রাজনীতি ও অর্থনীতি এই দুই সাপ পরস্পর পরস্পরকে লেজের দিক থেকে অনবরত খেয়ে যাচ্ছে
সময়টা ছিল ভিসিআর বা ভিসিপির যুগ। এক হাজার টাকা দিয়ে রোজ ভ্যালির সদস্য হয়েছিলাম। একটা ছবির ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। ইব্রাহিমপুর থেকে সাইকেল চালিয়ে যেতাম ছবি আনতে। তখনও আনার্স পরীা দেইনি।
নেশা ছিল ছবি দেখার। কোনটা ভাল ছবি আর কোনটা ভাল নয়, জানার উপায় ছিল কম। পত্রিকা ঘেটে ঘেটে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করতাম ভাল ছবির কিছু নাম। আমি আজ থেকে ২০ বছর আগের কথা বলছি।
সেই বয়সে, সেই সময়ে ভাল কিছু ছবি দেখেছিলাম।
ছবিগুলো দেখে মহামুগ্ধ হয়েছিলাম। সেসব ছবির অনেক কিছুই ভুলে গেছিলাম, খালি মনে আছে মুগ্ধতার কথা।
তারপর এলো ভিসিডির যুগ। এই যুগ দ্রুত শেষ হয়ে চলে আসলো ডিভিডির যুগ। মুভি কেনার একটা ঝোঁক চাপলো।
দুহাত ভরে মুভি কিনেছি। এরমধ্যে আগের দেখাও মুভি কিনেছি অনেক। ঠিক করলাম প্রায় ২০ বছর আগের দেখা সেইসব মুগ্ধ ছবি আবার দেখবো। তারপর একে একে পাঁচটা ছবি দেখলাম। মুগ্ধতা কমেনি, বরং বেড়েছে।
বলা যায় দর্শকের মৃত্যু হয়নি।
১. সোফিস চয়েজ: ১৯৮২ সালের ছবি, পরিচালক অ্যালান জে পাকুলা। বেশিরভাগ সমালোচক মানেন এটাই মেরিল স্ট্রিপের অভিনয় জীবনের সেরা ছবি। সেরা অভিনেতার অস্কার পায় এ ছবি থেকে মেরিল স্ট্রিপ।
সোফি একজন পোলিস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজী বন্দী শিবিরে বন্দী ছিল।
ছবি শুরু হয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ব্রুকলিনে থাকতে আসে স্টিঙ্গো। স্টিঙ্গোর ধারাবিবরণী সারাটা ছবি জুড়ে। একই বিল্ডিং-এ থাকে সোফি ও তার প্রেমিক নাথান (কেভিন ক্লেইন)। তিনজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়।
নাথান সবসময় সন্দেহ করে সোফিকে, আস্তে আস্তে জানা যায় নাথানের আসলে মানসিক সমস্যা রয়েছে। যুদ্ধ শেষে সোফি যখন অনাহারে ছিল তখন নাথানই তাকে আশ্রয় দেয়। আমেরিকার এই জীবন ছবির একদিকের কাহিনী।
আরেকটি কাহিনী হচ্ছে সোফির নাজী শিবিরের বন্দী জীবন। সোফি একজন মা, তাঁর এক ছেলে আর ছোট একটা মেয়ে।
সোফি ধরা পড়েছিল ছেলে ও মেয়ে সহ। ছেলে ও মেয়েকে মায়ের সাথে থাকতে দেওয়া হতো না। বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখতেও ছিল নাজীদের অনীহা। কারণ বাচ্চাদের দিয়ে কাজ করানো যায় না। সোফিকে বলা হল তাকে যে কোনো একজনকে বেছে নিতে হবে।
আরেকজন যাবে গ্যাস চেম্বারে। সোফি কাকে বাঁচাবে? ছেলে না মেয়ে? মা হয়েও সোফি শেষ পর্যন্ত একজনকেই বেছে নিয়েছিল? কাকে? যারা ছবিটা দেখবেন তাদের জন্য উত্তরটা আর দিলাম না।
সোফি যখন বেছে নেয় সেই সময়কার মুখের অভিব্যক্তিকে চলচ্চিত্রের সেরা একটি মোমেন্ট বলে ধরা হয়। যদিও মেরিলকে মাথায় রেখে এই চরিত্রটি নির্মাণ করা হয়নি। পরিচালকের পছন্দ ছিল উরসুলা আন্ড্রেস।
মেরিল স্ট্রিপ চুরি করা একটি চিত্রনাট্য পড়ে রীতিমত পরিচালকের পায়ের উপর পড়েছিলেন চরিত্রটা পাওয়ার জন্য। তারপর তো ইতিহাস।
২. দি গ্রাজুয়েট: ছবিটি ১৯৬৭ সালের, পরিচালক মাইক নিকোলস। অভিনয়ে জাস্টিন হফম্যান, ক্যাথারিণ রস ও অ্যানা ব্যানক্রফট। এটিকে সর্বকালের সেরা ছবির একটি বলে মানেন সমালোচকরা।
বেঞ্জামিন সদ্য গ্রাজুয়েট। কলেজ জীবন শেষ করে বাসায় ফিরেছে, বয়স মাত্র ২৩। গ্রাজুয়েশন উপলক্ষে বাসায় পার্টি, এখানেই পরিচয় মিসেস রবিনসনের সঙ্গে। মি. রবিনসন বেঞ্জামিনের বাবার ল’ পার্টনার। মিসেস রবিনসন একা, বাসায় পৌঁছে দিতে বলে বেঞ্জামিনকে।
মিসেস রবিনসন সফলতার সাথে সিডিউস করে বেঞ্জামিনকে।
তাদের এই সম্পর্ক চলছিল সবার অগোচরে।
বেঞ্জামিনের বাবা-মা ও মি. রবিনসনের ইচ্ছা তাঁর মেয়ে এলেইনের সাথে ডেট করুক বেঞ্জামিন। সম্পর্ক মায়ের সঙ্গে, মেয়ের সঙ্গে ডেট করার কোনো ইচ্ছা ছিল না বেঞ্জামিনের। তারপরেও বাধ্য হয় একদিন বাইরে যেতে।
এক সময় এলেইনকে ভালও লাগে। সম্পর্ক হয় দুজনের। কিন্তু আগের সম্পর্ক গোপন থাকে না। এলেইন জেনে যায় সব, সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়।
এলেইন চলে যায় অন্য শহরে, সেখানে হাজির হয় বেঞ্জামিন।
এলেইনের সম্পর্ক তখন আরেক ডাক্তারের সাথে। আবার সম্পর্কও হতে থাকে বেঞ্জামিনের সাথে। এসময় হাজির হয় মি. রবিনসন। সব কিছু ভেস্তে যায়। এলেইন বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় সেই ডাক্তারকে।
নানা নাটক করে সেই বিয়েতে হাজির হয় বেঞ্জামিন।
শেষটা অনেক নাটকীয়। খানিকটা এদেশীয় আবহাওয়ার সাথে মেলে। তারপরেও ছবি হিসেবে অত্যন্ত উপভোগ্য এটি। আর এই ছবির আরেকটি সেরা জিনিষ হচ্ছে গান।
পল সায়মন আর গারফুনকেল। তাদের বিখ্যাত প্রায় সব গান পাওয়া যায় এই ছবিতে। বিশেষ করে সাউন্ড অব সাইলেন্স। শেষ দৃশ্যটায় তো এই গানটি অসাধারণ লাগে।
এই ছবির চরিত্রদের নিয়ে ২০০৫ সালে রব রেইনার্স করেছিলেন রিউমার হ্যাজ ইট।
সদ্য মুক্তি পাওয়া (৫০০) ডেজ অব সামার ছবির মূল থিমই হলো দি গ্রাজুয়েট ছবিটি।
৩. অন গোল্ডেন পন্ড: ১৯৮১ সালের ছবি। অভিনয়ে হেনরি ফন্ডা, ক্যাথারিন হেপবার্ন এবং জেন ফন্ডা। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ছবি। হেনরি ফন্ডা ও ক্যাথারিন হেপবার্ন এই মুভি থেকে সেরা অভিনেতা ও অভিনেত্রীর অস্কার পেয়েছিলেন।
৭০ বছরের নর্মান (হেনরি ফন্ডা) ও ৬০ উত্তীর্ণ ইথেল (ক্যাথারিন হেপবার্ন) প্রতি সামারে গোল্ডেন পন্ড নামের লেকের পাশে কিছুদিন থাকেন। এবারও এসেছেন। কিছুদিন পর নর্মানের ৭০ তম জন্মদিন। তাদের একমাত্র মেয়ে চেলসি (জেন ফন্ডা)। স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে।
সেও উপস্থিত, সাথে নতুন ছেলে বন্ধু ও তার ১৩ বছরের ছেলে। বাবা ও মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল না। মেয়ের ইচ্ছা ১৩ বছরের বিলকে এখানে রেখে সে তার নতুন বন্ধুকে নিয়ে ইউরোপ বেড়াতে যাবে।
বিলের সাথে সম্পর্ক, মেয়ের ফিরে আসা, বাবার সাথে সম্পর্কের উন্নতি এবং বাবার অসুস্থ্য হওয়া। ছবিটা আসলে প্রেমের ছবিও বটে।
শেষ দৃশ্যে নর্মান ও ইথেলের যে সংলাপ, তাতে এটিকে প্রেমের ছবিও বলা যায়।
মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে এর চেয়ে ভাল ছবি আমি কমই দেখেছি।
এই ছবির সেরা সম্পদ অভিনয়, লোকেশন আর ফটোগ্রাফি। অসাধারণ কিছু দৃশ্যকল্প আছে এই ছবিতে।
শেষ বয়সের জীবন নিয়ে যারা ভাবেন তাদের জন্য অবশ্য দ্রষ্টব্য এই ছবি।
অসাধারণ! অসাধারণ!
প্রথমে এটি ছিল একটি মঞ্চ নাটক। মেয়ে জেন ফন্ডা বাবার জন্য এর স্বত্ত্ব কিনে নেয়। যদিও ছবিতে যেমনটি দেখানো হয়েছে, বাস্তবেও বাবা-মেয়ের সম্পর্ক সেরকমই ছিল। এই ছবির আগে হেনরি আর ক্যাথারিন কখনোই একসঙ্গে অভিনয় করেননি। এমনকি তাদের সঙ্গে নাকি এর আগে কখনো দেখাও হয়নি।
হেনরি ফন্ডার মাথার যে টুপি সেটি আসলে ক্যাথারিন হেপবার্নের জীবনসঙ্গী স্পেন্সার ট্রেসির। যারা একটু ভিন্ন স্বাদের ছবি পছন্দ করেন তারা চোখ বুজে ডিভিডিটা কিনে আনেন।
৪. গেজ হু ইজ কামিং টু ডিনার: ১৯৬৭ সালের আরেকটি ছবি। স্পেন্সার ট্রেসি, ক্যাথারিন হেপবার্ন ও সিডনি পটিয়ার। এ ছবি থেকেও ক্যাথারিন হেপবার্ন সেরা অভিনেত্রীর অস্কার জিতেছিলেন।
ম্যাট ও ক্রিস্টিয়া সুখী, উদারমনা বাবা-মা। তাদের একমাত্র মেয়ে গেছে বেড়াতে হাওয়াই। ২৩ বছরের মেয়ে জোয়ানা ফিরে আসলো ছেলে বন্ধু নিয়ে। ছেলে বন্ধু বিপত্নীক, বয়স ৩৮। সবচেয়ে বড় কথা ছেলে বন্ধু ডা. জন প্রেন্টিক একজন আফ্রিকান-আমেরিকান।
সময়টা ১৯৬৭ সাল। সে সময়ে আমেরিকার বেশিরভাগ রাজ্যে সাদা-কালো বিয়ে ছিল অবৈধ। স্বাভাবিক ভাবেই জোয়ানার বাবা-মা হতভম্ব হয় পড়েন। তবে মেয়ে ঘোষণা দিয়ে দেয় সেই এই ছেলেকেই বিয়ে করবে এবং সে চায় বাবা-মা আশীর্বাদ করুক, অনুমোদনের ধার সে ধারে না। জন আবার অন্যরকম।
পেশাগত জীবনে অত্যন্ত সফল। নিজ পেশায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সুতরাং ছেলে ভাল না বলে উড়িয়ে দেওয়াও যাচ্ছে না। জন গোপনে জোয়ানার বাবাকে বলে আসে তারা অনুমোদন না দিলে এই বিয়ে হবে না। জন সেই রাতেই চলে যাবে নিউইয়র্ক।
সুতরাং সময় রাত পর্যন্ত। এরই মধ্যে আবার হাজির হয় জনের বাবা-মা। এর মধ্যে জনের বাবাও সাদা মেয়ে দেখে আরও বেশি হতভম্ব।
পুরো ছবিটাই এই ঘটনা নিয়ে। সংলাপ এই ছবির মূল প্রাণ।
অভিনয় তো আছেই। এটাও সম্পর্কের ছবি, উপলব্ধির ছবি। ভালবাসারও ছবি।
হলিউডে সর্বপ্রথম যে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছিল তা হচ্ছে স্পেন্সার ট্রেসী ও ক্যাথারিন হেপবার্ন-এর প্রেম। এই ছবিটির শুটিং শেষ হওয়ার ১৭ দিন পর স্পেন্সার ট্রেসী মারা যান।
আর ছবিটি মুক্তি পায় তার মৃত্যুর ৬ মাস পর। শুটিং চলার সময় সবাই জানতেন এটাই ট্রেসীর শেষ ছবি। এমনকি শেষ দৃশ্যে যখন ট্রেসি বক্তব্য দিচ্ছিল তখন তখন ক্যাথারিন হেপবার্নের চোখে ছিল টলটলে অশ্রু। এই চোখের পানি ছিল সত্যিকারের, ট্রেসীর জন্য। ছবিটি কখনোই দেখেননি ক্যাথারিন, ট্রেসীর জন্য।
৫. ওয়ান ফ্লু ওভার দ্য কাক্কুস নেস্ট: এখন পর্যন্ত তিনটি ছবি অস্কারে সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা ও সেরা অভিনেত্রী ও সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার পেয়েছে। ১৯৩৪ সালে পেয়েছিল ইট হ্যাপেন্ড ওয়ান নাইট, ১৯৭৫ সালে এই ছবিটি আর ১৯৯১ সালে সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্ব।
এই ছবির পরিচালক মিলোস ফোরম্যান, তাঁর অ্যামাদিউস দেখেও আমি সমান মুগ্ধ।
ছবিতে আছে জ্যাক নিকলসন ও লুইজি ফ্লেচার।
পুরো ঘটনা একটা মানসিক সংস্থার ভিতরের।
নিকলসন মূলত অপরাধী। তবে তাঁর মানসিক সমস্যা আছে কিনা সেটা দেখতে তাকে পাঠানো হয়েছে এই সংস্থায়। সংস্থার হেড নার্স লুইজি ফেচার। এখানে নিকলসন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে আটকা পড়ে। সংস্থার পুরো আবহাওয়াই পাল্টে দেয় সে।
সে প্রতিবাদ করে সংস্থার কার্যক্রমকে, তবে সেটিও করা হয় নিজস্ব ভঙ্গীতে। যেভাবে রোগীদের ভাল করার পথ বেছে নেওয়া হয়েছে, একসাথে বসে আলোচনা করা হয়, নার্সকে সবার ভয় পাওয়া-সবকিছুই পাল্টে দিতে চায় নিকলসন।
নিকলসন একদিন সবাইকে নিয়ে পালিয়ে যায়, মাছ ধরে নিয়ে আসে। আরেক রাতে দুজন মেয়ে নিয়ে আসে সংস্থায়। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া ভাল হয় না।
মুভির ঘটনা লিখতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার চলে যাবে। তার চেয়ে যারা দেখেননি তাদের বলি আপনারা জানেন না আপনারা কি মিস করেছেন।
এটি একটি উপন্যাস থেকে করা ছবি। এ নিয়ে মঞ্চ নাটকও হয়েছে। কার্ক ডগলাস এখানে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
তিনি এর স্বত্ব কিনে নেন, আশা ছিল নিজেই অভিনয় করবেন। ছবির স্বত্ব কার্ক তাঁর ছেলে মাইকেল ডগলাসকে দিয়ে দেন। মাইকেল মনে করলো চরিত্রের তুলনায় তাঁর বাবার বয়স অনেক বেশি। ফলে কার্ককে আর অভিনয় করা হয়নি। এ নিয়ে বাবা-ছেলের মধ্যে সম্পর্কও খানিকটা খারাপ হয়েছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।