জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই
মন-ভোলানো দর্শক থেকে মগজ খাটানোর দর্শক : আরও জ্ঞানের নেশা
অনুশীলনী :
মোটামুটি সিনেমার চিত্রনাট্য লেখার জন্য যে সব তাত্ত্বিক বিষয় জানা দরকার, আমরা প্রায় তার সব কিছু সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে ফেলেছি। এবার আপনি দর্শক হিসেবে মগজ খাটানোর দর্শক হতে পারবেন। হীরক রাজার দেশে সিনেমার প্রথম দৃশ্য থেকে মগজ খাটিয়ে দেখা যাক। দেখে লিখুন - কী দেখছেন, কী শুনছেন।
লিখার পর যা হবে তার একটা নমুনা -
সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রের প্রথম থেকে ।
টাইটেল শেষ হওয়ার পর থেকে লেখা শুরু করা যাক।
শট - ০১
একটি বালি ঘড়ি। জুম আউট করে এলে দেখা যায় বাঘা বাইন ও গোপী গায়েন খাটে শুয়ে আছে। তাদের ২ জনকে বাতাস করছে ২ জন রাজ-খানসামা।
কাট।
শট - ০২
ক্লোজ আপ।
গোপী গায়েন খাটে শুয়ে আছে। পান মসলা মুখে দেয়।
কাট।
শট - ০৩
ক্লোজ আপ।
বাঘা বায়েন খাটে বসে আছে। সে খানসামার দিকে তাকায়।
শট - ০৪
মিড শট টু ক্লোজ আপ।
বুড়ো খানসামা বাতাস করছে।
শট - ০৫
ক্লোজ আপ।
বাঘা বায়েন খাটে বসে আছে। সে বালি ঘড়ির দিকে তাকায়।
শট - ০৬
লং টু ক্লোজ শট। জুম ইন।
বালি ঘড়ি থেকে বালি পড়ছে।
শট - ০৭
বাঘা বায়েন খাটে বসে আছে। সে পাশা খেলার ঘুটি ছুঁড়ে মারে।
শট - ০৮
ক্লোজ শট।
পাশা খেলার ঘুটি খাটে ছুঁড়ে মারে বাঘা বায়েন।
শট - ০৯
লং শট।
বাঘা বায়েন খাট থেকে নামে। নেমে পায়চারি করে।
শট - ১০
মিড শট টু ক্লোজ আপ টু গোপী গায়েন।
গোপী গায়েন খাটে শুয়ে আঙ্গুর খাচ্ছে। বাঘা গায়েন পায়চারি করেই চলেছে।
জুম ইন করে গোপী গায়েনকে।
এইভাবে লিখে যেতে থাকুন।
এইভাবে লেখার ফলে বুঝে গেছেন যে সিনেমা অনেকগুলো শটের সমষ্টি। বিভিন্ন শট পর পর জোড়া দিয়ে গোটা সিনেমাটি গড়ে তোলা হয়। এই শটগুলো কোন একটা স্থানে গৃহীত হয়েছে।
এটা গল্পের স্থান, বাস্তবের স্থান নয়। এভাবে একটি স্থানে এক বা একাধিক শট নেয়া হয়। তারপর সেই শটগুলো জুড়ে দেয়া হয়। কিন্তু একই জায়গায় সব শট নেয়া হয় না। শট নেয়া হয় বিভিন্ন জায়গায়।
বিভিন্ন জায়গায় ক্যামেরার মাধ্যমে গৃহীত এই শটগুলো পর পর জুড়ে দিয়েই গড়ে ওঠে একটি সিনেমার শরীর।
চিত্রনাট্য লেখার জন্য আরও কিছু বিষয় বুঝতে হবে।
দৃশ্য বা সিন :
আমরা জানি ঘটনা একই স্থানে ঘটে না। বিভিন্ন স্থানে ঘটে। এভাবে নানা স্থানে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে নিয়ে একটি গল্প গড়ে ওঠে।
একই স্থানে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে একটি দৃশ্য বলে। স্থান পরিবর্তন হলেই দৃশ্য বদলে যায়। সাধারণত চিত্রনাট্য লেখা হয় দৃশ্য ধরে। দৃশ্য নাম্বার দিয়ে একের পর এক দৃশ্য লিখে যেতে হয়।
একটি দৃশ্যে একাধিক শট থাকে।
তবে একটি শট দিয়েও একটি দৃশ্য গড়ে উঠতে পারে।
অংক/ সিকোয়েন্স বা দৃশ্য পর্যায় :
সিকোয়েন্স বা দৃশ্য পর্যায়ের সম্পর্ক কাহিনীর সঙ্গে। একটি সিকোয়েন্স বা দৃশ্য পর্যায়ে একটি ঘটনা শুরু হয়ে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল পর্যন্ত শেষ হয়ে যায় । একটি অংক/ সিকোয়েন্স বা দৃশ্য পর্যায় কয়েকটি দৃশ্য বা সিন নিয়ে গড়ে ওঠে। একটি দৃশ্য বা সিন নিয়েও একটি সিকোয়েন্স বা দৃশ্য পর্যায় হতে পারে।
চিত্রনাট্যে অংক বা সিকোয়েন্স উল্লেখ করা হয় না, কেবল দৃশ্য উল্লেখ করা হয়। কিন্তু একটি কাহিনীকে বোঝার জন্য অংক বা সিকোয়েন্স বোঝা খুবই দরকার।
একটি গল্প যেখানে গিয়ে ভিন্ন দিকে মোচড় দেয়, সেখানেই একটি সিকোয়েন্স শেষ হয় এবং আরেকটি সিকোয়েন্স শুরু হয়। গোটা সিনেমাটিকে সাদামাটাভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় - শুরু, মধ্য ও শেষ।
মোট কথা হল চলচ্চিত্রের গঠনটা হয় এই রকম
ফিল্ম ফ্রেম > ফিল্ম শট > ফিল্ম সিন > ফিল্ম সিকোয়েন্স
ফিল্ম ফ্রেম হল বেসিক ইউনিট।
ফিল্ম শট হল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিট। ফিল্ম সিন হল বড় ইউনিট। ফিল্ম সিকোয়েন্স হল সবচেয়ে বড় ইউনিট।
চিত্রনাট্য লেখার পরিকল্পনা :
চলচ্চিত্র তৈরির বিশদ পরিকল্পনার নাম চিত্রনাট্য। এক কথায় বলা হয় - ব্লু প্রিন্ট অব এ ফিল্ম।
একটি সিনেমায় যা যা করা হবে তার প্রায় সবই উল্লেখ থাকে একটি চিত্রনাট্যে।
প্রথম কাজ : একটি গল্প তৈরি করুন
সাদামাটাভাবে একটি চিত্রনাট্য লেখার ধাপগুলো এ রকম :
মূল বক্তব্য > বিষয়বস্তু > সিনোপসিস > ট্রিটমেন্ট > চরিত্রায়ণ > সংলাপ
মূলত, গল্পটি হবে একজনের গল্প। তার জীবনের একটি খণ্ড গল্প। সেই গল্পে সে একটা আকাক্সা প্রকাশ করবে বা কিছু অর্জন করতে চাইবে। এই চাওয়াটা হতে পারে প্রেম, টাকা, সম্পদ, খ্যাতি বা আধ্যাত্মিক জীবন।
তাহলে গল্প তৈরির ধাপগুলো কী পেলাম ? ধাপগুলো হল এই রকম
০১) একটি মূল বক্তব্য তৈরি করতে হবে।
০২) সেই মূল বক্তব্য প্রতিপন্ন করার জন্য একটি গল্প তৈরি করতে হবে যার শুরু শেষ ও মধ্য থাকবে।
০৩) সেই গল্পটি একজন মানুষের গল্প হবে। তাকে বলা হয় প্রধান চরিত্র বা নায়ক। এই প্রধান চরিত্রের একটি আকাঙ্ক্ষা থাকবে এবং তার আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে অনেক অনেক বাধা থাকবে।
০৪) নায়কের আকাঙ্ক্ষা পূরণের বাধা হয়ে দাঁড়াবে প্রতিনায়ক বা ভিলেন। ভিলেন হতে পারে কোন ব্যক্তি, কোন দৈব ঘটনা, কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ।
০৫) সেই বাধা অতিক্রম করে নায়ক তার আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে।
০৬) এই লড়াইয়ে সে হারবে বা জিতবে।
পৃথিবীর তাবৎ সিনেমার এই হল সহজ গল্প।
দ্বিতীয় কাজ : গল্পটি সাজান চিত্র আর শব্দে
গল্পটি সাজাতে হবে চিত্রে এবং শব্দে। কেননা ওটাই চলচ্চিত্রের দাবি।
প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, আমরা আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণে ডিজিটাল ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহার করব। ব্যয়বহুল চলচ্চিত্রের ক্যামেরার কথা আপাতত ভুলে যাওয়াই ভালো। ক্যামেরা বলতে আমরা ডিজিটাল ভিডিও ক্যামেরাই বুঝব।
যে কোন জায়গায় নিয়ে একটি ভিডিও ক্যামেরা চালু করলে ক্যামেরা সেই জায়গার চিত্র ও শব্দ নেয়। ক্যামেরা সেই ছবির সঙ্গে কতগুলো তথ্যও গ্রহণ করে। যেমন :
০১) দৃশ্যটি জানায় ওটা কোন জায়গা, জায়গাটা কেমন, ঘরের ভেতরে নাকি বাইরে।
০২) দৃশ্যটি জানায় ওটা কোন সময়, রাত, দিন, সকাল, বিকাল, ভোর, সন্ধ্যা।
০৩) দৃশ্যটি জানায় ওখানে কারা কারা আছে, তারা কী করছে।
০৪) দৃশ্যটি জানায় ওখানে চারপাশে কোন শব্দ আছে কিনা, পাখির শব্দ, বাতাসের শব্দ, গাড়ির শব্দ, রেডিওর শব্দ, মানুষের কথা বলার শব্দ।
তাহলে সাধারণত ক্যামেরা চালু করলে যেসব তথ্য গৃহীত হয়, সেই সব তথ্যের কথাও লিখে দিতে হবে আপনার চিত্রনাট্যে। মূলত আপনাকে গল্পটি লিখতে হবে চিত্র ও শব্দ ব্যবহার করে। কেননা, সিনেমা মাধ্যমটি হচ্ছে চিত্র ও শব্দের জগৎ। তাহলে আসুন গল্প বলি চিত্র ও শব্দে।
চিত্রের মাধ্যমে গল্প বলা
চিত্রের মাধ্যমে গল্প বলতে গেলে প্রথমেই নির্ধারণ করতে হবে ঘটনাটি কোথায় ঘটছে। যেমন : খেলার মাঠে, রাস্তায়, নদীর ধারে, কোন যানবাহনে, স্টেশনে, স্কুলে, কলেজে, বাড়িতে। সেই স্থানটি উল্লেখ করতে হবে।
তারপর নির্ধারণ করতে হবে ঘটনাটি কখন ঘটছে। যেমন : ভোর বেলা, সকালে, দুপুরে, বিকেলে, সন্ধ্যায়, রাতে বা গভীর রাতে।
এই সময়টি উল্লেখ করতে হবে।
তারপর নির্ধারণ করতে হবে এই ঘটনার স্থানে ওই সময়ে কত জন আছেন। তাদের সংখ্যা ও নাম লিখতে হবে। এদেরকে বলা হয় গল্পের চরিত্র ।
তারপর নির্ধারণ করতে হবে ঘটনাটি।
পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে লিখতে হবে। যত সংক্ষেপে হয় ততই ভালো। কেবল ওই দৃশ্যের ঘটনাটি লিখবেন।
এবার একটা উদারহণ দেয়া যাক - -
যেমন :
দৃশ্য - ০১
স্থান : নদীর ধার / আউট ডোর
সময় : সকাল
চরিত্র : সোমা ও রোমেল
ঘটনা : সোমা রোমেলকে জানায় তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। রোমেল পাত্তা দেয় না।
শব্দের মাধ্যমে গল্প বলা
যে কোন স্থানের একটি শব্দ থাকা স্বাভাবিক। আপনি যেখানে বসে এই বইটি পড়ছেন তার চারপাশে কান পাতুন। হয় তো আপনার মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তার ভো ভো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, পাশের ঘরে কাশছে কেউ, রাস্তায় গাড়ি যাচ্ছে, জানালার বাইরে ২টি বিড়াল ঝগড়া লেগেছে। এই সব কিছুর শব্দ পাচ্ছেন আপনি। অনেকগুলো শব্দের উৎস দেখতে পাচ্ছেন আপনি।
কতগুলো শব্দের উৎস দেখতে পাচ্ছেন না।
চলচ্চিত্রে দেখবেন, কতগুলো শব্দের উৎস পর্দায় দেখা যাচ্ছে, কতগুলো শব্দের উৎস দেখা যাচ্ছে না।
বাস্তবে যেভাবে শব্দগুলো আমাদের জীবনে আছে, সেইভাবেই আপনার পাণ্ডুলিপিতে শব্দগুলোর কথা লিখুন। সহজ করে ও সংক্ষিপ্ত ভাষায়।
চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি লেখার একটা সহজ নিয়ম আছে।
সাধারণত চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপিতে চিত্র ও শব্দ আলাদা করে লেখা হয় । বা পাশে চিত্র এবং ডান পাশে শব্দ। সবাই এই নিয়ম মানেন তা নয়, তবে চলচ্চিত্রকারদের এই নিয়ম জানা আছে। আপনাকেও জানতে হবে। আপনি সৃজনশীল মানুষ, মানবেন কি মানবেন না, সেটা আপনার ব্যক্তিগত বিষয়।
এবার আরেকটা উদাহরণ দেখি। যেমন :
স্থান : নদীর ধার / আউট ডোর
সময় : সকাল
চরিত্র : সোমা ও রোমেল
ঘটনা : সোমা রোমেলকে জানায় তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে । রোমেল পাত্তা দেয় না।
নদীর তীরে বসে আছে সোমা ও রোমেল।
পাখি ডাকছে।
নদীর স্রোতের ছলাৎ
ছলাৎ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে
সোমা : আমার বিয়ে
হয়ে যাচ্ছে।
রোমেল কোন জবাব দেয় না। নদীর
দিকে তাকিয়ে থাকে।
স্রোত এসে পাড়ে বাড়ি দেয়।
সোমা তাড়া দেয়।
সোমা : আমার কথা শুনতে
পাচ্ছ তুমি ?
রোমেল : আমার সামনে
পরীক্ষা।
সোমা রোমেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে নামে অশ্রু । তারপর
নীরবে হাঁটা দেয়।
এই দৃশ্যে কেবল চিত্র নয়, শব্দকেও লেখা হয়েছে।
সহজভাবে এই হল চিত্রনাট্য লেখার নিয়ম। আপনি যা-ই লেখেন না কেন সেটাকে লিখতে হবে চিত্রে ও শব্দে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : মূলত চিত্র ও শব্দকে আলাদা টেবলে ভাগ করে লেখা হয়, ব্লগে ওভাবে টেবল করা যায় না বলে বুঝতে সমস্যা হতে পারে।
(অফ টপিক : আমার লেখা "কিভাবে আপনার প্রথম চলচ্চিত্রটি বানাবেন ? " নামের একটি অপ্রকাশিত বই থেকে লেখাটি দেয়া। এই পোস্টটি অনেক বড় হয়ে গেল বলে দুঃখিত।
)
পর্ব - ০৫
পর্ব - ০৭
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।