আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৌলানা সাহেবের কাব্য প্রয়াস... (অনুগল্প)


এক. মৌলানা সাহেব কবিতা লিখতে বসেছেন। তিনি ইহজনমে কখনও কাব্যচর্চা করেননি। কবিতা তাঁর বিষয় নয়। কিন্তু আজ তাঁকে একটা কবিতা লিখতে হবে....একুশের কবিতা। স্কুলের একুশের সংকলন বের হচ্ছে।

হেড মাস্টার সাহেবের অনুরোধে এবং উৎসাহে মৌলানা সাহেব একখানা কবিতা লেখার প্রয়াস পেলেন... ''একুশ মানেই ফুলের হাসি একুশ তোমায় ভালবাসি একুশ আসে সবার প্রাণে একুশ হাসে গানে গানে....'' নাহ.... এটা কোন কবিতা হচ্ছেনা! শুধু ছন্দ মিলালেই কি কবিতা হয়!? আজকাল কবিতা হয় বিমূর্ত। কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার না করলে কবিতা হবে কি করে!? মৌলানা সাহেবের মনে ধরলোনা। নতুন কিছু লেখবেন তিনি! মৌলানা সাহেব আবার চেষ্টা করলেন... ''একুশ তুমি ছেঁড়া পালে দখিনা হাওয়া যৌবনা কিশোরীর টোল খাওয়া গাল নারীদেহের উষ্ণ আলিঙ্গনে আত্মাহুতি বসন্ত বেলায় বৈশাখী তান্ডব!...'' 'ছিঃ ছিঃ...এটা আমি কি লিখছি! কি সব আজেবাজে কথা লিখছি আমি?!'..... মৌলানা সাহেব নিজেকে ধিক্কার দিলেন। নিজের লেখা শব্দগুলি দেখে নিজেই লজ্জা পেলেন, বিব্রত হলেন । এটা-তো কোন একুশের কবিতা হতে পারেনা।

কবিতা লেখা তাঁর কর্ম নয়! কেন যে তিনি কবিতা লিখতে সম্মত হলেন?! কিছুতেই যে তাঁর কবিতা লেখা আসছেনা! দুই. চরফ্যাশন উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম দক্ষিণ আইচা। দক্ষিণ আইচা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ধর্মের শিক্ষক মৌলানা সিদ্দিকুর রহমান। সাদাসিদে নির্ভেজাল মানুষ! দুই কন্যা সন্তানের জনক। ছোট মেয়েটা জন্ম হওয়ার পর থেকেই স্ত্রী শরীফা বানু অসুস্থ্। পয়সার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না।

অংক ইংরেজীর শিক্ষকগণ প্রাইভেট পড়িয়ে বেশ আছেন, কিন্তু মৌলানা সাহেবের কাছে ধর্ম পড়ার প্রাইভেট ছাত্র কই!?। বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের অনিয়মিত বেতন দিয়েই কোন মতে চলে মৌলানা সাহেবের সংসার। এম.পি সাহেব আশ্বাস দিয়েছেন...এবার এমপিও-ভূক্ত করে দেবেন স্কুলকে। অনেকের মত সেই আশায় আছেন মৌলানা সাহেবও। এমপিও-ভূক্ত হলে নিয়মিত বেতন পাবেন... ন্যায্য বেতন পাবেন।

স্ত্রীর চিকিৎসা করাবেন। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারীর অনুষ্ঠানে এম.পি সাহেব-কে প্রধান অতিথি করা হয়েছে। আসবেন টিএনও সাহেবও। স্কুল পারিচালনা পরিষদের মেম্বার স্থানীয় এক উঠতি নেতা কিছু পয়সার জোগাড় করে দিয়েছেন। একটা একুশের সংকলনও বের করাবার ইচ্ছে আছে স্কুল কমিটির।

হেড মাস্টার সাহেব ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে অনুরোধ করেছেন একুশের সংকলনে লেখা দেবার জন্য। সবাই মিলে চেষ্টা করছেন... স্কুলটি যদি এমপিওভূক্ত হয়! মৌলানা সাহেবেরও ইচ্ছে এই প্রচেষ্টায় শরীক হওয়ার। তিনি হেড মাস্টার সাহেব কে কথা দিয়েছেন.... একটা কবিতা দেবেন তিনি। তিন. মৌলানা সাহেবের কিছুতেই কবিতা লেখা হচ্ছেনা। কয়েক দিন ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন... কিন্তু যুৎসই কিছু লিখে উঠতে পারছেন না তিনি।

মাগরেব নামাজ পড়ে খাতা কলম নিয়ে বসলেন.... দু'চার লাইন লিখে উঠে পড়লেন, লেখা হলোনা। কাল সকালের মধ্যে লেখা জমা দিতে হবে । মাওলানা সাহেব একবার চিন্তা করলেন... হেড স্যারকে বুঝিয়ে বললে তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন...তাঁকে দিয়ে কবিতা হবেনা। তিনি-তো অনুষ্ঠানে কোরান তেলওয়াত করবেনই... আবার কবিতা লেখা কেন?! কিন্তু পরক্ষণেই এ চিন্তা বাতিল করলেন মৌলানা সাহেব। এশার নামাজ পড়ে আবারও কাগজ কলম নিয়ে বসলেন তিনি।

মৌলানা সাহেব হাল ছাড়লেন না। কিছু একটা লিখবেনই তিনি! প্রবল ইচ্ছেশক্তির জোরে এবার লিখলেন তিনি ... আপন মনে লিখলেন, যা ভাল মনে করলেন লিখলেন। যা লিখলেন.... তা গদ্য, কি পদ্য সে চিন্তায় গেলেন না। শুধু একটানা লিখে গেলেন। পরদিন সকালে হেড স্যারের হাতে শিরোনামহীন লেখাটা জমা দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন মৌলানা সাহেব।

হেড মাষ্টার সাহেব লেখাটা পড়লেন... হা করে তাকিয়ে থাকলেন মৌলানা সাহেবের দিকে... তারপর বুক পকেটে রেখে দিলেন মৌলানা সাহেবের লেখাটা, মুখে কিছু বললেন না। চার. দক্ষিণ আইচা মাধ্যমিক স্কুলের মাঠে একুশের অনুষ্ঠানমালা চলছে। সকালেই হয়ে গেছে প্রভাত ফেরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন এম.পি সাহেব, টিএনও সাহেব... আরও অনেক গণ্যমান্য লোক। অতিথি-দের হাতে দেয়া হলো ৩২ পাতার একুশের সংকলন...' সময় শানায় সঙ্গীন'।

বাংলার শিক্ষক আবু বকর সাহেব সম্পাদনা করেছেন। একটা কপি হাতে পেলেন মৌলানা সাহেবও। সাদা-কালোয় করা প্রচ্ছদটা ভাল হয়েছে। দুরু দুরু বুকে পাতা উল্টিয়ে সূচীপত্র দেখার চেষ্টা করলেন মৌলানা সাহেব। প্রচ্ছদ উল্টিয়ে সংকলনের প্রথম পাতায় লেখাটা দেখেই চোখে পানি এসে গেল মৌলানা সাহেবেরে! হেড মাস্টার সাহেব নিজেই লেখার শিরোনাম দিয়ে দিয়েছেন নিশ্চয়ই।

গোটা গোটা হরফে লেখা.... মৌলানা সাহেব পড়তে লাগলেন- ''আ-মরি বাংলা ভাষা! মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান, সহকারী শিক্ষক। মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধই আসল কথা। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি গভীর মমত্ত্ববোধ হইতেই বায়ান্ন'র একুশে ফেব্রুয়ারী রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার রাজপথে বুকের রক্ত ঢালিয়া দিয়াছিলেন। যে ভাষায় আমরা 'মা' ডাক শিখিয়াছি সেই ভাষায় কথা বলিবার অধিকার ছিনাইয়া নেওয়ার মত অধর্ম আর হইতে পারেনা ! মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই শহীদের আত্মদান। মায়ের ভাষা মধুর ভাষা।

মাতৃভাষা ব্যাতিরিকে মনের ভাব, আবেগ, অনুভূতি সঠিকভাবে প্রকাশ করা অসম্ভব। কঠিন কাব্যচর্চা আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করে বটে, কিন্তু সহজ সরল মায়ের ভাষায় মনের ভাব প্রকাশের যে আনন্দ, তাহার তুলনা হয়না। বাংলা ভাষার প্রতি অন্তর হইতে আমাদের সম্মান জানাইতে হইবে। সকল স্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করিতে হইবে। তাহা হইলেই শহীদের রক্তের প্রতি সম্মান দেখানো হইবে।

(আমীন)''
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.