আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কতিপয় প্রেমময় বা প্রেমহীনতামূলক পংক্তিমালা

জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে, চেতনার ছাপ জীবনধারাকে নয়

বর্ষা নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রমথ চৌধুরী শুরু করেছিলেন এমনিভাবে, “এমন দিনে কি লিখতে মন যায়?” আজকের এই নববসন্তের দিনে আমারও লিখতে মন পুরো যায় না, কিন্তু, কিছু কথা কইতে মন যায়। আজ সুন্দরবন দিবস। কে বা কারা এই দিবস চালু করেছেন জানি না। পত্রিকায় এর বিবরণ দেখলাম কিছুটা। আর যতটুকু দেখলাম, তাতে মনে হলো মূলত সুন্দরবনের কাছাকাছি জেলাতেই এটা উদযাপিত হয় বা হবে।

স্লোগানটাও সুন্দর। “বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসুন”। ওঃ, আজ তো বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও বটে। জানি ভাই, ওটা নেহাৎ বিশ্বায়ন বা বৈশ্যায়নের বাণিজ্যিক সত্য, তবে, অর্ধসত্য। যে-যুবতী বা যুবক আজ অপেক্ষায় আছে একটি কথার দ্বিধাথরথরচূড়ে সাতটি অমরাবতী ভর-করতে দেখার বা সেগুলো সৃষ্টি করার, ব্যাকুল হয়ে আছে চিরচঞ্চল কালকে একটি নিমেষের জন্যে থামানোর, উন্মুখ হয়ে আছে মর্ত্যে ধ্রুবতারকাকে ধরে আনতে কিংবা প্রতিজ্ঞা করেছে প্রলয়ের হুমকিও তাকে থামাতে পারবে না, তাদের কাছে নিশ্চয় এর সত্যতা আজি প্রাতে-ওঠা সূর্যের চাইতেও উজ্জ্বল।

ভালোবাসা তো সবারই চাই; ওটা ছাড়া বাঙালি আরো সুলভে পায় একটি মাত্র ব্যাপার-উপদেশ। ছোটবেলায় ঘরের লোকেদের ভালোবাসা, আরেকটু বড় হলে তাতে মন ভরে না। তাই যত্রতত্র খুঁজে ফিরি বিপরীত লিঙ্গের (বিরল কেউ-বা সমলিঙ্গেরও) ভালোবাসা। কেউ পায়, কেউ বা হারায়। সুখের জন্যেই তো, নিজের আত্মার সুখ, মানে নিজের সুখ।

এই স্বার্থপর সুখের জন্যে অন্যকে কষ্ট দিতেও বাধে না। যাক। কিন্তু, শুধু নারী-পুরুষের প্রেম কেন? বা, ভালোবাসা, যা হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, “মাংসের জন্যে মাংসের সোনালি আকাঙ্ক্ষা”? ভালোবাসা কি নেই সেই সন্তানের হৃদয়ে যে মায়ের বা বাবার রোগশয্যার পাশে বিনিদ্র রাত কাটায়, অনারোগ্য ব্যাধি জেনেও কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে অকাতরে? প্রেম কি নেই সেই মা-বাবার বা অন্য কোন আত্মীয়ের বুকে যে এমনিভাবে সন্তানের বা অন্য আত্মীয়ের জন্যে পালন করে একই ধর্ম? সেই বিদেশে পড়ে-থাকা একলা যুবক, যে শিশুসন্তানের মুখ দেখে নি অনেকদিন, প্রতিদিন যার দিনগত দুর্জয় পাপক্ষয়, তার বুকের ভেতর জমে-থাকা অপার প্রেমের ফল্গুধারার হিসেব করে কে? বা, সেই স্বল্প-আয়ের লেখক, যিনি বইমেলায় অনেকদিন ধরে জমানো টাকা একসাথে ব্যয় করে একখানি বই বের করেছেন এবং সমালোচকের শীতল অনীহায় যিনি তুমুল কাঁটায় আচ্ছন্ন, নিজের লেখার প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসার মূল্য কার কাছে তিনি চান? প্রবাসীদের দেশের জন্যে, দেশের প্রথম বৃষ্টির পর সোঁদামাটির ঘ্রাণ-হারানোর জন্যে, প্রভাতফেরির গম্ভীর ছায়ায় হাঁটার সুযোগ-হারানোর জন্যে, মায়ের কোলে শুয়ে নিরাপদ ছায়ায় নিশ্চিন্ত হওয়ার ক্ষণটি হারানোর জন্যে যে-যন্ত্রণা, ওতে লুকনো ভালোবাসা পরিমাপ করার সাধ্য কার? তারপরও, সেসব থাক। আজ তরুণদের মুহূর্ত, তারুণ্যের দিন। নববসন্তবিলাসের পরমপ্রিয় আন্দোলিত নিমেষ।

আজ পথে পথে গোলাপগাঁদা ইত্যাদি পুষ্পসমারোহের দিন, আজ রঙে রাঙানোর আর হৃদয়রাঙানোর মেলা, আজ প্রাণ খুলে আত্মহারা হওয়ার আর অন্যকে আপনহারা আর আপন-করার দিন। আজ কেউ প্রথম জানাবে তার রাতের সুনিদ্রাহারী বা হারিণীকে তার একান্ত ব্যক্তিগত মধুরতম, তীব্রতম কথাটি; কেউ বা প্রথমবারের মত স্পর্শসুখে মাতাল হবে’ কেউ উদযাপন বা যাপন করবে আবারো পুরনো সুখের অমরঅমৃত মুহূর্ত নতুন করে,…আর কেউ আমারি মতো ঝরাবকুল বিছানো পথে আনমনে স্মৃতিপথের গহনে হেঁটে চলে যাবে সবকিছু পেছনে ফেলে, যে-চলা শুরু হয়েছে অনেক আগেই, যে-চলা আমৃত্যু চলবে সে-পথে, যে-পথ শেষ হয়েছে সব-শেষের দেশে। আজ যারা জানাতে চান প্রেয়সীকে নিজের মনের গোপনতম গোলাপ-রাঙা কাহিনিটি, তাদের জন্যে একটি কবিতা উপহার দিতে চাই। নিজের মনের কথা জানানোর জন্যে, নিবেদন করার জন্যে এমন উপযোগী কাব্যমুহূর্ত সৃষ্টির ক্ষমতা আমি আর অন্য কোন কবিতায় খুঁজে পাই নি। হয়তো, থাকতেই পারে বাংলায় বা অন্যভাষায় এর চাইতেও অমোঘ রূপকাহিনি, কিন্তু, আমার কাছে এটিই সেরা।

ভিক্ষা যদি করিই, হব রাজভিখিরি সোনার থালা ধরব মেলে- দিতে চাইলে মোহর দিও রাজকুমারী, মোহর দিও, মোহর দিও, মোহর দিও। কানাকড়ির চাইতে আমার শূন্য থালা, সোনার থালা অনেক দামি। তাই সামান্য দিলে আমার ভরবে না মন- ভিক্ষা যদি করিই, তুমি মোহর দিও। রাজকুমারী তোমাকে চাই। নেই অর্ধেক রাজত্বে লোভ।

রাজমুকুটের বাসনা নেই, সিংহাসনে বসার চেয়ে তোমার পায়ের কাছে বসে থাকা অধিক প্রিয়। তাই সামান্য দিলে আমার ভরবে না মন, ভিক্ষা যদি করিই, তুমি মোহর দিও। [মোহরপ্রার্থীঃ আবু হাসান শাহরিয়ার] আরেঃ, শুধু ছেলেরাই বুঝি প্রেম নিবেদন করবে? মেয়েরা নয়? আসুন, তাহলে রমনীকুলের জন্যেও একটি- একবার ভিক্ষা চাও এ হাত আমার হাত, এই হাতে খুদকুঁড়ো ওঠে না কখনো দিতে হলে মোহরই দেব। কড়া নেড়ে প্রতীক্ষায় দাঁড়াও ভিক্ষুক কড়া নাড়ো, কড়া নাড়ো জীবনের অযুত বছর ঘুম একবার পারো তো ভাঙাও। এ চোখ আমার চোখ, এ চোখের চেয়ে বেশি নীল অন্য আর আকাশ কোথায়? তোমাকে মোহর দেব।

ভয় নেই। ভিক্ষা চাও। চেয়ে দেখো আমি আর যা কিছু্ই পারি একবার দু’হাত বাড়ালে তাকে আমি ফেরাতে পারি না। [সম্প্রদানঃ তসলিমা নাসরিন] আর যদি কিছুই বলতে না পারা যায়, তাহলে শুনুন, “কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া, তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া”, সাগর সেন বা বন্যার কণ্ঠে, যার ক্ষেত্রে যেটা খাটে। আর সৌভাগ্যবান যুগলদের জন্যে আরেকটি।

এটি আরেকটু প্রাচীন- ঠাকুর , তব পায়ে নমোনমঃ , পাপিষ্ঠ এই অক্ষমেরে ক্ষম , আজ বসন্তে বিনয় রাখো মম— বন্ধ করো শ্রীমদ্‌ভাগবত । শাস্ত্র যদি নেহাত পড়তে হবে গীত-গোবিন্দ খোলা হোক - না তবে । শপথ মম , বোলো না এই ভবে জীবনখানা শুধুই স্বপ্নবৎ । একটা দিনের সন্ধি করিয়াছি , বন্ধ আছে যমরাজের সমর— আজকে শুধু এক বেলারই তরে আমরা দোঁহে অমর দোঁহে অমর । স্বয়ং যদি আসেন আজি দ্বারে মান্‌ব নাকো রাজার দারোগারে— কেল্লা হতে ফৌজ সারে সারে দাঁড়ায় যদি , ওঁচায় ছোরা - ছুরি , বলব , ‘ রে ভাই , বেজার কোরো নাকো , গোল হতেছে , একটু থেমে থাকো , কৃপাণ - খোলা শিশুর খেলা রাখো খ্যাপার মতো কামান - ছোঁড়াছুঁড়ি ।

একটুখানি সরে গিয়ে করো সঙের মতো সঙিন ঝম - ঝমর । আজকে শুধু এক বেলারই তরে আমরা দোঁহে অমর দোঁহে অমর । ' বন্ধুজনে যদি পুণ্যফলে করেন দয়া , আসেন দলে দলে , গলায় বস্ত্র কব নয়নজলে , ‘ ভাগ্য নামে অতিবর্ষা - সম ! এক দিনেতে অধিক মেশামেশি শ্রান্তি বড়োই আনে শেষাশেষি , জান তো ভাই , দুটি প্রাণীর বেশি এ কুলায়ে কুলায় নাকো মম । ফাগুন - মাসে ঘরের টানাটানি— অনেক চাঁপা , অনেকগুলি ভ্রমর । ক্ষুদ্র আমার এই অমরাবতী— আমরা দুটি অমর , দুটি অমর ।

' [যুগলঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] যাক, যাঁরা করলেন তো করলেন, যাঁরা বললেন তো বললেন। আর যাঁরা কিছুই পেলেন না বেদনা, হতাশা আর শূন্যতা ছাড়া? আমার মতো যাঁরা এই দলে, তাঁদের জন্যে- তোমার চোখের চেয়ে বেশি নীল অন্য কোনও আকাশ ছিল না যেখানে উড়াল দিতে পারি তোমার স্পর্শের চেয়ে সুগভীর অন্য কোনও সমুদ্র ছিল না যেখানে তলিয়ে যেতে পারি তোমাকে দ্যাখার চেয়ে নির্নিমেষ অন্য কোনও দ্রষ্টব্য ছিল না যেখানে নিমগ্ন হতে পারি তোমাকে খোঁজার চেয়ে বেশি দূর অন্য কোনও গন্তব্য ছিল না যেখানে হারিয়ে যেতে পারি। কেবল তোমার চেয়ে বেশি দীর্ঘ তুমিহীন একাকী জীবন। [তুলাদণ্ডঃ আবু হাসান শাহরিয়ার] নিজের বেদনা আর কি বলি। আজকের দিনে কারো সৌভাগ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলারও মানে হয় না।

অন্যের ক্ষতি হতে পারে। তাই, শুধু এই পংক্তি গুনগুন করতে করতেই বিদায় নেই, “কী জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়…”

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।