আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিশুবয়সে আমারদেখা গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ-১

স্বাগতম
একাত্তুর সালে আমার আব্বার চাকুরীর সুবাদে টাংগাইল শহরের আশেকপুর ছিলাম। আমার বয়স কতইবা মাত্র ক্লাস থ্রীতে পড়ি। তবে তখনকার বাবা মারা ঐ বয়সে আমাদের খেলাধুলার জন্য বাইরে ছেরে দিতো। সেই সুবাদে কোন মিছিল মিটিং দেখলে আমরা ছোটরাও দলবেধে ঐ বড়দের মিছিলে বা মিটিংয়ে যোগ দিতাম। তখন প্রায়ই হরতাল ডাকা হতো আর সাইকেল-রিক্সা পিকেটাররা আটকালে পেছন থেকে আমরা চাকার হাওয়া ছারার কাজটা করতাম।

রাজনৈতিকভাবে টাংগাইলের অবস্থান তখন খুবই শক্ত ছিল। শোনা যেত প্রায় রাতেই নাকি শেখ মুজিব টাংগাইলের সন্তোষ আসতেন মাওলানা ভাসানির সঙ্গে পরামর্শ করতে। আমরা খেলা ছেরে নিরালার মোড়ে যেতাম পথ সভা শুনতে,কারন সেখানে বাংগালী জাতীর মুক্তি আন্দোলনের আপডেট খবর থাকতো। সেই জ্বালাময়ী ভাষনগুলো কে দিতেন আমার নাম মনে নেই। তবে এইটুকু মনে আছে তারা মুজিবের কথা, ইয়াহিয়া,ভুট্টো,মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এরা আমাদের বাংগালীদের নিয়ে কে কি বলেছেন ইত্তাদি শুনাতেন।

আর শ্লোগান দিতেন জয় বাংলা,পিন্ডি না ঢাকা...ঢাকা ঢাকা,তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা ইত্যাদি। একদিন খবর এলো ঢাকাতে বাঙ্গালীদের মেরে ফেলা হচ্ছে। ট্রাক বাসে করে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা শত শত লোকজনেরা যে বর্ননা দিচ্ছিল তা সবাই শুনে ক্ষেপে যাচ্ছিল। সেই নিরালার মোড়ের পথ সভা বড় হয়ে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুলের বিশাল মাঠে অনুষ্ঠিত হলো। আমার মনে আছে তখন একটা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী(পরে মুক্তি বাহিনী) গঠিত হলো তারা টাংগাইল প্রতিরোধ করবে,তরুন লতিফ সিদ্দিকীকে বাহিনী প্রধান করা হলো।

তারা শেখ মুজিবের নামে সেখানে শপথ নিলেন। তারা সকল অফিস আদালত,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে আমাদের জয় বাংলার নুতন পতাকা ঊড়ানোর নির্দেশ দিলেন। পরদিন সবাই লাল সবুজ আর মানচিত্র আকা পতাকা উরিয়ে দিলেন। কিন্তু আমাদের বাসায় ছিল লাল পতাকার উপরে ধান-কাস্তে আকা খান আতাউর রহমানের জাতীয় দলের একটা বড় পতাকা। সেই দলের টাংগাইলের নেতা ছিলেন আল-মুজাহিদী,শামীম আল-মামুন নামের দুই ভাই এবং ইনারা আমাদের পাড়াতেই থাকতেন।

আমারভাই ঐ পতাকাটা বেশ উচু করে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু পরদিন আওয়ামীলিগের দুই-তিনজন কর্মী এসে বললো কি ব্যাপার এটাতো ভুল পতাকা। কিন্তু আমার ভাই তাদের বুঝিয়ে দিলেন,সর্বোদলীয় সিদ্বান্ত এখনো হয়নি যে বাংলাদেশের পতাকা কি হবে?ওরা আর কথা না বাড়ীয়ে চলে গেল। টাংগাইল বাসস্ট্যান্ডের(পুরানো)মোড়ে ট্রাফিক আইল্যান্ডটাতে একটা মোটা পাইপ কালো রং করে কামানের আকার করে হেলমেট পড়িয়ে এক লোককে বসিয়ে দিল। দূর থেকে দেখে মনে হলো আর্মী পজিশন নিয়ে বসে আছে।

আমরা বাচ্চারা এসব দেখতে সারাদিনই ঘুরে বেড়াতাম। একদিন দেখলাম সর্বোদলীয় ব্যনারে ডিসি অফিস ঘেড়াও করতে সবাই ডিস্ট্রিক অভিমুখে রওয়ানা হয়েছে। অনেকের হাতেই ছিল এয়ারগান ও অন্যান্য ছোট খাট বন্দুক। আমরা মিছিলকারীদের জিজ্ঞেস করে জানলাম তারা বিহারী/পাকিস্তানী সেনা-পুলিশ ও উর্দুভাষী সরকারী অফিসারদের সারেন্ডার করানোর জন্য যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে আমরাও প্রায় সারাদিন লেকের পারে বসে কাটালাম কারন বড়রা আমাদের ওদিকে যেতে দেয়নি।

বিকেলের দিকে দেখলাম তারা হাসি মুখে ফিরতে শুরু করলো। কারন বিনা বাধাতেই তারা বিহারীদের কব্জা করেছিল। তারা নাকি কথা দিয়েছিল বাংগালীর সঙ্গেই তারা থাকবে। ঢাকার অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগলো। খবর এলো পাকিস্তানী মিলিটারী ঢাকা থেকে অন্যান্য জেলার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

ওদিকে চট্টগ্রামের সমুদ্রে পাকিস্তানী একটি অস্রের জাহাজ এসেছে ওটা থেকে বাংগালী সৈন্যরা অস্র খালাস করতে দিচ্ছেনা ইত্যাদি নানা কথা শুনা যাচ্ছিল। আরো শোনা গেল মেজর জিয়া শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন। চট্টগ্রাম সেনা সদর বাংগালীদের দখলে ইত্তাদি ইত্তাদি। আমরা এই সব খবরগুলি রাতে বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠান ও আকাশবানী কোলকাতা থেকে শুনতে পেতাম। আমার আব্বা ছিলেন সাদা সিদে সরকারী কর্মচারী,তিনি এইসব রাজনীতির ব্যাপারে খুব একটা খোজ খবর রাখতেননা।

আমাদের ছিল তিন নবের সাদা রঙ্গের একটা ফিলিপস রেডিও । আমরা ছোট বড় ভাইবোন গোল হয়ে বসে রেডিও থেকে এই সব খবর শুনতাম। এছাড়া টাংগাইলের রাস্তা ঘাটে দাড়ালেই অনেক কথা শোনা যেত বাসায় ফিরে এসে আমরা যে যা শুনেছি এগুলো আলোচনা করতাম। নবগঠিত মুক্তিসেনারা পাকিস্তানী সৈন্যদের টাঙ্গাইল দখল ঠেকাতে ঢাকার দিকে এগিয়ে নাটিয়াপাড়া নামক স্থানে সমবেত হলো। এর আগে জেলা অস্রাগার দখল করে নিয়ে সব অস্র তারা নিয়ে নিলো আর অবাঙ্গালীদের আটক করে রাখলো।

আমরা এই খবর শুনে ভীত হয়ে উঠলাম। কারন আমাদের দেশের বাড়ী কুমিল্লা যেতে হলে সেই ঢাকা অতিক্রম করতে হবে!আমাদের পরিচিত অনেকেই ইতিমধ্যে গ্রামে চলে যেতে শুরু করলো। এরই মধ্যে শুরু হলো নাটিয়া পাড়ার যুদ্ধ। আমাদের বাসার সামনে দিয়েই ঢাকা-টাংগাইল মহা সড়ক। দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম মুক্তিসেনাদের সঙ্গে বাংগালী সৈন্যরাও যোগ দিয়ে একত্রে যুদ্ধে নেমেছে।

তাই দেখে আমরা কিছুটা ভরষা পেলাম। এই নাটিয়া পাড়ার যুদ্ধ থেকেই আমি প্রথম গোলাগুলীর আওয়াজের সঙ্গে পরিচিত হলাম। দুইদিন একনাগারে যুদ্ধ চললো,আকাশে আমরা কালো ধুয়া দেখে সঙ্কিত হলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুধু গাড়ী আসা যাওয়া দেখি,এরই মধ্যে একটা ট্রাক নাটিয়াপাড়া থেকে ফিরে এসে সবাইকে হাত নেড়ে পালানোর নির্দেশ দিতে লাগলো। সেই কথা আমার কানে এখনো বাজ়ে।

সেই মুক্তিসেনা রাস্তার ধারের লোকজনকে বলে যাচ্ছিল তারা এবার হেরে গিয়ে পিছু হটেছে কিন্ত শিঘ্রীই আবারো ফিরে এসে এই শহরসহ সারা বাংলা জয় করবেন। আমি হাপাতে হাপাতে দ্রুত বাসায় ফিরে গেলাম এবং সবাইকে এই কথাটা বললাম। তখন দুপুরবেলা ছিল বলে বাসায় সবাই ছিল। তারাও বাইরে গিয়ে দেখতে পেল ওদিক থেকে আরো ট্রাকে করে মুক্তি সেনারা ছুটে আসছে আর হাত নেড়ে নেড়ে সবাইকে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলছেন। ওদিকে তাকিয়ে দেখি শতশত নারী-পুরুষ লোটাকম্বল নিয়ে বিলের দিকে দৌড়াচ্ছে।

বাসায় ফিরে আমরাও হাতের কাছে যা প্রয়োজনীয় মনে করেছি সঙ্গে নিয়ে একইদিকে বেড়িয়ে পড়লাম। আমাদের ভাই-বোন সবার হাতেই ছিল কিছুনা কিছু জিনিষপত্র। আব্বা-আম্মা দৌড়াতে পাড়ছিলেননা। পাকিস্তানীদের স্টেনগানের শব্দ কানে আসতে লাগলো আমরা চিৎকার করে কাধছি আর দৌড়াচ্ছি কিন্তু একবারও পেছনে তাকাচ্ছিনা। আশে পাশে আরো হাজার হাজার লোকজন একইভাবে দৌড়াচ্ছিল।

আমরা হাটু পানি বিল ডিংগিয়ে ওপাড়ে গিয়ে আব্বা-আম্মার জন্য একটু বসলাম। তখনই চোখে পড়লো আশেকপুর ব্রীজের দিকে পাকিস্তানীদের সারি সারি জীপগাড়ী শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা তখন ফায়ার রেঞ্জের বাইরে ছিলাম তবুও ভয়ে আবারো উঠেপড়ে দৌড়াতে লাগলাম। এভাবে অনেক দুরের একটা গ্রামে গিয়ে উঠলাম। সেখানে গিয়ে দেখি শতশত লোকজন আগে থেকেই আশ্রয় নিয়েছেন।

বাড়ীর মালিক আমাদেরকেও ডেকে নিয়ে আম্মা ও বোনদের একটা বড়টিন সেডের ভেতরে যেতে বললেন। আমি আব্বার সঙ্গে বাইরে খেড় বিছিয়ে হাতে নিয়ে আসা চাদরের উপড় বসে পড়লাম। আমাদের আশে পাশে আরো প্রচুর লোকজন এভাবেই শুয়ে-বসে ছিলেন। তাদের মুখে শুনলাম কয়েকজন গুলিবিদ্ব হয়ে সেখানেই পড়ে রয়েছে। আমার ভাই এসে বললেন পাশের ঘড়ে আল-মুজাহিদ ভাই আশ্রয় নিয়েছেন।

আমি তাকে দেখতে গেলাম। সেখানে উনিসহ আরো কয়েকজন বসে ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন আয় আমার নিকট বস। তিনি আমাদের ছোটদের নিয়ে খেলাঘড় জাতীয় একটা দল করেছিলেন। সেখানে আমাদের বুদ্বি পরীক্ষা দিতে হতো।

কাছে বসে দেখলাম কালো একটা পোটলা,জিজ্ঞেস করতেই বের করে দেখালো চকচকে একটি পিস্টল ও কিছু বুলেট। আমার জীবনে সেটাই ছিল প্রথম অতি নিকট থেকে স্বচক্ষে দেখা পিস্টল। আমি দৌড়ে আব্বার নিকট গিয়ে এই সংবাদটা দিলাম। এদিকে রাত নেমে আসতেই জোৎনার আলো নেমে এলো,অনেকে বলাবলি শুরু করলো নুতন টিনের চাল উপড় থেকে দেখে পাকিস্তানীরা বোম্ব মারতে পারে!কেউ কেউ কাথা দিয়ে এই চালকে ঢেকে দেয়ার পরামর্শ দিলেন। পুরো রাতটাই আমাদের কাটলো এই বুজি আমরা আক্রান্ত হলাম সেই ভয় আর দুঃচিন্তায়।

সেদিন রাতে আমরা কিছু খে্যেছিলাম কিনা আমার মনে নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম অর্ধেক লোকই চলে গিয়েছে। মুজাহিদ ভাইও নেই। শুনলাম সেখান থেকে অনেকেই মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতে চলে গিয়েছেন। আমরা কোথাও না গিয়ে সেখানেই আরো একদিন ও একরাত কাটালাম।

খবর এলো শহরে মাইকিং হচ্ছে সবাইকে ফিরে যেতে। অফিস আদালত ও ব্যবসা শুরু করতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে অন্যথায় শাস্তি দেয়া হবে। আব্বা আমাদেরকে রেখে একাকী শহরে গিয়ে ফিরে এলেন বিকালে। এসেই আমাদেরকে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরী হতে বললেন। তিনি বললেন সরকারী কর্মচারীদের কোন ভয় নেই।

উনাকে চেকপোস্টে আর্মীরা উর্দুতে কিভাবে জিজ্ঞেস করেছেন সব বললেন। আব্বা সরকারী চাকুরে এবং মুসলমান শুনেই নাকি ছেরে দিয়েছে!আমরা এইসব শুনে বুকে সাহস পেলাম এবং শহরের দিকে ফিরে চললাম। (চলবে) কলকাতা শরনার্থী শিবির
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।