হোটেল বনলতা আবাসিকের বিশাল রিসিপশনে এখন কেউ নেই। তার সঙ্গে থাকা মিজানও গেছে বাইরে। সামনের সোফাগুলোও খালি। মাহতাব চারশ দুই নম্বর রুমের চাবিটা হাতে নিল। এই শান্ত রিসিপশনেও কথা ভেসে আসছে।
এলাকাটা কেমন?
ভালোই, তবে মাত্রাতিরিক্ত শান্ত।
একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস? এলাকার মানুষ কিন্তু খুবই নিরীহ টাইপের।
হুম। ঠিক।
মাহাতাব সশব্দে চাবিটা রেখে দিল।
চাবিটা রেখে দেবার শব্দের পর আর কোন শব্দ ভেসে আসছে না মাহাতাবের কানে।
এই রকম ঘটনা ঘটছে আজ আট মাস হলো। মাহাতাব অনেক কষ্টে বিষয়টার সাথে মোটামুটি অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। মাহাতাব এই হোটেল বনলতায় রিসিপশনে বসে। কোন রুমে কি সুবিধা আছে? কোনটার ভাড়া কত? এসব বলা আর নাম ঠিকানা লিখে রুম ভাড়া দেয়া, রুমের চাবি বুঝিয়ে দেয়া, আবার সে চাবি বুঝে নিজ দায়িত্বে রাখাই মাহাতাবের কাজ।
বনলতা এই ব্যবসায়ী এলাকার পুরাতন হোটেল। ভাড়া কম হওয়ায় এই হোটেলে মানুষের আনাগোনা একটু বেশি। তবে রুম কম থাকায় সবাইকে ভাড়া দেয়াও যায় না। দিনে অন্তত দুয়েকজনকে তো ফেরাতেই হয়।
বনলতায় এখন বারোটি রুম।
এর মধ্যে সাতটিতে বোর্ডার আছে। সব রুমের মানুষগুলোকে মাহতাবের চেনা হয়ে গেছে।
রহস্যময় ক্ষমতাটা না পেলে এতোকিছু জানা মাহতাবের কখনোই সম্ভব হতোনা। কি অদ্ভুত ক্ষমতা পেয়ে গেছে মাহতাব। ভাবতে নিজেরই গা শিরশির করে ওঠে।
একদিন রিসিপশনে একা বসে আছে মাহাতাব। আগের দিনের হিসেব মেলানো, কোন রুমে এখন কে আছে সে লিষ্ট দেখাসহ তার নিয়মিত কাজগুলো করছে। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে সে হোটেলের সব রুমের ডুপ্লিকেট চাবিগুলো দেখে। আজও দেখবে। একটা চাবি ধরতেই আজগুবি ঘটনাটা ঘটল।
কোথা থেকে যেন কথা ভেসে আসছে। দুই জন কথা বলছে। দুই বন্ধু। নাম শোনা যাচ্ছে, শফিক আর জাকির । তার নামগুলো পরিচিত লাগলো।
সে চারদিকে তাকিয়ে কাউকেই পেলনা। বাইরে খুঁজে দেখার জন্য রিসিপশনের ডেস্ক থেকে বের হবার জন্য হাত থেকে যেই চাবিটা রাখলো অমনি সব চুপ।
মাহাতাব হিসেব মেলাতে পারছেনা কি হলো?
এ হিসেব মিললো ছয় ঘন্টা পর। হিসেবটা হচ্ছে, ওই ডুপ্লিকেট চাবিতে। ভয়ংকর হিসেব।
মাহতাব ওই ডুপ্লিকেট চাবিগুলোর মধ্যে থেকে যে চাবিটাই নেয় অবাক ব্যাপার সে রুমের কথাবার্তা ভেসে আসে মাহাতাবের কানে।
প্রথম দুদিন অস্থির হলেও এখন কিছুটা সয়ে ওঠেছে সে বিষয়টায়।
অদ্ভুত ঘটনা। সে ভাবনায় সারাদিনই ডুবে থাকে মাহাতাব। এখনো সে ডুবে আছে।
এই কতক্ষণ ধরে তার সামনে একটা ভদ্রলোক দাড়িয়ে হ্যালো হ্যালো করছে সে শুনছেই না। লোকটারও বোধহয় আর ধৈর্য্যে কুলাচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে গেছেন। তাই একরকম চিৎকার দিলেন, হ্যালো ভাইজান। হোটেলে কি কোন রুম খালি আছে?
এবার মাহাতাব চমকে উঠলো।
তার ভাবনায় ছেদ পড়ল। মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হ্যা আছে?
সিঙ্গেল লাগবে নাকি ডবল?
২.
পৃথিবীর আশ্চর্য রহস্যময়তা মাহতাবকে অসুস্থ করে ফেলছে প্রতিদিন। মাহাতাব তার ক্ষমতার ভার বহন করতে করতে অস্থির হয়ে উঠেছে এই আট মাসে। যে অস্থিরতা এখন এই সময়ে এসে আরো জটিল ও ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করেছে।
৩.
গত আট মাসের মধ্যে মনে হয় মাহতাবের সবচেয়ে কঠিন সময়।
বিচিত্র সব লোকজনে ভরা পুরো হোটেল এখন। গত তিন দিনে যাদের কারনে মাহতাবের খাওয়া দাওয়া, ঘুম কোনটাই হচ্ছে না। খেতে বসলে খেতে পারছে না। মুখে ভাত নিয়ে বসে থাকে। অনেকণ পর তার খেয়াল হয় সে ভাত খাচ্ছে।
শুয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যায় ঘুম আসেনা। চোখের নিচে কালি ক্রমাগত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে প্রতিদিন।
তিন তলায় তিনটা রুমেই এখন সন্ত্রাসীদের বাস। তাদের প্ল্যান ভয়ঙ্কর। সব কিছু মাহতাব জানে।
কিন্তু কিছুই করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কিভাবে সে এগুলো বলবে? বললেই কি কেউ বিশ্বাস করবে? এই যে দোতলার দুইশ ছয় নম্বর রুমটা। সেখানে কি ঘটতে যাচ্ছে? সে কিভাবে জানাবে? কিভাবে বাঁচাবে ওই সরল মনা তরুণীকে? অথবা চার তলার চারশ এক নম্বর রুমে যে চরিত্রহীন লোকটা আছে? তার ব্যাপারেই সে কি করবে? প্রতিদিন যে তার স্ত্রীকে ফোন করছে, একটা বড় কাজে আটকে আছি তো দুয়েক দিনের মধ্যেই এসে পড়বো। কাজের ব্যাস্ততায় দম ফেলার সময় পাচ্ছিনা। তোমার সাথেও সময় নিয়ে কথা বলার সুযোগ হচ্ছেনা।
অথচ ফোন রাখার পর থেকেই ঘর থেকে ভেসে আসে এক অপরিচিত নারীর সাথে তার কথাবার্তা।
শুধু দুইশ তিন নম্বর রুমের লোকটা সম্পর্কে মাহতাবের কোন আইডিয়া নেই। কারন তার কথা শোনা যায় না। মাঝে মাঝে শুধু ফিসফিস দুয়েকটা কথা ভেসে আসে, এখনো কি আগের মতো হয়? কেউ কি শোনে? লোকটার কথা কিছুই বুঝতে পারেনা মাহতাব। বুঝার সময়ও নেই মাহতাবের।
এতগুলো ভয়ঙ্কর ঘটনার লোডই তার পক্ষে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিছু করারও নেই মাহতাবের। মাহতাব অসহায়। কাউকে সে বলতেও পারছেনা। বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
৪.
আজ শহরে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল। একটা নামীদামী ব্যাংকে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতির সময় ডাকাতদের গুলিতে দুজন মারাও গেছে। ঘটনায় পুরো শহর তোলপাড়। সবার মুখে মুখে দিনভর একটাই কথা।
এমন একটা ঘটনা ঘটবে কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। আগে থেকে জানা তো দুরে।
কিন্তু ঘটনাটা মাহতাব জানতো। এই সন্ত্রাসীগুলো তাদের হোটেলে থাকতো। এই হোটেলে বসেই এই প্ল্যান করেছে।
তাদের প্ল্যানের বেশি অর্ধেক মাহতাব তার নিজ কানে শুনেছেও।
কিছু করতে পারেনি। করার কিছু নেইও।
৫.
মাহতাব চারশ এক নম্বর রুমের ডুপ্লিকেট চাবিটা হাতে নিল। হাতে নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে ফেলে দিল চাবিটা।
ওই রুমে আবারো নতুন এক নারী। ছিঃ।
মাহতাবের খুব ইচ্ছে করছে ওই চরিত্রহীন লোকটাকে গিয়ে কষে একটা চড় মারতে। বউ থাকতেও দিনের পর দিন হোটেলে থাকে। শালা, হারামজাদা।
কিন্তু মাহতাবের কিছুই করার নেই। তার চাকরীর হিসেবে এটা পড়েনা। এই হোটেলে যারা থাকে তাদের টাকা দিয়েই মাহতাবের বেতন হয়। সে চলে। বাড়ীতে টাকা পাঠায়।
৬.
মাহতাবের হাতে দু’শ ছয় নম্বর রুমের চাবি। মাহতাবের এবার মাথা খারাপ হয়ে ওঠছে। সে মনোযোগ দিয়ে এক প্রতারক আরেক সরল মেয়ের কথাবার্তা শুনছে।
আরে বাবা বললাম তো বিয়ে হবেই।
না হাসান এমন কথা ছিলনা, তুমি বিয়ে করবে বলেই কিন্তু আমি তোমার সাথে বের হয়ে এসেছি।
আশ্চর্য, নীলা তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না?
না না, বিশ্বাস করবো না কেন? তবে এটা মনে রেখো হাসান, বিয়ে না করে আমার কিন্তু মুখ দেখানো সম্ভব না।
আরে সব হবে সব। কিন্তু তুমি এমন করছ কেন? আসো। কাছে আসো।
মাহতাব কথা শুনে আর ঘটনা চিন্তা অস্থির হয়ে ওঠলো।
আর কিছু শোনার প্রয়োজন নেই। চাবিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে দুইশ তিন নম্বর রুমের চাবি নিল। রহস্যময় লোকটার কি অবস্থায় আছে জানতে। কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে শুধু ওই কথাগুলোই শোনা যায়, এখনো কি আগের মতো হয়? কেউ কি শোনে? লোকটার কথা এবারও কিছু বুঝা হয়না মাহতাবের।
৭.
মাহাতাবের আর ভালো লাগছে না এসব। এই হোটেল জীবন তাকে অসুস্থ করে ফেলছে।
একটা সুন্দরী মেয়ে আজ হোটেলে ওঠেছে। তার সাথে একটা ছেলে আছে। চোখের পলক ফেলা যায় না এমন মেয়ে।
মেয়েটাকে দেখেই মাহতাব নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এই মেয়ে গত আট মাসে দু’বার এসেছিল। মেয়েটাকে প্রথমবার দেখে কেন জানি তার মায়ের কথা মনে হয়েছিল। ইস! এমন একটা মেয়ে বিয়ে করে যদি মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া যেত? মেয়েটা যখন আগেরবার এসেছিল তখন তার সাথে ছিল অন্য একজন। মাহতাব মেয়েটার দিকে না তাকিয়েই নাম এন্ট্রি করে রুমের চাবি দিয়ে দেয়।
এন্ট্রিতে মেয়েটার সাথের ছেলেটার পরিচয় লিখতে হয়েছে স্বামী। অথচ মাহাতাব জানে এই ছেলেটা তার স্বামী না। এর আগে যারা এসেছে। তাদের পরিচয়েও সে একই লেখা লিখেছিল।
মাহতাব এসব নিয়ে আর ভাবতে চায়না।
তার মাথা ধরে আসে। মাহতাব ঠিক করে আর এই চাকরী করা যাবেনা। আজই মালিককে বলে চলে যাবে সে। এই হোটেলে অনেক ভালো ভালো মানুষ আসে। অনেক ভালো ভালো ঘটনা ঘটে।
অনেক আনন্দের ঘটনা ঘটে।
কিন্তু গত কিছু দিনের ঘটনাগুলোতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। ছোট বেলা থেকে খারাপ বিষয়গুলো তাকে কষ্ট দিত। সে এগুলো সহ্য করতে পারে কম। তাই চাকরী ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই মাহতাবের।
মাহতাব চাবিগুলো গুছিয়ে ড্রয়ারে রেখে দেবার জন্য হাতে নেয়। অনেকগুলো দ্রুত রেখে দিলেও হাতে থেকে যায় দুইশ তিন নম্বর রুমের চাবি। সেই রহস্যময় লোকটার রুমের চাবি। এবার কিছুটা কথা শোনা যায় লোকটার। লোকটা একা একা কথা বলছে, না আগের মতো কোন ঘটনা হয়তো এখানে ঘটে না।
রিপিশনে বসে হয়তো এখন আর রুমের কথা শোনেনা কেউ। আচ্ছা, ওই ড্রয়ারে কি এখনো ডুপ্লিকেট চাবিগুলো রাখা আছে? একবার ধরে দেখতে পারলে ভালো লাগতো।
মাহাতাব চরম বিস্মিত হয়। সে দ্রুত রিশিপসন থেকে বেরিয়ে দোতলায় উঠে ওই লোকটার দরজা ধাক্কা দেয়। দরজা খুলতেই, মাহাতাব কিছুক্ষণ লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর কি মনে করে মুখ ফসকে জিজ্ঞাসা করে ফেলে ভাই কি এই হোটেলের রিশিপসনে কখনো চাকরী করেছেন?
প্রশ্ন শুনে লোকটা যেন ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। কিছু না বলে সঙ্গে সঙ্গে ভয়ংকর শব্দে দরজা লাগিয়ে দিল।
মাহতাব চুপ করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। কি করবে বুঝবে না পেরে নিচে নেমে সোজা রাস্তায় বেরিয়ে হাটতে শুরু করলো। পৃথিবীর রহস্যময়তায় সে এক রকম স্তব্দ হয়ে গেছে।
রাস্তার এক পাশ ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেটে যাচ্ছে মাহতাব।
৯.
আজ তিন বছর পরের কথা। মাহাতাব এসেছে তার এক সময়ের কর্মস্থল হোটেল বনলতায়। মাহাতাব চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে নিল। অনেক পাল্টে গেছে।
রিসিপশনের দিকে তাকিয়ে মাহতাব কেমন যেন হয়ে গেল। এই সেই জায়গা। রহস্যময় জায়গা। রিসিপশনে বসে আছে সুদর্শন এক যুবক। মাহতাব তার কাছ থেকে এক রুমের ভাড়া দিয়ে চাবি বুঝে নিল।
মাহতাবের দুদিন ভালোই কাটলো। আজই চলে যেতে হবে। এই দুদিন বাইরে বেরোবার চেয়ে হোটেলে বসেই কেটেছে তার। রুমগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছে সে। সেই সব রুম।
কত ঘটনা। আর দুইদিনে সে বারবার আনমনে অনেকবার বলেছে আচ্ছা, এখনও কি এমন হয়? এখনো রিসিপশনে বসে কেউ কথা শুনতে পায়?
হঠাৎ করে মাহাতাবের রুমে ধাক্কার শব্দ। মাহাতাব দরজা খুলল। দরজার সামনে কেন জানি চরম বিস্ময় নিয়ে রিসিপশনের সুদর্শন যুবটি দাঁড়িয়ে আছে। আজ তাকে প্রথমদিনের মতো সুন্দর লাগছেনা।
প্রচন্ড বিধস্ত মনে হলো। চোখের নিচে হালকা কালিও পড়েছে বোঝা যাচ্ছে। মাহাতাব তাকে কি এক প্রশ্ন করতে যাবে তার আগেই সে প্রশ্ন করে বসল,
ভাই কি এই হোটেলের রিশিপসনে কখনো চাকরী করেছেন?
প্রশ্ন শুনে মাহাতাব যেন ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। কি বলবে বুঝতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে ভয়ংকর শব্দে দরজা লাগিয়ে দিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।