আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনআন্দোলনের তরঙ্গেই জনপ্রিয়তম জননেতা জ্যোতি বসু


ইতিহাস কীভাবে তাঁকে মনে রাখবে তা নিয়ে চিরকালই তিনি ছিলেন নিষ্পৃহ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে, তথা ভারতে, উথালপাতাল করা গণ-আন্দোলনের তরঙ্গে শীর্ষেই তিনি উদ্ভাসিত। কমরেড জ্যোতি বসু শুধু এক ঐতিহাসিক চরিত্র নন — এক চলমান ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। কমরেড জ্যোতি বসু মানে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীর প্রত্যয়ের পরীক্ষা। কমরেড জ্যোতি বসু মানে চা বাগানের আন্দোলনরত মদেশীয় মজুর রেলওয়ে শ্রমিকের রুখে দাঁড়ানো।

কমরেড জ্যোতি বসু মানে কাজের দাবিতে এগিয়ে চলো দৃপ্ত যুব মিছিল। কমরেড জ্যোতি বসু মানে খাদ্য আন্দোলনের দৃপ্ত জনতা। কমরেড জ্যোতি বসু মানে আধা ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের মোকাবিলায় গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে হার না মানা শহীদের স্মৃতি। ফসলের অধিকার পেতে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন। কমরেড জ্যোতি বসু মানে সাম্রাজ্যবাদী হুকুমদারির বিরুদ্ধে আমাদের ঘাড় সোজা করে এগোনো।

কমরেড জ্যোতি বসু মানে সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ আর বিভেদকামিতার বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই। জ্যোতি বসু মানে এদেশে সমাজবদলের লড়াইয়ের চড়াই উৎরাই। আনতশির লাল পতাকা হাতে সময়ের সারথী। বিশ শতকের চারের দশক থেকে নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশক বিশেষত এ বাংলায় গরিব মেহনতী মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযুদ্ধ যেন বাঁধা তাঁর স্মৃতির গ্রন্থিতেই। রাজনীতিতে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন বিলেতে ছাত্র থাকাকালেই।

ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলন যখন ইউরোপ জুড়ে দীপ্ত হয়ে উঠছে। লন্ডন মজলিশের সম্পাদক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদভ্রান্ত সময়েই তিনি চিনে নিয়েছিলেন সাম্যবাদী লড়াইয়ের ধ্রুবপদ। ব্যারিস্টারি পাসের বিলেতী সিলমোহরকে পাশে সরিয়ে রেখেই কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী। প্রথমেই যুক্ত হয়েছিলেন ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে।

অবিভক্ত বাংলাদেশে সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির সম্পাদক ১৯৪১ সালে যুদ্ধচলাকালীনই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ। প্রথমে বন্দর ও ডক শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে। তারপরই রেল শ্রমিকদের সংগঠনে — ১৯৪৪ সালে বি এন রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। সভাপতি বঙ্কিম মুখার্জি। আসাম, পূর্ববঙ্গ উত্তরবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ চষে বেড়িয়েছেন।

তাঁর নেতৃত্বেই রেলওয়ে, শ্রমিকদের সংগঠন শুধু অর্থনৈতিক প্রশ্নেই শ্রমিকদের সংগঠিত করেনি। চেষ্টা চালিয়েছে নিরন্তর তাঁদের রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে। বোম্বাইয়ে নৌ-বিদ্রোহের সময় বাংলার রেল শ্রমিকরা শামিল হয়েছিলেন ধর্মঘটে। নেতা কমরেড জ্যোতি বসু। তখনকার নিয়মে রেলওয়ে কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবেই বসু নির্বাচিত হয়েছিলেন বিধানসভায়।

১৯৪৬ সালে। কি আজাদ হিন্দ বাহিনীর মুক্তির দাবিতে উদ্বেলিত রাজপথে, কি মজুতদারি-বিরোধী সংগ্রামে কি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াইয়ে, বন্দীমুক্তি আন্দোলনে, কি তেভাগার দাবিতে লড়াকু কৃষকের পাশে — এদেশে আইনসভায় মেহনতী মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবেই তাঁর ভূমিকা অনন্য তেভাগা আন্দোলনের দাবি বিধানসভার ভিতরে প্রতিধ্বনিত করতে তাঁর অসামান্য ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তেভাগা আন্দোলনের সময় গোটা বাংলাদেশে গেছেন। কৃষক আন্দোলনের মাঝখানে দাঁড়িয়েছেন। চল্লিশের দশকের শেষদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে গেছেন অকুস্থলে।

শান্তি আন্দোলনের প্রধান সংগঠকদের অন্যতম। পঞ্চাশের দশকে এরাজ্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মোড় বদলাতে শুরু করে উদ্বাস্তু আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলনের ঢেউ। ১৯৫৪-র ঐতিহাসিক শিক্ষক আন্দোলনের সময় সভার ভিতরে আন্দোলনের দাবি তুলে ধরার স্বার্থেই গ্রেপ্তার এড়াতে বসু টানা সাতদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন বিধানসভা ভবনেই। তাঁর বিরুদ্ধে সরকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। কিন্তু বিধানসভা ভবনের ভিতর থেকে গ্রেপ্তার করার সাহস দেখায়নি।

কমরেড জ্যোতি বসু এরই মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৫৩ সালে। এই দায়িত্বে ছিলেন টানা ১৯৬১ সাল পর্যন্ত। তারপরই কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত পার্টির প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকে কুখ্যাত নিবর্তনমূলক আইনের বিরুদ্ধে, গোয়া মুক্তি আন্দোলনের সপক্ষে, চা-বাগিচা শ্রমিকদের আন্দোলনের সমর্থনে, পৌরসভাগুলিতে সর্বজনীন ভোটাধিকার চালু করার দাবিতে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতেও তাঁর অবদান অসামান্য। ১৯৫৯ সালের ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন সংগঠিত করার উদ্যোগেও তিনি রাস্তায় নেমেছেন।

১৯৫৭-র ১৭ই সেপ্টেম্বর মহাকরণের সামনে আইন অমান্য করে যাঁরা গ্রেপ্তারবরণ করেছিলেন কমরেড বসু তাঁদের অন্যতম। বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের দাবিতেও বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে তিনি সমান সক্রিয়। ষাটের দশকে ছাত্র-যুব-মহিলা, কৃষক, মধ্যবিত্ত কর্মচারী, শ্রমিকদের সংগঠিত আন্দোলনের প্রতিটি পর্বে ঝলসে উঠেছেন কমরেড জ্যোতি বসু। যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূত্র ধরেই গড়ে উঠেছে বামফ্রন্ট। গণ-আন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষেই ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন।

রাজ্যে প্রথম অকংগ্রেসী সরকার। আসন সংখ্যার বিচারে সি পি আই (এম)-রই মুখ্যমন্ত্রী পদ পাবার কথা। কিন্তু ঐক্যের স্বার্থেই পার্টি ছেড়ে দিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী পদ। জ্যোতি বসু হয়েছিলেন উপ-মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৬৭-র প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার এবং ১৯৬৯-র দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার রাজ্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাছে এক বড় অভিজ্ঞতা।

দুটি সরকারেরই মেয়াদ ছিল অল্প। কিন্তু জনস্বার্থবাহী গণতান্ত্রিক কর্মসূচীরূপায়ণের এক নতুন দিশা দেখিয়েছিল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা। কমরেড জ্যোতি বসু তার অন্যতম প্রধান কারিগরের ভূমিকায়। কংগ্রেস দল, কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার, শাসকশ্রেণী প্রবল সন্ত্রাসে পশ্চিমবঙ্গের পালাবদলকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছিল যখন, তখন গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ জনগণকে সংগঠিত করার সংগ্রামেও বসু রাজপথে। সত্তর দশকের আধা ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের পর্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে, দেশের নানা জায়গায়, তিনি ঘুরেছেন জনতার মাঝে।

আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন। বামপন্থী আন্দোলনের, দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অকুতোভয় প্রতীক। ইতিহাস গড়াতেই ব্যক্তির ইতিহাস হয়ে ওঠার কাহিনী। একাধিকবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। পাটনা স্টেশনে ১৯৭০ সালের ৩১শে মার্চ আততায়ীর ছোঁড়া গুলিটা বসুর আঙুল ছুঁয়ে গিয়েছিল।

একটু এদিক-ওদিক হলেই সব শেষ হয়ে যেত সেদিনই। বসিরহাটে কংগ্রেসী দুষ্কৃতীরা তাঁকে আক্রমণ করেছিল। বেঁচেছিলেন কোনক্রমে গাড়ির চালকের দক্ষতায়। কিন্তু কমরেড জ্যোতি বসু গণ-আন্দোলনের অকুতোভয় নেতা। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্বভার নেবার সময় তাঁর সেই দিকনির্দেশক উচ্চারণ — ‘‘বামফ্রন্ট সরকার শুধুমাত্র রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে সরকার চালাবে না।

ভূমিসংস্কারের দাবিতে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন এবং বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের কর্মসূচীর সফল রূপায়ণ — গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রবর্তী ঘাঁটি হয়ে ওঠাও এক ঐতিহাসিক পর্বান্তর। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার গোটা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাছে আশা-আকাঙ্ক্ষার এক নতুন মাত্রা। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শেষদিন পর্যন্ত গণ-আন্দোলনের তিনি নেতা। মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকারও যেন নতুন সজ্ঞায়ন ঘটেছে। আশির দশকের গোড়া থেকেই একদিকে স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজ।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েতের কাজের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার ও গরিব মানুষের ক্ষমতার সম্প্রসারণ। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নগুলিকে সামনে টেনে গোটা দেশের রাজনীতিতে অনপনেয় প্রভাব ফেলার উদ্যোগেও তিনি নেতা। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের দাবি কমরেড বসুর নেতৃত্বে গোটা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনে নতুন অভিমুখ এনে দেয়। বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সক্রিয় গণ-উদ্যোগেরও তিনি অন্যতম প্রধান সংগঠক, নেতা। একইভাবে সক্রিয় সাম্প্রদায়িকতা এবং বিভেদকামীতার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে সংগঠিত করার কর্মসূচীতেও।

গোটা দেশের মানুষের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর। একদিকে যেমন লড়াই করেছেন কেন্দ্রের বৈষম্যের বিরুদ্ধে অন্যদিকে তেমনি পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণের পক্ষে গণ-সমাবেশ ঘটাতে তিনি জনতার মিছিলে। নব্বইয়ের দশকে ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর্বে তাঁকে আমরা দেখেছি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পক্ষে মতাদর্শগত সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে। মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাসই গভীর রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ভিত্তিভূমি। শেষদিন পর্যন্ত তিনি বলে গেছেন — মানুষই ইতিহাস রচনা করেন।

তাই মানুষকে সংগঠিত করতে হবে, সচেতন করতে হবে। সেই লড়াকু মানুষের মধ্যে কমরেড জ্যোতি বসু মৃত্যুহীন।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.