"পুখু সুবু কুরু রুবু রুতু পুহুল, কুনুনু কুসুমু কুলু সুকুলু ফুটুলু
২১ ডিসেম্বর ২০১২। পৃথিবীর কোনো একটি শহর।
হঠাৎ করে পুরো এলাকার ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। একেবারে নেই হয়ে গেছে সূর্য। পুরো পৃথিবী জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারের কালো চাদর।
হঠাৎ লকলক করে মাটির ভেতর থেকে জ্বলে উঠলো তীব্র ভয়াবহ আগুন। প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হচ্ছে একের পর এক সব স্থাপনা। সাগরের পানি ফুঁসে উঠে তীব্র জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জনপদ। ভয়াবহ শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়া বিভ্রান্ত লোকজন ছুটোছুটি করছে। পরিস্কার করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তান্ডবলীলায় নিমেষে ধ্বংস হয়ে গেলো গোটা জীবজগত।
এইচ জি ওয়েলসের লেখা কল্পকাহিনীর কোনো বইয়ের অনুচ্ছেদ এটি হতে পারতো এটি বা স্পিলবার্গের বানানো নতুন কোনো সাই-ফাই মুভির একটি দৃশ্য। অথচ বলা হচ্ছে, এমনটি হবে বলেই নাকি ভবিষ্যৎবাণী করে গেছে আজ থেকে হাজার বছর আগের প্রাচীন এক সভ্যতার অধিবাসী ‘মায়া’রা। তাদের মতে হুমকির মুখেই রয়েছে আমাদের এই পৃথিবী।
কী আছে সেই মায়ান লিপিতে? কেমন সেই হুমকির মাত্রা এবং বাস্তবতা? জানতে হলে একটু পেছনের দিকের ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে।
আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে আজকের মেক্সিকোতে ‘মায়া’ নামের একটা সভ্যতা ছিলো।
প্রাচীন সেই সভ্যতার অধিবাসী মায়ারা খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিলো পৃথিবীতে। মায়ারা বেশ শিক্ষিত জাতি হিসেবেই পরিচিত ছিলো সবার কাছে। প্রাচীন সেই মায়াদের নিজস্ব ভাষারীতি এবং লেখন পদ্ধতিও ছিলো। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায়, বিশেষ করে জ্যোর্তিবিজ্ঞানে খুবই পারদর্শী ছিলো তারা।
সেই সময়ে মায়ারা পৃথিবীর জন্য দীর্ঘ এক ক্যালেন্ডার তৈরি করে।
তখন থেকে শুরু হয়ে সেই ক্যালেন্ডারটি বর্তমান ২০১২ সালের ২১ অথবা ২৩ তারিখে এসে শেষ হয়ে গেছে। এই বিষয়টি নিয়েই আসলে যত সমস্যার শুরু। নৃবিজ্ঞানীদের যে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে তা হচ্ছে মায়ারা যদি এতো দীর্ঘ দিনের ক্যালেন্ডার তৈরি করলোই তবে তা ২০১২ সালের ডিসেম্বরের ২১ তারিখে এসেই কেন শেষ হলো? আরো কিছুদিন আগে কিংবা পরে কেন শেষ হলো না? এই প্রশ্নগুলো মাথায় রেখে বিভিন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, নৃ-বিজ্ঞানীরা এর কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করেন। তখন থেকেই বের হতে থাকে একের পর এক চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। একেক বিজ্ঞানী একেক রকম তথ্য দিতে থাকেন।
এদের কারও মতে, মায়াদের ওই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০১২ সালের ২১ অথবা ২৩ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে অর্থাৎ মহাপ্রলয় সংঘটিত হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন ওই দিন প্রলয়ের কোন ঘটনা ঘটবে না তবে পৃথিবীতে এমন কিছু হবে যাতে পৃথিবীর ভৌগলিক অবস্থানসহ অনেক কিছুরই রূপান্তর ঘটে যাবে। এটা পৃথিবীবাসীর জন্য মঙ্গলজনকই হবে এবং এরপর শুরু হবে এক নতুন যুগের।
মায়াদের এই প্রাচীন মিথ নিয়ে এভাবে ব্যাপক গবেষণা, পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার কথাগুলো নানা সময়ে নানা বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আবার ইন্টারনেটের মাধ্যমেও ছড়িয়ে যায় এই কথাগুলো।
অনেক চ্যানেল যেমন: ডিসকভারি এই বিষয়টি নিয়ে আবার ডকুমেন্টারিও প্রচার করে। এর ফলে পৃথিবীব্যাপী একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ এটা বিশ্বাস করে বসে যে সত্যিই সেদিন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। পরবর্তীতে এই বিষয়টি নিয়ে আরো ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণা শুরু হয়।
এই মায়ান মিথের বিষয়ে মূলধারার মায়া গবেষকরা আবার বলছেন ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর মায়া ক্যালেন্ডারের সঙ্গে পৃথিবীও যে ধ্বংস হয়ে যাবে এই কথাটি ঠিক নয়।
এই গুজব দিয়ে মায়াদের আসলে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পৃথিবীর ধ্বংস এই বিশ্বাসের সঙ্গে মায়াদের কোনো সংশ্রব নেই।
অন্যদিকে বিজ্ঞানী সমাজ মহাপ্রলয়ের এই মিথকে অস্বীকার করে বলছেন ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের এই মিথটি আসলে অবৈজ্ঞানিক। এর কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ও তবে পৃথিবী ভৌত বিজ্ঞানের যে সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত তা মিথ্যা হয়ে যাবে।
অন্যদিকে অনেক বিশেষজ্ঞ আবার বলছেন, এই মিথটা আসলে মায়াদের নয়। এই ক্যালেন্ডার আসলে মেসোআমেরিকান ওলমেক সভ্যতার মানুষদের তৈরি করা। এই ওলমেকদের সঙ্গে মায়াদের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো। পরবর্তীতে ওলমেকদের এই দীর্ঘ ক্যালেন্ডারটি মায়াদের নামে পরিচিত পায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ারা একটি ‘সময় চক্র‘কে বিশ্বাস করতো।
তাদের মতে এই ‘সময় চক্র’ অনুসারে পৃথিবীর সবকিছু চালিত হয়। তাদের সময় হিসেবের জন্য আলাদা একটি মাপকাঠি ছিলো। এই মাপকাঠি অনুসারে ২০ দিনে হয় এক ইউনাল, ১৮ ইউনাল তথা ৩৬০ দিনে হয় এক টান, ২০ টানে হয় কে’ আটান, ২০ কে আটন তথা ১৪৪,০০০ দিনে হয় বি’ এক টান। এই হিসাব মতে মায়াদের তারিখ ৮.৩.২.১০.১৫ কে যদি ব্যাখ্যা করা হয় তবে তার মানে হবে ৮ বি’ এক টান, ৩ কে’ আটান, ২ টান, ১০ ইউনাল এবং ১৫ দিন।
ধারণা করা হয় মায়ারা বিশ্বাস করতো পৃথিবীর সময়ের একটা নিজস্ব চক্র আছে।
প্রতি ১৩ বি’ এক টান পর পর একটা পরিবর্তন আসে পৃথিবীতে। এই পরিবর্তনটা যে আসলে কি, অর্থাৎ ভালো না মন্দ তা নিয়েই যতো গোলমাল।
মায়াদের ক্যালেন্ডারের শেষ তারিখ ১৩.০.০.০০ যা পশ্চিমা ক্যালেন্ডারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় পশ্চিমা ক্যালেন্ডারের ২০১২ সালের ২১ অথবা ২৩ ডিসেম্বর এসে এই চক্রটি শেষ হয়। ১৯৫৭ সালে একজন মায়া অ্যাস্ট্রনমার মাউড ওরমেস্টার মেকমসন লিখেছিলেন যে ১৩ বি’ এক টানের চক্রটি যখন পূর্ণতা পাবে তা মায়াদের জন্য অত্যন্ত গুর্বত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলে বিবেচিত হবে। এর সঙ্গে আরো যোগ করেছেন মাইকেল ডি কোই।
তিনি বলেছেন, ‘পবিত্র এই ১৩ বি’ এক টান চক্রটি যে দিন পূর্ণ হবে (অর্থাৎ ২০১২ সালের ২১-২৩ ডিসেম্বর) সেদিন পৃথিবীসহ এর অধিবাসীদের জন্য শুর্ব হবে এক নতুন জীবনের (এটা কি মৃত্যু পরবর্তী জীবন?)।
‘কেই’ এর প্রলয় মতবাদ ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানী মহল গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে অন্যান্য গবেষকরা বলেন, ১৩ বি’ এক টানের মানে এই নয় যে যেদিন ক্যালেন্ডারটি শেষ সেদিনই প্রলয় কান্ড ঘটবে পৃথিবী জুড়ে; হতে পারে ঐদিন এমন কিছু ঘটবে যার ফলে সেদিন পৃথিবীতে উদযাপনযোগ্য কোন উৎসবের মুহূর্তও হতে পারে।
লিন্ডা শেলী এবং ডেভিড ফ্রেইডাল এই দু’জন মায়া গবেষক ও বিজ্ঞানী মায়াদের এই ১৩ বি’ এক টানের উপর দীর্ঘ এক গবেষণা করে শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ১৩ বি’ এক টানের চক্রটি আসলে ধ্বংসাত্মক কোন কিছু প্রকাশ করতে চায়নি। এর মানে হলো- সেদিন পৃথিবীতে ভালো কিছু ঘটবে।
তবে এতোদিন তাহলে মায়াদের ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিলো?
মায়াদের এই মিথটি নিয়ে খোদ মায়ারা কি ভাবছে? এ ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুয়েতেমালায় বসবাসকারী কিছু আদীবাসী মায়া, যারা এখনও প্রাচীন সেই মায়া ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তাদের দিন তারিখ হিসাব করে। ২০১২ সালের ২১-২৩ ডিসেম্বর এই ব্যাপারটি নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথাই নেই। অর্থাৎ তারা পৃথিবী ধ্বংসের কারণটি বিশ্বাস করে না। একই কথা বর্তমান যুগের মায়াদেরও। তাদের মতে, ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস নিয়ে যে মাতামাতি চলছে তা আসলে পশ্চিমা সংস্কৃতি ও তাদের বিশ্বাস।
এখানে ভুলভাবে মায়াদের জড়ানো হচ্ছে।
অনেক গবেষকের আবার বিশ্বাস, ওই দিন পৃথিবীর কৰপথে আসবে নতুন একটি গ্রহ, যার সাথে পৃথিবীর সরাসরি সংঘর্ষ হবে এবং ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। আবার কেউ কেউ বলছেন, সৌরজগতের মূল চালিকা শক্তি সূর্য, ছায়াপথ মিল্কিওয়েতে এমন কিছু ঘটবে যাতে ধ্বংস হতে পারে পৃথিবী নামে গ্রহটি।
অনেক গবেষক আবার এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, এদিন পৃথিবীর বাইরে থেকে মানুষের চেয়েও উন্নত প্রজাতির এবং বুদ্ধিমান ভিনগ্রহবাসীর আগমন হবে। এই ভিনগ্রহবাসীরা অবশ্য পৃথিবী ধ্বংস করবে না নতুন করে সাজাবে তেমন কিছু তারা বলেনি!
এখন এই মিথটি নিয়ে নতুন যুগের নতুন মানুষদের চিন্তাভাবনা কি? তারা এ বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছে? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ তর্বণদের বিশ্বাস এই মিথটি আসলে পশ্চিমাদের কারসাজি।
এর আগেও বেশ কয়েকবার মহাপ্রলয়ের গুজব শোনা গেছে। সেই বিষয়গুলো নিয়ে যথারীতি বেশ হইচইও হয়েছিল পৃথিবীতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বিষয়গুলো গুজবই থেকে গেছে। তাই মায়াদের এই ২০১২ সালের প্রলয়কান্ডের ভবিষ্যতবাণীকে থোড়াই কেয়ার করছেন তর্বণরা।
অন্য দিকে এই গুজবের বির্বদ্ধে মাঠে নেমেছে খোদ মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’।
নাসার বক্তব্য হচ্ছে ওই দিন যদি সত্যি সত্যিই পৃথিবী ধ্বংস হতো তবে তার কিছু না কিছু আলামত অবশ্যই দেখা যেতো। তা খালি চোখেই দেখতে পারতো সবাই।
এই গুজবের বির্বদ্ধে নাসা যে কোমর বেধে লেগেছে তা বোঝা যায় তাদের ব্যাপক প্রচারণার কৌশল দেখে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে কার্যকর মিডিয়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে নাসা গুজবের বির্বদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সনি পিকচার্স ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে একটি মুভিও নির্মাণ করেছে।
এই মুভির নাম ‘২০১২’। নাম শুনেই আন্দাজ করা যায় এই মুভির বিষয়বস' কি হতে পারে। এই নভেম্বরেই রিলিজ হবার কথা মুভিটির। দেখা যাক কি বলা হয়েছে সেখানে।
লিংক: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।