সময় গেলে সাধন হবে না
“উফ, একটুর জন্য ম্যচটা হাতছাড়া হয়ে গেল”-বলছিল রাসেলের টিমমেট তারেক। তারেকের দিকে এক পলক তাকিয়েও দৃষ্টি সরিয়ে নিল রাসেল। মনটা তার একটু বেশীই খারাপ। এই টুর্নামেন্টের জন্য তার ২ টা পরীক্ষা মিস হয়ে গেছে। তার উপর এই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরারও সে, তারপরও ফাইনালে তার জন্যই কিনা দল হেরে গেল! শেষ ৫ সেকেণ্ডে ফ্রি-শুট পেয়েও স্কোর করতে না পারায় তারা হেরে গেছে ৭৮-৭৭ পয়েন্টে।
‘খুব একা একা লাগছে, তুমি কি এখন একটু বের হতে পারবা?’-ফোনে সুমিকে বলে রাসেল। সুমি রাসেলের গার্লফ্রেণ্ড। প্রচলিত ধারার প্রেম বলতে যা বুঝায় তাদের সম্পর্কটা তা থেকে কিছুটা আলাদা। জীবনটাকে ফ্যান্টাসি ভেবে শুধু কষ্ট পাওয়া মানুষদের থেকে তারা একটু আলাদা। দুজনেই দুজনের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নিজের জীবনের সাথে বেশ মানানসই ভাবেই তারা এঁটে নিয়েছে অপরজনের জীবন।
তাদের সম্পর্কের শুরুটাও বেশ অদ্ভুত। রাসেলের খুব কাছের বন্ধু মারজুক। স্কুল জীবন থেকেই একসাথেই সকল প্রকার অর্থ-অনর্থ ঘটিয়েছে তারা। মারজুকের একমাত্র ছোটবোন সুমি। কিন্তু আর দশটা প্রেমের মত এখান থেকেই সম্পর্ক প্রেমে গড়িয়ে যায়নি।
তবে রাসেলের প্রতি সুমির দুর্বলতা জন্ম নিয়েছিল তাদের পরিচয়ের শুরু থেকেই। সুমি তখন হলিক্রস স্কুলে ক্লাস টেনে উঠেছে মাত্র। জীবনের এই অবাধ্য সময়টায় সুমির জীবনে রাসেলের প্রবেশ। কিন্তু রাসেলের কাছে সুমি নিতান্তই তার বাকি সব ‘পাড়াতো’ বোনের মতই। জীবনের অনেক ঘটনাই মানুষের নিয়ন্ত্রণের লাগাম ছিড়ে এঁকে দেয় বিমূর্ত ভবিষ্যত।
সুমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। রাসেলের লিভারে বড় ধরণের একটা সমস্যা দেখা দিল। উদ্ভ্রান্ত পথিকের পথ খুজে পাওয়ার মতই সুমি খুজে নেয় তার ডেসটিনি। রাসেলের সেবায় ২৪ ঘন্টা হাসপাতালের নির্জন করিডোরে কাটাতে না পারলেও, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় একবারের জন্যও তার মন বের হয়নি রাসেলের ১২ ফুট বাই ১২ ফুট ঘর থেকে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা রাসেল একবারের মত জানতেও পারল না যে একজন মানুষ অন্তত আছে যে প্রতি মূহুর্তে তার জীবনের বিনিময়ে রাসেলের জীবন ভিক্ষা করছে।
প্রকৃতির অমোঘ খেলায় সে যাত্রায় নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পেয়ে যায় রাসেল। আবার সেই চঞ্চল জীবন, আবারও জীবনের ব্যস্ততা। রাসেলের সেই চঞ্চল জীবনে সুমির অবস্থান আগে থেকে কিছুটা বদলালো বটে, তবে সেটা ‘শুধুই’ পাড়াতো বোন থেকে ‘বিশেষ’ পাড়াতো বোন অবস্থানে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছুই না। এদিকে ঘটে গেল আরেক ঘটনা। রাসেলকে প্রপোজ করে বসল তারই খুব কাছের এক বান্ধবী।
জীবনের জুয়ার দোলচালে এখানেই কাব্য ছাড়িয়ে যায় বাস্তবতাকে। জীবন কাব্যের অদ্ভুত নাটকীয়তায় গাঁটছাড়া বাঁধে দুটি জীবন-রাসেল আর সুমি। সরল অংকের গড়লতাকে মোটা দাগের বন্ধনীতে আবদ্ধ করে জীবন মাঝে মাঝে তার প্রবাহ ঠিক করে নেয়।
সবুজ একটা ফতুয়া পড়ে এসেছে সুমি। দূর থেকেই সুমিকে দেখতে পায় রাসেল।
গত পহেলা বৈশাখের সময় এটা কিনে দিয়েছিল সেই।
-টিপ পড়োনি কেন?
-কিনে দাওনি তাই...মুখ এমন বাংলার পাঁচ বানিয়ে বসে আছ কেন?
-জানো না কেন? শুধু শুধু জিজ্ঞেস করছ কেন?
-জানি, কিন্তু এর জন্য মন খারাপ করার কি আছে!খেলায় হারজিত না থাকলে কেউ টিকেট কেটে খেলা দেখতো বলো? আসল ব্যাপারটা হল কতটুকু আনন্দ মানুষকে দিতে পেরেছো...আমার মনে হয় এ কাজটা তোমার চেয়ে ভালো কেউ করেনি। তোমার মন খারাপ করার কি আছে?
-তারপরও হারজিতের মূল্য সবসময়ই আছে। মানুষ দিনের শেষে হয়ত শুধু আনন্দ নিয়েই যায়, কিন্তু সময় বিজয়ীকেই শুধু শ্রেষ্ঠত্ব দেয়। তারপরও বলব তোমার কথায় যুক্তি আছে।
বাদ দাও। মারজুকের খবর কি?
-ভাইয়া তোমাকে খুব মিস করে। ও আমাদের সাথেও সবসময় তোমার কথা বলে। ও একটা পার্টটাইম চাকরি পেয়েছে মিডেলসবার্গে। ভালোই আছে ও।
-দাঁড়াও, তোমার জন্য একটা জিনিস নিয়ে আসি। একটু বস......(বলেই হুট করে হাঁটা দেয় রাসেল)
রাসেলের এই স্বভাবের সাথে পরিচিত সুমি। কিন্তু কেন যেন এটা ভীষণ ভালো লাগে সুমির। রাসেলের আরেকটা গুণ ভীষণ ভালো লাগে সুমির। মানুষকে ভালবাসার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এই ছেলেটির।
সুমির ভীষণ মনে পড়ছে তার ভাইয়ের দুঃসময়ে কি দৃঢ়তার সাথেই না পাশে দাঁড়িয়েছিলো এই চঞ্ছল ছেলেটি, তার মায়ের অসুস্থতার সময় কি ভীষণভাবে আপন করে নিয়েছিল পুরো পরিবারটিকে; এমনকি সুমিদের পাশের বাসার মেয়েটাকেও হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল পরীক্ষা বাদ দিয়ে। কিছু কিছু সময় আসলেই মানুষ নিজেকে অতিক্রম করে, কিন্তু সুমির ধারণা রাসেল প্রতি মূহুর্তেই নিজেকে অতিক্রম করে।
-ওই, এমন বেকুবের মত একদিকে তাকিয়ে কি ভাবছ?
-ও, তুমি এসে গেছ! তা কি আনলা, দাও!
-আহা হা হা......এত সহজে!
-কঠিন করতে চাইলেই পারবা!!!!
তারপর সুমির আহ্লাদিপনায় রাসেল বের করে দিতে বাধ্য হল তার ‘আচমকা উপহার’। তেমন কিছুই না, সেটা ছিল নিতান্তই সাধারণ একটা মুখোশ; কিন্তু সুমির মনে হচ্ছিল এর চেয়ে ভালো উপহার সে জীবনে পায়নি.......তার চোখের পানির ফোঁটায় ফোঁটায় লুকিয়ে ছিল শুধুই ভালবাসা।
এদিকে জাতীয় দলে ডাক পায় রাসেল।
জাতীয় দলের সাথে সে খেলতে যায় থাইল্যান্ডে। খরোস্রোতা নদীর স্রোতের দিকবদল করতে প্রয়োজন ভূমিকম্পের, কিন্তু নিয়তির স্রোত দিকবদল করতে হয়ত প্রবল বাতাসেরও প্রয়োজন নেই; সামান্য দোলেই কেঁপে উঠে জীবন কুঁড়েঘর। থাইল্যান্ডে রাসেলের সাথে ঘটনাক্রমে দেখা হয় একজন বাঙালী ব্যবসায়ীর। তিনি হঠাৎ করেই রাসেলকে এমন একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন যে এর চেয়ে রাসেল ওই লোকটিকে নগ্ন হয়ে নাচতে দেখলেও এর চেয়ে কম অবাক হত। সে বুঝতে পারছিলনা এই লোকটিকে কিভাবে উত্তর দিবে-আসলে মানুষ যখন উত্তর দেয়াটাই প্রাসংগিক মনে করে না, তখন উত্তর কি হবে সেটা খুব বেশি গুরুত্বপুর্ণ না, উত্তর দেয়াটাই আসল ব্যাপার।
কিন্তু বিধি বাম, সরাসরি কাউকে ‘না’ করতে না পারা রাসেলের চরিত্রের দুর্বলতম দিকগুলোর একটা। কিন্তু সিনেমা করার মত নিছক একটা হেয়ালী সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই সে নিয়ে পারে না-মনে মনে ভাবে রাসেল। এই লোকটি ভিন্ন ধারার একটা বাণিজ্যিক ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব দেয় রাসেলকে। আসলে রাসেলের সাথে ওই ব্যবসায়ীর পরিচয় খুব স্বল্প সময়ের। কিন্তু কোন এক দূর্বোধ্য কারণে রাসেলকে সে এই অবিবেচিত প্রস্তাব দিয়ে বসে।
রাসেল ভাবে সে যেখানে সে বিয়ে বাড়ির ক্যামেরা দেখলেও মুখ লুকিয়ে ফেলে, সেখানে একেবারে সিনেমা ক্যামেরা!!! তারপরও সুমিকে ফোন করে সে ঘটনাটা বলে। ‘এমনি নাচুনি বুড়ি, তার উপর ঢোলে বাড়ি’-এই প্রবাদের সত্যতা প্রমাণ করে সুমি রাসেলকে সিনেমায় নামিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগে যায়। কারণ সুমির ধারণা রাসেল সেই মানুষদের একজন যারা কোথাও হাত দিলেই সোনা ফলে।
বছরখানেক পর একদিনের ঘটনা। হতাৎ করে একটু বেশি সকালেই একটা ফোনকল রিসিভ করে সুমি।
এরপর থেকেই তার মেজাজ অসম্ভব রকমের খারাপ। মন খারাপের সাথে যে জিনিসটি যুক্ত হলে ষোলকলা পুর্ণ হয় তা হল দূর্ভাগ্য। সকাল থেকেই রাসেলের ফোনে ঢুকতে পারছে না সুমি। রাসেলের আজকের এই অবস্থানের পিছনে তারও তো অবদান কম নয়, তাহলে রাসেল কেন তাকে অবজ্ঞা করবে? কেন অন্য সব সিনেমা স্টারদের মত সেও অন্য মেয়ের হাত ধরে অ্যাওয়র্ড সিরিমনি তে ঢুকবে? কেন তার নামে একের পর এক স্ক্যান্ডাল বের হবে? কেন অন্য সব স্ত্রীর মত সুমি একটা সাধারন জীবন পাবে না? কেন কাজের সাথে জীবনকে আলাদা করা যাবে না?এমন শতশত প্রশ্ন সুমির মনকে ফালা ফালা করে কাটছে আজকের ওই ফোন কলটির পর। ঐ মহিলার কথা যে সুমি বিশ্বাস করে নিয়েছে তা নয়, কিন্তু অতি উত্তাপে যে হিমালয়ের বরফও গলে যায় কিংবা অতি ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়ে বিশাল পাহাড়! সুমির কাছে তার জীবনটা অনেকটা বইয়ের ছেড়া পাতার মত, যতক্ষণ বইয়ের সাথে ছিল ঠিক ততক্ষণ এর মূল্য ছিল অসীম, কিন্তু যেই ছেড়া হয়ে গেছে, তার স্থান ময়লার বাক্স ছাড়া আর কোথাও নয়!
সুমির মনে সন্দেহের বীজ মহীরুহ হতে থাকে দিনের পর দিন।
কিন্তু রাসেল কোন কথারই যুতসই উত্তর দিতে পারেনা। সে শুধু বলে ,“ সবই তোমার ব্যাপার সুমি!আমার সাথে এতদিন থেকেও তুমি যদি আমাকে না চিন্তে পারো, তাহলে আমি কার কাছে যাব?” নরম কথায় চিড়ে আপাতদৃষ্টিতে ভিজলেও সুমির মনের খেদ দূর হয় না কখনই। এই খেদ থেকেই জন্ম নেয় দূরত্ব, মুক্তি হয় একটা দৃঢ় মানসিক বন্ধনের! সমুদ্রের শোঁ শোঁ ধ্বনির মত নিস্তরঙ্গ আর্তনাদ তাদের সম্পর্কের দোটানায় কেবল ভারীই হলো, মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলো সামান্যই।
সবুজ ঘাসের চারণভূমিতে হাঁটতে থাকলে আকাশটা বড় বেশী স্পর্শযোগ্য মনে হয়, কিন্তু যতই হাঁটা হয়,ততই দূরে যেতে থাকে নিঃসীম আকাশ। মানুষও হয়ত সারাজীবনে এই আকাশ ছোঁয়ারই চেষ্টা করে নিরন্তর, কিন্তু জীবন যেখানে সসীম সেখানে অসীমের স্পর্শ কিছুটা অলৌকিকই বটে।
সুমির প্রতিটি দিন এখন আর আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নয়, প্রতিটি দিন হয় মর্ত্যের কষ্টগুলোকে আরো বেশি শাণিত করে তোলার সোপান । কারণ এর মাঝেই ঘটে গেছে সুমির জীবনের সবচেয়ে বড় অঘটন। তার নোটে কেবল একটি লাইনই লেখা ছিল “সুমি,আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি”। কাউকে কিছু না বলে,কোথাও কিছু না জানিয়ে কিভাবে কোথায় কখন রাসেল উধাও হয়ে গেল,এটা বুঝার সাধ্য পরম সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারও আছে বলে সুমির মনে হয় না। হয়ত কিছু মানুষ জন্মই নেয় হারিয়ে যাবার জন্য।
রাসেলের এই প্রস্থান যতটা না আকস্মিক, তার চেয়ে বেশী কাল্পনিক। সুমি আজও বিশ্বাস করে কোন এক গভীর রাতে রাসেল তার চিরচারিত মিষ্টি হাসি দিয়ে বলবে “সুমি, একটু মজা করলাম, তুমি ভয় পাওনি তো?”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।