আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তৃতীয় ছবিতে সংহত ফারুকী: প্রতিক্রিয়া

আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী..

আধেয় এবং আঙ্গিক- দু’টির একটি বিবেচনাতেও ‘সংহতি’ খুঁজতে গিয়ে হতাশ হতে হ’ল ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রটির আধেয় এবং আঙ্গিক মূলত প্রধান তিনটি চরিত্রকে অনুসরণ করেছে। এর মাঝে প্রথমেই ধরা যাক মুন্না চরিত্রটিকে। 'নগরায়ন ও আধুনিকতার প্রভাবে প্রথাগত অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিই নতুন প্রজন্মের মানুষের আস্থা কমতে থাকা' বা যে কারণেই হোক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিয়ে রেজিস্ট্রি না করে প্রথাগত একটি পরিবারের মধ্যে স্ত্রী পরিচয়ে কাউকে তোলার সামাজিক বাধাটির মুখে দাঁড়ানোর জন্য একজন ব্যক্তির যে পরিমান সাংস্কৃতিক অগ্রসরতা বা দৃঢ়তার ভিত্তি থাকতে হয় মুন্না চরিত্রটিতে আগাগোড়া তা অনুপস্হিত। শুধু জেল হওয়ার প্রকৃত কারণ বিশ্লেষণ নয়, বস্তুত. এই চরিত্রটির বিশ্বাসযোগ্য কোনো পশ্চাদপট(background) বা বিকাশ(development) কোনোটাই পাওয়া যায়না ছবি জুড়ে।

চলচ্চিত্রটিতে প্রধান চরিত্রের একটি হিসেবে সুতরাং ‘মুন্না’ দুর্বল, অসম্পূর্ণ একটি অনুষঙ্গ হয়ে থেকে গেছে। প্রধানতম চরিত্রটি রুবার। শুধুমাত্র অভিনয় দুর্বলতার কারণেই(মিডিয়ার সুবাদে রুবা চরিত্রে তিশার অভিনয়ের ব্যাপক প্রশংসা জেনে সঙ্গত প্রত্যাশা ছিল)রুবা চরিত্রটির বিপন্ন অবস্থাটি অনুধাবনে বরাবর হোঁচট খেতে হয়। এই সমাজে একা একটি মেয়ের বিপন্নতা বা তাকে অতিক্রমের দৃঢ়তার বিভিন্ন পর্যায়ে অভিনেত্রীর অগভীর অভিনয়, অভিব্যক্তি বিশেষত এর পারম্পর্য রক্ষা করতে না পারা চলচ্চিত্রটির গুরুত্বপূর্ণ দুর্বল দিকের একটি। তিশা শেষ পর্যন্ত রুবা হয়ে ওঠেনা কোথাও।

তারপরেও চলচ্চিত্রটির প্রথমার্ধ তূলনামূলকভাবে উপভোগ্য হয় যে দু’টি কারণে- ১. এই সমাজে একা একটি মেয়ে কতভাবে বিপদগ্রস্ত, বিপন্ন হতে পারে এই ভাগেই তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টাটি থাকে, এবং অবশ্যই ২. আবুল হায়াতের অভিনয়। দ্বিতীয়ভাগে পাওয়া তৃতীয় চরিত্র তপুকেই সার্বিক বিবেচনায় সবচেয়ে ‘সংহত’ মনে হয়েছে। রূপদানকারী তপুও সহজ, মানানসই কাজ করেছেন। একই সাথে দ্বিতীয় ভাগ থেকেই চলচ্চিত্রটি 'ঝুলে' যেতেও শুরু করে। রুবাকে অপ্রত্যাশিত যে বিশাল ফ্ল্যাটটিতে, যে শর্তে(অর্থনৈতিক) তোলা হয়- তাতে মোটা দাগে যুক্তির নীরিখে উল্লম্ফন দেখা যায়।

রুবা এবং তপুর ভেতর সম্পর্ক দানা বাঁধার বিষয়টিও মোটেও সংহত পথে আসেনা। এই সম্পর্কের মধ্যে রসায়নটি ঠিক কখন, কীভাবে জমাট বেঁধে উঠতে থাকে, দর্শক হিসেবে তা বুঝে ওঠার সুযোগ ঘটেনি। এবং তা ঘনিয়ে ওঠার আগেই রুবার ১৩ বছরের সত্তাটি বরং সহসা উপস্থিত হয় কাম তাড়িত রুবার নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। প্রবল মানসিক দ্বন্দ্বেও রুবার জন্য দর্শক হিসেবে কোনো উপলব্ধিগত সম্পৃক্তি তৈরি না হওয়া একটি বিশেষ ব্যর্থতার জায়গা এবং তা ঘটেছে সামগ্রিক ‘সংহতি’র অভাবেই। অনুভূতিতে নাড়া দেয়না তপু বা মুন্নার অবস্থানও।

ফারুকী’র কাজের প্রতি শুরুর মুগ্ধতার প্রধান একটি দিক ছিল স্বত:স্ফূর্ত স্বাভাবিক অভিনয়- সংলাপ(প্রত্যাবর্তন, চড়ুইভাতি)। কালক্রমে বোধকরি সংলাপে এই চূড়ান্ত ইম্প্রোভাইজেশনই তাঁর অন্যতম দুর্বলতা হয়ে উঠেছে(তাঁর চরিত্রেরা পাল্লা দিয়ে একজন আরেকজনের চেয়ে বাচাল হয়ে উঠছে যেন)। তাই প্রসঙ্গত একজন রুবাকে ভেঙে তিনটি সত্তা নির্মাণের পরাবাস্তব মুগ্ধতার ঘোর কেটে যায় এই বিষয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে রুবার অপ্রয়োজনীয় সংলাপ দৃশ্যটিতে। অভিনয়েও ‘ব্যাচেলর’ বা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’-এর চেয়ে ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ স্পষ্টতই অস্বচ্ছন্দ, আড়ষ্ট - রুবার জটিল অভিব্যক্তি থেকে পুতুলে উপগত মুন্না পর্যন্ত। এরই সাথে শুরুতে আশ্রয় দেয়া রুবার বোন, তার শাশুড়ি এবং ১৩ বছর বয়সী রুবার চরিত্রের অভিনয়শিল্পীদের কাজ উজ্জ্বলতায় চিহ্নিত।

আবুল হায়াতের কথা আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য(বিস্তারিত করছিনা)। নুভেল ভাগ প্রভাবিত ফারুকী’র কাজে দ্বিতীয় চমৎকার বৈশিষ্ট্য ছিল বিশ্বাসযোগ্য প্রতিপার্শ্ব নির্বাচন বা নির্মাণ(এদেশী বেশিরভাগ চলচ্চিত্রই এ জায়গাটিতেই ভীষন ‘মেকি’ লাগে)। থার্ড পারসনে এক্ষেত্রেও অস্বস্তিকর খামতি রয়েছে। আঙ্গিক, চলচ্চিত্রভাষায় নীরিক্ষা প্রসঙ্গে পরাবাস্তবতার আবহ নির্মাণে মায়ের মৃত্যুর পরের স্বপ্নদৃশ্যটির প্রথম অংশ, যেখানে সবুজ বিস্তৃত চত্বরে একটা খাট, খাটে রুবা শুয়ে- আর্ট ফিল্মীয় কায়দায় তো বটেই, পরবর্তিতে এমনকি মুম্বাইয়ের মিউজিক ভিডিওতে পর্যন্ত- বহুল ব্যবহৃত একটি ক্লিশে। বরং চৌকো দীঘির ওপারে সাদা নৌকো আর মায়ের আভাস এবং বিস্তীর্ণ প্রান্তরে শূণ্যতার চিত্রকল্পটি সুন্দর ।

তবে এ দৃশ্যেও রুবার অপ্রয়োজনীয় বাড়তি সংলাপ বিষাদের গভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে পীড়াদায়ক বিঘ্ন হিসেবে এসেছে। বিছানায় মন বিহীন পড়ে থাকা শরীর বোঝাতে পুতুলের সিকোয়েন্সটি, রেল গাড়ীর ইফেক্ট সাউন্ড ব্যবহারের দৃশ্যটির চেযেও, চমৎকার সৃজনশীল একটি প্রয়োগ। সমাপ্তির মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ‘থার্ড পারসন..’-এ আরো সুচিন্তিত হতে পারত। সুব্রত রিপনের ক্যামেরা বিশেষ কোনো উল্লেখের দাবি রাখেনা-লিমনের আবহ সংগীতে সামগ্রিক সংহতির অভাব। মোটের ওপর পুরো চলচ্চিত্রে বিশেষ বিশেষ কোনো ভালো লাগা খন্ড মুহূর্ত থাকলেও এদেশের সমসাময়িক প্রায় সমস্ত চলচ্চিত্রের মতই সবটা মিলিয়ে অখন্ড আস্বাদনের সম্পূর্ণতা থাকেনা ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’-এও।

মূল ভাবনাগত দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিকতার কৃতিত্বের কিছুভাগ নিশ্চয়ই সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের প্রাপ্য(তাঁর উপন্যাসের অনুপ্রেরণা সূত্রে), বাকিটা ‘ব্যাচেলর’ এবং ‘মেড ইন বাংলাদেশ’-এর নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী’র বিষয় হিসেবে ক্রমশ পরিণত নির্বাচন এবং তা প্রয়োগের কিছু কিছু অংশের কুশলতায়। আর সাধুবাদ এই সময়ের নির্মাতা হিসেবে সমসাময়িক প্রজন্ম এবং ইস্যু নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য। তবে সফল চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার প্রকল্পে অভিনন্দন প্রাপ্তির জন্য ফারুকী’র নিশ্চয়ই 'আরো সংহত’ চলচ্চিত্র নির্মাণের অবকাশ থেকেই যায়। ------ (২৪ ডিসেম্বর ২০০৯, দৈনিক প্রথম আলো'র আনন্দ পাতায় প্রকাশিত ফাহমিদুল হক স্যার এর রিভ্যু-এর প্রতিক্রিয়ায়)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।