থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর আগে
পঁচিশে জানুয়ারি এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক কালো দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালের এই দিনটিতে জাতীয় সংসদের মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। এই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব স্বয়ং প্রেসিডেন্ট হন এবং সকল রাজনৈতিক দল বাতিল করে সারাদেশে একটিমাত্র দল রাখার বিধান করা হয়।
চতুর্থ সংশোধনীর ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন এবং তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশালের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। প্রেসিডেন্ট এবং বাকশাল চেয়ারম্যান শেখ মুজিবের নির্দেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়ে যায় ১৬ জুন।
১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারত থেকে ঢাকায় ফিরে আসে। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানে বন্দী। শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। সেই সময় থেকেই দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়নের জন্য চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম হবে, না প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার প্রচলিত হবে, সে সময় বিষয়টি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়।
এসব জল্পনা-কল্পনার অবসান হয় ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ' জারি করার মাধ্যমে।
সেই আদেশের পঞ্চম অনুচ্ছেদে বর্ণিত ছিল বাংলাদেশে ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে'। ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে ছিল ‘রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী তাহার সমস্ত কার্য করিবেন'। ৭ম অনুচ্ছেদে ছিল ‘রাষ্ট্রপতি গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন একজন পরিষদ সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন। অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রীগণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন'।
সেই আদেশের অষ্টম অনুচ্ছেদে ছিল যে, ‘নতুন সংবিধান প্রবর্তিত হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রিসভা বাংলাদেশের একজন নাগরিককে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করিবেন'।
বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ' (রাষ্ট্রপতির ২২ নং আদেশ) নামক সেই আদেশটির গুরুত্ব অনেক। এই আদেশ অনুসারে ১৯৭০ সালে নির্বাচনে বাংলাদেশ থেকে যে সকল জনপ্রতিনিধি তদানীন্তন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের নিয়েই গণপরিষদ গঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল ৪৩০ সদস্যবিশিষ্ট গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধানটি বিল আকারে পেশ করেন।
৪ নবেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক তা গৃহীত হয়। ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর হয় এবং সে দিনই গণপরিষদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। ১৫৩ অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট এই সংবিধান ১১টি ভাগে বিভক্ত। ১৯৭২ সালের এই সংবিধান ছিল জাতির সবচেয়ে বড় পাওয়া।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির ১৫ মাসের মধ্যে সংবিধানের অধীনে জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এই নির্বাচনে ১৪টি দল অংশ নিয়েছিল। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯২টি আসন পেয়েছিল। একটি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন তদানীন্তন জাতীয় লীগ প্রধান মরহুম আতাউর রহমান খান, জাসদেরও একজন সদস্য সে সময় বিজয়ী হয়েছিলেন। বাকী সবাই ছিলেন স্বতন্ত্র সদস্য। তবে সেদিন সেই নির্বাচনের স্বরূপ যারা দেখেছেন তাদের অনেকেই হতবাক ও আশংকিত হয়েছিলেন।
হতবাক হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ‘আচরণ' দেখে। যে আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দিতে পেরেছে তারা কিভাবে নির্বাচনে অগণতান্ত্রিক আচরণ করতে পারে আর আশংকিত হয়েছিলেন এজন্য যে, এমন আচরণকারী একটি দলের হাতে ভবিষ্যতে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ থাকবে কি না।
প্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আচরণ সম্পর্কে যে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল সেই আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। এই দিনই জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী গৃহীত হয়। সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর দ্বারা সংবিধানের ২৬, ৩৩, ৬৩, ৭২ ও ১৪২ নং অনুচ্ছেদগুলো সংশোধনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ ও কালাকানুন প্রণয়নের যেসব বাধা সংবিধানে সন্নিবেশিত ছিল তা দূর করা হয়।
২৬ নং অনুচ্ছেদটি সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল সংবিধানে কালাকানুন সংযোজনের ব্যবস্থা করা আর ৩৩ নং অনুচ্ছেদটি সংশোধন করা হয়েছিল জাতীয় সংসদকে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান সম্বলিত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করার জন্য। এছাড়া দেশের জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা সরকারকে দেয়া হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। গণতন্ত্র মৌলিক অধিকার হরণের প্রক্রিয়া মুজিব আমলে এভাবে সূচিত হয়েছিল।
একের পর এক ব্যর্থতার কারণে ১৯৭৪-এর শেষাশেষি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের হাত থেকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে থাকে, দেশব্যাপী উগ্র বামপন্থীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সরকারের তাঁবেদার ‘রক্ষীবাহিনী'র অত্যাচারে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ।
চতুর্দিকে এক নৈরাজ্যকর অবস্থা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণের লক্ষ্যে দেশের শিল্পকারখানা সরকারের হাতে নিয়ে নেয়ার চরম অব্যবস্থায় উৎপাদন বন্ধ। গোটা অর্থনীতি তখন ধসে পড়তে শুরু করেছে।
এই চরম অবস্থায় সরকার দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। আর এই সময়ই অর্থাৎ ১৯৭৪ সালেই দেখা দিয়েছিল ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষ।
১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয় এবং সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ তা মারাত্মক রূপ ধারণ করে। তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা এবং দলীয় লোকজনের লুটপাট এই দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ ছিল।
পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি রোধের জন্য সরকার সে বছরের ডিসেম্বর মাসে জরুরি অবস্থা জারি করে। এই জরুরি অবস্থা জারির প্রধান লক্ষ্য কিন্তু শুধু ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করা নয়, বরং রাজনৈতিক বিরোধীদের শায়েস্তা করা ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা। যাতে সরকারের চরম ব্যর্থতার কথা সংবাদপত্রে প্রকাশ না পায়।
জরুরি অবস্থা জারির আরও একটা গোপন কারণ ছিল। যেটা সরকার তখন গোপন রেখেছিল। আর সেই গোপন লক্ষ্যটি ছিল একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা কায়েমের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করা। যাতে নয়া একদলীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দ করতে না পারে। যারা প্রতিবাদ করবে তাদের যাতে জরুরি অবস্থার অজুহাতে ধরা যায়।
১৯৭৫ সালের সূচনার ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে মাত্র কয়েক মিনিটে সংবিধানের কুখ্যাত ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল গঠন করা হয়। এর অধীনে এক অদ্ভূত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি চালু করা হয়, যে ব্যবস্থার অধীনে প্রেসিডেন্ট দেশের সর্বময় কর্তা হয়ে পড়েন এবং তিনি যাতে আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন, তার ব্যবস্থা ছিল তাতে। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ বেঁধে দেয়া হয়নি। ৪র্থ সংশোধনী পাসের পর ২৪ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব এক ঘোষণায় তথাকথিত জাতীয় দল বাকশাল গঠন করেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনেই যেখানে ১৪টি দল অংশ নিয়েছিল, সেখানে আওয়ামী লীগের ‘বি' টিম হিসেবে কথিত সিপিবি ও ন্যাপকে নিয়ে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়।
সে ঘোষণায় অন্যান্য দলকে পরবর্তী ২৫ এপ্রিলের মধ্যে বাকশালে যোগদানের আহবান জানানো হয়। এরপর ৬ জুন শেখ মুজিবকে বাকশালের সভাপতি এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে সেক্রেটারি জেনারেল করে দলের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়। ১৬ জুন দেশের সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে মাত্র ৪টি সংবাদপত্র দলীয় ও সরকারের নিজস্ব প্রচারের জন্য বাঁচিয়ে রাখা হয়। তারপর ২৩ জুন শেখ মুজিব গোটা প্রশাসনকে দলীয়করণের লক্ষ্যে তথাকথিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে দেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করেন এবং পরে সেখানে দলীয় লোকদের জেলা গবর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েমের সময় সংবিধান সংশোধন করে দেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করেছিল তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার।
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে সংবিধান প্রবর্তিত হবার সময় কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল। বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫ থেকে ১১৬ পর্যন্ত মোট ২২টি অনুচ্ছেদ হচ্ছে বিচার বিভাগ সংক্রান্ত। সংবিধান প্রবর্তনের সময় কোনো সমস্যা ছিল না। কেবলমাত্র সংকট ছিল জেলাসহ অন্যান্য পর্যায়ে ফৌজদারী আদালতসমূহে যারা বিচারক ছিলেন তাদের নিয়ে। তারা একদিকে যেমন প্রশাসনের সাথে জড়িত তেমনি একই সাথে ফৌজদারী আদালতে বিচারক।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি যখন আওয়ামী লীগ দেশে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা কায়েম করে গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোকে ধ্বংস করেছিল, মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য সকল সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, দেশে একটি রেজিমেন্টের সোসাইটি গড়ার জন্য আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করেছিল, সংবিধানের কুখ্যাত ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অন্যান্য বিষয়সহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করার জন্য সংবিধানের ৯৫ থেকে ১১৬ অনুচ্ছেদের বিভিন্ন স্থানে সংশোধনী সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিভাবে নস্যাৎ করা হয়েছিল তার উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংশ্লিষ্ট ধারা নিয়েই কেবল আলোচনা করা হবে।
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ৯৫ অনুচ্ছেদে ছিল, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন'। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয় এভাবে, ‘‘প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন’’।
ইতোপূর্বে প্রেসিডেন্টের একক এখতিয়ার ছিল কেবলমাত্র প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দান করার। অন্যান্য বিচারকদের নিয়োগ করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ছিল সীমিত। কিন্তু ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের নিয়োগ দানের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টকে নিরংকুশ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল।
অনুরূপভাবে ৯৮ অনুচ্ছেদে প্রধান বিচারপতিকে যে ক্ষমতা দেয়া হয় তা এই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে খর্ব করা হয়েছিল। ৪র্থ সংশোধনী পূর্ববর্তী এই ধারার সুপ্রিমকোর্টের কোনো বিভাগের বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হলে প্রেসিডেন্টকে প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে তা করতে হতো।
৪র্থ সংশোধনীর দ্বারা প্রধান বিচারপতির সে ক্ষমতা রহিত করে তা এককভাবে প্রেসিডেন্টের হাতে অর্পণ করা হয়েছিল।
১০৯ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অধঃস্তন ট্রাইব্যুনালের উপর হাইকোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রহিত করা হয়েছিল। ৪র্থ সংশোধনীর পূর্বে ১১৫ অনুচ্ছেদ মোতাবেক বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টকে সুপ্রিমকোর্টের সুপারিশের উপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু ৪র্থ সংশোধনীর পর এক্ষেত্রে পুরো কর্তৃত্ব ন্যস্ত করা হয়েছিল প্রেসিডেন্টের কাছে। ৪র্থ সংশোধনীর পূর্বে ১১৬ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের বদলী, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরসহ শৃংখলা বিধানের দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের উপর ছিল।
কিন্তু ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা খর্ব করে এ ব্যাপারে একক কর্তৃত্ব তুলে দেয়া হয়েছিল প্রেসিডেন্টের হাতে। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়েছিল এবং বিচার বিভাগকে প্রশাসন বিভাগের অধীনে নিয়ে গিয়েছিল।
যে বিশেষ পরিস্থিতিতে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তার জন্য আসলে দায়ী ছিল সর্বব্যাপী দুর্নীতি, কালোবাজারী ও চোরাচালানসহ প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা, সরকারের উদ্যোগে পরিচালিত নির্যাতন ও হত্যাকান্ড এবং সেই সঙ্গে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। কিন্তু সময়ের দাবি অনুযায়ী পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর পথে না গিয়ে ক্ষমতাদর্পী প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার বিরোধিতার পথরোধ করার অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্যদিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং বাকশাল ও একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল।
সমগ্র এই প্রক্রিয়া ও কর্মকান্ডের একমাত্র উদ্যোক্তা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব, সর্বময় ক্ষমতাও কেন্দ্রীভূত হয়েছিল তার একার হাতে। বহুদলীয় বা ‘জাতীয় প্লাটফর্ম' বলা হলেও বাকশাল যে আওয়ামী লীগেরই নামান্তর মাত্র ছিল, সে কথার প্রমাণ মেলে বাকশালে বিলীন হয়ে যাওয়া অন্য দু'টি দল ন্যাপ (মোজাফফর) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি'র নেতৃবৃন্দের শোচনীয় পরিণতি থেকে। ১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গঠিত ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট'-এর শরীক এই দল দু'টি থেকে মাত্র ৬ জনকে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেয়া হয়েছিল এবং ১১৫ সদস্যের সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহী কমিটিতে কিংবা পাঁচটি অঙ্গ সংগঠনের কোনোটির নেতৃত্বেই সুযোগ পাননি মনিসিংহ এবং মোজাফফর আহমেদের মতো সিপিবির নেতারা। এসব অবস্থানে কেবল মুজিব অনুসারীদেরই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ও কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন এবং সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন দান থেকে বাকশাল ও রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে একক ও সর্বময় ক্ষমতা ছিল বাকশাল চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের হাতে এবং তিনি এমন একজন চেয়ারম্যান ছিলেন যাকে নির্বাচনের কোনো বিধান বা পন্থারই উল্লেখ ছিল না গঠনতন্ত্রে।
অর্থাৎ পরোক্ষভাবে একথাই ঘোষিত হয়েছিল যে, শেখ মুজিব আজীবন বাকশালের চেয়ারম্যান এবং দেশের প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকবেন। তার কখনও মৃত্যু ঘটবে কিংবা তার অনুপস্থিতিতে অন্য কাউকে চেয়ারম্যান বানানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে, এই অনুমানও বাকশাল গঠনকালে করা হয়নি।
আওয়ামী-বাকশালী শাসনামলে ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানায় তথা দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণভাবে দলীয়করণ করার ফলে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য বিরাজ করতে থাকে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, মন্দাভাব, ‘কল-কারখানায় উৎপাদন অস্বাভাবিকভাবে নিম্নমুখী, দেশ সম্পূর্ণভাবে আমদানীর উপরে নির্ভরশীল হয়ে উঠার ফলে চাহিদা অনুপাতে আমদানি সামগ্রীর পরিমাণে কম থাকা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কালোবাজার ছাড়া স্বাভাবিকভাবে খোলা বাজারে পাওয়া যেত না। এ কারণেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্বাভাবিক অবস্থা থেকে চার-পাঁচগুণ বেশী দামে বিক্রয় হতে থাকে। এভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এর মাধ্যমে এক শ্রেণীর আওয়ামী-বাকশালী রাজনৈতিক ব্যবসায়ী মহল সমাজে বিত্তবান, প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হতে নিঃস্বতর হতে থাকে।
২ জুন ১৯৭২ সাপ্তাহিক হক কথা লিখেছে, ‘ঢাকা জেলার মনোহরদী থানার পাটুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মকর্তার দলীয় কর্মীদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শত্রুতা সাধনের উদ্দেশ্যে জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর দিয়েছে। এই অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করিয়া নারায়ণগঞ্জ থানায় চালান দিলে জনৈক এমসিএ হস্তক্ষেপ করিয়া এই নরঘাতকটিকে মুক্ত করিয়াছেন। '
স্বাধীন বাংলাদেশে নরমেধযজ্ঞে শেখ মুজিবের ভূমিকার এক ভয়ঙ্কর তথ্য জানা যায় মাসুদুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এবং সিআইএ' গ্রন্থে। ঐ গন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, ‘১৯৭২ সালে একদিকে তিনি (মুজিব) সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন, অপরদিকে আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানকে অস্ত্র জমা দিতে বারণ করলেন।
শেখ মুজিবের ওই নিষেধ সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সিরাজুল আলম খান আর আমাকে ডেকেই বঙ্গবন্ধু (শেখ মুজিব) বলেছিলেন, সব অস্ত্র জমা দিও না। যেগুলো রাখার দরকার সেগুলো রেখে দাও। কারণ, সমাজ বিপ্লব করতে হবে। প্রতি বিপ্লবীদের উৎখাত করতে হবে, সমাজতন্ত্রের দিকে এগুতে হবে। এটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন।
‘বাংলাদেশে শ্রমিক হত্যা' শীর্ষক সংবাদে দৈনিক গণকণ্ঠ (৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩) উল্লেখ করেছে, ‘বিগত ৪ ফেব্রুয়ারি বারবকুন্ডে অবস্থিত আর আর টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের উপর ব্যাপক হামলার খবর এখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি হিসেব মতে সেখানে নিহতের সংখ্যা ইতোমধ্যে দাঁড়িয়েছে ২২ জনে। বেসরকারি, শ্রমিক ও অন্যান্য সূত্রের খবরে বলা হচ্ছে যে, সেখানে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। সব মিলিয়ে সেখানে হতাহতের সংখ্যা বিরাট। '
এ প্রসঙ্গে ফ্রন্টিয়ার কলকাতা : ভলিউম বি, নং-২-এ প্রকাশিত চিত্রটি হচ্ছে- ‘....রক্ষীবাহিনী গত জানুয়ারীতে এক ময়মনসিংহ জেলাতেই অন্তত এক হাজার ৫শ' কিশোরকে হত্যা করেছে।
এদের অনেকেই সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (ইবিসিপি)-এর সদস্য ছিল। অন্যদের মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এমনকি অনেক বাঙ্গালী যুবক যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও এই সন্ত্রাসের অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন... বস্তুত বাংলাদেশে বীভৎসতা ও নিষ্ঠুরতার অভাব নেই। ' (ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ ঃ আহমেদ মুসা, পৃষ্ঠা-১৩৬)
‘বাম রাজনীতি : সংকট ও সমস্যা' গ্রন্থে হায়দার আকবার খান রনো লিখেছেন, ‘মুজিববাদীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সন্ত্রাসের রাজনীতি, প্রকাশ্য হত্যা, গুপ্ত হত্যা, গুন্ডামি এগুলো ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া।
যশোরের কালীগঞ্জ থেকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প উঠে গেলে সেখানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়-যেখানে ৬০টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। টঙ্গী থানার সামনে মেশিনগান স্থাপন করে শ্রমিক কলোনীর উপর নির্বিচারে গুলী চালানো হলো। শতাধিক নিহত হলেন। হাজার হাজার শ্রমিক বিশ মাইল হেঁটে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হল এবং তারা তিনদিন তিনরাত পল্টন ময়দানের উন্মুক্ত আকাশের নিচে অবস্থান করতে বাধ্য হল। '
আহমেদ মুসা তার ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ' গ্রন্থের উৎসর্গনামায় আওয়ামী ঘাতক বাহিনীর অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার বাজিতপুরের ইকুরটিয়া গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক আব্দুল আলীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলে ধরে লিখেছেন, ‘....ঐখানে আমাকে (আব্দুল আলী) ও আমার ছেলে রশিদকে হাত-পা বেঁধে তারা খুব মারলো।
রশিদকে আমার চোখের সামনে গুলী করলো। ঢলে পড়লো বাপ আমার। একটা কসাই আমার হাতে একটা কুঠার দিয়ে বলল, তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলবো তার মাথা দিয়ে। আমার মুখে রা নেই। না দিলে বলল তারা, তোরও রেহাই নেই।
কিন্তু আমি কি তা পারি? আমি যে বাপ। একটানা দেড় ঘণ্টা মারার পর আমার বুকে ও পিঠে বন্দুক ধরল। শেষে নিজের হাতে কেটে দিলাম ছেলের মাথা। আল্লাহ কি সহ্য করবে। '
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হয় ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫।
আর আগে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গঠিত হয় দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ। ১৯৭৫ সালের ১৮ জানুয়ারি বসে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক। এই বৈঠকেই শেখ মুজিব সংসদ সদস্যদের কাছে তুলে ধরেন তার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক নতুন পরিকল্পনার কথা। এই বৈঠকে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘শতাব্দীর জীর্ণ ঘুণেধরা সমাজ ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে প্রশাসন যন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতন্ত্রীকরণ এবং একটি মাত্র রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমের পতাকাতলে সমগ্র জাতিকে সমবেত করে সুসংহত ও সংঘবদ্ধ জাতীয় প্রয়াস ছাড়া সংকট থেকে পরিত্রাণের কোন পথ নেই। খন্ডিত, বিক্ষিপ্ত এবং অসংলগ্ন পরস্পর বিরোধী কর্মতৎপরতা বন্ধের জন্য আজ যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সকল দেশপ্রেমিক শক্তির নিবিড় একাত্মতা এবং ঐক্যবদ্ধ ও গঠনমূলক সর্বাধিক কর্ম-প্রয়াস।
কেবলমাত্র একটি শক্তিশালী ও বৈপ্লবিক ব্যবস্থার অধীনেই তা সম্ভবপর। '
এরপর ২০ জানুয়ারি বসে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। এই অধিবেশনেও দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি পেশ করা হয়। কিন্তু শেখ মুজিবের এই নতুন পদ্ধতির বিষয়টি অনেকেই সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। অন্যদল বা ব্যক্তিতো দূরে থাক আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেও একটি অংশ শেখ মুজিবের এই নতুন নীতির প্রতিবাদ করেন।
এদের মধ্যে ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ, জেনারেল এমএজি ওসমানী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, নূরে আলম সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার মঈনুল ইসলাম প্রমুখ। জেনারেল ওসমানী ১৮ তারিখের বৈঠকেই এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমরা আইয়ুব খানকে দেখেছি, ইয়াহিয়া খানকে দেখেছি। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খান হিসেবে দেখতে চাই না। '
বিরোধিতা সত্ত্বেও ২১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে শেখ মুজিবকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এরপরই শেখ মুজিব তার নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হয় ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদ প্রায় ২ বছর মেয়াদ অতিক্রম করার পর সংসদে পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ষষ্ঠভাগের পর ষষ্ঠ ক ভাগ সংশোধিত হয়। তাতে বাকশালকেই বৈধ ঘোষণা করা হয় জাতীয় দল হিসেবে।
শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনয়ন করে পবিত্র সংবিধানের ১১, ১৪, ৪৮, ৫৮, ৬৬, ৬৭, ৭০, ৭২, ৭৪, ৭৬, ৮০, ৮৮, ৯৬, ৯৮, ১০১, ১০২, ১১৬, ১১৭, ১১৯, ১২২, ১২৩, ১২৪, ১৪১, ১৪৮ আর্টিকেলে বর্ণিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, কৃষক ও মেহনতি মানুষের শোষণ হতে মুক্তি, প্রেসিডেন্ট পদের ক্ষমতায়ন, মন্ত্রীদের কার্যক্ষমতা, সংসদ সদস্যদের অবস্থানের নিশ্চয়তা, সংসদ সদস্যদের নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, সংসদের অধিবেশন, স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকারদের অবস্থান, সংসদের স্থায়ী কমিটির কার্যপ্রণালী, আইন প্রণয়ন পদ্ধতি, বিচারকদের পদের নিয়োগ প্রদান, সুপ্রীম কোর্টের অতিরিক্ত বিচারকদের কর্মক্ষমতার অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম, নির্বাচন কমিশনের দায়-দাযিত্ব, ভোটার তালিকায় নামভূক্তির অধিকার, নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণজনিত ক্ষমতা, নির্বাচন সম্পর্কে সংসদের বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনের বার্ষিক রিপোর্ট প্রদান, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ যথা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সুপ্রীম কোর্টের বিচারক, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যদের শপথ গ্রহণ প্রভৃতিসহ সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কার্যকরিতা রহিত ঘোষণা করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান দেশের একক ক্ষমতার অধিকারী হন এবং দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।
চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ষষ্ঠভাগের পর ষষ্ঠ ক ভাগ সংশোধিত হয়। তাতে বাকশালকেই বৈধ ঘোষণা করা হয় জাতীয় দল হিসেবে। সংশোধনটি ছিল নিম্নরূপ :
১১৭-ক।
জাতীয় দল। (১) রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এই সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহের কোন একটা পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে অনুরূপ করা প্রয়োজন তাহা হইলে তিনি, আদেশ দ্বারা নির্দেশ দিতে পারিবেন বা রাষ্ট্রে শুধু একটা রাজনৈতিক দল (অতঃপর জাতীয় দল নামে অভিহিত থাকিবে)।
(১) যখন (১) দফার অধীন কোন আদেশ প্রণীত হয়, তখন রাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক দল ভাঙিয়া যাইবে এবং রাষ্ট্রপতি জাতীয় দল গঠন করিবার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে।
(৩) জাতীয় দলের নামকরণ, কর্মসূচি সদস্যভুক্তি, সংগঠন, শৃক্মখলা, অর্থ সংস্থান ও কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কিত সকল বিষয় রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা নির্ধারিত হইবে।
(৪) (৩) দফার অধীন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত আদেশ সাপেক্ষে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি জাতীয় দলের সদস্য হইবার যোগ্য হইবেন।
(৫) এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যখন জাতীয় দল গঠিত হয়, তখন কোন ব্যক্তি- (ক) যদি তিনি, যে তারিখে জাতীয় দল গঠিত হয়, সেই তারিখে সংসদ সদস্য থাকেন, তাহা হইলে তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাতীয় দলের সদস্য না হইলে, সংসদ-সদস্য থাকিবেন না এবং সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে।
(খ) যদি তিনি জাতীয় দলের দ্বারা রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত না হন, তাহা হইলে অনুরূপ নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য হইবেন না।
(গ) জাতীয় দল ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দল গঠন করিবার বা অনুরূপ দলে সদস্য হইবার কিংবা অন্যভাবে অনুরূপ দলের কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করিবার প্রাপ্ত অধিকার প্রাপ্ত হইবেন না।
(৬) এই অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত কোন আদেশ পরবর্তী কোন আদেশ দ্বারা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকিবে।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই সংযোজনের ফলে একদিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রত্যক্ষভাবে বাকশাল রাজনীতি করতে বাধ্য করা হয়।
অপরদিকে সংবিধানে যেসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে সেগুলোর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করা হয়। হরণ করে নেয়া হয় বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, হরণ করে নেয়া হয় সংবাদপত্রের অধিকার, হরণ করে নেয়া হয় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা। কার্যত হরণ করে নেয়া হয় সকল গণতান্ত্রিক অধিকার, বিচার পাবার অধিকারসহ সকল অধিকার।
চতুর্থ সংশোধনীতেই রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান পাস করা হয়। ওই বিধানে বলা হয়, সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও এই আইন প্রণয়নের সঙ্গে (ক) এই আইন প্রণয়নের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে, (খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।
'
এই আইন প্রণীত হবার পর থেকে জাতীয় সংসদ আরো ৫ বছর থাকবে বলে সংশোধনীতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে কতদিন বহাল থাকিবেন' সেকথা উল্লেখ করা হয়নি।
চীপ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সংশোধনী বিল ১১ মিনিটের মধ্যে ২৯৪ জন পার্লামেন্ট সদস্যের ভোটে সবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘পার্লামেন্টারী কেবিনেট ফরম' প্রেসিডেন্সিয়াল ফরমে রূপান্তরিত হয়। সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত অধিকাংশ অঙ্গদলের অদূরদর্শিতা, সংকীর্ণতা, ব্যক্তি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোন্দল এবং জাসদের বাল্যসুলভ হঠকারী মনোবৃত্তিই মুজিবকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পথে অগ্রসর হতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উৎসাহ এবং সাহস যোগায়। (সূত্রঃ অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫')
শেখ মুজিব সংসদের সহায়তায় সকল রাজনৈতিক দল বাতিল ঘোষণা করে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের আদেশ জারি করেন। বাকশাল গঠনের পর (ক) আওয়ামী লীগ, (খ) ন্যাপ-ভাসানী, (গ) সিপিবি, (ঘ) ন্যাপ-মোজাফফর, (ঙ) জাসদ, (চ) বাংলা জাতীয় লীগ, (ছ) বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস, (জ) বাংলাদেশ লেবার পার্টি, (ঝ) জাতীয় গণতন্ত্রী দল, (ঞ) জাতীয় গণমুক্তি পার্টি, (ট) বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, (ঠ) ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, (ড) কমিউনিস্ট পার্টি এবং (ঢ) শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলকে বাতিল ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৭৫ সালের ২০ মে বাংলা জাতীয় লীগ, ন্যাপ-ভাসানী, সিপিবি এবং ইউনাইটেড পিপলস পার্টি অফিসে দালাবদ্ধ করা হয়।
মুজিব নিজ শাসন পাকপোক্ত করার হীন উদ্দেশ্যেই সকল এমপিকে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে বাকশালে যোগ দেয়ার ফরমান জারি করেন। অন্যথায় সংসদ সদস্যপদ বাতিল হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়। বিরোধী দলের আতাউর রহমান খান ২৫ এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলনে বাকশালে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
সংসদ ভবনে স্বৈরাচারী একদলীয় শাসন পদ্ধতি বাকশাল আইন উত্থাপনের বিরোধিতা করার অভিযোগে জাসদের আব্দুল্লাহ সরকার ও ময়েনউদ্দিন মানিককে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হলে তারা আন্ডার গ্রাউন্ডে যেতে বাধ্য হন। সেই সময়কার ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আলাপ করতে গিয়ে ২৫ জানুয়ারী ১৯৯৮ দৈনিক দিনকালকে আব্দুল্লাহ সরকার ও ময়েন উদ্দিন মানিক পৃথক পৃথক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন যে, ‘এই একদলীয় আইন পার্লামেন্টে পাস করার আগে কোন আলোচনা করতে দেয়া হয়নি।
প্রতিবাদ জানিয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আমরা সেদিন সংসদ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। ' দুই নেতা জানান যে, তারা শংকিত হয়ে পড়েন বিশেষ ক্ষমতা আইন পাসের পর। ২৫ জানুয়ারী সংসদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী শ্রী মনোরঞ্জন ধর সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী বা বাকশাল বিল উত্থাপনের জন্য স্পীকারের অনুমতি চান। মানিক ও আব্দুল্লাহ সরকার এই বিলটি উত্থাপনের বিরোধিতা করেন।
কিন্তু তখন বিরোধিতা গ্রাহ্য করা হয়নি। এরপর বিলের ওপর আলোচনারও বিরোধিতা করে বসেন চীপ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ় ও কঠোর ভাষায় বলেন, ‘এই বিলটি কোনো আলোচনা ছাড়াই পাস হবে। ' শেষ পর্যন্ত তাই হয়।
বাকশাল কালো আইন পাসের পর আওয়ামী লীগের ২ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন।
এরা হলেন জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন। ময়েনউদ্দিন মানিক ও আব্দুল্লাহ সরকার সংসদে দাঁড়িয়ে পদত্যাগ করার দৃপ্ত ঘোষণা দিয়ে সংসদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। এর পরই তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হলে তারা আত্মগোপন করলে সেখানে উপ-নির্বাচন করা হয়। মানিকের শূন্য আসনে বাকশাল মনোনীত মোহাম্মদ মোহসীন ও আব্দুল্লাহ সরকারের শূন্য আসনে সিরাজুল ইসলামকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার সেই নির্বাচন ছিল প্রহসন।
১৫ আগস্টের পরে
রেডিওতে মুজিবের সরকার পতন ও শেখ মুজিবের নিহত হবার খবর ঘোষিত হয়েছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্নেল (অবঃ) তাহের, কর্নেল (অবঃ) আকবর হোসেন, মেজর (অবঃ) শাহজাহান ওমর, মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন, মেজর (অবঃ) রহমতউল্লাহ, ক্যাপ্টেন (অবঃ) মাজেদ এবং এক্স পিএমএ ক্যাডেট মোস্তাক ও সরাফত এসে হাজির হল রেডিও বাংলাদেশে। ঘোষণা শুনেই এসেছেন তারা বিপ্লবের প্রতি তাদের সমর্থন ও অভিনন্দন জানাতে। খবর এল পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর আমিন আহমদ চৌধুরী ইতিমধ্য।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।