আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হামিম আর ফিরে আসবে না

সকালের মিষ্টি রোদ পেরিয়ে আমি এখন মধ্যগগনে,
হামিম আর বাড়ি ফেরেনি। ফেরেনি তার মমতাময়ী মাও। মৃত্যুর গভীর ঘোর অন্ধকারে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে ফুলের মতো এই শিশুটি। অচেতন মা হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। তিনি জানেন না, তার বুকের নিধি আর কোনোদিন 'মা' বলে ডাকবে না।

কাকরাইলের উইল্স লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের কেজির ছাত্র ৫ বছরের হামিম শেখকে গতকাল সকাল ১১টায় স্কুলের সামনেই ঘাতক বাস চাপা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। হামিম সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারায়। মা কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে সংকটাপন্ন। বেঁচে গেলেও চোখ দুটি হয়তো বাঁচবে না_ সারাজীবন হামিমের নানা স্মৃতি তাকে উন্মাদপ্রায় করে রাখবে। বেপরোয়া বাস-ট্রাক চালকরা নির্বিচারে মানুষ খুন করছে_ মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই।

সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র ৩ বছর কারাদণ্ড। হামিমের ঘাতক ধরা পড়েছে। থানায় তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত, দুঃখ ভারাক্রান্ত বলে মনে হয়নি। সে সমকালকে নির্বিকারে বলেছে : রাস্তায় নামছি দুর্ঘটনা হইবই। সবই আল্লাহ্র লীলাখেলা।

পুলিশরে জিগাইছি কবে ছাড়া পামু। পুলিশ কইছে পাইবি না। আদালতে গিয়া দেহি কী হয়! বেলা যখন ১১টা : বেলা ১১টা। উইল্স লিটল ফ্লাওয়ারের সকালের পালার ছুটি হয়েছে। হাসিখুশি শিশুরা মায়ের হাত ধরে কেউ হেঁটে চলেছে।

কেউ গাড়ি কিংবা রিকশায় উঠছে। কলকাকলিতে মুখরিত স্কুলের সামনের রাস্তা। হামিম মার হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছিল। হঠাৎ দ্রুতগতিতে ছুটে আসা একটি যন্ত্রদানব নিষ্পেষিত করল হামিমকে। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তার মস্তক।

মগজ ছিটকে পড়ে রাস্তায়। শক্ত করে হাত ধরে থাকা নাড়িছেঁড়া ধনকে বাঁচানোর কোনো সুযোগই পাননি মা সোনিয়া শেখ। বাসচাপায় তিনিও গুরুতর আহত। হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা হতভাগ্য মা জানেন না, তার বুকের মানিক আর নেই। হারিয়ে গেছে চিরতরে সকল মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে।

সে আর কখনও মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাবে না। বাবার বকুনিতে পালাবে না মায়ের আঁচলের নিচে। সময়-অসময়ে ধরবে না চুইংগাম কিংবা আইসক্রিম কেনার বায়না। একমাত্র শিশুসন্তানের করুণ মৃত্যু, স্ত্রী মরণাপন্ন। শোকে পাগলপ্রায় হামিমের বাবা মোতালেব শেখ।

শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে হামিমের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, তার ছোট ছোট বল্পুব্দরা। শোক জানাতে দু'দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে উইল্স লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতা ৫-৬টি যানবাহন ভাংচুর করেছে। কাকরাইল-বিজয়নগর সড়কে বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাচল। প্রায় এক ঘণ্টা পর পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

ঘাতক বাস ও চালককে আটক করেছে রমনা থানা পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার পরই স্থানীয় লোকজন অচেতন অবস্থায় সোনিয়া শেখকে উদ্ধার করে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে দ্রুত সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বাসের ধাক্কায় সোনিয়ার ডান চোয়াল থেতলে গেছে। চিরতরে তিনি অন্ধ হয়ে যেতে পারেন।

শিশু হামিমের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। দুর্ঘটনার পর বাসটি দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বাসের যাত্রীরা চালক শামসুর রহমানসহ ঘাতক বাসটি আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুরান ঢাকার বংশাল এলাকার লুৎফর রহমান লেনের ১০৮ নম্বর বাসা সবসময় মুখর থাকত হামিমের দুষ্টুমি আর দুরন্তপনায়। এখন কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে বাসাটিতে। মোতালেব শেখের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে।

উলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে জানান, হামিম শেখ উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাতি শাখার কেজি ক্লাসের ছাত্র। হামিমের মৃত্যুর ঘটনায় স্কুল দু'দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সব অভিভাবককে স্কুলে যাতায়াতের সময় যে কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারের অনুরোধ জানান তিনি। একাধিক অভিভাবক অভিযোগ করেছেন, স্কুলের সামনে একটি ফুটওভারব্রিজ থাকলেও তার ব্যবহার প্রায় অসম্ভব। ফুটওভারব্রিজ পতিতাসহ বিভিন্ন শ্রেণীর ভবঘুরের দখলে থাকে।

এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপনে ফুটওভারব্রিজ ঢেকে থাকায় কেউ ব্যবহার করেন না। রমনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শিবলী নোমান জানান, চালক শামসুর রহমান ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে বাস চালাত। তার কাছ থেকে ওই লাইসেন্স উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার একেএম শহিদুল হক সমকালকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় ড্রাইভারের অপরাধ প্রমাণ করা গেলে ২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালকদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না।

তিনি বলেন, নিরাপদ সড়কের জন্য আমিও নিয়মিত যুদ্ধ করে যাচ্ছি। কিছুটা সফলতা এলেও রাজধানীতে অল্প সড়কে অধিক যান চলাচলের কারণে পুরোপুরি সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ কমিশনার বলেন, ড্রাইভারদের সচেতনতার সঙ্গে গাড়ি চালানোর জন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আমরা প্রায়ই বৈঠক করছি। বুধবার বাসচাপায় শিশু হামিমের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক। চালকের শাস্তি নিশ্চিত করতে পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হবে।

রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল ছাত্রছাত্রী ছাড়াও প্রতিনিয়তই জীবন দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এরপরও গাড়িচালকদের বেপরোয়া গতি থামানো যাচ্ছে না। ২০০৫ সালে শাহবাগ মোড়ে দ্রুতগামী বাসের চাপায় নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী শাম্মি আক্তার হ্যাপি। একই স্থানে ঘাতক বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে মোবারক ও রিয়াদসহ আরও অনেক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এই এলাকায় একটি ফুটওভারব্রিজ নির্মিত হলেও এর কোনো সুফল পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা।

আন্দোলনকারীদের দাবি, শাহবাগ মোড় থেকে ফুটওভারব্রিজের দূরত্ব বেশি হওয়ায় পথচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। বাংলামোটর এলাকায় দ্রুতগামী বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে মারা যান দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ও কবি ইউসুফ পাশা। এরপর সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি ফুটওভারব্রিজ। কিন্তু পথচারীরা সেদিকে যান না। রাস্তা পার হন ঝুঁকি নিয়েই।

ঢাকা কলেজ এবং মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে দ্রুতগামী বাসের ধাক্কায় আহত হওয়ার ঘটনাও নিত্য-নৈমিত্তিক। ছাত্র আন্দোলনের মুখে এই এলাকায় গতিরোধক তৈরি হলেও দুর্ঘটনার হার কমেনি। এ নিয়ে প্রতিনিয়তই ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ, গাড়ি ভাংচুর করছে। নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, দুর্ঘটনায় প্রচলিত যে আইন রয়েছে, তা কার্যকর নয়; এবং এটাকে শাস্তি হিসেবে গণ্য করা যায় না। এছাড়া এই আইনের কোনো ব্যবহারও নেই।

দেশে প্রতি বছর গড়ে ১০-১২ হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। আহত হন ২০-২৫ হাজার। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এসব দুর্ঘটনার একটিরও বিচার হয়নি। আইনি দুর্বলতার কারণে অনেকেই শুরুতেই বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দেন। সড়ক দুর্ঘটনায় কঠোর কোনো আইনের বিধান নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তৈরি করা আইন অনুযায়ী দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং ১ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

এক্ষেত্রে দুর্ঘটনার জন্য চালক বা বাসের দোষ নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের আইন সংস্কার করে কঠোর আইন করা না হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা বেড়েই চলবে। এক্ষেত্রে কোনো দুর্ঘটনার পর শুধু বাস বা চালকের শাস্তির বিধান না করে দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তির বিধান করতে হবে। http://www.shamokal.com/
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।