আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিরোধীরাই মাওবাদীদের এনেছে



ভারতের রাজনীতি এ মুহূর্তে উত্তাল। বলা ভালো, কতক ক্ষেত্রে অগি্নগর্ভ। তেলেঙ্গানা ইস্যুতে গোটা ভারতই জ্বরাক্রান্ত। তেলেঙ্গানা বা গোর্খা রাজ্যের জন্য আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, পৃথক রাজ্য গঠনের। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলোও এতে হালে যথেষ্ট পানি পাচ্ছে।

উপরন্তু মাওবাদী তৎপরতা তো রয়েছেই। পাশের পশ্চিমবঙ্গ গোর্খা আন্দোলন নিয়ে যেমন সমস্যায় আছে, তার চেয়েও বেশি সমস্যায় মাওবাদী তৎপরতা নিয়ে। সাম্প্রতিক মাওবাদী তৎপরতা এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিরোধ নিয়ে কথা বলেছেন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্কসবাদী) তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। সিএনএন-আইবিএনের ডেভিল'স অ্যাডভোকেট অনুষ্ঠানের জন্য তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন করন থাপার। পরে এটি হিন্দু পত্রিকায় ছাপা হয়।

সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ বহির্বিশ্বের পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো। ভাষান্তর : ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ। করন : মাওবাদীদের দমনে পশ্চিমবঙ্গে আপনাদের সরকার কি সত্যিই আন্তরিক? ইয়েচুরি : খুবই আন্তরিক। করন : পশ্চিম মেদিনীপুরে পুলিশের নথিতে দেখা যাচ্ছে, ২০০২ থেকে এ পর্যন্ত মাওবাদীরা ১৭০ জনকে হত্যা করেছে। নিহতদের ৬৬ শতাংশই সিপিএমের।

কিন্তু এ সময়ের মধ্যে কোনো মাওবাদী গুলি খেয়ে মারা যায়নি বা উল্লেখযোগ্য কেউ গ্রেফতারও হয়নি। আপনাদের সরকার তাদের হাত খোলা রাখার সুযোগ দিয়েছে। ইয়েচুরি : এ কথা একেবারেই ঠিক নয়। আপনি যদি মার্কসবাদী ও মাওবাদীদের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে চান তাহলে আপনাকে শুধু ২০০২-০৯ পর্যন্ত সময়ের দিকে তাকালে হবে না। আপনাকে ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত সময়ের দিকেও তাকাতে হবে।

করন : নকশালবাড়ির কথা বলবেন? ইয়েচুরি : দয়া করে জনগণকে জানাতে দিন; কারণ এটি আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত একটি অভিযোগ। কিন্তু মাওবাদীদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের বিষয়ে উত্থাপিত এ অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আমরাই সবচেয়ে বেশি লোক হারিয়েছি। করন : আমি তা অস্বীকার করছি না। আমি বলতে চাচ্ছি, সম্প্র্রতি যেসব ঘটনা ঘটছে সেসবের পরিপ্রেক্ষিতে আপনারা কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছেন না।

ইয়েচুরি : দয়া করে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি গ্রামটির কথা একটু মনে করুন, যেখান থেকে চরমপন্থি বামদের সূত্রপাত। গত ৩০ বছর ধরে আমাদের লড়াইয়ের কারণেই মাওবাদ ফিরে আসতে পারেনি, কিন্তু... করন : কিন্তু ২০০২ থেকে, যখন তারা ফিরে এলো, তখন আপনারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। আমি জানতে চাচ্ছি ২০০২ থেকে আপনারা কেন ভীরুর মতো আচরণ করেছেন। ইয়েচুরি : আমি ভীরু নই। আমাদের বিরোধীরাই তাদের পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে এসেছে।

আমাদের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করার জন্যই বিরোধী রাজনীতিকরা তাদের এনেছে। করন : কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি, তাদের হটানোর জন্য আপনারা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করছেন না কেন? ইয়েচুরি : আগে তো আমার কথাটা পুরোপুরি শুনুন। মাওবাদীরা যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে, আর যা ঘটছে, এর সবই ঘটছে উড়িষ্যা আর ঝাড়খ ের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত থাকার সুবাদে। করন : কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, ঘটনাগুলো পশ্চিমবঙ্গেই ঘটছে আর আপনারা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।

ইয়েচুরি : আপনার নিশ্চয় বীরাপ্পনের কথা মনে আছে। ২০ বছর ধরে সে কর্নাটক, কেরালা ও তামিলনাড়ূর জঙ্গলে রাজত্ব করছে। আপনারা কি তাকে ধরতে পেরেছেন? করন : তার মানে আপনি কর্নাটকের সরকারের অযোগ্যতার সঙ্গে তুলনা দিয়ে নিজেরাও তাদের সমকক্ষ হতে চাচ্ছেন? ইয়েচুরি : না, না, তা নয়। দয়া করে যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন। আমার ব্যাখ্যাটা হচ্ছে, তিন রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একসঙ্গে কাজ না করলে তা সম্ভব নয়।

বীরাপ্পনকে ধরতে চাইলেও এমনটিই করতে হবে। করন : আবারও মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। গত নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। মাওবাদীরা আদিবাসীদের নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করছে। নভেম্বর থেকে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়েছে।

কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বদলে আপনার সরকার নিষ্ক্রিয়, তারা কিছুই করছে না। তারা সংকটকে আরও তীব্র হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। ইয়েচুরি : আপনাকে কে বলেছে? করন : ঘটনা আমি জানি। আমি কি এ ব্যাপারে কোনো উদ্ধৃতি টানব? ইয়েচুরি : আপনাকে এ কথা কে বলেছে? আপনি ইচ্ছা করেই মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গটি হচ্ছে, বামফ্রন্টের বিরোধীরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, তারা মাওবাদীদের নিয়ে এসেছে, তারা তাদের রক্ষা করছে এবং বিরোধীরা কেন্দ্রীয় সরকারে বসে আছে।

সে বিষয়ে আপনি মোটেও কথা বলছেন না। করন : বিরোধীরা মাওবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, তাদের নিয়েও এসেছে_ এসব বিষয় আমি মোটেও অবজ্ঞা করছি না। কিন্তু আমি আপনাকে যে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি তা হচ্ছে_ আপনারা কেন মাওবাদীদের দমন করছেন না? আপনি তো এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না। ইয়েচুরি : আমরা দমনের চেষ্টা চালাচ্ছি। মাওবাদীদের প্রধান নেতা ছত্রধর মাহাতোকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

করন : তিনি মাওবাদী নন। মাওবাদীরা তাদের সমর্থন করে। মাওবাদী ও পিসিপিএর মধ্যে পার্থক্য আছে। তিনি পিসিপিএর লোক। নিজের সম্পর্কে তিনি এ কথাই বলেছেন।

ইয়েচুরি : আপনাকে কে বলল? আপনি তাদের হয়ে ওকালতি করছেন কেন? করন : এবার বৃহত্তর সংকটের কথায় আসা যাক, যে সংকটের কারণে মাওবাদীদের দমনের ক্ষেত্রে আপনাদের সরকার পঙ্গু হয়ে আছে। আপনারা ইচ্ছাকৃতভাবে বছরের পর বছর ধরে আপনাদের পুলিশ বাহিনীর মর্যাদাহানি করেছেন। প্রতি লাখ জনসংখ্যার অনুপাতে ১০২ জন পুলিশের মধ্যে বর্তমানে আপনাদের আছে ৯২ জন। জনসংখ্যার অনুপাতে পুলিশের এ সংখ্যা জাতীয় পর্যায়ে ১২৫। আপনাদের ২৭ শতাংশ কম।

আপনাদের পুলিশ বাহিনীকে ধীরে ধীরে এ অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ কারণে আপনারা মাওবাদীদের দমন করতে পারবেন না। ইয়েচুরি : না, না, আগে আপনি প্রশ্নটা করুন। আগেই উপসংহার বা রায় দিয়ে দেবেন না। পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের সংখ্যা জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে যদি কম হয়ে থাকে... করন : কম হয়ে থাকে মানে! কম তো আছেই।

অনেক কম। ২৭ শতাংশ কম। ইয়েচুরি : আপনার কথা ঠিকই আছে। কম আছে। কারণ কোনো দাবি নিয়ে জনগণ যখন আন্দোলন করে তখন আমরা তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবহার করি না... করন : তাহলে আপনারা মাওবাদীদের দমন করবেন কীভাবে? ইয়েচুরি : কীভাবে দমন করব সেটা আমাকে বলতে দিন।

আমরা বিশেষ বাহিনী দিয়ে মাওবাদীদের দমন করব। সেই বাহিনী কাজ করছে। তারাই মাওবাদীদের দমন করবে। করন : এবার আমি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে আসি। আমি এবার আপনার কুঞ্চিত হয়ে আসা তথাকথিত বাহিনীর ঘাটতিগুলোর কথা বলি।

সাধারণ পুলিশের ক্ষেত্রে আপনাদের ২৮ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে, দাঙ্গা পুলিশের ক্ষেত্রে আপনাদের ঘাটতি ১৭ শতাংশ এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, আপনাদের দাঙ্গা পুলিশের নেতৃত্বের ঘাটতি রয়েছে ৩৫ শতাংশ। ইয়েচুরি : এই ঘাটতিগুলো কোন দিক থেকে? করন : আমি আপনাকে বলছি। প্রয়োজনীয় মানের দিক থেকে আপনাদের এই ঘাটতি। ইয়েচুরি : মিস্টার থাপার, আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেই মানগুলো কী? এবং সেদিক থেকে আমরা কতটা নিচে? এটা শুধু রাজ্য নয়, গোটা দেশের সমস্যা। সারাদেশেই প্রয়োজনের তুলনায় ঘাটতি রয়েছে।

কত জনসংখ্যার জন্য কত জন পুলিশ থাকা দরকার সেই মান জাতিসংঘের সুপারিশে আছে। দেশ হিসেবে সেদিক থেকে আমরা অনেক নিচে আছি। করন : সে ক্ষেত্রে গোটা দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান আরও অনেক নিচে? ইয়েচুরি: কিসে নিচে? ১২৫ থেকে ৯২? আমি অবশ্যই বলব এটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নীতির অংশ। এটা নিয়ে আমরা গর্বিত। জনগণের কোনো আন্দোলনে বাধা দেওয়ার জন্য আমরা পুলিশকে হামলা চালাতে বা লাঠিচার্জ করতে পাঠাই না।

তবে হতাশার কিছু নেই, মাওবাদী সমস্যার সমাধান হবে। করন : এবার আমাকে বলুন, ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, তার রাজ্য তুলনায় দরিদ্র হলেও অনেক বেশি শক্তিশালী বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হয়েছে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের সবকিছু থাকা সত্ত্বেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মাওবাদীদের দমন করতে পারছেন না। এতে কি প্রমাণ হয় না যে তার সরকার অযোগ্য? ইয়েচুরি : না, তা প্রমাণ হয় না। আপনাকে আমি আবারও বলছি, আগাম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকবেন না।

মাওবাদী সমস্যার সমাধান হবে এবং আপনি হতাশ হবেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।