আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: দার্শনিক

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

সময়কাল : খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০. স্থান: প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের নিনেভ নগর। ধূসর রঙের পাহাড় ঘেরা উপত্যকাটি অত্যন্ত মনোরম । ধূসর পাহাড়ের মাঝে বিস্তর সবুজ বৃক্ষরাজি এবং একটি তুষারাচ্ছন্ন শিখর পরিলক্ষিত হয়।

শিখরটি সারা বছরই তুষারাচ্ছন্ন থাকে বলেই মনে হয়। উপত্যকায় এঁকেবেঁকে একটি নদী বয়ে চলেছে। নদীটির নাম টাইগ্রিস-যার দু-পাড়েই ফলবান শষ্যের বিস্তীর্ণ প্রান্তর দিগন্ত অবধি ছড়িয়ে রয়েছে । আদিগন্ত শষ্যের প্রান্তরটি অত্যধিক উর্বর । প্রান্তরের বেশির ভাগ ক্ষেতই যব-এর।

যবক্ষেতে কৃষ্ণকায় ও তাম্রাভ বর্ণের কর্মঠ কৃষকদের কর্মরত দেখা যায়। শষ্যের অতিমাত্রায় ফলনের কারণে স্থানীয় সেচপ্রকল্পসমূহ যে অতি উন্নত তা সহজেই অনুমিত হয়। এখন হলুদ রঙের অবারিত যবক্ষেতের ওপর শেষ বিকেলের নম্র হলুদ আলো এসে পড়েছে । আর, ওপরের আকাশটি শেষ বেলার ফিরোজা রং ধারণ করেছে। বাতাস মৃদুমন্দ।

আর, যবক্ষেতের মধ্যে একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন দেখা যায়। বৃদ্ধকে স্থানীয় কৃষক বলে বোধ হয় না: বরং তাঁর পরনের পোশাক-পরিচ্ছেদই বলে দেয় যে বৃদ্ধটি ভিনদেশি পর্যটক। ঈষৎ ঝুঁকে যব ফুলের হলুদ বরণ সৌন্দর্য অবলোকন করছেন। কী কারণে মিটমিট করে হাসছেন তিনি। পশমী কাপড়ের তৈরি কালো রঙের আলখাল্লা পরিহিত বৃদ্ধের শরীরটি দীর্ঘ ও শীর্ণ, দেহের রং -যদ্দূর বোঝা যায়-ঈষৎ তাম্রাভ, ভেড়ার লোমের তৈরি ছাই বর্ণের মস্তক আবরণীটির নিচে পলিতকেশ পরিলক্ষিত হয়, পাকা ভ্র“র নিচে চোখ দুটি বহু পুরাতন নীলকান্ত মনির ন্যয় নীলাভ আর ধূসর, তামাটে বর্ণের মুখটিতে অজস্র বলিরেখা- যা তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতারই নির্দেশ করে।

সৌম্য দর্শন দার্শনিকটির দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেও প্রশান্ত ও সমাহিত ভাবটি প্রকট। যেন তিনি এই মনোরম উপত্যকাটিতে মিশে রয়েছেন। যে কারণে মৌমাছিরা তাঁর উপস্থিতি টের পাচ্ছে না। কাছেই একটি দলছুট নিঃসঙ্গ মৌমাছি যব ফুলে বসে মধু আরোহণ করছিল। সেদিকে অপলক চেয়ে থেকে বৃদ্ধ ভাবলেন: কী সুন্দর ঈশ্বর-সৃষ্ট কালো-হলুদ রঙের প্রাণি! যব ফুলের মধুও ঈশ্বরের সৃস্টি।

তবে ঈশ্বর তার সৃষ্টিলোকে কখনোই হস্তক্ষেপ করেন না। তার মানে আমি এখন মৌমাছিটিকে ধরে আঙুলে পিষে মেরে ফেললেও ঈশ্বর এটিকে বাঁচাতে আসবেন না ...কিংবা আমাকে একটি বিষধর সাপ ছোবল মারলেও ঈশ্বর আমাকে বাঁচাতে আসবে না । তবে আমার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে। আমি মৌমাছিটিকে মারব না বরং বাঁচিয়ে রাখব। কেননা মৌমাছিটি জনসমাজে পুষ্ঠিকর মধুর যোগানদাতা, তাছাড়া এটি একটি সুন্দর প্রাণি।

জগতে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করা প্রতিটি বিচক্ষণ মানুষের দায়িত্ব। তিনি আরও ভাবলেন মৌমাছির বোধবুদ্ধি সীমিত ও অপরিবর্তণীয়। তার তুলনায় মানুষ এক মহৎ প্রানি-যদি তার মনে কুসংস্কারের বদলে স্বাধীন বিচারশক্তি পূর্নমাত্রায় সক্রিয় থাকে। হ্যাঁ। বৃদ্ধ একজন দার্শনিক।

তাঁর নাম এরিদু। এই উপত্যকা থেকে সুদূর দক্ষিণে নীল নদের দেশ। সেখানকার নুবিয়া অঞ্চলে আজ থেকে আশি বছর আগে তাঁর জন্ম। চল্লিশ বছর অবধি জন্ম-নগরেই ছিলেন দার্শনিক এরিদু; এরপর স্থানীয় শাসকের সঙ্গে মতের অমিল ঘটে, যে কারণে বলপূর্বক তাঁকে নির্বাসিত করা হয়। এরপর চল্লিশ বছর ধরে ভ্রমনরত আছেন।

বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে ঘুরে জ্ঞানের সঙ্গে অভিজ্ঞতার মিশ্রণ ঘটছে বলে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। বিচক্ষণ মানুষের দেশভ্রমন বাধ্যতামূলক বলেই তিনি মনে করেন। ইলাম লাঘাশ নিপপুর উর উরুক প্রভৃতি নগর ভ্রমন শেষ করে দার্শনিক এরিদু এখন নিনেভ নগরে যাচ্ছেন। হ্যাঁ। টাইগ্রিস নদীর পাড়ে নগরটির নামই নিনেভ ।

গভীর পরিখা ও ধূসর রঙের সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা বিশাল নগরটি অত্যন্ত সুরক্ষিত। সর্বদা শক্রপক্ষের হুমকির মধ্যে রইলেও অত্যন্ত প্রাণচঞ্চল নগর নিনেভ-দাসদাসীসহ অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় দুই লক্ষাধিক। নগরকেন্দ্রে পাথরের বিশাল চতুস্কোন চত্তর; উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিম থেকে চারটি সুপ্রশস্ত সড়ক এসে চত্তরে মিলেছে। সড়কে ঝলমলে রাজকীয় রথ ও সড়কের দুপাশে সাদা রঙের একতলা-দোতলা দরদালান পরিলক্ষিত হয়, পরিলক্ষিত হয় বিপনী বিতান ও রাজকীয় ভবনসমূহ, প্রাসাদ ও স্থাপত্য। সড়কে দাসদের ব্যস্ত পদচারণা।

ধনীদের গৃহগুলি অমলিন ও মনোরম। দার্শনিক এরিদু কিঞ্চিত বিস্মিত। ধনে-মানে নিনেভ কে বেশ সমৃদ্ধশালী নগর বলেই মনে হচ্ছে । নগরপ্রান্তে একটি অতিথিশালায় উঠেছেন। রাত্রিকালে অতিথিশালার ছাদে শুয়ে ঝলমলে নক্ষত্রের পানে প্রহরের পর প্রহর চেয়ে থাকেন ... নগরের প্রধান উপাসনালয়টি নগরকেন্দ্রের কাছেই।

ধাপে ধাপে বিশাল কাঠামোটি ওপরে উঠে গেছে । মাটি থেকে চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে । ওপরে পাথরের সমতল চাতালে দেবতা মারদুক এর জমকালো উপাসনালয় । এতদ্বঞ্চলের অত্যন্ত শক্তিশালী দেবতা মারদুক । সারা বছরই দেবতার আরাধনা করা হয়।

তা ছাড়া নববর্ষের সময় দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখতে শিশুবলি দেওয়া হয়। তখন শিশুর চিৎকার নাকি বহুদূর থেকে শোনা যায়; তখন নিনেভ নগরের বাতাসে মাংসপোড়া গন্ধ ভাসতে থাকে। উপাসনালয়টির নিচে অনেকগুলি ছোট ছোট কুঠুরি। তারই একটিকে বাস করেন নিনেভ নগরের প্রধান পুরোহিত। কুঠুরিগুলি অন্ধকার অন্ধকার।

দিনের বেলায় মশাল জ্বেলে রাখতে হয়। প্রধান পুরোহিতের ঘরেও দিনের বেলায় প্রদীপ জ্বলে। নববর্ষের পরেই প্রধান পুরোহিত তালিকা তৈরি করেন কোন্ কোন্ পরিবার থেকে বলির শিশু নেওয়া হবে। প্রধান পুরোহিত এখন আগাম কাজ সেরে রাখছেন। লোকটার মাথার চুল নিখুঁত ভাবে কামানো।

বয়স পঞ্চাশের মতো, গায়ের রং তামাটে। তাঁর কুঠুরিতে প্রচুর গ্রন্থ পরিলক্ষিত হয়। কীলক (পেরেক) আকৃতির বর্ণমালায় লেখা গ্রন্থগুলি শুকনো কাদার তৈরি। দেখতে দেখতে নববর্ষের দিনটি এসে গেল। নগরবাসী উৎসবে মেতে উঠেছে।

তাদের পরনে উজ্জ্বল পরিচ্ছদ, রং বেরঙের পোশাক, তাদের হাতে নানাবর্ণের পতাকা । প্রাণবন্ত তালে ঢোল বাজাতে বাজাতে ধর্মীয় সংগীত গাইতে গাইতে তারা হাঁটছে। কয়েকজনের কাঁধে একটি বিশাল কাঠের মঞ্চ। মঞ্চের ওপর দেবতা মারদুক-এর মূর্তি। চলমান মূর্তির পিছনে দীর্ঘ মিছিল।

মিছিলটি অত্যন্ত বর্নাঢ্য। মঞ্চের ওপর অজস্র ভক্ত অর্ঘ্য নিবেদন করছে। সেই সঙ্গে শিশুবলিও চলছে। শিশুর চিৎকার বহুদূর ছড়িয়ে যাচ্ছে । মাংসপোড়ার গন্ধ ভাসছে নগরের উৎসবমূখরিত বাতাসে।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন দার্শনিক এরিদু । দেবতা মারদুকের মুখটি অবিকল শেয়ালের মুখের মতন। বৃদ্ধর বিবমিষা বোধ হয়। একটি শিশুর আর্তচিৎকার শুনতে পেলেন। আশে পাশের মানুষজন কেমন নির্বিকার।

দার্শনিক এরিদু অত্যন্ত বিষন্ন বোধ করলেন। তিনি একটি মমতাময় হৃদয়ের অধিকারী, তাছাড়া দার্শনিক বলেই গভীর সৌন্দর্যবোধের অধিকারী। রৌদ্রময় উপত্যকায় যবক্ষেতের ভিতর প্রহরের পর প্রহর দাঁড়িয়ে থেকে যব ফুলের হলুদাভ সৌন্দর্য উপভোগ করেন, রাত্রিকালে অতিথিশালার ছাদে শুয়ে ঝলমলে নক্ষত্রের পানে প্রহরের পর প্রহর চেয়ে থাকেন, কখনও গলির বেড়ালছানার নিষ্পাপ মুখের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকেন দার্শনিক এরিদু, নগরনটীদের কন্যাসম মনে করেন, তাঁর হৃদয়ে প্রমোদবালাদের প্রতি বিন্দুমাত্র ঘৃণাবোধ নেই-এমন সংবেদী হৃদয়ের মানুষ কেন শিশুহত্যার মতন জঘন্য অপকর্ম মেনে নেবেন । তিনি মনে করেন, নিনেভ নগরের অনেক বিষয়ই প্রশংসাযোগ্য, যেমন: নগর-পরিকল্পনা ও এর চতুর্দিকের নাগরিক শোভা...দক্ষ প্রশাসনব্যবস্থা; বানিজ্যিক কর্মতৎপরতা, নিনেভের মৃৎশিল্পের মান, নিচ্ছিদ্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও কীলকলিপিতে রচিত গ্রন্থসমূহ ...তবে শিশুবলি যেন ঠিক মেনে নেওয়া যায় না। তাঁর আশেপাশে ব্যাপক ভিড়।

তাঁর পাশে একজন ঝলমলে পোশাক পরে মোটাসোটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাকে বললেন, এই যে শুনছেন? জ্বী। বলুন। আচ্ছা, নববর্ষের সময় এ নগরে শিশুবলি দেওয়া হয় কেন? সে কি! আপনি কি নগরে নতুন এসেছেন? হ্যাঁ। দার্শনিক এরিদু মাথা নাড়েন।

ও, তাই বলেন। সময়টা মধ্যাহ্ন বলেই সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরে ছিল। মোটাসোটা লোকটা হাতের চেটোয় কপালের ঘাম মুছে নিল। তারপর বলল, শিশুবলি দিলে দেবতা মারদুক খুশি হন। এ কারণে নববর্ষের সময় শিশুবলি দেওয়া হয় কথাটা মনে হয় আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনের কানে গেছিল।

তারা সমস্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। শিশুবলি দিলে দেবতা মারদুক খুশি হন। দেবতা খুশি হন। ও, আচ্ছা, তাই? দার্শনিক এরিদু ফ্যাকাশে হাসলেন। ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত শূন্য বোধ করছেন।

জনতার মুখোমুখি হলেই তাঁর এরকম শূন্যবোধ হয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই। জনতা সমস্বরে বলে উঠল। দার্শনিক এরিদু প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করলেন।

তিনি বিশ্বাস করেন দেবতা বা ঈশ্বর নির্বিকার সত্ত্বা। যে কারণে দেবতা বা ঈশ্বরের খুশি বা অখুশি হওয়া সম্ভব না। তা ছাড়া ঈশ্বর তার সৃষ্টিকর্মে কখনোই নাক গলান না। দার্শনিক এরিদু এবার পালটা প্রশ্ন করে বসলেন, শিশুবলি দিলেই যে দেবতা মারদুক খুশি হন এই কথাটা প্রথম কে বলেছে আপনারা জানেন? লোকজন চুপ। সেই মোটা লোকটা আমতা আমতা করে বলল, তা আমরা বলতে পারব না তবে ... তবে? তবে প্রাচীনকাল থেকেই নিনেভ নগরে দেবতা মারদুক এর উদ্দেশ্যে শিশুবলি হয়ে আসছে।

জন্মের পর থেকে আমরা এমনই দেখছি। দার্শনিক এরিদু সামান্য উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, আহা, তাই বলে কেউ ভেবে দেখবে না শিশুবলির মতন এমন রোমহর্ষক কান্ড কেনই-বা করতে হবে? লোকজন চুপ। দার্শনিক এরিদু বললেন, আমি যদি বলি শিশুরা জীবিত থাকলে দেবতা বেশি খুশি হন-তাহলে? দার্শনিক এরিদুর কথায় কী ছিল, ভিড়ের মধ্যে প্রথমে অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এল, তারপর গুঞ্জন উঠল, তারপর সে গুঞ্জন বহূদূরে ছড়িয়ে পড়ল। একে অন্যের মুখের দিকে চাইল। লোকেদের মুখেচোখে স্পস্ট বিস্ময়ের ছাপ- দার্শনিক এরিদুর কথায় যেন নীরবে বজ্রপাত ঘটে গেছে।

শিশুরা জীবিত থাকলে দেবতা বেশি খুশি হন? লোকজন একে অন্যের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। সবার অলখে দার্শনিক এরিদু ভিড়ের মধ্য থেকে সরে যেতে লাগলেন। তাঁর আরব্ধ কাজটি সম্পন্ন হয়ে গেছে। দ্রুত পায়ে নগর তোরণের দিকে যেতে যেতে মুচকি মুচকি হাসছেন তিনি। দীর্ঘকাল ধরে দার্শনিক এরিদু বিশ্বাস করে আসছেন: মানুষ আসলে এক মহৎ প্রানি-যদি তার মনে কুসংস্কারের বদলে স্বাধীন বিচারশক্তি পূর্নমাত্রায় সক্রিয় থাকে।

এইমাত্র তিনি নিনেভবাসীর মনে স্বাধীন বিচারশক্তি পূর্নমাত্রায় সক্রিয় করে দিয়েছেন। অবিলম্বে নিনেভ নগরে জীবনধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। আমি যদি বলি শিশুরা জীবিত থাকলে দেবতা বেশি খুশি হন-তাহলে? এক পর্যটক দার্শনিকের এই কথাটাই নিনেভ নগরের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। আশ্চর্য! এমন করে তো আগে কেউই বলেনি। ভাবেওনি ।

কথাটা অবশ্যই ভাবার মতো। তাই তো ...শিশুবলিতে দেবতার কী লাভ! শিশুরা জীবিত থাকলেই বরং দেবতার বেশি খুশি হওয়ার কথা। নগরের নারীরা ঘন ঘন একে অন্যের সঙ্গে দেখা করতে লাগল। তাদের মধ্যে চলল ফিসফাস। শিশুবলি দেওয়ার সময় তাদেরই যে বুক বেশি পোড়ায়।

আট-ন’মাসের দুধের শিশুকে প্রধান পুরোহিতের হাতে তুলে দিতে হয়। কী দরকার শিশু বলির- শিশুরা জীবিত থাকলেই তো মারদুক দেবতা বেশি খুশি হন। নববর্ষের পরেই প্রধান পুরোহিত তালিকা তৈরি করেন কোন্ কোন্ পরিবারের শিশু নেওয়া হবে, তখন কার না বুক ফেটে যায়। দার্শনিক এরিদুর কথায় নগরময় পুরুষেরাও বিচলিত। শিশু সন্তান তো তাদেরও।

তাদের চোখের সামনে যেন এতকাল একটি পর্দা ছিল। কালো রঙের পর্দা। এখন সে পর্দা সরে উপত্যকায় উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে। ঠিকই তো- শিশুরা জীবিত থাকলে দেবতা মারদুক কি বেশি খুশি হন না? কথাটা নানা কান হয়ে রাজার কানে পৌঁছতে দেরি হল না। তার আগে প্রধান পুরোহিতের কানে উঠল।

তিনিও পরম বিস্মিত ও ভীষণ বিচলিত হলেন। তিনি পুরোহিত হতে পারেন, হলেও রক্তমাংসের মানুষ তো। শিশুবলি দিলে দেবতা মারদুক খুশি হবেন এই কথাটা প্রথম কে বলেছে ? প্রধান পুরোহিত গভীর ভাবনায় নিমজ্জ্বিত হলেন। নিনেভ নগরের রাজা প্রধান পুরোহিতকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, শিশুবলি যে দিতেই হবে এমন কোনও কথা কি প্রাচীন গ্রন্থগুলির কোথাও লেখা রয়েছে? উত্তর দেওয়ার জন্য অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে তিনদিন সময় চাইলেন প্রধান পুরোহিত । রাজা অনুমতি মঞ্জুর করলেন।

তিন দিন ধরে প্রধান পুরোহিত নগরের প্রাচীন গ্রন্থাগারে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন উত্তর। তিনদিন পর তিনি রাজাকে বললেন, নাঃ। শিশুবলি দিতেই হবে এমন কোনও কথা প্রাচীন গ্রন্থসমূহে আমি খুঁজে পাইনি। রাজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তা ছাড়া শিশুবলি রদ করার জন্য রানিও ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিলেন।

রানি হলেও তো তিনি আসলে নারীই; ক’দিন ধরেই রানিও এক তৃপ্তিকর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন: শিশুরা জীবিত থাকলে দেবতা মারদুক অবশ্যই বেশি খুশি হবেন। এই আমি যেমন বেঁচে আছি বলে দেবতা মারদুক খুশি। রাজা সাধারণত যে কোনও গুরুত্বপূর্ন ধর্মীয় সিদ্ধান্তের আগে প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে পরামর্শ করেন। আজ প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই রাজা ঘোষনা করলেন, আজ থেকে নিনেভ নগরে শিশুবলি রদ করা হল। সংবাদটি নগরকেন্দ্রে পৌঁছামাত্র উপস্থিত জনসাধারণ তীব্র উল্লাসে ফেটে পড়ল।

সংবাদটি বিদ্যুতের গতিতে নগরময় ছড়িয়ে গেল। তারপর নিনেভবাসী দীর্ঘকালীন এক আনন্দময় উৎসবে মেতে উঠল। এতোসব হই-হট্টগোলের ভিতরে কেউ কেউ সেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন দার্শনিকটির খোঁজ করল। ততদিনে আরেকটি কুসংস্কারগ্রস্থ নগরের উদ্দেশে নিনেভ নগর ত্যাগ করেছেন দার্শনিক এরিদু ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.