আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিকান্দার আবু জাফর

সুশীল নয়, ইহা কুশীল ব্লগ

সিকান্দার আবু জাফরকে-যাঁর প্রকৃত পিতৃদত্ত নাম ছিল সৈয়দ আল হাশমী আবু জাফর মুহম্মদ বখত সিকান্দার-আমরা কবি, সঙ্গীত রচয়িতা, নাট্যকার ও সাংবাদিক হিসেবে জানি। তিনি এর সবকটিই ছিলেন এবং এর সব ক’টিকেই অতিক্রম করে ছিলেন আরো কিছু। তিনি ছিলেন এক ও অনন্য সিকান্দার আবু জাফর। তাঁর মৃত্যুর পরের বছর থেকেই সরকার প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষ্যে আমাদের সাহিত্য, শিল্প, সাংবাদিকতা, শিক্ষা ইত্যাদি জীবনের বিবিধ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদকের প্রবর্তন করেন। সিকান্দার আবু জাফরকে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ১৯৮৪ সালের একুশে পদক দেয়া হয়।

এর ১৮ বছর আগে ১৯৬৬ সালে তিনি নাট্যকার হিসেবে বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত হন। কিন্তু সাংবাদিকতা বা নাটক রচনা কোনটিতেই তিনি পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিরেন না। যে নিবিড় একনিষ্ঠদতা ও গভীরতা মহৎ ও কালোত্তীর্ণ সাহিজত্যকে চিহ্নিত করে তা তাঁর মজ্জাগত ছিরো না। কিন্তু তবু তাঁর প্রত্যেক কর্মে, সাহিত্যকর্মেও, একটা দুর্মর প্রতিভার অনপনেয় স্বাক্সর গভীরভাগে উৎকীর্ণ ছিলো। তাঁর ভিতরে, অনুমান করি, প্রজ্জ্বলিত ছিলো সেই অনির্বাণ অগ্নি যা সজ্ঞার অতীত এক শক্তি দিয়ে মানবাত্মাকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে, যা যুগে যুগে তাকে প্রগতির পথে ধাবিত করে, যা লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাকে খড়গকৃপাণ ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও সুন্দরের স্বপ্নে বিভোর করে রাখে অনুক্ষণ।

৭৪. কোন একটি নির্দিষ্ঠ পেশায় তিনি কখনোই দীর্ঘসময় ধরে নিয়োজিত থাকেননি। ঐ প্রজ্জ্বলিত অগ্নির নিরবচ্ছিন্ন প্রদাহই হয়তো তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে, এক বৃত্তি থেকে অন্য বৃত্তিতে। কাঁচা চামড়ার ব্যবসা থেকে ইটখোলার ব্যবসা, খোয়াড় পরিচালনা, রেসের ঘোড়াপোষা অনেক কিছুই তিনি করেছেন জীবনের বিভিন্ন সময়ে। সুস্থির থাকেননি কখনো। তবে সম্ভবত একমাত্র সাংবাদিকতাতেই তিনি বিচ্ছিন্নভাবে হলেও দীর্ঘ সময় ধরে নিয়োজিত ছিরেন।

কোন সৃনির্দিষ্ট ধারায় কোন দিনই তাঁর জীবন ও জীবিকা প্রবাহিত হয়নি। সেটাই স্বাভাবিক। কেননা তাঁর স্বভাব বা প্রকৃতিতেই সম্ভবত ছিল না নিরবচ্ছিন্ন একনিষ্ঠতা। কিন্তু তবু এক অর্থে দারুণ বর্ণাঢ্য ছিলো তাঁর জীবন তার বৈচিত্র্যে। হায়াৎ মামুদ তাঁর অত্রন্ত সুলিখিত তথ্যবহুল গ্রন্থ ১৯৫৩ সালকে অর্থাৎ সমকাল প্রকাশনার সময়কে তাঁর সাংবাদিকতা বৃত্তির আদিপর্ব বলে চিহ্নিত করেছেন।

এই পত্রিকা এক নাগাড়ে তেরো বছর ধরে টিকে ছিলো কিন্তু অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, অনেক লাভজনক কাজ বাদ দিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক কো পত্রিকা প্রকাশ করা এবং দীর্ঘ সময় বাদ দিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক কোন পত্রিকা প্রকাশ করা এবং দীর্ঘ সময় ধরে তাকে টিকিয়ে রাখা কী নিদারুণ বিড়ম্বনার কাজ হতে পারে। সমকাল স্বভাবতই সবসমই নিয়মিত থাকেনি। আবার এরই সমান্তরাল সময়ে তিনি নাট্যগোষ্ঠিতে নেতৃত্বদান, স্থাপত্য সংস্থা সৃষ্ঠি- এমন নানাবিধ ক্রিয়াকলাপে অনবরত ব্যাপৃত থেকেছেন। পঞ্চাশ দশকের শুরুতে রেডিওতে কাজ করেছেন। কিন্তু তাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

তাঁর সম্পূর্ণ কর্মজীবনে নানাকারণে সমকাল পত্রিকাকেই সম্ভবত আমরা তাঁর প্রধান ও একটি অক্ষয়কীর্তি হিসেবে অভিহিত করতে পারি। পঞ্চাশ দশকের শেষ ও পুরো ষাটের দশক জুড়ে যে সময়টি অতিবাহিত হয়েছে তা আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নানাবিধ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের ভিতর দিয়ে ঐ সময়টিই আমাদের জাতীয় চৈতন্যের মৌলিক চরিত্রটিকে প্রকটিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে এ অঞ্চলের মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির বিকাশ ও পরিণতি ঘটে ঐ সময়েই। আর্থ-সামাজিক প্রতিবেশের বিভিন্ন ঘটনার অভিঘাতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাংলাদেশে বোধ ও চেতনায় বিপুল পট পরিবর্তন ঘটেছে।

সাতচল্লিশের তথাকথিত স্বাধীনতার পর একদিকে যেমন কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি ঘটেনি তেমনি ক্রমাগত ঔপনিবেশিক শক্তির অশুভ আক্রমণে আমাদের মানসজীবন ছিল পর্যুদস্ত। এই অবস্থার বিরুদ্ধ-প্রতিক্রিয়াতেই ষাটের দশকে আমদের জাতীয় চেতনা দানা বেঁধে ওঠে এবং ধীরে ধীরে বাক্সময় হয়ে ওঠে জাতির অন্তরাত্মা। আমাদের সেই সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক উদবর্তনে সমকালের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই পত্রিকার বিতর দিয়ে এবং তাকে কেন্দ্র করেই সিকান্দার আবু জাফরের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব যেন আমাদের কাছে উজ্জ্বল বর্ণে রঞ্জিত হযে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতি, চিন্তা ও সৃজনশীল সাহিত্যের মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল সমকাল।

সিকান্দার আবু জাফরের মধ্যে ছিল সেই দুর্দমনীয় প্রতিবাদী সত্তা, একটি প্রচ- নিওরোমান্টিক আবেগ ও একই সঙ্গে মৌলিক বোহেমিয়ান প্রকৃতি যা ঐ আবহে সেদিন বিচিত্র বর্ণে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল। ঐ একই প্রকৃতির প্রমত্ত প্রকাশ প্রত্যক্ষ করি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে তাঁর এবার বাংলা ছাড়ো, বাংলাদেশ ঃইতিহাস থেকে ইতিহাসের মতো কবিতায় ও অন্রান্য বিবৃতি বিবরণীতে। গভীর সামাজিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন এই অসম সাহসী মানুষটির জীবনসায়াহ্নে রোগাক্রান্ত কাটলেও সে সময়েও তাঁর স্বাভাবিক উচ্ছলতা, চরিত্রের বর্ণাঢ্যতা ও দার্ঢ্য সামান্য ম্রিয়মাণ হয়নি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.