গৃহশ্রমে মজুরী হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু
স্পার্টাকাসের মৃত্যু নেই। নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্পার্টাকাসদের জন্ম হয় বিরামহীনভাবে। ফার্স্টের অনবদ্য সৃষ্টি স্পার্টাকাস উপন্যাসে এভাবেই দাস বিদ্রোহের মহানায়ককে উপস্থাপন করা হয়েছে। আধুনিক সাহিত্যের উপন্যাসে অতীত মানুষের সংগ্রামের কাহিনী উপস্থাপনের এমন নজির খুব বেশি একটা নেই। ফাস্ট শুধুমাত্র স্পার্টাকাসের মধ্যেই তার সৃষ্টি থামিয়ে রাখেননি।
আরো একাধিক উপন্যাসে মানুষের সংগ্রামের বিস্তৃত কাহিনী তিনি তুলে ধরেছেন। পিকস্কিল উপন্যাসে দেখা যায়, ফাস্ট কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং নিপীড়নের দৃশ্য চিত্রিত করেছেন। যা তাদের আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী হতে ভূমিকা রাখে। একইভাবে সাইলাস টিম্বারম্যান, ডিনার পার্টিসহ আরো একাধিক গ্রন্থে প্রচলিত সমাজের অন্তসারশূন্যতার উদাহরণ তিনি চমৎকারভাবে বিবৃত করেছেন। এর জন্য অবশ্য তাকে কম মূল্য দিতে হয়নি।
জেলে যাওয়া থেকে শুরু করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের রাষ্ট্রদ্রোহীতা মামলারও শিকার হয়েছেন।
হাতে গোণা আধুনিক মার্কিন সাহিত্যিকদের একজন হচ্ছেন ফাস্ট। শুধুমাত্র শিল্পের জন্য শিল্প নির্মাণের মধ্যেই তিনি আবদ্ধ থাকেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই তার মাতৃভূমি যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র ব্যাপকভাবে অর্জন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ দেশের অর্থনীতি আগ্রাসী রূপ নেয়।
কিন্তু, একজন মার্কিন নাগরিক হওয়ার পরও তিনি এসব আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। লেখনী দিয়ে মার্কিন আগ্রাসনের বর্ণনা ফার্স্ট চমৎকারভাবে বিভিন্ন উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। ফাস্টকে ছদ্মনামেও লেখালেখি করতে দেখা যায়। তার এ রকম দু’টি নাম হচ্ছে ই.ভি চুন্নিংঘাম এবং ওয়াল্টার এরিকসন।
তার পুরো নাম হাওয়ার্ড মেলভিন ফাস্ট।
তিনি নিউইয়র্কে ১৯১৪-এর ১১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মা আইডি (নী মিলার) ছিলেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভুদ আমেরিকান ইহুদী। অন্যদিকে বাবা বার্নি ফার্স্ট ইউক্রেন বংশোদ্ভুত আমেরিকান। ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা ফাস্টকে কখনো স্পর্শ করেনি। তার কিশোর বয়সেই প্যালেস্টাইনে ইহুদী বসতি প্রক্রিয়া শুরু হয়।
কিন্তু, একই সময় ফাস্টের বিভিন্ন লেখায় সাম্্রাজ্যবাদ বিরোধী শ্লোগানের আধিক্য লক্ষ করা যায়। প্যালেস্টাইনে ইহুদী আধিপত্যকে তিনি কখনো সমর্থন করেননি। ১৯২৩-এ ফাস্টের মায়ের মৃত্যুর পর বাবা খুব বেশিদিন কর্মক্ষম ছিলেন না। ফলে কিশোর জীবন দারিদ্রতার মধ্যে অতিক্রান্ত হয়। পরিবার থেকে ভরণপোষণের অক্ষমতার কারণে, ফার্স্টের ছোটভাই জুলিয়াস জনৈক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যায়।
উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে এই জুলিয়াস ফাস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকজন বিখ্যাত সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি পান। অন্যদিকে ফাস্ট এবং তার বড় ভাই জেরোম সংবাদপত্র বিক্রির সাথে যুক্ত হন। ওই সময় হাওয়ার্ড ফাস্ট নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরীতে খণ্ডকালীন চাকরীতে যোগ দেন। এখনের মত ওই সময়ও এ লাইব্রেরী বিশ্বের অন্যতম গবেষণাগার হিসেবে পরিচিত ছিল। যা হোক, এখানে চাকরী করার মাধ্যমে ফাস্ট পড়ার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহী হয়ে উঠে।
যা তাকে পরবর্তীতে সময়ে একজন ভালো লেখক হতে সহায়তা করে।
হাওয়ার্ড ফাস্ট কিশোর বয়সেই লেখালেখি শুরু করেন। তার লেখনি সত্বা বিকাশে ওই সময়ে একটা ঘটনা বিশেষ প্রভাব ফেলে। চাকরীর খুঁজে ফাস্ট তখন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল বিনাভাড়ায় রেলে ভ্রমণ করেন। যা তার জন্য অভিজ্ঞতাকে ব্যাপকভাবে ঋদ্ধ করে।
১৯৩৩-এ মাত্র ১৮ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস ‘টু ভ্যালিস’ বা দুই উপত্যকা প্রকাশিত হয়। তার প্রণীত প্রথম জনপ্রিয় সাহিত্য কর্ম হচ্ছে ‘সিটিজেন টম পেইন’। এখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি টমাস পেইনের জীবন কর্ম চিত্রিত করেন। টমাস পেইন রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি একাধারে লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং অসংখ্য ছোট বড় গ্রন্থের প্রণেতা। তিনি ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হন। স্বদেশী ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে টমাস মার্কিন স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। হাওয়ার্ড ফাস্টের অধ্যায়ন জগতের বিশেষভাবে প্রিয় বিষয়বস্তু ছিল ইতিহাস। তার বিভিন্ন উপন্যাস নির্মাণে ইতিহাসের আশ্রয় নিতে দেখা যায়। তার প্রথম জীবনের এমন একটি উপন্যাস হচ্ছে ‘দ্যা লাস্ট ফন্টিয়ার’।
এখানে উত্তর আমেরিকার আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ‘চেইন্নে’র স্বদেশভূমি ফিরে পাওয়ার আন্দোলন তুলে ধরেন। ওই সময়কার তার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস হচ্ছে ‘ফ্রিডম রোড’। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিকনস্ট্রাকশান সময়কালে দাসদের প্রকৃত পরিস্থিতি উপস্থাপিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র্রে রিকনস্ট্রাকশন যুগ বলতে ১৮৬৩ থেকে ১৮৭৭ কে বুঝানো হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে খুব কাছ থেকে হাওয়ার্ড ফাস্ট দেখতে সমর্থ্য হয়েছিলেন।
এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের যুুদ্ধ তথ্য কার্যালয়ে চাকরী করেন। ওই সময় তিনি ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ বিভাগে কাজ করেন। কিন্তু, অচিরেই বুঝতে পারেন, বিশ্বযুদ্ধের মূল লক্ষ হচ্ছে বাজার দখল। এ ব্যাপারটি ফাস্টের উপলব্দিতে আসার পর তিনি ১৯৪৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ফাস্টের জীবনে দেখা যায়, সমাজের অসঙ্গতি লেখার মধ্যেই তার কর্মজীবন সীমিত রাখেননি।
তিনি সরাসরি রাজনৈতিক ময়দানে এসব অসঙ্গতির বিরোধিতা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রেপ্রিজেন্টেশন কমিটি ১৯৫০-এ ফাস্টকে তলব করে। জিজ্ঞেসা করা হয়, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কারা? পাশাপাশি স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে নিহত আমেরিকান সৈনিকদের সন্তানের জন্য কারা কারা তহবিল যোগাড় করছে। সে সময় হাউস অব রেপ্রিজেন্টেশন যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বিরোধী তদন্ত পরিচালনা করত। তাদের প্রদত্ত প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংবিধানের ১ম সংশোধনীর ক্ষমতাবলে তিনি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নন।
তারপরও তাকে এর জন্য শাস্তি পেতে হয়। শাস্তি হিসেবে ওই বছর তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। জেলে থাকা অবস্থায় হাওয়ার্ড ফাস্ট তার যুগান্তকারী সৃষ্টি স্পার্টাকাস উপন্যাস লিখেন। এ উপন্যাস পরবর্তীতে একাধিক ভাষায় অসংখ্যবার মুদ্রীত হয়েছে। উপন্যাসে খ্রিস্ট পূর্ব ৭১ সালে রোমে সংঘটিত দাস বিদ্রোহের কাহিনী তুলে ধরা হয়।
রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে পরবর্তীতে স্বনামে লেখালেখি করা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এ সময় তিনি ছদ্ম নামে লেখা প্রকাশের কাজ চালিয়ে যান। জেল থেকে বের হয়ে তিনি প্রকাশনী সংস্থা খুলেন। প্রকাশনী সংস্থার নাম দেন ব্লু হ্যারুন প্রেস। এখান থেকে ১৯৫১ সালে তিনি স্পার্টাকার্স প্রকাশ করেন।
ফাস্টের আরেক যুগান্তকারী সৃষ্টি সাইলাস টিম্বারম্যান এ প্রকাশনী সংস্থা থেকে ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি মার্কিন সমাজের নিপীড়নের বিভিন্ন ধরন তুলে ধরেন। সাইলাস টিম্বারম্যান উপন্যাসের কাহিনীর সাথে তার জীবনের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হচ্ছে সাইলাস টিম্বারম্যান। তিনি পেশায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
টিম্বারম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্ক টোয়েন পড়াতেন। আর তা হয়ে যায় শাসক শ্রেণীর জন্য চুশূল। কেননা মার্ক টোয়েনের উপন্যাসে ঔপনিবেশিক শোষণের কাহিনী বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা গহয়েছে। আর তা প্রকারন্তরে মার্কিন শোষণের বিরোধিতার পর্যায়ে পড়ে। তাছাড়া টিম্বারম্যান যুক্তরাষ্ট্রের কোরিয়া আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেন।
ফলে তাকে আদালতে তলব করে রাষ্ট্রদ্রোহীতার খেতাব দেয়া হয়। এছাড়া তার বাসায় গুপ্ত হামলার ঘটনাও ঘটে। শেষ পর্যন্ত তাকে জেল খাটতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকজন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী মাইকেল প্যারেন্টির জীবন সংগ্রামও এ উপন্যাসের বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্যারেন্টির ঘটনা উপন্যাস নির্মাণের আরো পড়ে।
ভিয়েতনাম আগ্রাসনের সময় প্যারেন্টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তিনি এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ছাত্র শিক্ষকদের এ আন্দোলনে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকাও রাখেন। আর তা মার্কিন শাসকদের কাছে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে তাকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
যা হোক, ফাস্টের জীবনে ফিরে আসা যাক। ওই সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমজীবী মানুষের সংবাদপত্র ডেইলি ওয়ার্কারে স্টাফ রাইটার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৩ সালে ফাস্ট স্ট্যালিন শান্তি পুরষ্কার পান। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তিনি অনুগত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে স্ট্যালিন প্রসঙ্গে তৃতীয় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভের সমালোচনা এবং হাঙ্গেীরতে রাশান ভূমিকার বিরোধিতা করে তিনি দল ত্যাগ করেন।
হাওয়ার্ড ফাস্ট স্বনামে ৪০টির বেশি উপন্যাস লিখেন। এছাড়া ছদ্মনাম ই.ভি চুন্নিগাম ব্যবহার করে ২০টি উপন্যাস লিখেন। তার উল্লেখযোগ্য কিছু সাহিত্য কর্ম হচ্ছে দ্যা আমেরিকান ঃ এ মিডল ওয়েস্টার্ন লিজেন্ড (১৯৪৬), সিটিজেন টম পেইন (১৯৪৩), দ্যা গোল্ডেন রিভার (১৯৬০), এপ্রিল মর্নিং (১৯৬১), পাওয়ার (১৯৬২), দ্যা ইমিগ্র্যান্ট (১৯৭৭), দ্যা আউটসাইডার (১৯৮৪), দ্যা ডিনার পার্টি (১৯৮৭) ইত্যাদি। তিনি ১৯৬৫ সালে মিরাজ নামক একটি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্টও লিখেন। ফাস্টের সবশেষ উপন্যাস হচ্ছে বাঙ্কার হিল (২০০১)।
হাওয়ার্ড ফাস্টের ছেলে জোনাথন ফাস্টও একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ মহান মার্কিন সাহিত্যিক ২০০৩-এর ১২ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।