জলের অহং
গল্প : শেকড় ২
০৪.
বিকেলে বাবার হাত ধরে বাইরে যায় সে। বাড়ির গেট থেকে বেরুলে টুকুর আনন্দ যেন আর থামে না। আকাশে লাল নীল ঘুড়ির মতো টুকুর মনেও ঘুরে বেড়ায় কতশত ফড়িং। তবে নাটাই এর মতো বাবা তার হাত ধরে রাখে।
মতি গেট বন্ধ করে এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা রান্না ঘরে ঢোকে, মামানি টুকুভাইয়া না ঐ পাগলাডারে একটা চকলেট দিসে।
তপন মামাই ঐ ইদরিসের দোকান থাইক্যা কিনা দিসে।
ওর বাবা না কিছুই খেয়াল করে না , ছেলেটা কী করে , কার সাথে মেশে! আমি আর পারিনা।
টুকু বাবার হাত ধরে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় সিএনজি অটোরিক্শা তেমন পাওয়া যায় না। লোকটা চকলেটের মোড়ক খুলে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে।
তুমি আমাদের সাথে যাবে? চলো না।
নাহ্ ! লোকটা হাসি হাসিমুখ করে বলে।
তপন কিছু বলে না। ছেলের হাত ধরে সিএনজিতে উঠে বসে, টুকু, তুমি ওকে চেনো?
হ্যাঁ বাবা, ওতো এখানেই থাকে, দোকানের সিঁড়িটা আছে না ওখানে ঘুমায়। আমি আর ও রোজ গল্প করি ।
বাবা মতি বলে , ও নাকি পাগল। পাগল মানে কি খারাপ বাবা ?
ঢাকা শহরের শব্দ দূষণ বেড়েছে আজকাল। তপনের উত্তরটা টুকু আর শুনতে পায় না।
০৫.
মতি কাল দেশে যাবে। সকাল থেকেই কাজে মন নেই তার।
দিদার শুপারির কথা দোকানে গিয়েও ভুলে গেছে।
ছাদের কাপড়গুলো নিয়ে আয়, মতি। আরতি রান্নাঘর থেকে চেচায়। রেডিওতে পুরোনোদিনের গান বেজে ওঠে। ভলিউম বাড়িয়ে দেয় সে।
আমি তোমার সাথে ছাদে যাই, মতি।
না না মামানি ছাদে যাইতে মানা করছে না, ভাইয়া!
বারান্দায় মোড়াতে তাকে বসিয়ে রেখে ছাদে যায় মতি। টুকুর হাতে একটা চাররঙা বল।
০৬.
তপন বাড়ি ফিয়ে টুকুকে খোঁজে। মতি, আরতি, দিদা সবাই টুকুকে খোঁজে।
আরতি ছাদে দৌড়ে যায়। মতির ভয়ে কান্না পায়। টুকু ভাইয়া, ও টুকু ভাইয়া...। ওর পেছন পেছন ছাদে গেলো নাতো ! দিদা চিৎকার করে মতিকে ডাকে, তোকে না বলেছি ওকে চোখে চোখে রাখতে! আমার ঘরের খাটের ওখানটায় দেখতো দেখি।
আরতি চোখ মুছে আর এঘর ওঘর ঘুরে বেড়ায়।
তপন ইদরিসের দোকানের দিকে খোঁজে। সতীশবাবু তপনের ফোনে পেয়ে চলে এসেছেন। কাকা, তপনমামার মাথা ঠিক নাই। আমরা অহন কী করুম ?
বারান্দায় এসে দাঁড়ায় আরতি, মা, ও মা ঐ লোকটা নেই এখানে! ঐ আমার টুকুকে নিয়ে গেছে সতীশদা!
শাশুড়ির হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে আরতি।
কে, কে ? সতীশবাবু অবাক হয়ে বলে।
পাগলা, এহানে থাকে।
মতির গালে একচড় বসিয়ে দেয় আরতি , তুই নিশ্চয়ই গেটটা খোলা রেখেছিলি!
মতির কিছুই মনে পড়ছেনা। মতির কষ্ট হচ্ছে।
০৭.
সতীশবাবু টুকুর একটা ছবি নিয়ে থানায় গেছেন। সাথে মতিকে পাঠিয়েছে আরতি।
পাগলটার বর্ণনা হয়তো দিতে পারবে সে।
০৮.
সন্ধ্যে হয়ে এলে ঘরে ফেরে তারা। টুকুর খেলনাগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। আরতি মেঝেতে শুয়ে আছে। আজ পুজো দেয়া হয় নি।
পূর্ণিমার আলোয় তার চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু মুক্তকণা দেখা যায়।
০৯.
বাড়িতে চুলো জ্বলে নি। মতির ক্ষুধা পায়, তপন মামা, কয়ডা টাকা দেন বিস্কুট খামু।
তপন পান্জাবির পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বলে, তুই কিছু খেয়ে শুয়ে পড়, কাল সকালেতো তুই বাড়ি যাবি।
মামা আমি যামু না মামা, আমি আর বাড়িত যামু না।
রাত গভীর হয়। তপন বারান্দায় বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মতির হাতে বিস্কুটের প্যাকেট, মামা বিস্কুট খাইবেন ?
মতি, মা কিছু খেয়েছে আজকে ?
উমাদেবীর ক্ষুধা নেই, কোনো ঘুম নেই।
পূর্ণিমার এই রাতে চারিদিকে শুধু আঁধারে ঘেরা।
১০.
গেটে কে যেনো শব্দ করে।
মতি চিৎকার করে ওঠে, টুকুভাইয়া , টুকুভাইয়া। মতি দৌড়ে গেট খুলে। জটাধারি লোকটার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে টুকু। বাড়ির সবাই ছুটে আসে সিঁড়ির কাছে। টুকু লোকটার হাত ধরে উপরে উঠতে থাকে।
কোথায় ছিলে সারাদিন, বাবা? আরতি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।
স্কুলের পাশে একটা মাঠ আছে না, ওখানে খেলতে গিয়েছিলাম, মা।
টুকুর সারা গায়ে ধুলো বালি মাখা। লোকটারো।
এটুকু ছেলেকে নিয়ে তুমি কোথায় গেলে, আমরা খুঁজে খুঁজে হয়রান।
খরবদার ওর ধারে কাছেও আসবে না। উমা দেবীর গলা কেঁপে ওঠে।
মা, ভেতরে যাওতো। মতি , ওকে কিছু খেতে দে।
লোকটা নির্বিকারে দাঁড়িয়ে আছে।
মতি রান্নাঘরের দিকে যায়।
পানি, একটু পানি... লোকটা মৃদুস্বরে বলে ওঠে।
আরতি গ্লাসে জল ঢালতে গিয়ে শাড়িতে ছলকে পড়ে। লোকটা একপলকে তার দিকেই চেয়ে আছে।
১১.
ছেলেকে বিছানায় রেখে বারান্দায় এসে দাড়ায় আরতি।
দোকানের সিঁড়িতে ঘুমিয়ে আছে সে। শিশুর মতো। টুকুর মতোই কুকড়ে গোল হয়ে শুয়ে আছে লোকটা। তপন এসে আরতির কাঁধে হাত রাখে।
শোনো তপন, এই লোকটাকে এখান থেকে তাড়াও।
আজ ভালোয় ভালোয় টুকু বাড়ি ফিরেছে। ওকে যদি অন্য কোথাও নিয়ে যেতো ? আরতি আর কিছুই ভাবতে পারে না। এখন এসব ভাবার সময় নয়।
আরতিকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে যায়। শিশুরা ঘুমিয়ে থাকলে কী নিষ্পাপ দেখায়, তাই না? আরতি , তুমি কি লোকটাকে চেনো ?
চলবে .....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।