আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের এক বছর ইন্ধনদাতার সন্ধান পায়নি সিআইডি

বাংলা আমার দেশ

বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানায় হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি সিআইডি। এ ঘটনায় বাইরের কোনো ইন্ধনদাতা ছিল—এমন তথ্য পাওয়া যায়নি সিআইডির তদন্তে। বরং জওয়ানদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও দাবি-দাওয়া থেকেই এ বিদ্রোহের সূত্রপাত বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা গতকাল বুধবার সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। তবে সিআইডির তদন্তে বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যে অন্য কোনো ইন্ধনদাতা বা বাইরের শক্তি জড়িত থাকার প্রমাণ না মিললেও সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি ও সেনা তদন্ত আদালতের (কোর্ট অব এনকোয়ারি) প্রতিবেদনে ইন্ধনদাতা বা মদদদাতাকে খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইন্ধনদাতা বা উসকানিদাতাদের বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল গাজীপুরের নাওজোর এলাকায় ঢাকা বাইপাস সড়কের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের বিচার বাংলাদেশের মাটিতেই হবে। উসকানিদাতাদেরও খুঁজে বের করা হবে, বিদ্রোহের উসকানিদাতারা রেহাই পাবে না। ’ পিলখানা হত্যাকাণ্ড মামলাটি এক বছর ধরে তদন্ত করছে সিআইডি। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, এ পর্যন্ত দুই হাজার ২০৫ জন বিডিআর সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তদন্তে তাঁদের মধ্যে ৯০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন মারাত্মক অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত কয়েকজন জওয়ান এখনো পলাতক। বিদ্রোহের এক বছরের মাথায় মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে সিআইডি এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। বলা হয়, তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শেষ মুহূর্তের যাচাই-বাছাই চলছে।

লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত সেনা তদন্ত আদালতের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘মূল পরিকল্পনাকারী ও মদদদাতাদের সবাইকে বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের সহায়তায় এবং অন্যান্য যারা বিডিআর বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তকরণের কাজে নিয়োজিত, তাদের মাধ্যমে চিহ্নিতকরণ ও হত্যাকাণ্ডের কারণ কী ছিল, তা আরও তদন্তের মাধ্যমে উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। ’ সেনা তদন্ত আদালতের এ প্রতিবেদন গত বছরের ১১ মে সেনাপ্রধানের কাছে জমা দেওয়া হয়। এ ছাড়া আনিস উজ জামানের নেতৃত্বে গঠিত সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিডিআরের কতিপয় মামুলি দাবি এত বড় ঘটনা ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। এসব দাবিকে সামনে রেখে মূল কুশীলবরা নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটি তথ্য-প্রমাণসহ বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারীদের শনাক্ত করতে পারেনি।

গতকাল সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তদন্তকারী কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, গত বছরের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর জওয়ানদের হাতে ৫৭ কর্মকর্তা ও তিন নারীসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। এ মামলা তদন্তের জন্য সিআইডির ২০০ কর্মকর্তা একসঙ্গে কাজ করছেন। এক বছর তদন্তের পর তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন, বিডিআর সদস্যরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে ও দাবি আদায়ের জন্য সরকারকে চাপে রাখতে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে কর্মকর্তাদের হত্যা করে। তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের নজির নেই। তিনি বলেন, পিলখানার পরিধি সাড়ে চার কিলোমিটার।

এখানে বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে প্রায় ১১ হাজার সদস্য উপস্থিত ছিলেন। পিলখানা একটি সংরক্ষিত এলাকা। সেনাবাহিনী ও বিডিআর সদস্য ছাড়া সেখানে অন্য কোনো সাক্ষী পাওয়া দুরূহ। পিলখানার ভেতরে শতাধিক স্থাপনায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কাহার আকন্দ বলেন, বিদ্রোহ মামলায় এ পর্যন্ত দুই হাজার ২০৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মন্ত্রী, সাংসদ, র্যাব, বিডিআর কর্মকর্তা, পুলিশ, সেনাসদস্যসহ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সাত হাজার ৯৭৪ জনকে। তাঁদের মধ্যে সাধারণ নাগরিক রয়েছেন ৪৩১ জন, বিডিআরে কর্মরত সাধারণ সদস্য আছেন ৩১১ জন। গতকাল পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি লোককে রিমান্ডে আনা হয়েছে। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ৫২৩ জন। এ মামলার আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে তিন হাজার ৭০০টি।

নিহত বিডিআরের মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোন, পরিবারগুলোর স্বর্ণালংকারসহ লুণ্ঠিত অনেক মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। সম্মেলনে জানানো হয়, তদন্তকালে পাঁচ মন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে জওয়ানেরা ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। কাহার আকন্দ বলেন, এতে রাজনৈতিক দলের কোনো ইন্ধনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কেউ ব্যক্তিগতভাবে এতে জড়িয়েছিলেন।

তিনি বলেন, বিএনপির সাবেক সাংসদ নাসির উদ্দীন পিন্টু ও গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা তোরাব আলী বিডিআর সদস্যদের অসন্তোষের কথা জানতেন। তবে তাঁদের এই সম্পৃক্ততা ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক নয়। ওই সময় দুজন বিদেশি পিলখানায় ছিলেন, তাঁরা বেড়াতে এসেছিলেন। বিদ্রোহের পরপরই এক সেনা কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পিলখানার ভেতরে বাইরে থেকে আসা অস্ত্রসহ একটি গাড়ি তিনি দেখেছিলেন। ওই গাড়িতে মুখ বাঁধা জওয়ানেরা ছিলেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কাহার আকন্দ বলেন, সিআইডির তদন্তে পিলখানায় বাইরে থেকে আসা কোনো অস্ত্র বা গাড়ির প্রমাণ মেলেনি। গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি মিরপুর সেনানিবাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহ কারও একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ ঘটনার পেছনে একটি গোষ্ঠীর ইন্ধন রয়েছে। ’ এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কাহার আকন্দ বলেন, তদন্তে সিআইডি কোনো গোষ্ঠীর সন্ধান পায়নি। তাহলে ঘটনার পেছনে মূল কারণ কী ছিল, জানতে চাইলে কাহার আকন্দ বলেন, ডাল-ভাতসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিডিআর সদস্যদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভই বিদ্রোহের কারণ।

জওয়ানদের পরিকল্পনা ও বৈঠকের ব্যাপারে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এরা অনেক বৈঠক করেছে। এদের মধ্যে ১৯৯১ সালে বিদ্রোহে জড়িত ছিল এমন সদস্যও আছেন। বিডিআর জওয়ানেরা সাংসদ শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও ফজলে নূর তাপসসহ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও বিদ্রোহের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র ছিল কি না, জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগ থাকতে পারে। এর সঙ্গে বিদ্রোহের কোনো যোগসূত্র নেই। গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলীর জবানবন্দি প্রসঙ্গে কাহার আকন্দ বলেন, তিনি ও নাসির উদ্দীন পিন্টু ব্যক্তিগতভাবে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।

যোগাযোগ করা হলে বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) এম আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শুধু ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এত হিংস্র হতে পারে না। বিদ্রোহের সময় কর্মকর্তাদের বেছে বেছে খুন করা হয়েছে। যাঁরা নতুন বিডিআরে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরাও রেহাই পাননি। এটা সাধারণ ক্ষোভের ব্যাপার নয়। তিনি বলেন, বিডিআরকে নেতৃত্বহীন ও সেনাবাহিনীকে মেধাশূন্য করতেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে, যাতে করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, যেভাবে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছে, সেটা পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয়। যারা এসব পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত, তাদের শেকড় অনেক গভীরে হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, দীর্ঘ তদন্তের মাধ্যমে এদের খুঁজে বের করে আনতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।