"Man is disturbed not by things, but by the views he takes of them.”—Epictetus.
সুন্দর দিন। বছরের ৮ মাস সুন্দর দিন থাকে। মাঝে মাঝে স্বর্গীয়। সকালে হাল্কা ঠান্ডার মাঝে নোরা জোনস ছেড়ে দিয়ে এক হাতে স্টিয়ারিং আরেক হাতে কফির কাপ ধরে মাঝে মাঝে চুমুক দিতে দিতে যখন পাহাড়ের মাঝে তৈরী রাস্তা দিয়ে যাই মনে হয় হয়ত রুপকথার রাজ্যে যাচ্ছি। আমি আমার এই সৌন্দর্য উপভোগের ভাগ্য নিয়ে বড় সুখী হই।
সারাদিন বাস্তবতার মাঝে সুখ দুঃখ দুটোই থাকে। তখন রুপকথা মাথায় উঠে যায়। আবার বিকেলে বা সন্ধ্যায় ফেরার সময় একই সুখানুভুতি হয়। বিশেষ করে যখন আমাদের নেইবরহুডের মাঝে ঢোকার পথে পাহাড়, গাছ, আর সাজান বাড়ি ঘরগুলোকে সুস্বপ্নের জগতের মত সুন্দর মনে হয়, আমি আমার জন্মকে সার্থক মনে করি। মনে হয় জীবনটা কি অপুর্ব।
বেচেঁ থাকাটা খুব সুখের মনে হয়। আমি অনেক অনেক দিন বাচঁতে চাই এই স্বপ্নের জগতে।
আমার মনে পড়ে আমি যেদিন প্রথম রওনা দিলাম আমেরিকার উদ্দেশ্যে। প্লেনে ওঠার আগ পর্যন্ত কান্না আর কান্না। সবাইকে ছেড়ে আসার জন্যে বুকের ভেতর কষ্ট চোখ বেয়ে উপচে পড়ছিল।
প্লেনে উঠেই আমি সবচে আগে মাথা ব্যাথার ওষুধ খেয়ে ঘুমাবার আয়োজন করলাম। মেয়ে আমার ছোট, চার হবে আর কি। সে ঘুমিয়ে পড়ল আগে ভাগেই। সকালে আমরা সিঙ্গাপুরে পৌছালাম। সেখানে কয়েক ঘন্টা বিরতি।
আমি মেয়েকে এক কার্টে বসিয়ে সেটা ঠেলে ঠেলে এয়ারপোর্টের মাঝে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালাম। বাথরুমে যেয়ে জীবনের সবচে পরিস্কার বাথরুম প্রথমবার দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। আসলেই কিন্তু সিঙ্গাপুর অতি পরিস্কার (কিংবা সবচে’ পরিস্কার) একটি দেশ। তো সেই বাথরুমে হাত মুখ ধোবার সময় আমার ঘড়িটা খুলে বেসিনের বাসে রেখেছিলাম কিন্তু পরে তা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। যখন মনে পড়েছিল তখন বাথরুমটাই খুজে পাইনি।
এত্তগুলো বাথরুমের মাঝে কি করে খুজে পাওয়া সম্ভব? তারমাঝে আমি হলাম দিক কানা। একেবারেই দিক চিনতে পারিনে। আমি যদি একটি গ্যাস স্টেশনে এক দিক দিয়ে ঢুকি তবে সেই দিক দিয়ে ছাড়া অন্য কোন দিকে দিয়ে বের হলে আমি হারিয়ে যাব। বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ছাড়া আমি কোন জায়গা নিজে নিজে চিনতে পারতাম না। সেখানে সুবিধে ছিল যে রিকশাওয়ালা ভাইয়েরা অতি দরদের সাথে অচেনা জায়গাগুলো দিব্যি চিনিয়ে নিয়ে যেতেন।
কিন্তু নিউমার্কেটে গেলে আমি খুব বিপাকে পড়তাম। এটা খুব কম ঘটেছে যে আমি একা গেছি। কিন্তু যদি ভুল ক্রমেও একা গেছি তাহলেই সর্বনাশ। আমি ঢুকতে পারতাম কিন্তু কিছুতেই বের হবার পথ খুজে পেতাম না। আই কিউ টেস্টের অনেক দিক আছে।
তার মাঝে একটি হল স্পেশাল (spatial) ইন্টালিজেন্সি। আমার সেই ইন্টালিজেন্সি স্কোর নির্ঘাত বর্ডারলাইন। যেহেতু আমাকে বিভিন্ন এসেসমেন্টের মাঝে ইন্টালিজেন্সি এসেস করতে হয়, তাই ব্যাপারটি ভালই বুঝি। শুধু জানিনা কি করে দিক চেনা যায়। এখন অবশ্য জি পি এস হওয়াতে বেশ সুবিধে হয়েছে।
তবে জি পি এস যখন বলে take left after 500 yards আমি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ি। কারন ৫০০ ইয়ার্ডস যে কতটুকু সেটা আমার জ্ঞানে নেই। চেষ্টা করলে এই সমস্যার কিছুটা সমাধান করা যায় কিন্তু আমার সে ইচ্ছে নেই। জীবনের সব ক্ষেত্রে এক্সেলেন্ট হবার ইচ্ছেটাকে এভাবেই দমন করি। তো যা বলছিলাম, সেই সিঙ্গাপুরের বাথরুমে ঘড়ি হারাবার কথা।
সেটা আর পাইনি। ঘড়ির দুঃখ ভোলার জন্যে এবং সময় কাটাবার উদ্দেশ্যে আমি মেয়ের কার্ট ঠেলে ঠেলে দোকানে দোকানে বিভিন্ন জিনিষপত্র দেখে বেড়ালাম। একটি দোকান থেকে ৩০ ডলারস খরচ করে একটি সেসিমি স্ট্রীট ক্যারেকটার কিনলাম মেয়ের জন্যে। নীল রঙের এটার নাম কি? কুকি মন্সটার, তাইনা? এই যে ৩০ ডলার খরচ হল, আমি এটার কোন গুরুত্ব বুঝলাম না। আমি কখনই টাকা পয়সার হিসেব বুঝিনা।
অন্তত আমার স্বামী যেভাবে বোঝে তেমনভাবে বুঝি না। তার কারন হল, কুকি মনস্টার কেনার পর সে আমাকে লম্বা লেকচার দিয়েছিল টাকার শ্রাদ্ধ দেবার জন্যে। আমার কাছে মনে হয়েছিল আমার মেয়ে একটি জিনিষ পছন্দ করেছে আমি কিনেছি। ৩০ ডলারস দিয়ে ওর যে খুশি কিনেছিলাম সেটা আসলে অমুল্য আমার কাছে। তো যাইহোক, আমাদের দুজনার ভ্যলুজ নিয়ে বেশ দ্বিমত আছে।
আমি ভ্যালু চিন্তা করি ফিলিংস ইকুইভেলেন্ট করে, আর সে চিন্তা করে টাকার অংকে ইকুইভেলেন্ট করে। মন্দ নয়, এভাবেই সংসার।
সিঙ্গাপুর থেকে প্লেন গেল টোকিও। যাবার পথে যতবার যা খেতে দেয় আমি আর আমার মেয়ে মুগ্ধ হয়ে খাই। তখন আমরা দুজনাই খুব সামান্য খেতাম।
একবারে বেশি খেতে পারতাম না। আমার ওজন ছিল ৯৫ পাউন্ডের নিচে। আমি এবং আমার মেয়ে বরাবরই দুনিয়ার বেশিরভাগ খাবারে মজা খুজে পাই। বিশেষত তা যদি আমার রান্না করা না হয়। ভেব না আমি খারাপ রান্না করি।
বরং বলতে পার খুবই ভাল রান্না করি। কিন্তু নিজের রান্না খেতে আমার ভারি অরুচি। প্লেনে আমরা মজা করে খেলাম, মুভি দেখলাম। তারপর টোকিও এলে কিছুক্ষন সেখানে বিরতির সময় এয়ারপোর্টে ঘুরলাম।
আমি একটি লাল সোয়েটার কালো প্যান্টের ওপরে পরেছিলাম।
একটি কালো ওড়না দিয়ে মাথা আর গলা পেচিয়ে রেখেছিলাম। ফ্যাশনে আমি বরাবরই ওস্তাদ। আর ঠোটে দিয়েছিলাম গাঢ় লাল লিপস্টিক। এটা দিয়েছিলাম কারন আমি এই লিপস্টিক দিলে আমার স্বামী খুব পছন্দ করত। সে আসার দেড় বছর পর আমরা আসছিলাম।
আমি তো চাইবই সে তার পছন্দের সবকিছু দেখুক আমার মাঝে। কিন্তু এখন আমার ধারনা যে আমাকে নির্ঘাত হোর মনে হচ্ছিল। কে প্লেন জার্নিতে লাল লিপস্টিক দেয়? তাছাড়া খুব জমকাল ইভিনিং পার্টিতে না গেলে কেই বা কালারফুল লিপস্টিক দেয় এখানে? ইয়াক ইয়াক ইয়াক। ৯৮-তে আমি এই সাংঘাতিক ফ্যাশন ফো পা (faux pas) করেছিলাম।
লস এঞ্জেলেস এয়ারপোর্টে পৌছেছিলাম সকালে।
প্লেন থেকে নেমে দুরুদুরু বুকে ইমিগ্রেশনে গিয়েছিলাম। কত্ত কথা শুনেছি যে এই হয়, সেই হয়, একটু এদিক থেকে ওদিক হলে ফেরত পাঠায় ইত্যাদী ইত্যাদী। কিছুই হল না। ওয়েলকাম টু আমেরিকা বলে সিল দিয়ে দিল পাসপোর্টে। আমি ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ এরিয়াতে গেলাম।
এক পোর্টার আমাকে সাহায্য করল। চারটে সুটকেস, দুটি ব্যাগ। একটি কার্টে দিয়ে সে আমাকে দেখিয়ে দিল কোত্থেকে ফোন করতে হবে। এমনকি সে ডলার ভাঙ্গিয়ে কয়েন এনে দিল। আমি তাকে ১৫ ডলারস দিলাম।
পরে জেনেছিলাম সবাই বড়জোর তখন ৫ ডলারস দিত। আমি তো কে কি দেয় চিন্তা করিনি, আমি দিয়েছি সাহায্যের মুল্য। তো আমি যখন ফোনে কয়েন দিয়ে কিভাবে ফোন করব চিন্তা করছি, দূর থেকে কয়েনের দোকানের মেয়েটি আমাকে দেখে এগিয়ে এল। সে আমাকে বল্ল ৯ ডায়াল করে (কিংবা জিরো, কে জানে!) তারপর ফোন নম্বর ডায়াল করতে। আমি করলাম।
তারপর অপেক্ষার সময়টুকুতে ভাবলাম কিছু খাই। একটি দোকানে অনেক কিছুর মাঝে মাফিনটাকেই কেবল চেনা লাগল। তাও ওটাকে আমি মাফিন নামে চিনতাম না, জানতাম কাপ কেক (ফ্রস্টিং ছাড়া)। একটি মাফিন আর এক কাপ কোক। মেয়েটি আমার হাতে কোকের খালি কাপ ধরিয়ে দিয়ে কি যেন বল্ল।
আমি কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাংলাদেশে তখনও ফাউন্টেন কোকের রাজ্য জমজমাট হয়নি। যে দোকানগুলোতে ফাউন্টেন কোক ছিল সেখানে কাস্টমারদের নিজে নেবার অপশন ছিল না। তাই আমি জানতাম না কিভাবে ফাউন্টেন থেকে কোক নিতে হয়। দোকানের মেয়েটি নিশ্চয়ই এয়ারপোর্টে কাজ করতে করতে আমার মত অনেক আনাড়ী দেখেছে।
তাই সে এসে কাপটি আমার হাত থেকে নিয়ে ধম ধম করে কিছু আইস আর কোক ভরে দিল। ফেব্রুয়ারীতে আইস দিয়ে কোক খাবার মত ক্ষমতা তখনও আমার হয়নি। আমি কোকে এক চুমুক দিয়ে ভয়ে ভয়ে রইলাম যেন সাইনাস পেইন শুরু না হয়। তারপর মেয়ে আর আমি মিলে পাখির মত খুটে খুটে কিছুটা মাফিন খেলাম। মনে খুব আনন্দ যে আমি আমেরিকায় এসেছি।
তারপর যখন গাড়িতে চড়ে চওড়া ফ্রি ওয়ে ধরে বাসায় যাচ্ছিলাম আমার বুক জুড়ে সুখের প্রজাপতি নাচানাচি করছিল। আমার মনে হচ্ছিল জীবনের সবচে সুন্দর স্বপ্নটি পুরো হয়েছে—আমি আমেরিকায় এসেছি ফর ফরএভার। কি সুখ তা বলে বোঝাবার মত নয়। এখনও ভাবলে বুকের ভেতর সুখের সেই ছোয়া পাই। অনেকের যেমন দেশের জন্যে মন কাঁদে, কিছুতেই এখানে মন বসে না, কিংবা প্রথমে ভাল লাগলেও কিছুদিন পর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে—আমার এসব কিছুই হয়নি আজ পর্যন্ত।
কে জানে আমি হয়ত ভাল বাঙ্গালী নই। কে জানে দেশকে ভালবাসার চেয়ে আমি হয়ত আমাকে বেশি ভালবাসি। তা সে যাই হোক আর যত দোষনীয় হোক, আমি আমেরিকায় এসে নিজেকে অনেক অনেক ধন্য মনে করেছি এবং আজ পর্যন্ত করে যাচ্ছি।
এখনও তাই প্রতি দিন আমি আবহাওয়া সুন্দর হলে মুগ্ধ হই। গত দশ বছর যাবৎ একই নেইবরহুডে আসা যাওয়া করেও মুগ্ধতা ফুরোয় না।
এখনও মনে হয় আমি স্বপ্নের জগতে বাস করি। এ মুগ্ধতা আসলে বাহ্যিক নয়, এ আমার ভেতরের মুগ্ধতা। আমি জানি, আমি পুংখানুপুঙ্খরুপে এনালাইস করতে পারি কেন এবং কিভাবে আমার এই মুগ্ধতা, এর রুট কোথায়, কিভাবে এটা মেইনটেইন হয় ইত্যাদী। আমি অত্ত বিচারে যাইনা। এনালিসিসগুলো রোগী দেখার জন্যে রেখে দিয়ে আমি নোরা জোনস শুনতে শুনতে স্বপ্নের জগতে ঢুকে যাই।
নোরা জোনস গেয়ে চলে, ‘হোয়াই ক্যান্ট আই ফ্রি ইওর ডাউটফুল মাইন্ড এন্ড মেল্ট ইওর কোল্ড কোল্ড হার্ট’।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।