আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: কুয়াশায় নিঃসঙ্গ যুবক

সহজ সরল সবকিছুই ভালবাসি। জটিলতা পছন্দ করি না।

শফিক আজো অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ী ফিরছে প্রতিদিন যেমন ফেরে। এই সময়টাতে অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে শীতের বিকেল দ্রুতই ফুরিয়ে আসে। বিকেলের ঘাড়ে চুমু খাওয়া সন্ধ্যের ঐ আধো অন্ধকারেই বাসায় ফিরবার ভিড়ের ৭ নং বাসটা ধরতে প্রতিদিনই তাকে রীতিমতো লড়াই করতে হয়।

বাসের ভিতরর ভীড়, ঠেলাঠেলি আর চাপাচাপিতে যখন দম বন্ধ হয়ে আসে তখন চরম বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে মনে মনে সরকারের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না। আজ অবশ্য এসবের ঝামেলা তাকে কিছুমাত্র পোহাতে হয়নি। অফিস থেকে বেরিয়ে প্রতিদিনকার মতো বাসস্টপে না গিয়ে খাবার ব্যাগটা কাঁধ ঝুলিয়ে নিয়ে ফুটপাত ধরে ঘোরলাগা মানুষের মতো হাঁটছে সে। অফিস শেষে বাড়ী ফিরতে হবে এই উপলব্ধিটকুই হয়তো তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলছে। আজ দুপুরে মিতুর ফোনটা পেয়েই সব কিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল শফিকের।

ভীষন এক অস্হিরতায় পেয়ে বসেছিল তাকে, নিজেকে আর কখনো এতটা অসহায় মনে হয়নি তার। ব্যস্ত সড়কের ফুটপাত ধরে হাটঁতে হাঁটতেই একবার তার মনে হলো এই পৃথিবীতে শফিক নামের কোন একজন যদি আজ বাড়ী না ফেরে? তবে খুব কি খুব বেশী ওলোট-পালোট হয়ে যাবে এই পৃথিবীতে। তার না ফেরার গল্পটুকু তার মায়ের এত বছরের দীর্ঘ নির্ঘুম রাতগুলো আর কতটা দীর্ঘ করে তুলতে পারবে। অথবা বড় বোন তার না ফেরার ঘটনায় কতখানি আঘাত পাবে শফিক জানে না। শুধু এতটুকু নিশ্চিত জানে শাপলা নিজের ও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে একদম ভেঙে পড়বে।

এই বোনটির জন্য শফিকের মাঝে মাঝেই বেশ কষ্ট হয়। এমন মিষ্টি সংসারী একটি মেয়ে অথচ...। শাপলার কথা ভাবলেই তার বুকের ভিতরটা টন্‌টন্‌ করে উঠে। তিন বছর আগে যেদিন স্বামীর সংসার ছেড়ে দু'বছরের বাচ্চা নিয়ে চলে আসে, সেদিন যেন শফিকদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। কি হয়েছে, কেন চলে এলি, জাহাঙ্গীর কি করেছে, কি দোষ এমন শত শত প্রশ্নের কোন উত্তরই দেয়নি।

শফিক আলাদা ডেকে জানতে চেয়েছিল শাপলা তার হাত ধরে কেঁদে ফেলে বলেছিল, শফিক তুই থাকতে না দিলে রাস্তায় গিয়ে উঠব তাও ঐ বাসায় আর না। শফিক আর কিছু বলেনি, বলার সাহস পায়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, শাপলাকে না জানিয়ে জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় বিয়ের কথা। বেশী দিন অবশ্য চাপা রাখতে পারেনি, শাপলা ঠিকই জেনে গিয়েছিল। ইদানিং জাহাঙ্গীর নতুন উৎপাত শুরু করেছে।

ছেলের জন্যে কোর্টে মামলা করবে, স্কুল থেকে ছেলেকে তুলে নিয়ে যাবে প্রায়ই ফোনে শাপলাকে হুমকি দেয়া শুরু করেছে। শাপলা উপরে শক্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই দুর্বল হয়ে পড়ছে দিন দিন। ছেলেকে দুরের স্কুল থেকে এনে কাছেই ভর্তি করে দিয়েছে। ভালো মন্দের বিচারে যায়নি। জাহাঙ্গীরের সংগে একবার দেখা করা দরকার মনে মনেই ভাবে শফিক।

জাহাঙ্গীরের কথা ভাবতে গিয়ে শীত বাঁচাতে পকেটে রাখা হাত দুটো তার আপনাতেই মুঠো হয়ে আসে। ''শফিক একবার বলো, সব ছেঁড়ে চলে আসব। তোমাকে ছাড়া সুখী হবো এ যে আমি কল্পনাতেও কোনদিন ভাবিনি। একবার বলো শফিক, শুধু একবার। '' মিতুর আকুতি ভরা কান্নাভেজা শেষ কথাগুলো পুনরায় শফিকের অন্যমনস্ক ভাবনাগুলো এলোমেলো করে দেয়।

কী ব্যাকুল আর অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল সেই কন্ঠে। অথচ শফিক কী নির্দয় ভাবেই না আজ ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। এছাড়া কিইবা করার ছিল তার। যার বড় বোন স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে এসেছে, তেত্রিশ পার করা শফিকের দু'বছরের বড় বোন শম্পার বিয়ের সম্বন্ধগুলো ফিরে যাচ্ছে একের পর এক। খুব শিঘ্রী কিছু হবে সেই আশাও নেই।

ছোট বোন সীমা এ বছর অনার্স দিল। এই আগোছালো সংসারে মিতুকে তুলে আনতে কিছুতেই সায় দেয়নি শফিকের মন। শম্পা অবশ্য দিনকয়েক আগে মিতুর ব্যপারটা তুলেছিল। শফিকের রুমে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। কিছু বলছে না দেখে শফিকই জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে কিছু বলবি? - না।

- চুপচাপ দাঁড়েয়ে আছিস যে। - এমনি। অনেক দিন তোর ঘরে আসি না। সত্যিই অনেক দিন শম্পা এ ঘরে আসে না। পিঠাপিঠি হওয়াতে একসময় তাদের সম্পর্কটা অন্যরকম ছিল।

হাসি-ঠাট্টা, খুনসুঁটি আর ঝগড়া ছিল নিত্যদিনের বিষয়। সময় সেই শম্পাকেই আজ তার কাছ থেকে কতদুরে ঠেলে দিয়েছে। সেই পুরনো দিন গুলোর কথা ভেবে শফিক একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে। - মিতুর সাথে দেখা হয় তোর। হঠাৎই প্রশ্নটা করে শম্পা।

প্রশ্নটা শুনে অবাক হয় শফিক। মিতু হয়তো শম্পাকে কিছু বলেছে। তাদের দু'ভাই-বোনের পিঠাপিঠি সম্পর্কটা মিতু ভালোই জানে। বিছানায় আধশোয়া থেকে সামান্য উঠে বসে জিজ্ঞেস করে, কেন! তোকে কিছু বলেছে। - নাহ।

টেবিলে রাখা শফিকের হাত ঘড়িটা নাড়তে নাড়তে অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দেয় শম্পা। খুব বিষন্ন দেখাচ্ছে আজ শম্পাকে। অবশ্য শম্পাকে শেষ কবে হাসতে দেখেছে শফিকের মনে পড়ে না। - মিতু খুবই ভালো একটা মেয়ে। ওকে তুই কষ্ট দিস না শফিক।

আমার কথা আর কত ভাববি তোরা। মা তো আমার চিন্তাতেই বিছানায় পড়লো। স্কুলে চাকরি নিয়েছি। আমার বেশ কেটে যাবে দেখিস। আমার জন্যে নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না তুই।

সীমারও বিয়ের বয়স হয়ে এলো। ওর জন্যে আসা সম্বন্ধগুলো আর ফিরিয়ে দিস না। একটানা বলে যায় শম্পা। শফিকের মনে হয় শম্পার বলা কথাগুলো যেন কোন গভীর সুড়ঙ্গ থেকে ভেসে আসছে, সে কোন উত্তর দেয় না। শম্পা মিথ্যে বলেনি, সত্যি সত্যিই সীমা অনেক বড় হয়ে গেছে।

সেদিন বান্ধবীদের সাথে কী একটা অনুষ্ঠানে যাবে বলে শাড়ী পড়েছিল। সেজেওছিল খুব করে। শফিক অবাক হয়ে বলেছিল, তোকে তো শাড়ীতে খুব সুন্দর লাগছে! সীমা মুখটিপে অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলেছিল, সুন্দর, তবে মিতাপার মতো নয়। শাড়ীতে মিতাপাকে যা সুন্দর লাগে না! পরক্ষণেই শফিকের মুখের ছায়া বদলে যেতে দেখেই হাসি থামিয়ে দিয়ে বলল, রাগ করলি ভাইয়া। শফিক মাথা নেড়ে না বলে সরে এসেছিল।

শম্পাকে রেখে কোন কিছুর চিন্তা শফিক কখনো কল্পনাও করেনা। মিতুকে আজ যখন সে ফিরিয়ে দিল তখন হ্য়তো সে তাকে নির্দয়, স্বার্থপর না জানি আরও কত কিছু ভেবেছে আবার তার কথা ভেবে অশ্রু ফেলতেও হয়তো ভুলেনি, অথচ ফোনের এপাশে তার ক্লেশমাখা বিবর্ণ মুখটা যদি দেখতে পেত; এক বাক্যহীন স্তব্ধতায় যেন পেয়ে বসেছিল তাকে। মিতুর সাথে তার প্রথম সাক্ষাত, পরিচয়, ভালবাসার একান্ত মূহুর্তগুলো বার বার মনে পড়ে একটা কষ্টের তীব্র স্রোত তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতেই তার একবার মনে হয় মিতু কেন আরও কিছুদিন অপেক্ষা করে না। মিতুকে কথাটা বলতেই মিতু বলেছিল, ভাইয়া আমার বিয়ের ব্যাপারে একমূহুর্ত দেরি করতে রাজি নয়।

সেতো তার ভাইকে বুঝিয়ে বলতে পারত আগে মার্স্টাসটা শেষ হোক। শফিকের দিকটা কি মিতু একবারও বিবেচনা করবে না। হাঁটতে হাঁটতেই এসব ভাবতে থাকে আর মিতুর উপর একটা অকারন অভিমান জমা হয়। হয়তো এই ভাবনাটাই তার ভালো লাগে। সব দোষ তার ঘাড়ে কেন চাপবে।

আজকের পর আর কোনদিনই তাদের দেখা হবে না। আজকের পর আর কোনদিনই মিতু ফোন করে বলবে না, এই নিউমার্কেটে আছি। দশ মিনিটের মধ্যে চলে এসো। তারপর হেসে বলবে, আচ্ছা যাও পনেরো মিনিট সময় দিলাম তোমাকে। মিতু বুঝতে চাইতো না, এভাবে অফিস থেকে হুটহাট বেরোনো যায় না।

শফিক তবু যায়, মিতুর কেনাকাটা দেখে। একতলার ফুড কর্ণারে দাঁড়িয়ে মিতু ফুচকা মুখে পোরে। শফিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখে হাসে, কখনো খায় না। মিতু দু'আঙ্গুলে ফুচকা তুলে শফিকের দিকে বাড়িয়ে দেয়, জোর করে। শফিক সংকোচে মাথা নাড়িয়ে বলে, পাগল নাকি? চারদিকে এতো মানুষ, কি ভাববে? - ভাববে আমার বরটি কি করে ফুচকা খেতে হয় জানে না।

তাই খাইয়ে দিচ্ছি । হাসতে হাসতেই জবাব দেয় মিতু। - তুমি খাও। আমি দেখি। শফিকের দেখতেই ভালো লাগত।

চারদিকে এত বুকচাপা ভীড়, নাগরিক ব্যস্ততা, ছুটন্ত গাড়ীর হুশহাশ শব্দ, বিলবোর্ডগুলোর রাত জেগে শহুরে মানুষগুলোকে সংঙ্গ দেয়া তবু মিতুর কথা ভাবতে ভাবতে এসবকিছুর মাঝেও নিজেকে আজ তার বড়ই নিঃসঙ্গ মনে হয়। আজ মিতুর এ্যাংগেজমেন্ট এই ভাবনাটুকু তার ভিতরে তোলপাড় করে ফেরে, একটা অপরাধবোধ যেন সর্বক্ষণ কাঁটার মতো বিঁধে আছে। হঠাৎই একটা হাতের ধাক্কা খায় শফিক, একটা বিকট হর্ণ তার কানে আসে আর কেউ যেন খেঁকিয়ে উঠে, হাঁটার সময় মন কৈ থাকে মিয়া। আরেকটুর জন্যে তো গাড়ীচাপা পড়তেন। শফিক যেন বাস্তবে ফিরে আসে।

দেখে প্রচন্ড ব্রেক কষে মাইক্রোবাসটা তার পাশেই দাঁড়িয়ে পড়ে। ড্রাইভার মাথা বের করে অদ্ভুত চোখে তাকে একবার দেখে নিয়ে হুশ শব্দ তুলে বেরিয়ে যায়। বড় অদ্ভুত লাগে শফিকের, এখনি সে নেই হয়ে যেতে পারত। যে লোকটা ধাক্কা দিয়েছে সে তখনো শফিককে এক হাতে ধরে আছে। বললো, ভাইয়ের কি শরীর খারাপ? বাসায় যান, বাসায় গিয়া রেস্ট লন।

শফিক কোনরকমে স্যরি বলতেই লোকটা চলে যায়। শফিক আচ্ছন্নের মতো একবার চারদিকে তাকায়। রাস্তার ওপারের আখতারুজ্জামান সেন্টারের বিশাল দৈত্যাকার চেহারা দেখে বুঝতে পারে সে আগ্রাবাদ বাদামতলীর মোড়ে এসে পড়েছে। রাতের কুয়াশায় সোডিয়াম লাইটগুলোকে তার ধাঁধার মতো মনে হয়। অদূরেই সিঙ্গাপুর মার্কেটের সামনে এক দঙ্গল মানুষ ৭ নং বাসটার জন্য উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.