু বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এটাই আমরা সবাই উপভোগ করছিলাম মন দিয়ে। কারন প্রায় সবার মনে একই চিন্তা জোনাকী পোকা দেখার মধ্যে কি বা আছে !
খাবারে জন্য সবার অপেক্ষা
খাও্য়া শেষ হলো , আবার যাত্রার পালা , এবার আমাদের অন্ধকারের মধ্যেই কোন শব্দ না করে আস্তে আস্তে ভ্যান চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হল অল্প একটু দুরে এক নদীর ধারে।
নদীর নাম kampung kuantan । আধো আলোয় আধো অন্ধকারে নেমে আসলাম ভ্যান থেকে ।
কটেজের মত ছোটো ছোটো দু একটা ঘর। চারিদিকে হালকা মৃদু বৈদ্যুতিক বাতির আলো । এর মধ্যে গাইড একটি ছাউনির নীচে আমাদের লাইন করে এনে দাড় করালো।
অনেক ট্যুরিস্ট ছিল তবে আমরা তিনজন ছাড়া বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত আর কোন দেশের ট্যুরিস্টই সেখানে দেখলাম না। আরবদের আমরা সবচেয়ে বেশী দেখেছি গেনটিং হাইল্যান্ডে। যেখানে সাউথ ইস্ট এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এক ক্যাসিনো । মজার ব্যাপার সেই ক্যাসিনোতে মালয়েশিয়ানদের প্রবেশ বা জুয়া খেলা সরকারী ভাবে সম্পূর্ন নিষিদ্ধ।
গেনটিং হাইল্যান্ড
যাক এ সব কথা ,তখনও বুঝিনি কি ব্যাপার ঘটবে ! ওরা আমাদেরকে লাইনে দাড় করিয়ে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দিল ।
এর পর ব্যাটারী চালিত শব্দহীন এক একটি নৌকায় বার জন করে পর্যটককে উঠানো হলো । সারি ধরে সিটে বসিয়ে বলে দেয়া হল কোনরকম কথা না এবং কোন ছবি তোলা চলবেনা না। ঐ নিষেধাজ্ঞা না থাকলে হয়তো ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোয় জোনাকীরা তাদের আবাস ছেড়ে পালিয়ে যেত অচিরেই। তার জন্য সেই অপরূপ দৃশ্যের কোন নিদর্শনই আমাদের কাছে থাকলোনা।
আস্তে আস্তে নদীর পার ঘেষে নৌকা চলছে কিন্ত একটুও শব্দ নেই,তার মধ্যেই অবাক বিস্ময়ে দেখলাম নদীর ধার ঘেষে সারি সারি ছোট ছোট ঝোপ, তার মধ্যে কোটি কোটি জোনাকী পোকা, সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে মিট মিট করে জ্বলছে আর নিভছে।
কি যে সেই অপূর্ব দৃশ্য আমি ভাষায় বর্ননা করতে পারবোনা। নদীর দুপারে মাইল খানেক সারিবদ্ধ জায়গা জুড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম জোনাকীর কলোনী। আস্তে আস্তে দুই তীর টাই ঘুরিয়ে আনলো এত টুকু শব্দ না করে ।
নিঃশব্দতার সেই দম বন্ধ করা অপার সৌন্দর্য দেখে ফিরে এসে সবাই অনেকক্ষন চুপ করে ছিলাম, কারো মুখেই কোনো কথা নেই। তারপর সবাই একসাথে বলে উঠলো, ' সত্যিই কি অপরূপ'!
পাঠক হয়ত বলবেন আমাদের দেশে গ্রামে কত জোনাকী পোকা! তা আমিও জানি ।
কিন্ত একই জায়গায় এত জোনাকী পোকা এবং তার উপর ওদের প্রদর্শনীর যে কৌশল সেটা সত্যিই বিস্ময়কর !!
এ ব্যাপারে ধন্যবাদ জানাই মালয়েশিয়ান ট্যুরিজম সেন্টারকে।
বুকিত বিনতাং এর রাস্তা
রাত সাড়ে দশটায় গাইড আমাদের পৌছে দিল হোটেলে ,আর বুকিত বিনতাং এর রাস্তা জুড়ে চলছে তখন বড়দিনের ঊৎসব।
জর্জ মাইকেলের last Christ mass গানটির সাথে সাথে স্থানীয় ছেলে মেয়েরা নাচছে সান্তা ক্লজের পোশাকে। সাথে অনেক অল্প বয়স্ক ট্যুরিস্ট ও ছিল ।
কোন রকম অশোভনীয় কিছু নেই , প্রচুর ট্যুরিস্ট আমাদের মত ফুটপাতে দাড়িয়ে দেখছিল তারুন্যের উৎসব।
সেখানে আমার ছেলেও রাত ১টা পর্যন্ত ওদের সাথে আনন্দোৎসবে অংশগ্রহন করে আসলো।
লিখেছেনঃ মাহজাবীন জুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।