আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেক্স অ্যান্ড দি থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার - সাইফ সামির - এর **মুভি রিভিউ**

মুভি ক্রিটিক ব্লগ (প্রথম বাংলা মুভি ব্লগ) ★★★★★ © ২০০৭ - ২০১৩ ওয়েবসাইট: www.saifsamir.com

মুন্না ও রুবা কি বিয়ে করেছিল? মুন্না যখন রুবাকে বাড়ি নিয়ে এলো তখন তার বাবাকে বলেছে তারা বিয়ে করেছে। কিন্তু মুন্না যে বলল সে নাস্তিক- কাগজপত্র নয় পারষ্পরিক বিশ্বাস থাকলেই চলে! বিশ্বাস কথাটা আস্তিকতার সাথে সম্পর্কিত - তবে কি তাদের 'বিয়েটা' মৌখিক ছিল? এটা কি বিয়ের প্রচলিত সংজ্ঞার পরিপন্থি নয়? এ অনেকটা মাজারে গিয়ে গার্মেন্টকমীদের মতো 'তুমি আমার স্বামী/তুমি তোমার স্ত্রী' টাইপ বিয়ে করা যেন! তারা তো কোর্ট ম্যারেজ করতে পারতো। নাস্তিকতার সঙ্গে ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসের সম্পক কিন্তু এই আধুনিক যুগে কাগজপত্রের প্রতি অবিশ্বাস থাকবে কেন? যেহেতু নাস্তিকরাও বিয়ে করেন তাই শুধু নাস্তিকতা অজুহাত হতে পারে না। চরিত্রের আরও গভীরে যাওয়া উচিত ছিল। থানার কর্মকর্তা যখন রুবাকে জিজ্ঞেস করলেন 'লিভ টুগেদার' কিনা - তখন মনে হতে পারে 'লিভ টুগেদার' যেন আমাদের সমাজে খুব সাধারণ কিছু! অথচ লিভ টুগেদারের কোন আইনগত ভিত্তি এ দেশে নেই।

লিভ টুগেদারই যদি হবে রুবা মুন্নাকে 'স্বামী' পরিচয় দিচ্ছে কেন? 'লিভ টুগেদার' ব্যাপারটাতে কি 'স্বামী-স্ত্রী' টার্মগুলো আছে? তাছাড়া মুন্না জেলের একটি দৃশ্যে রুবাকে 'ডিভোর্স' দেবার কথা বলল কেন - যদি তারা বিয়ে না করেই থাকে? আরেকটা ব্যাপার, মুন্নাকে জেল মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে রুবা নিজেকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে থাকলে তার আইনগত ভিত্তি কি? রুবা এ ধরণের কোন বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিল কিনা তা মুভিটিতে দেখানো হয়নি। যা দেখালে ভালো হতো। অন্যদিকে জেলে থাকতে ডিভোর্সের কথা বললেও বাইরে এসে মুন্নার কথা হলো যেহেতু তাদের বিয়ে হয়নি তাই ডিভোর্সেরও প্রয়োজন নেই! সব কিছুতে চেঞ্জ দেখতে পাওয়া জেল ফেরত মুন্নার জবানই চেঞ্জ হয়ে গেল! কাগজপত্রবিহীন এই সম্পর্ক কতই যে ঠুনকো! এই বিয়ে-অবিয়ের দ্বিধা শুভঙ্করের ফাঁকি না স্ক্রিপ্টের দূর্বলতা - কথাটির পর আরেকটি প্রশ্নবোধক চিহৃ দেয়া যায়! অবশ্য মুন্না চরিত্রে মোশাররফ করিমের অভিনয় প্রসঙ্গে কোন প্রশ্ন তোলার প্রশ্নই আসে না! গণিতের ভাষার আশ্রয় নিয়ে বলতে পারি- আমরা জানি, মুন্না ও রুবার সম্পর্কটা লিভ টুগেদার। কিন্তু কেন তারা লিভ টুগেদারে যেতে প্ররোচিত হলো, কিভাবে তারা এই সিদ্ধান্ত নিল, পরবর্তীতে পরিবারের ভেতরে-বাইরে তাদের অবস্থান, নিজেদের উপস্থাপন কেমন ছিল বিষয়গুলো চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক এড়িয়ে গেছেন। সম্ভবত তারা 'হ্যাপি লিভ টুগেদার' জীবন-যাপন করছিল।

তাই ডিরেক্টর প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু এই প্রয়োজন বোধ না করাটাই আমাদের সমাজে অপ্রচলিত-অনাকাঙ্খিত লিভ টুগেদারকে প্রচলিত দেখানো বা প্রমোট করার মতো। কারণ ঘটনাক্রমে মুন্না যদি জেলে না যেত পরবতী ঘটনাগুলো রুবার জীবনে ঘটতো না। এবং তা না ঘটলে সুদক্ষ বিজ্ঞাপন নির্মাতা এই ডিরেক্টর বিয়ে বহিভূত এমনকি লিভ টুগেদার বহির্ভুত রুবা-তপুর একই ফ্ল্যাটে রাত যাপনে উভয়ের কামজ আকর্ষণের দীর্ঘ রসালো মিউজিকাল চিত্রায়ন তথা সেক্সকে প্রমোট করতে পারতেন না। প্রমোট বলতাম না, যদি ব্যাপারটা শুধু একা একটা মেয়েকে একলা পাওয়া অবিবাহিত তপুর বেলায় হতো।

কিন্তু এখানে কথিত 'স্বামী' সম্পন্ন রুবার আকর্ষণও দেখানো হয়েছে, অথচ ইতিপূবে তপুর প্রতি রুবার ভালবাসার স্বাভাবিক বহি:প্রকাশ দেখানো হয়নি। এখানে ভালবাসা নয়, রাত গভীর হওয়াতে দেহজ কামনা উথলে উঠেছে। তাই তো রুবার আপন দ্বন্দ। ভালবাসা হলে এতো দ্বিধা হতো না, কেননা রুবার তো লিভ টুগেদারে দ্বিধা নেই! প্রথম দিকে গায়ক তপুর যে সেলিব্রিটি ইমেজ দেখানো হলো - যিনি ঝোপঝাড়ের আড়াল ছাড়া রুবার সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না সেই তিনি আবার ওষুধের দোকানে যখন ঘুরঘুর করছেন কনডম কেনার জন্য তখন উনার সেলিব্রিটি ইমেজ ডিরেক্টর হরণ করলেন কিনা ব্যাপারটা ভাবায় বৈকি! অবশ্য ডিরেক্টর যে অপেশাদার তপুর থেকে প্রয়োজনীয় অভিনয়টুকু আদায় করে নিতে পেরেছেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। রুবাকে সহায়তার বিনিময়ে সরাসরি প্রতিদান না চাওয়া আবার মনে মনে ও আকার-ইঙ্গিতে রুবাকে দৈহিকভাবে পেতে চাওয়া তপুর মনে কি রুবার প্রতি ভালবাসা ছিল না কেবলই কামনা! ঋণ পরিশোধের দৈহিক পথে যাওয়ার রুবার উদগ্রীবতাও কি কামনা নয়! এভাবে এতোই যদি প্রতিদান দেবার ইচ্ছা রুবা তো চাইলে ঐ পথের আগেই প্রাপ্ত অফার গ্রহণ করে তৎকালীন বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারতো।

স্ক্রিপ রাইটার আনিসুল হক ভালবাসার চেয়ে ঋণ পরিশোধকে বড় করে দেখালেন কেন? এখানে এসে মেয়েটিকে এতো ছোট করবার কারণ কি? সেক্স ভালবাসার প্রথম প্রকাশ নয়, চূড়ান্ত ক্ষণ বলা যতে পারে। অথচ তপু ও রুবার মধ্যকার ভালবাসাবাসির প্রকাশই তো দেখালেন না পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সেক্সকে বাংলা মুভিতে বিচরণের পথ সুগম করলেন তিনি। হলিউড স্টাইলের এই আকস্মিক 'আধুনিক ভালবাসা' প্রকাশের চেষ্টাকে এই বাংলায় সাধুবাদ জানাতে পারছি না। সেক্সকে এখনই যদি দেশীয় মুভিতে প্রমোট করা শুরু হয়ে যায় তবে ভবিষ্যৎ ভয়ংকর হতে পারে।

অনেক রাতের একটি দৃশ্য দিয়ে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের শুরু। যেখানে একা একটি মেয়ে রাতের শহরে সম্ভাব্য বিভিন্ন বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। মুভির অংশ জুড়ে থাকে মেয়েটির বাসস্থান জনিত সমস্যা, চাকরি প্রাপ্তির সমস্যা। কখনও পালিয়ে, কখনও নীরব, কখনওবা রুখে দাঁড়াচ্ছে সে। বিষয়গুলো অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ডিরেক্টর।

কিন্তু কোন পরিস্থিতির শিকার হয়ে মেয়েটি এতো রাতে মার বাড়ি থেকে বের হলো তা চিত্রিত করেননি পরিচালক। বণিবনা না হওয়াই যদি ঘর ছাড়ার কারণ হয় সে তো সকালেও বের হতে পারতো, এরপর খুঁজে নিতো কোন একটি ঠিকানা। কিন্তু তা না করাতে প্রমাণ হয় মেয়েটি রাগী, অভিমানী ও স্বাধীনচেতা। সেই মেয়েটিরই নাম রুবা। অভিনয়ের ব্যাপক সম্ভাবনাময় এই চরিত্রে ভালই করেছেন তিশা।

যদিও নিজস্ব গন্ডির মধ্যে আটকে আছেন তিনি। এখানেও তিনি নাটকের তিশাই রয়ে গেলেন। নিজের অভিনয়-চরিত্রকে আরও ভেঙ্গে-গড়ে তুলতে হবে তাকে। রুবার প্রাথমিক সমস্যার সমাধানের পর তপুর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ভালবাসায় মোড় নেয়া এবং তা নিয়ে মুন্না-রুবা-তপুর মধ্যে টানাপোড়েন দেখানোর সুযোগ না নিয়ে ডিরেক্টর বেছে নিয়েছেন রুবা-তপুর কামজ আকাঙ্খা প্রকাশের দ্বিধা-দ্বন্দকে। বলা যায় পুরো মুভি জুড়ে 'সেক্স' ছিল এক অদৃশ্য প্রধানতম 'চরিত্র'।

মনুষ্য প্রবৃত্তি হিসেবে একটা সময় পর্যন্ত তা মেনে নেয়া গেলেও এক পর্যায়ে তা বিজ্ঞাপনের মতো আরোপিত মনে হয়। একটা বৃত্ত সৃষ্টি হয়ে যায়। এই বৃত্ত থেকে শেয পযন্ত বের হতে পারে না কাহিনী, বের হতে পারে না ডিরেক্টর, পারে না কুশীলব। দ্বিধার জালে আবদ্ধ সবাই। রুবা বারে বারেও পারে না বের হতে, তপু আরও জড়িয়ে যায়, মুন্না ছাড়তে পারে না রুবাকে।

কে যে কার? কে যে কার? রুবাকে দেখানো হয় থার্ড পারসন হিসেবে। কিন্তু কেন রুবা থার্ড পারসন হবে? সব দ্বিধা-দ্বন্দ ঝেড়ে একটি সিদ্ধান্তে আসার ক্ষমতা কি এই স্বাধীনচেতা মেয়েটির নেই? তাদের ভবিষ্যত কোথায় বলতে ব্যর্থ গল্পকার। তাই তো মুভির শেষটাও হয় ছোট গল্পের মতো। শেষ হয়েও শেষ নয়। যেন মুভির শুরু এখানেই।

এবার দ্বিধায় নিমজ্জিত অতৃপ্ত দর্শক! পারফেক্ট না হলেও ফারুকী তার আগের দুটো মুভি ব্যাচেলর (রেটিং: ২.৫/৫) ও মেড ইন বাংলাদেশ (রেটিং: ২.৫/৫) -এর চেয়ে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারে অনেক বেশি পরিণত। কিছু দৃশ্য তার মেধার পরিচয় বহন করে। সহকারী পরিচালকরাও কৃতিত্বের দাবিদার। কিন্তু মুভির প্লট আরও সুসংহত হওয়া উচিত ছিল। চিত্রগ্রাহক সুব্রত রিপনের কাজ প্রশংসার যোগ্য।

লিমনের আবহ সঙ্গীত ছিল দারুণ। তবে মিউজিক ট্র্যাকগুলোর পিকচারাইজেশন আরও ভাল হতে পারতো। এডিটিং-এ কিছুটা দূবলতা আছে যা তিতাস সাহার পক্ষে কাটিয়ে ওঠা অসম্ভবপর ছিল না। কাস্টিং যথার্থ। রহমান চরিত্রে আবুল হায়াত তার ক্যালিবারের স্বাক্ষর রেখেছেন।

রুবার কিশোরী চরিত্রে লেখা হকের সুন্দর পারফরম্যান্সের কথা না বললেই নয়। ফারুকীর টিম লোকেশন নির্বাচনে বরাবর পটু। কিন্তু কাহিনীর লোকেশনের সঙ্গে বাস্তব লোকেশন তালগোল পাকিয়ে ফেলে! এই মুভিতে আগের মুভির চেয়ে তেমন ঘটনা কম ঘটেছ। পরিশেষে বলার আছে - মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কাছে দাবি থাকবে তিনি বাঙালির সমাজ-সংষ্কৃতির প্রতি কমিটমেন্ট রেখে পাশ্চাত্য বিমুখ আশা জাগানিয়া বাংলা মুভি বানাবেন, যা প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা এক সঙ্গে বসে দেখতে পারবে। শুধু নির্দিষ্ট দর্শক শ্রেণী যেমন ইয়াং জেনারেশনকে টাগেট করে, পশ্চিমের বাহবা পাওয়ার জন্য বা পুরষ্কার কমিটিগুলোর জন্য মুভি বানালে আমাদের চলবে না।

দর্শকদের বলবো, ডিরেক্টর যা দেখান তার বাইরেও উদ্দেশ্য থাকে তাই মুভি দেখতে মনের চক্ষু যোগ করুন। তিনি কি বলতে চান বা করতে চান সেটাও অনুভব করুন, তবেই মুভি দেখা সার্থক হবে। রেটিং: ২.৫/৫ http://www.i-love-movies.tk


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।