আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

থ্রি ইডিয়টস ও স্লামডগ মিলিয়নেয়ার: অতি প্রচারণার কাছে পরাজিত "কোয়ালিটি"



বিশিষ্ট মুভিবোদ্ধা বা সমাজতাত্ত্বিক অথবা বুদ্ধিজীবি হলে হয়তো কোন ম্যুভি দেখার সাথে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজবদল ইত্যাদি নানা উঁচুমানের বিষয় খুঁজতেও পারে, কিন্তু আমজনতা হিসেবে সিনেমা জিনিসটাকে বিনোদনের বিষয় হিসেবেই দেখি আর সেদিক থেকে কোন সিনেমা দেখে যদি মনে হয় সময়টা ভাল কাটলো তাহলে সেই ম্যুভিকে একজন সাধারণ দর্শকের চোখে "চলনসই" সার্টিফিকেট দিয়ে দিই। এমন না যে কোন কোন সিনেমা দেখে খুব বেশি নাড়া খাই না, সেগুলোকে আলাদা একটা জায়গা সবসময়ই দিয়ে রাখতে হয়, কিন্তু কোন একটা "চলনসই" ম্যুভিকে যখন স্রেফ বাজারজাতকরণ নীতি বা অতি প্রচারণার জোরে "কিংবদন্তী" বা সমাজ-সংস্কার বদলের পথপ্রদর্শক বানিয়ে দেয়ার অশ্লীল চেষ্টা করা হয় আর সেটার সাথে আমজামযদুমধু জনতার মত একেবারে বোদ্ধারাও লাফঝাঁপ দিতে থাকে, তখন এই নাদানের মনেও কিছু ভারি দর্শনের উদয় হয়, উদাস হয়ে ভাবি, হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দুনিয়া, সবকিছুই যে বিক্রিযোগ্য হয়ে গেল! যে ম্যুভিখানা এই অচিন্তাশীলের মাথাতেও ভারি চিন্তার উদয় ঘটালো, সেটা সাম্প্রতিক সময়ের উপমহাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ছবি, আমির খান অভিনীত "থ্রি ইডিয়টস"। দর্শক হিসেবে আমি নিম্নশ্রেণীর, কুব্রিকের "ক্লকওয়ার্ক অরেন্ঞ্জ" কে ৩ দিয়ে ক্যামেরনের টার্মিনেটর-২ কে ৯ রেটিং দিয়ে দেই এমন অবস্থা, যুক্তি সহজ, এত ভাবের জিনিস বুঝতে গেলে দর্শনের ক্লাস করলেই হয়, ম্যুভি দেখা কেন? কিন্তু এরপরেও হিন্দি ম্যুভি জিনিসটা ঠিক হজম হয় না, অতি নাটুকেপনা, অহেতুক নাচগান আর হয় বস্তাপচা নইলে নকল করা কাহিনীর জন্য হিন্দি ম্যুভি এড়িয়েই চলি, তবে বক্স অফিস হিট ২-১টা মাঝে মাঝে দেখা হয়। অভিনেতা হিসেবে আমির খানকেও যথেষ্ট উঁচুমানের মনে হয়, কাহিনী যাই হোক নিজের অভিনয়ের তার টা যথেষ্ট উঁচুতেই তিনি বেঁধে রাখেন। সেদিক থেকে দেখলে, থ্রি ইডিয়টস মন্দ না, টাইমপাস ম্যুভি হিসেবে ভালই বিনোদন দেয়।

নিজে প্রকৌশলী বলে কৌতুকের পেছনের বাস্তব কষ্টটাও অন্য যে কারো চেয়ে অনেক বেশি অনুভব করি। মোটের উপর সময়টা খারাপ কাটে না, যদিও প্রচলিত হিন্দি ছবির অনেক আলতুফালতু বিষয় এই ম্যুভিতেও এড়ানো যায়নি। অহেতুক কিছু নাচগান, তারচেয়েও অহেতুক একটা শোপিস নায়িকা আমদানি যার পুরো ম্যুভিতেই কোন ভূমিকা নেই, আর চিকিৎসার বদলে চিৎকার চেঁচামেচি করেই রোগী ভাল করে ফেলার "ঢাকাই সিনেমা"র অবাস্তব কায়দা, এবং সবশেষে সেই মেলোড্রামা, সবাই নিজের ভুল বুঝতে পেরে ভাল হয়ে যাওয়া (যেন দুনিয়াতে সব ফেরেশতা), অল ইজ ওয়েল!!! তারপরেও, শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব কিছু সমস্যা খুব প্রকটভাবে উঠে এসেছে, যেটা ভারতে কেমন জানি না, বাংলাদেশের জন্য খুবই সত্যি। সমাধান গুলো আবার সেরকমই অবাস্তব, কিন্তু সিনেমা তো আর কেউ দেশ-জাতি-সভ্যতা বদলে দেয়ার জন্য দেখতে বসে না, বসে বিনোদনের জন্যই। ঠিক এখানটাতেই অধমের আপত্তি, এই ম্যুভিটাকে নিয়ে আমাদের মাঝে মাতামাতিটা এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে যে মনে হচ্ছে এই ম্যুভিটা একেবারে দেশকাল বদলে দেয়ার হাতিয়ার হয়ে গেছে আর অস্কারটা এবার আমাদের ঘরেই চলে আসতে যাচ্ছে।

বিনোদন পাতার গর্দভ প্রতিবেদকগুলোর কথা বাদই দিলাম, ফেসবুক বলি মেসেন্ঞ্জার বলি ব্লগ বলি সবখানেই এমন হল্লা যেন এরকম যুগান্তকারী প্লট বা ধারণা নিয়ে কোন সিনেমা আর কেউ কখনো বানায়নি, বন্ধুদের মাঝে এক গাধা তো দেখলাম ফেসবুকে বিশাল এক আবেগী নোট লিখে বসেছে যে এমন ম্যুভি পরিচালকের নখের সমান যোগ্যতাও বাংলাদেশের কারো নেই আর ভারতের ম্যুভি দেখে বাংলাদেশীদের শেখা উচিত কিভাবে ম্যুভি বানাতে হয়। আমি বলি, তওবা, সাফ তওবা, আর লাখো শুকরিয়া যে এখনো বাংলাদেশে প্রচলিত ঢাকাই ফর্মূলার বাইরে যে ক'টা ভাল সিনেমা বানানো হয় সেগুলো হিন্দি সিনেমার ফর্মূলার বাইরে আছে। ভারতীয়দের ম্যুভি, কাজেই তারা লাফঝাঁপ দিলে দোষ দেয়া যায় না, কিন্তু এই ম্যুভি ব্লকবাস্টার হিট হলে বাংলাদেশের কার ঘাড়ে ক'টা মাথা গজাবে সেটাই এই অধমের মাথায় ঢুকলো না। সে-ও মানলাম, আন্ঞ্চলিক স্বজাত্যবোধ, উৎসাহ, ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু লাফঝাঁপ দিতে হলে একদম সত্যিকারের মান দেখে দেয়াই ভাল না? বলিউড চিরকালই হলিউডের নকল করে মেরে দিয়েছে, আমির খানে আগের হিট "গজিনী"-ও ছিল "মেমেন্টো"র নকল, আর থ্রি ইডিয়টস এবং রাজকুমার হিরানীর আরেক হিট "মুন্নাভাই এমবিবিএস" এর প্লট যে ১৯৯৭ সালের হলিউডি ম্যুভি "প্যাচ অ্যাডামস" থেকে নেয়া, সেটাতেও সন্দেহ নেই। তো, মারবি তো মারবি, সেটা স্বীকারও করবি না, এমন ম্যুভি দেখে সাময়িক বিনোদন নিলে আপত্তি নেই, কিন্তু একেবারে সমাজ বদলের "আদর্শ" হিসেবে নেয়া কেন বাবা? কারণটা সম্ভবত, যা মাথায় আসে, মার্কেটিং, বাজারজাতকরণ।

সেই সাথে, আমাদের "ভারত অনুকরণীয়" নীতি। ভারতীয়দের মার্কেটিং পলিসি আসলেই অনুকরণীয়, বস্তাপচা যা-ই বানাও, অন্যের বাজারে ডাম্পিং করে দাও, কম দামে সস্তা জিনিস দাও, সাথে নিজেরা অন্যের জিনিস, তা সে যত ভালই হোক, ব্যবহারে বিরত থাকো। কাজেই বস্তাপচা হিন্দি সিনেমা আর সিরিয়ালগুলো শুধু বাংলাদেশ না, বরং গোটা উপমহাদেশ ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পূর্ণ বাজারটাই দখল করেছে আর প্রবাসী ভারতীয়দের কল্যাণে আমেরিকা বা ইউকে তেও বাজার নেহাৎ মন্দ না। এই সুযোগটা আবার নিয়েছে ড্যানি বয়েলের মত ধুরন্ধর কিছু পরিচালক, স্লামডগ মিলিয়নিয়ারের মত মেলোড্রামা বানিয়ে। দ্বিতীয় শ্রেণীর এই পরিচালকের অস্কার মনোনয়ন পাওয়াই যেখানে কঠিন, ভারতীয় পটভূমিতে ভারতীয় কলাকুশলী আর সঙ্গীতজ্ঞদের নিয়ে চরম মেলোড্রামাটিক ছবি বানিয়ে ভারতের বাজারে এমনই ঝড় তুলেছে যে অস্কারটাই বাগিয়ে নিয়েছে।

অস্কারের মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও এটা যে বক্স অফিস দিয়েও খানিক প্রভাবিত হয় সন্দেহ নেই, শশ্যাঙ্ক রিডেম্পশনের মত ছবির একটাও অস্কার না পাওয়া আর "টাইটানিক" এর ১১ খানা অস্কার সেই ধারণাকেই জোরালো করে। এখানেও সেই মার্কেটিং, প্রচারের আর প্রসারের আলোয় সমালোচক আর নাকউঁচু বোদ্ধাদেরও অনেক সময় চোখ ধাঁধিয়ে যায়, ঠিক থাকেনা পুরস্কার প্রদানের মানদণ্ডও। সেই সুযোগটা হেলায় হারাবে, এমন বোকা ভারতীয়রা কখনোই ছিল না, ব্রিটিশরাও না, শেষমেশ কে কার ঘাড়ে কাঁঠাল ভাঙলো বোঝা না গেলেও, ৩য় শ্রেণীর একটা ম্যুভি অস্কার জিতে গিয়ে মনে হয় আসল কাঁঠালটা "কোয়ালিটি" নামক শব্দটার ঘাড়েই ভাঙলো। তা সেই কাঁঠাল যতক্ষণ আমার ঘাড়ে না ভাঙে, সমস্যা নেই। সমস্যা তখনই দাঁড়ায় যখন বাংলার ঘাড়ে হিন্দি কাঁঠাল ভাঙে আর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রী নেয়া ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব করে কোন সামাজিক নেটওয়ার্কে জানায় যে বাংলাদেশী কোন পরিচালকের হিন্দি ছবির কোন পরিচালকের পায়ের কাছে যাবারও সামর্থ্য নেই, বাংলাকে হিন্দি সিনেমা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

সমস্যা দাঁড়ায় যখন ফেসবুক বা মেসেন্ঞ্জারে হিন্দিতে স্ট্যাটাস মেসেজ লিখাকে উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা "স্ট্যাটাস সিম্বল" হিসেবে দেখে। সমস্যা দাঁড়ায় যখন বাংলাদেশের মানুষজন একটা খুবই সাধারন বিনোদনমূলক হিন্দি সিনেমাকে "সমাজবদলের হাতিয়ার" হিসেবে বিবেচনা করে অবসেসড হয়ে সবাইকে সেটা দেখতে আকুল আবেদন জানায় আর সেখানকার মহা অবাস্তব সব সমাধান নিজের জীবনে খাটানোর জন্য কোমর বেঁধে নামতে বলে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আজকালকার অনেক বাবা-মা যখন বাচ্চাকে ভাত খাওয়ান হিন্দি সিরিয়াল দেখিয়ে আর বাচ্চারা বাংলা কোন কবিতার চেয়ে হিন্দি গান আর হিন্দি সিরিয়ালের কাহিনী অনেক ভালভাবে গড়গড় করে বলে যেতে পারে। অবাস্তব এবং অপ্রয়োজনীয় আগ্রাসী বাজারজাতকরণ নীতি কিভাবে একটা প্রজন্মের ধ্যানধারণাকে বদলে দিতে পারে, গ্রামীনফোন বা মোবাইলের "ডিজুস মার্কেটিং" সেটার একটা ভাল উদাহরণ, আমরা এখন মোবাইলে খাই, মোবাইলে ঘুমাই আর মোবাইলে স্বপ্ন দেখি। ভারতীয়রা সেটা করছে সিনেমার মাধ্যমে, এমনিতেই আমাদের ভারতভক্তির কমতি নেই, তা ভারতের ভাল দিকের কমতি নেই, কিন্তু ভারতীয়দের দেশপ্রেমের বদলে তাদের বস্তাপচা সিনেমা আর সিরিয়ালকেই কেন আমাদের আদর্শ মানতে হবে আর সেটার জন্য নিজের খেয়ে ফেসবুকে হিন্দি সিনেমার মোষের দুধ বিলাতে হবে, সেটাই এই অধমের মোটা মাথায় ঢোকে না।

তারপরেও যারা এশিয়ান ভ্রাতৃত্ববোধ ইত্যাদিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এইরকম ম্যুভিগুলোকে মাথায় তুলবেনই, তাদের জন্য অধমের নিবেদন, একটু কষ্ট করে এই এশিয়ারই জাপান বা ইরানের দু'-চারটা ম্যুভি দেখুন না! নিজেরাই বুঝে যাবেন হালকা বিনোদনমূলক ম্যুভির সাথে কালজয়ী বা সত্যিকারের চিন্তাধারা বদলে দেয়ার মত অথচ সহজবোধ্য, এমন ম্যুভির তফাৎ কোথায়, আর বেচারা বাংলাদেশি পরিচালকদের যদি কাউকে অনুসরণ করতেই হয়, সেটা নকলবাজ বলিউডি ডিরেক্টরদের না করে কাদেরকে করা উচিত। আমরা নিজেরা তো মরেই গেছি, আমাদের পরের প্রজন্মকে একটু বাংলাদেশের নিজের হাওয়াতে নিঃশ্বাস নেবার সুযোগটা করে দিলে ভাল হয় না?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।